মাদকবিরোধী অভিযান : রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে গ্রেপ্তার ৫৬

আগের সংবাদ

ছাত্রলীগে এত আগাছা কেন : যুদ্ধাপরাধী সাঈদীকে নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দেয়ায় তিন শতাধিক পদধারী বহিষ্কার

পরের সংবাদ

ঢাকায় জাপান এয়ারলাইন্সের ছিনতাই করা উড়োজাহাজ

প্রকাশিত: আগস্ট ২৬, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: আগস্ট ২৬, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

এ জি মাহমুদের আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ মাই ডেসটিনি-র দ্বাদশ অধ্যায়টি তার সময়ের সবচেয়ে আলোচিত ও সমালোচিত ঘটনা জাপান এয়ারলাইন্সের হাইজ্যাক করা উড়োজাহাজ নিয়ে রেড আর্মির তেজগাঁও বিমানবন্দরে অবতরণ। উড়োজাহাজ আবিষ্কারের পর থেকে এ পর্যন্ত ঢাকা এ ধরনের ঘটনার মুখোমুখি একবারই হয়েছে। এই হাইজ্যাকের ডামাডোলে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর ইতিহাসের করুণতম ঘটনাটিও ঘটে। স্বদেশি বিদ্রোহীদের হাতে বিমানবাহিনীর ১১ জন কর্মকর্তা নিহত হন। এ জি মাহমুদের লেখাটি ঈষৎ সংক্ষেপে উপস্থাপন করা হলো :
১৯৭৭-এর সেপ্টেম্বরে দেশে মারাত্মক যে সংকট দেখা দিল তা আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা পদ্ধতির দুর্বলতা প্রকাশ করে দিয়েছে। এ ঘটনা আমার নিজের জীবনসহ বিমানবাহিনীর অনেকের জীবনই পাল্টে দিল। ২৮ সেপ্টেম্বর আমি বঙ্গভবনে কেবিনেট মিটিংয়ে হাজির ছিলাম। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে আমার এডিসি আমার হাতে এক টুকরো কাগজ দিল। তাতে লেখা হাইজ্যাক করা একটি উড়োজাহাজ তেজগাঁও এয়ারপোর্টের আকাশে চক্কর দিচ্ছে এবং এখানে অবতরণ করার অনুমতি চাচ্ছে। আমি কাগজটি প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়ার হাতে হস্তান্তর করলাম। তিনি আমার পাশেই বসা; তিনি পড়লেন এবং এয়ারপোর্টে গিয়ে আমাকে পরিস্থিতি সামাল দিতে বললেন। তখনই আমি এয়ারপোর্টের কন্ট্রোল টাওয়ারে চলে গেলাম।
আমি সেই উড়োজাহাজের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করি এবং পরামর্শ দিই যেন তারা অন্য কোথায় চলে যান কারণ আমাদের দেশটা নতুন এবং আমরা তাদের চাহিদামতো সেবা প্রদানে সক্ষম নাও হতে পারি।
তারা জানালো উড়োজাহাজে জ¦ালানির ঘাটতি রয়েছে, কাজেই যে কোনো মূল্যেই হোক তাদের অবতরণ করতে হবে। তারা তাই করল। আমি তাদের অবতরণ করাতে বাধা দেইনি। কারণ তাতে জাহাজে ভেতরে অবস্থানরত যাত্রীদের জীবনের নিরাপত্তা বিঘিœত হওয়ার আশঙ্কা ছিল। অবতরণের পর রানওয়ের শেষপ্রান্তে তাদের উড়োজাহাজ পার্ক করার নির্দেশ দেয়া হলো। এমন জায়গায় পার্ক করানো হলো যেন এয়ারপোর্টে অন্য উড়োজাহাজের স্বাভাবিক ওঠানামা বিঘিœত না হয়। ছিনতাইকারীদের উড়োজাহাজটি ছিল জাপান এয়ারলাইন্সের ডিসি-৮; ফ্লাইট নম্বর ৪৭২। প্যারিস থেকে উড্ডয়ন করে এথেন্স, কায়রো, করাচি ও বোম্বাই অবতরণ করে। বোম্বাই থেকে গন্তব্য ব্যাংকক। উড়োজাহাজে যাত্রী ১৫৬ জন এবং ক্রু ১৪ জন।
জাপানি হাইজ্যাকাররা বোম্বাই থেকে উড়োজাহাজে ওঠে। তারা যে ভয়ংকর মারণাস্ত্র নিয়ে উঠেছে এয়ারপোর্টের নিরাপত্তারক্ষীরা তা শনাক্ত করতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়। ভোর ৬টা ১০ মিনিটে উড়োজাহাজ এয়ারপোর্ট থেকে উড্ডয়ন করে। বোম্বাই ছেড়ে প্রায় ৭৫ কিলোমিটার দূরে আসার পর জাপানি ছিনতাইকারীরা উড়োজাহাজের নিয়ন্ত্রণ হাতে তুলে নেয়। প্রাথমিকভাবে এটাই আমার বোধগম্য হয়েছে যে তারা কোলকাতা বিমানবন্দরে অবতরণ করতে চেয়েছিল কিন্তু তারা প্রত্যাখ্যান করেছে। তারপর উড়োজাহাজ ঢাকায় চলে আসে এবং ৪৫ মিনিট আকাশে চক্কর দিয়ে ১১-৩০ মিনিটে যথাযথ অনুমতি না নিয়ে অবতরণ করে।
আমার কাছে এটাও বোধগম্য হয়নি ছিনতাইকারীরা ঢাকায় না এসে কোলকাতায়ই অবতরণ করার জন্য কেন পীড়াপীড়ি করেনি। ঢাকায় অবতরণের পর পরবর্তী ৩ ঘণ্টা ছিনতাইকারীরা কন্ট্রোল টাওয়ারের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। দুপুর ২টার পর পাইলট টাওয়ারের সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং এয়ারকন্ডিশনিং ট্রলি এবং একটি পাওয়ার ইউনিট চান। আমরা তা সরবরাহ করি।
ঢাকাস্থ জাপানি দূতাবাসকে জানানো হলে রাষ্ট্রদূত ইশিরো ইয়াশিওকা কন্ট্রোল টাওয়ারে চলে আসেন এবং নিজ থেকে পরিস্থিতির মূল্যায়ন করেন। বিকেল ৪টায় পাইলট সেই উড়োজাহাজে জ¦ালানি সরবরাহ করতে বলেন। আমি এই অনুরোধ বিবেচনা করলাম এই প্রত্যাশায় যে জ¦ালানি পেলে তারা হয়তো অন্য কোনো গন্তব্য চলে যেতে পারে।
সন্ধ্যা ৬টায় অবতরণের ৬ ঘণ্টারও বেশি সময় পর হাইজ্যাকাররা উড়োজাহাজের রেডিওতে নিজেদের পরিচয় দিল, তারা জাপানিজ রেড আর্মির ডাঙ্কে এন্ড হিডাকা গ্রুপ। তারা জাপান সরকারের বিরুদ্ধে একটি দীর্ঘ বিবৃতি দিল। তারা জাপানি সরকারকে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি বলে অভিহিত করলেন। তাদের এই বিবৃতিতে তাদের দাবি ব্যক্ত হলো : তাদের হাতে ষাট লাখ মার্কিন ডলার তুলে দিতে হবে। নোটগুলো হবে ১০০ ডলারের; আর জাপানের জেলে আটক তাদের ৯ সঙ্গীকে মুক্তি দিতে হবে। তারা আরো বলল, যদি তাদের দাবি মানা না হয় তাহলে উড়োজাহাজের সব যাত্রীকে হত্যা করা হবে, হত্যাকাণ্ড শুরু হবে আমেরিকান ব্যাংকার জো গ্যাব্রিয়েলকে দিয়ে। তারা ডেটলাইনও জানিয়ে দিল, সেদিন রাত ১২টা।
আমি যতটা পারি পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে যাচ্ছি। উড়োজাহাজে ১৪ দেশের ১৫৬ জন যাত্রী- যুক্তরাষ্ট্র, মিসর, কেনিয়া, ভারত, পাকিস্তান, ফিলিপাইন, নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, সৌদি আরব, সিঙ্গাপুর, গ্রিস এবং জর্ডান। আমরা বুঝতে বাকি নেই এ অবস্থায় যদি একজন যাত্রীরও মৃত্যু হয় তাহলে এর গুরুতর আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া হবে। প্রাথমিকভাবে হাইজ্যাকারদের নগদ অর্থের দাবির বিষয়টি তাদের এবং জাপান সরকারের সমস্যা, কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে ১৫৬ যাত্রী ও ১৪ জন ক্রু নিয়ে উড়োজাহাজটি আমাদের জমিনের ওপর দাঁড়িয়ে। আমি অবাক হচ্ছি বোম্বাই এয়ারপোর্টের নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্য দিয়ে মারণাস্ত্রসহ ছিনতাইকারীরা কেমন করে উড়োজাহাজে উঠল এবং সে উড়োজাহাজ অবলীলায় টেক-অফ করল। আমি আরো অবাক হই কোলকাতা বিমানবন্দরের কন্ট্রোল টাওয়ারের নিষেধ ছিনতাইকারীরা মেনে নিল কিন্তু ঢাকায় অবতরণের ব্যাপারে অনুমতির জন্য অপেক্ষাও করল না। অবতরণের ৬ ঘণ্টা পর রেডিওতে দাবি পেশ করল। অনেক ধরনের সম্ভাবনার কথা আমার মনে এলো। ভাবলাম তারা হয়তো বাইরের কোনো সূত্র থেকে নির্দেশনা ও পরামর্শ গ্রহণ করছে। তাই যদি হয়, এটা খারাপ লক্ষণ। আমি এটাও জানি আমাদের নিজেদের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতিও সংবেদনশীলতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আমি ভালোভাবেই বুঝতে পারছি এয়ারপোর্টের কোনো কার্যক্রম থেকে যদি ঝামেলা ও অস্পষ্টতা সৃষ্টি হয় তা সরকারকেও দুর্বল করে দেবে। আমাদের অগ্রাধিকার হচ্ছে কোনো ধরনের ঝামেলায় না গিয়ে যাত্রীদের জীবনরক্ষা করা। আমি ভাবলাম, এটা একটা জাতীয় সংকট। যথার্থভাবেই এর মোকাবিলা আমাদের করতে হবে।
সবার জন্য খাবারের যে সরবরাহ চাওয়া হয়েছে পরদিন ভোর পৌনে ৯টায় তা সরবরাহ করা হলো। তবে আমাদের সরবরাহ করা খাবার ছিনতাইকারীরা নিজেরা খেলো না। তাদের আসক্ত করে নিষ্ক্রিয় করার পরিকল্পনা নষ্ট করে দিল। সেই সকালে আমি মন্ত্রিপরিষদ বৈঠকে হাজির হলাম। বিস্তারিত আলোচনা হলো। সিদ্ধান্ত হলো শান্তিপূর্ণ সমাধানের সব উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। তার মানে ছিনতাইকারী দাবি মেনে নিতে জাপান সরকারকে রাজি করানোর কাজটা আমাদের করতে হবে। কিন্তু কাজটা ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠছিল।
আমি একই সঙ্গে বেসামরিক বিমান পরিবহন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী এবং বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর কমান্ডও আমার হাতে। বেসামরিক বিমান পরিবহন সচিব ও বেসামরিক বিমান পরিবহনের কর্তৃপক্ষের মহাপরিচালক দেশের বাইরে। আমি মন্ত্রিসভাকে আশ্বস্ত করি বেসামরিক বিমান পরিবহন কর্তৃপক্ষ ও বাংলাদেশ বিমান বাহিনী এয়ারপোর্টের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার বিষয় সামাল দিতে পারবে তবে এয়ারপোর্টের পরিসীমানার বহিরাঙ্গন নিরাপত্তা অন্য সংস্থাকে প্রদান করতে হবে। বাহ্যিক নিরাপত্তার জন্য আর্মড পুলিশ মোতায়েনের জন্য প্রেসিডেন্ট পুলিশের ইন্সপেক্টর জেনারেলকে নির্দেশ দিলেন। জাপান আমাদের বন্ধুপ্রতিম দেশ, গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত একটি সরকার দেশ চালাচ্ছে। কাজেই নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য তাদের সময় দরকার। সম্ভবত নিউইয়র্ক থেকে ১০০ ডলার নোট জোগাড় করতেও সময় লাগবে। তাদের দাবি অনুযায়ী যে ৯ জন সাজাপ্রাপ্তকে মুক্তি দেয়ার কথা, তাদের মুক্তি দিয়ে ঢাকা নিয়ে আসতে সময় লাগবে। সব কাজই সময়সাপেক্ষ। কাজেই আমি জাপান সরকারকে যতটা বেশি সময় দেয়া যায় সে পথেই এগোলাম।
অসুস্থ হয়ে পড়ার কারণে তারা ২৯ সেপ্টেম্বর ৫ জন যাত্রীকে মুক্তি দেয়। তাদের কাছ থেকে আমরা হাইজ্যাকারদের সম্পর্কে বিভিন্ন বিষয় অবহিত হলাম। তারা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নিয়ে সশস্ত্র অবস্থায় রয়েছে, তাদের সঙ্গে বিস্ফোরক রয়েছে। আমাদের পররাষ্ট্র সচিব তবারক হোসেন সাংবাদিকদের ব্রিফ করছেন এবং সংশ্লিষ্ট দেশসমূহের রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন। যতটা কম সম্ভব বিমানবাহিনীর সদস্য নিয়োগ করলাম। বিমানবাহিনীর যারা আমাকে তখন সহায়তা করছিলেন তারা হচ্ছেন গ্রুপ ক্যাপ্টেন তাহের কুদ্দুস, গ্রুপ ক্যাপ্টেন রাস মাসুদ, গ্রুপ ক্যাপ্টেন বি এ চৌধুরী, গ্রুপ ক্যাপ্টেন আনসার চৌধুরী, উইং কমান্ডার ওয়াহিদুন নবী এবং উইং কমান্ডার এন এ শেখ সিভিল এভিয়েশনের সঙ্গে বাংলাদেশ বিমানের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং ইঞ্জিনিয়ার এবং অপারেটররা ছিলেন। তাদের নাম আমার জানা ছিল না। কন্ট্রোল টাওয়ারে উপস্থিত ছিলেন ভাইস প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আবদুস সাত্তার। সঙ্গে এনএসআই এবং ফোর্সেস ইন্টিলিজেন্স প্রধান (ডিজিএফআই), পররাষ্ট্র সচিব তবারক হোসেন, পররাষ্ট্র দপ্তরের শেখ জালাল হোসেন এবং সুপরিচিত টেলিভিশন সংবাদ পাঠক তাজুল ইসলাম। শফিউল আজম, জেনারেল মীর শওকত আলী এবং অনেক রাষ্ট্রদূত কন্ট্রোল টাওয়ার পরিদর্শন করে যান। কন্ট্রোল টাওয়ারে কেবলমাত্র কর্মসংশ্লিষ্টদের প্রবেশাধিকার রয়েছে। আমি জানি না ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং অন্যরা সেখানে কী দায়িত্ব পালন করেছেন। তাদের নিজ নিজ অফিসে থাকলেই হতো। তৃতীয় দিন অর্থাৎ ৩০ সেপ্টেম্বর আরো ৪ জন যাত্রীকে মুক্তি দেয়া হলো। ছিনতাইকারীদের দাবিদাওয়া মানার ডেটলাইন ভোর ৪টাতে পেরিয়ে গেছে। সময় বাড়িয়ে নেয়ার জন্য আমি তাদের সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের আলোচনায় লিপ্ত হই। কৌতূহলের বিষয়, ছিনতাইকারীরা আমি ছাড়া অন্য কারো সঙ্গে কথা বলতে রাজি নয়। ফলে আমাকে সারাক্ষণই কন্ট্রোল টাওয়ারে অবস্থান করতে হয়েছে।
শেষ পর্যন্ত একটি রিলিফ উড়োজাহাজ রেড আর্মির ৬ জন কারাবন্দি ও ষাট লাখ মার্কিন ডলার এবং প্রায় ৭০ জন যাত্রী নিয়ে বেলা ১১টা ১৫ মিনিটে অবতরণ করল। বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের একজন কর্মকর্তা আমাকে জানালেন যে এ উড়োজাহাজ থেকে তাদের কাছে প্রয়োজনীয় মেনিফেস্ট প্রদান করা হয়নি। আমার সন্দেহ হয়েছে এই উড়োজাহাজে কিছুসংখ্যক কমান্ডো পাঠানো হয়েছে, ছিনতাইকারীদের মুখোমুখি হওয়ার মতো পরিস্থিতি ঘটলে তাদের কাজে লাগানো হবে। আমি এই উড়োজাহাজের পাইলটকে নির্দেশ দেই যেন রানওয়ের ওপর ট্যাক্সি করে তাদের উড়োজাহাজ ছিনতাই করা উড়োজাহাজ থেকে দূরতম স্থানে পার্ক করে। কোন কোন জাপানি কর্মকর্তাকে কন্ট্রোল টাওয়ারে পাঠানো হবে তাদের শনাক্ত করার জন্য তবারক হোসেনকে অনুরোধ করি। আগত বিশিষ্ট জাপানিদের অভ্যর্থনা জানানোর দায়িত্বও তাকে দেই। জাপানি টিমের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাদের ভাইস মিনিস্টার হাজিমে ইশি। অন্যরা হচ্ছেন দেশিও কোনিহিকা, তিনিও ভাইস মিনিস্টার, মিস্টার আসাদা, জাপান এয়ারলাইন্সের প্রধান। আরো ক’জন সদস্য ছিলেন তাদের নাম স্মরণ করতে পারছি না। প্রতিনিধি দল নেমে আসার পর আমি নির্দেশ দিলাম সেই উড়োজাহাজের দরজা বন্ধ থাকবে এবং কাউকেই বাইরে আসার অনুমতি দেয়া হবে না। ভাইস মিনিস্টার হাজিমে ইশি লম্বা ও হ্যান্ডসাম পুরুষ, অগাধ আত্মনিশ্বাস ও কর্তৃত্ব। তিনি আমার সঙ্গে আলোচনা করলেন। আমি তাকে আমাদের সরকারের নীতির কথা বললাম, আমরা সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান চাই। তিনি বললেন, তার সরকার চায় মুক্তিপণের টাকা হস্তান্তর করার আগে যেন জিম্মিদের মুক্তি হয়। আমি এর আগে ঢাকায় সব জিম্মির মুক্তি দেয়ার বিষয় নিয়ে ছিনতাইকারীদের সঙ্গে বিস্তারিত আলাপ করেছি। কিন্তু তারা তাদের নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সব যাত্রী ঢাকায় মুক্তি দিতে রাজি হয়নি। তবে যত বেশি সম্ভব যাত্রী ছেড়ে দেয়ার ব্যাপারে তারা সম্মতি দিয়েছে।
মিস্টার ইশি নিজে হাইজ্যাকারদের সঙ্গে কথা বলতে চাইলেন এবং বললেন। এই আলোচনা এবং মুক্তিপণের টাকা পেতে বিলম্ব হওয়া তারা উত্তেজিত হয়ে পড়ছিল। এক পর্যায়ে আমার চোখে পড়ল উড়োজাহাজের ইঞ্জিন চালু হয়েছে এবং উড়োজাহাজ রানওয়ের দিকে এগোচ্ছে। কিন্তু রানওয়েতে এই উড়োজাহাজের গতি এটা স্পষ্ট করে দিল তারা রিলিফ উড়োজাহাজের দিকে এগোচ্ছে, সম্ভবত বলপূর্বক তাদের কমরেডদের উদ্ধার করবে। এতে অবশ্যই রক্তারক্তির ঘটনা ঘটবে, উড়োজাহাজে আগুন ধরে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে এবং ভয়ংকর রকম ঝামেলা ও ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হবে। সুতরাং আমি আদেশ দিলাম দ্রুত এয়ারপোর্টের সব গাড়ি রানওয়েতে ওঠে রানওয়ে বন্ধ করে দেবে। তখন তারা মার্কিন ব্যাংকার মিস্টার গ্যাব্রিয়েলকে হত্যার হুমকি দিল এবং আমাদের গাড়ির ওপর গুলিবর্ষণ করতে শুরু করল। এরই মধ্যে তাদের সঙ্গে কথাও অব্যাহত থাকল, দেড় ঘণ্টা কথা বলে তাদের শান্ত করতে সমর্থ হলাম এবং ছিনতাই করা উড়োজাহাজ আগের জায়গায় ফিরে গেল। তখনকার মতো গ্যাব্রিয়েলের জীবন রক্ষা হলো।
(আগামী শনিবার সমাপ্য)

ড. এম এ মোমেন : সাবেক সরকারি চাকুরে,
নন-ফিকশন ও কলাম লেখক।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়