বিষপানে ঢাবির সাবেক ছাত্রীর মৃত্যু

আগের সংবাদ

এমটিএফই’র প্রতারণার ফাঁদ : হাতিয়ে নিয়েছে ১১ হাজার কোটি টাকা, নজরদারিতে ৪০০ সিইও, গ্রেপ্তার নেই

পরের সংবাদ

সমঝোতার কফিনে শেষ পেরেক : ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনা রাজনীতিসহ পুরো সমাজব্যবস্থায় বিভাজন সৃষ্টি করেছে

প্রকাশিত: আগস্ট ২১, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: আগস্ট ২১, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

ঝর্ণা মনি : ঊনিশ বছর আগের সেই দিনটি ছিল শনিবার। রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে পৈশাচিক গ্রেনেড হামলার টার্গেট ছিলেন বঙ্গবন্ধু তনয়া, আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। সেদিন বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রাণে বাঁচলেও ঘাতক বুলেট কেড়ে নেয় ২৪ তাজা প্রাণ। এ যেন নৃশংস আগস্টের নির্মম ইতিহাসেরই পুনরাবৃত্তি। ঠিক ঊনত্রিশ বছর পর রক্তাক্ত আগস্টে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের রক্তের ¯্রােত মিশে যায় ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে। পনের আগস্টের টার্গেট ছিলেন বঙ্গবন্ধু। রক্তের হোলিখেলায় উন্মাদ ঘাতকেরা সেদিন সপরিবারে হত্যা করে জাতির পিতাকে। আর একুশে আগস্টে মূল টার্গেট তারই কন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যা করাসহ পুরো আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করার পরিকল্পনায় যুদ্ধক্ষেত্রে আর্জেস গ্রেনেড ব্যবহার ঘাতক-হায়েনারা। রাষ্ট্রশক্তিকে ব্যবহার করে ওই হামলা চালিয়েছিল তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত সরকার। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ভয়াবহ এই গ্রেনেড হামলা দেশের রাজনীতির এক টার্নিং পয়েন্ট। সমাঝোতার রাজনীতির কফিনে শেষ পেরেক। রাষ্ট্রীয় মদদে বিরোধী দলকে নেতৃত্বশূন্য করার হীন চেষ্টায় তাদের ওপর বিভৎস আক্রমণ দেশের রাজনীতিকে অবিশ্বাস ও আস্থাহীনতার দিকে ঠেলে দিয়েছে। প্রতিহিংসার রাজনীতির কারণেই রাষ্ট্র ও সমাজে আজ এক ধরনের বন্ধ্যাত্ব সৃষ্টি হয়েছে। যার মাসুল দিতে হচ্ছে জাতিকে।
নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ভয়াল একুশে আগস্টের মামলার রায় হয় ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর। রাজনীতির মোড় ঘুরিয়ে দেয়া ওই মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, ১৫ আগস্টের মতোই একুশে আগস্টের হামলার মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে হত্যা এবং আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করতে চেয়েছিল। আর এই ষড়যন্ত্রে তখনকার সরকার ও রাষ্ট্রযন্ত্র জড়িত। তদন্তে প্রমাণিত হয়- বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যাসহ আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করা, গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা ব্যাহত করা, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধ্বংস করতে সেদিন প্রকাশ্য দিবালোকে এই দানবীয় হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে ঘাতকচক্র। রায়ের পর্যবেক্ষেণে বলা হয়, রাজনীতি মানেই কি বিরোধী দলের ওপর পৈশাচিক আক্রমণ? রাজনীতিতে অবশ্যম্ভাবীভাবে ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দলের মধ্যে মতবিরোধ থাকবে। তাই বলে বিরোধী দলকে নেতৃত্বশূন্য করার প্রয়াস চালানো হবে? এটা কাম্য নয়। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ক্ষমতায় যে দলই

থাকবেন বিরোধী দলের প্রতি তাদের উদারনীতি প্রয়োগের মাধ্যমে গণতন্ত্র সুপ্রতিষ্ঠিত করার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা থাকতে হবে। বিরোধী দলীয় নেতাদের হত্যা করে ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক ফায়দা অর্জন করা মোটেই গণতান্ত্রিক চিন্তার বহিঃপ্রকাশ নয়। এই রাজনীতি এ দেশের জনগণ চায় না। সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে শত বিরোধ থাকবে, তাই বলে নেতৃত্বশূন্য করার চেষ্টা চালানো হবে? রাজনীতিতে এমন ধারা চালু থাকলে মানুষ রাজনীতিবিমুখ হয়ে পড়বে।
সমঝোতার রাজনীতির কফিনে শেষ পেরেক : বিশ্লেষকদের মতে, ১৫ আগস্ট আমাদের রাজনীতিতে একটি গভীর ক্ষত তৈরি করেছে। তখন বিএনপি ছিল না। কিন্তু বিএনপির রাজনৈতিক ভিত্তি তৈরি হয়েছে ১৫ আগস্টকে ঘিরে। একুশ শতকে এসে যখন বিভিন্ন দেশ নতুন নতুন স্বপ্ন দেখছে, রূপকল্প তৈরি করছে, তখন এ দেশে প্রতিপক্ষকে নির্মূল করার রাজনীতি আরো বেগবান হয়েছে। একুশে আগস্টের ভয়াবহ গ্রেনেড ও বোমা হামলার মতো নির্মূলের রাজনীতির এই ভয়ংকর রূপ এর আগে খুব কম দেখা গেছে। সহাবস্থান ও সমঝোতার রাজনীতিতে সেদিনই কি শেষ পেরেকটা ঠুকে দেয়া হয়েছে- এমন প্রশ্নও উঠেছে।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক ভোরের কাগজকে বলেন, পনের আগস্টের ধারাবাহিকতায়ই একুশে আগস্ট। কারা একুশে আগস্ট ঘটিয়েছে? বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা। রাষ্ট্রশক্তিকে ব্যবহার করে। অবিস্ফোরিত গ্রেনেডসহ আলামত ধ্বংস করে দিয়েছে। শান্তির সম্মেলনে যুদ্ধক্ষেত্রের অস্ত্র ব্যবহার করে শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করার একটাই লক্ষ্য ছিল- দেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে দূরে রাখা, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, দর্শন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা নষ্ট করে দেশকে পাকিস্তানি ভাবধারায় ফিরিয়ে নেয়া। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড, জাতীয় চার নেতা হত্যাকাণ্ড, একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা একসূত্রে গাঁথা। একুশে আগস্টের পুরো রহস্য উন্মোচন করে শ্বেতপত্র প্রকাশ প্রয়োজন।
পৈশাচিক হামলায় স্পিøন্টারের দুর্বিষহ যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে থাকার লড়াই করছেন ৪শর বেশি আহত নেতাকর্মী। সর্বাঙ্গে বিঁধে থাকা স্পিøন্টারের কষ্ট নিয়েই মারা গেছেন জননেতা আব্দুর রাজ্জাক, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, ঢাকার প্রথম নির্বাচিত মেয়র মোহাম্মদ হানিফসহ অনেকেই। গ্রেনেডের বিকট শব্দে ক্ষতিগ্রস্ত কানের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এখনো ব্যবহার করতে হয় ‘হিয়ারিং এইড’। বিরোধী দলকে নিশ্চিহ্ন করার এই অপরাজনীতিই দেশকে আজ দ্বিধাবিভক্তির পথে ঠেলে দিয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এ ব্যাপারে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. হারুন-অর-রশিদ ভোরের কাগজকে বলেন, পনের আগস্ট টার্গেট ছিলেন বঙ্গবন্ধু। খুনিরা সেদিন সফল হয়েছে। একুশে আগস্টের টার্গেট ছিলেন শেখ হাসিনা। হত্যাকারীদের উদ্দেশ্য এক ও অভিন্ন। অভিন্ন লক্ষ্যেই বঙ্গবন্ধুকন্যার ওপর গ্রেনেড হামলা চালায় খুনিরা। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় পাকিস্তান থেকে আর্জেস গ্রেনেড এনে শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগকে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্নের জন্য পরিকল্পিত হামলা চালায়। এই হামলার সঙ্গে সরাসরি বিএনপি এবং জিয়াপুত্র তারেক রহমান জড়িত ছিল। ১৫ আগস্ট ছিল দ্বিধাবিভক্তির রাজনীতির শুরু; আর ২১ আগস্ট সমঝোতার রাজনীতির কফিনে শেষ পেরেক। তদন্ত কমিশন গঠন করা এখন সময়ের দাবি মন্তব্য করে এই রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বলেন, ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড, ৩ নভেম্বর কলঙ্কিত জেলহত্যা এবং ২১ আগস্ট একসূত্রে গাঁথা। তদন্ত কমিশন করে এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যের কুশীলবদের মুখোশ উন্মোচন করা, বিচার করা এবং প্রয়োজনে মরণোত্তর বিচার করা প্রয়োজন।
বিশ্লেষকদের মতে, গ্রেনেড হামলা নিয়ে আওয়ামী লীগ-বিএনপি দ্বিধাবিভক্ত রাজনীতির দুটি ধারায় পরিণত হয়েছে। শুধু রাজনীতিকরাই নন; শিক্ষক, চিকিৎসক, পেশাজীবীসহ পুরো সমাজব্যবস্থায় বিভাজন সৃষ্টি হয়েছে। রাজনীতিতে সমঝোতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ থাকবে। কিন্তু এখন আর এটি নেই। মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, আস্থাবোধ নেই। এসব হারিয়ে গেছে।
এ ব্যাপারে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. শান্তনু মজুমদার ভোরের কাগজকে বলেন, পনের আগস্টের ধারাবাকিতায়ই একুশে আগস্ট। বাঙালিত্ব, ধর্মনিরপেক্ষতা, মুক্তিযুদ্ধকে নিশ্চিহ্ন করার হীন প্রচেষ্টা- একুশে আগস্টের মতাদর্শের জায়গায় ছিল এটি। অন্যদিকে মুজিব পরিবারের ওপর যে নৃশংস হামলা হয়েছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট, একুশে আগস্ট শেখ হাসিনাকে হত্যার মধ্য দিয়ে তা শেষ করতে চেয়েছিল খুনিরা। তিনি বলেন, বিপরীত রাজনীতির মতাদর্শের মধ্যে চলনসই সম্পর্ক থাকার যে গুরুত্ব, তা একুশে আগস্ট নিঃশেষ করে দিয়েছে। কারণ রাজনীতিতে বিরোধী দল থাকবে। বিকল্প থাকবে। বিরোধী দলকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার চিন্তা অত্যন্ত ভয়ংকর। এটি শুধু আওয়ামী লীগের ওপর হয়েছে বলেই নয়, কারো ওপরই হওয়া উচিত নয়।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়