জামায়াতে ইসলামী : রাজনৈতিক কর্মসূচিতে নিষেধাজ্ঞার আবেদন শুনানি ৩১ জুলাই

আগের সংবাদ

ভোটের আমেজে তৃণমূলে ঈদ : শেখ হাসিনার বার্তা নিয়ে এলাকায় আ.লীগ নেতারা

পরের সংবাদ

উৎসবে বাড়ে সড়ক দুর্ঘটনা : বিশ্বে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু বাংলাদেশে

প্রকাশিত: জুন ২৮, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ২৮, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

আয়েন উদ্দীন : ঈদকে কেন্দ্র করে সড়কে ঢল নামে ঘরমুখো মানুষের। বাড়তি টাকার লোভে সিটি সার্ভিসের ক্রটিপূর্ণ বাসগুলো দূরপাল্লার যাত্রী নিয়ে চলাচল করে মহাসড়কে। এতে গাড়ির সংখ্যা বাড়ে, ‘ট্রিপ’ নেয়ার প্রতিযোগিতা বাড়ে, নিদ্রাহীনভাবে চালকরা চালান ‘আনফিট’ গাড়ি। এর সঙ্গে বেড়ে যায় দুর্ঘটনা। শোকের সাদা কাফনে ঢেকে যায় ঈদের আনন্দ। গাড়ি মালিকদের এই মুনাফার লোভে পঙ্গুত্বের জীবন বরণ করতে হয় অনেককেই। সড়ক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত ঈদের ছুটির আগে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে সড়ক দুর্ঘটনা ৭২ শতাংশের বেশি ছিল। কারণ হিসেবে তারা বলেন, শহরের গাড়ি মহাসড়কের উপযোগী নয়। টাকার লোভে অনেক অবৈধ গাড়ি মহাসড়কে চলে আসে। কিন্তু এসব চালক মহাসড়কে গাড়ি চালানোর উপযুক্ত নন। এছাড়া বাস মালিকদের অধিক মুনাফার লোভে চালকরা বিরামহীন ‘ট্রিপ’ দেন। এর ফলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
স¤প্রতি রোড সেফটি অ্যালায়েন্স বাংলাদেশের প্রকাশিত জরিপে দেখা যায়, গত এপ্রিল মাসে সড়ক দুর্ঘটনা ২৭৮টি। এর মধ্যে ঈদের ছুটির আগে ঘটে ৯৫টি। জরিপের তথ্য বিশ্লেষণ করে রোড সেফটি অ্যালায়েন্স বাংলাদেশের পরিচালক কাজী আতাহিয়া বলেন, গত ঈদুল ফিতরের আগের সপ্তাহে অর্থাৎ ৯ থেকে ১৫ এপ্রিলের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনার হার ছিল ওই মাসের মোট দুর্ঘটনার ৭১ শতাংশ। পরবর্তী সপ্তাহে অর্থাৎ ২৩ থেকে ২৯ এপ্রিলের মধ্যে দুর্ঘটনার হার ৯২ শতাংশ।
ঈদের আগে-পরে গাড়ি ও যাত্রীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়াকেই দুর্ঘটনার মূল কারণ বলে মনে করেন অনেকে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলেন, বাংলাদেশের প্রতি হাজার মানুষের বিপরীতে যান্ত্রিক যানের সংখ্যা মাত্র দুটি। অথচ সড়ক দুর্ঘটনায় বাংলাদেশেই বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে। বিশ্বে সবচেয়ে বেশি গাড়ি ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকরা। প্রতি ১ হাজার মার্কিন নাগরিকের জন্য গাড়ির সংখ্যা ৭৬৫টি। অথচ ওই দেশে বছরে প্রতি ১০ হাজার গাড়িতে মৃত্যুর হার মাত্র দুজন।
পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. শামসুল হক ভোরের কাগজকে বলেন, টাকার নেশায় ঈদের আগে নিদ্রাহীন ও বিশ্রামহীনভাবে ‘ট্রিপ’ দিতে থাকেন চালকরা। যেটা স্বাভাবিক সময় হয় না। ‘ট্রিপের’ সংখ্যা বাড়ানোর জন্য মালিকরাও চাপ দেন। চালকদের বলা হয়- যত ট্রিপ, তত টাকা। চালক তো আর বাড়ছে না। একই চালক ঘন ঘন ট্রিপ দেয়ার ফলে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েন।
দুর্ঘটনা বাড়ার দ্বিতীয় কারণ হিসেবে তিনি বলেন, শহরের সিটি সার্ভিস বাসগুলো দ্রুতগতিতে চলে না। দ্রুতগতিতে না চললে, গাড়ির মেকানিক্যাল ত্রæটি ধরা পড়ে না। শহরের চলাচল করা গাড়ি যখন ঈদের সময় যাত্রী নিয়ে হাইওয়েতে যায়, উচ্চগতিতে অনেকক্ষণ ধরে চলার পর মেকানিক্যাল ‘ফল্ট’ হয়। নিয়ন্ত্রণ হারায়। ঈদের সময় ছাড়া অন্য কোনো সময় তারা এই সুযোগটা পায় না। কারণ ঈদের সময় পুলিশের নজর থাকে যানজট নিরসন ও গাড়িগুলোকে কোনোভাবে পার করিয়ে দেয়ায়। গাড়ির কাগজপত্র বৈধ নাকি অবৈধ সেটা দেখার সুযোগ থাকে না। সুযোগসন্ধানীরা, উৎসবের সময় শহরের গাড়ি নিয়ে হাইওয়েতে ‘যুদ্ধে’ যায়। শহরের গাড়িচালকদের ‘টেম্পারমেন্ট’ ও হাইওয়ের গাড়িচালকদের টেম্পারমেন্টে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। চালকদের মানসিকতায়ও অনেক পার্থক্য থাকে। ফলে দুর্ঘটনা স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় বাড়ে।
সড়কের নিরাপত্তা জোরদার ও দুর্ঘটনা কমানোর তাগিদে কাজ করা ৩০টি সংগঠনের জোট ‘রোড সেফটি অ্যালায়েন্স’। সড়কে দুর্ঘটনার সংখ্যা, সময়, ক্ষতিগ্রস্ত যান ও নিহতের সংখ্যা সংরক্ষণ করে সংগঠনটি। সারাদেশে ২১৩ জন স্বেচ্ছাসেবী সংবাদদাতা আছে রোড সেফটি এলায়েন্সের। তারা সরাসরি দুর্ঘটনাস্থলে গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করে বলে দাবি করে। সংগঠনটির গত ফেব্রুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনার তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ঢাকায় সবেচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটে, ১০ দশমিক ৯৮ শতাংশ। এরপরই রয়েছে চট্টগ্রাম, ৫ দশমিক ৯৯ শতাংশ। ক্ষতিগ্রস্ত যানবাহনের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে মোটরসাইকেল, ২৫ দশমিক ০৯ শতাংশ। খোলা ট্রাক ১৫ দশমিক ৫৯ শতাংশ। বাস ১৬ দশমিক ৩০ শতাংশ।
সকাল ৯টা থেকে বেলা ১২টার মধ্যে দুর্ঘটনার ঘটার হার সবচেয়ে বেশি। ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে ৭২ শতাংশ যাত্রী, ১৫ দশমিক ৩ শতাংশ চালক, ১০ দশমিক ৫ শতাংশ পথচারী ও ২ দশমিক ২ শতাংশ পরিবহন শ্রমিক। এদিকে বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের জরিপের তথ্য অনুযায়ী, সারাদেশের শহরাঞ্চলে মোট সড়ক দুর্ঘটনার ৭৪ শতাংশই ঘটে রাজধানীতে।
দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ ড্রাইভারদের অবসাদ ও ক্লান্তি নিয়ে গাড়ি চালানো- এমন কথা বলেন পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী। তিনি বলেন, আমরা দুর্ঘটনা নিয়ে ভাবি, কিন্তু ড্রাইভারদের কথা ভাবি না। অনেক ড্রাইভার টানা গাড়ি চালিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। বিশ্রামের সুযোগ পায় না। বিদেশে গিয়ে দেখেছি, দুদিন গাড়ি চালানোর পর তৃতীয় দিন কোম্পানি তাকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠায়। তবে আমাদের সেই অবস্থা নেই, দেশে গাড়ির তুলনায় ড্রাইভারের সংখ্যা কম।
উৎসব ঘিরে দুর্ঘটনা কমাতে কী পদক্ষেপ নেয়া যায়? এমন প্রশ্নে ড. শামসুল হক ভোরের কাগজকে বলেন, ঈদের আগেই থাকে জরুরি মুহূর্ত। অবৈধ, ফিটনেসহীন, মহাসড়কের অনুপযোগী গাড়িগুলোকে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় না। কারণ যাত্রী চাহিদা থাকে। ঈদের আগে পুলিশ, কমিউনিটি পুলিশ, আনসার, বিজিবি মোতায়েন করেও দুর্ঘটনা কমানো যায় না। সারা বছর ধরে গাড়ির ফিটনেস, ড্রাইভারের লাইসেন্স ও নিবন্ধন, ফিটনেসের আয়োজন করা প্রয়োজন। আমরা মুখে বলছি স্মার্ট হচ্ছি, স্মার্টের নিয়ম হলো সারা বছর ধরে কাজ করা। উৎসব বা ঈদ এলে কিছু করতে চাওয়া বোকামি।
এই সড়ক বিশেষজ্ঞ বলেন, উৎসবের সময় বহুমাত্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থায় ভারসাম্য তৈরি করার যে সুযোগটা ছিল, পদ্মা সেতুসহ অনেক সেতুর কারণে তা নষ্ট করা হয়েছে। দেশের পরিবহন ব্যবস্থায় কৌশলগত কারণে প্রণোদনা দিয়ে, সরকারি সাহায্য সহযোগিতা দিয়ে নৌপথ টিকিয়ে রাখার প্রয়োজন ছিল। ফলে উৎসবের সময় সড়কের চাপ কমত এবং দুর্ঘটনা বাড়ার শঙ্কা থাকত না।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়