প্রিপেইড মিটার স্থাপনে আর্থিক লেনদেন না করার আহ্বান

আগের সংবাদ

হাটে পর্যাপ্ত গরু, দাম চড়া : কেনাবেচা আজ থেকে > শর্ত মানছেন না ইজারাদার > ট্রাক নিয়ে টানাটানি

পরের সংবাদ

সেন্টমার্টিন লিজ দিয়ে বা বিক্রি করে আমি ক্ষমতায় যেতে চাই না : শেখ হাসিনা > ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি

প্রকাশিত: জুন ২৪, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ২৪, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

কুয়েত ও সুইজারল্যান্ড সফরের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২১ জুন দেশের সিনিয়র সাংবাদিকদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় মিলিত হন। উক্ত সভায় অনেক প্রাসঙ্গিক বিষয়ের সঙ্গে মুচলেকা দিয়ে নির্বাচনে বিজয়ের প্রসঙ্গটিও আসে। এই প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেন যে, তার দল সেন্টমার্টিন দ্বীপ লিজ দিয়ে কিংবা বিক্রি করে ক্ষমতায় থাকতে চায় না এবং কেউ এমন পদক্ষেপ নিলে তাকে বা তাদেরকে প্রতিহত করবেন। এ ব্যাপারটি বাংলাদেশে ব্যাপক আলোচনার সূত্রপাত ঘটিয়েছে। ভোরের কাগজ পত্রিকায় লিজ গ্রহণকারী বা ক্রেতার পরিচিতি তুলে ধরা হয়েছে। জাসদ নেতা হাসানুল হক ইনু থেকে জানা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ ব্যাপারে উৎসাহী এবং সে কারণে একটি বিরোধী দলকে ছলেবলে কৌশলে ক্ষমতায় আনতে মরিয়া হয়ে উঠেছে।
আমার কাছে এ বিষয়টি ইতিহাস পুনরাবৃত্তির মতো প্রতীয়মান হচ্ছে। ১৯৭১ সালের দিকে ফিরে যেতে চাই। তখন ২৮ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে মার্কিন রাষ্ট্রদূত জোসেফ ফারল্যান্ডের সঙ্গে একটি একান্ত বৈঠকের কথা এসে যায়। একটি অতি জরুরি ও গোপনীয় বিষয়ে আলোচনার জন্য ফারল্যান্ড নিজে গাড়ি চালিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ৩২ নম্বর ধানমন্ডির বাসায় আসেন। তিনি বর্তমান মানিক মিয়া এভিনিউ হয়ে একাই এসেছিলেন। রাস্তাটির তৎকালীন ধারণক্ষমতা অতি সামান্য ছিল; বড়জোর একটা বাসের পাশ দিয়ে অপর একটি রিকশা চলতে পারত। ফারল্যান্ড এলেন এবং একান্ত আলোচনায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কতিপয় বিষয় আলোচনা করলেন। বঙ্গবন্ধু তাকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ব্যাপারে সহযোগিতার কথা উত্থাপন করলে ফারল্যান্ড তাতে শর্তহীন স্পষ্ট সম্মতিও দিলেন। বিষয়টা তদানীন্তন যুবনেতা ও বঙ্গবন্ধুর ভাগনে শেখ মনি জানতে পেরে এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানতে বঙ্গবন্ধুর সম্মতি পেলেন। মনি ভাই সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি আমাকে নিয়েই সাক্ষাৎ করবেন। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কমার্স বিভাগের শিক্ষক, থাকি মহসীন হলের দক্ষিণ-পশ্চিম কোনায় অবিবাহিত শিক্ষকদের জন্য নির্ধারিত একটি কক্ষে। এ কক্ষে আমার সঙ্গে আরো থাকতেন আমার দুজন সহপাঠী যারা বিভিন্ন কারণে আমার ছাত্র হয়ে গিয়েছিলেন।
মনি ভাই এলেন। আমি তখনো দুপুরের আহার শেষ করিনি বলে আমরা দুজনে খাবার খেতে বসলাম। খাবারের মাঝেই দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হলো। তিনি আমাকে একটা অনির্দিষ্ট স্থানে নিয়ে যাবেন বলে জানালেন। যুবনেতা ছাড়াও মনি ভাই তখন বাংলার বাণীর সম্পাদক। আমার সঙ্গে তার সম্পর্ক সেই ১৯৬২ সাল থেকে যখন তিনি বাংলাদেশ লিবারেশন ফ্রন্ট বা বিএলএফের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। তাই তার ছোট শেখ সেলিম আমার সহপাঠী ও ব্যক্তিগত বন্ধু হলেও মনি ভাই ছিলেন আমার রাজনৈতিক গুরু, যাকে বলে ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক বন্ধু। আমরা খাবার খেয়ে রওনা হলাম।
জিপটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহসীন হল থেকে পূর্ব দিকে রওনা হলে আমি আমাদের গন্তব্য এবং গন্তব্যস্থলের অপেক্ষমাণ ব্যক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে মনি ভাই বিরক্ত হলেন।
রাস্তাঘাটে তেমন কোনো ভিড় ছিল না বলে আমরা দ্রুতই পুরানা পল্টনে পৌঁছে গেলাম। দেখলাম স্থানটি তদানীন্তন আওয়ামী লীগ অফিস। অফিসে একমাত্র দপ্তর সম্পাদক মোহাম্মদ উল্লাহ ছাড়া দ্বিতীয় ব্যক্তিটি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
আমরা পৌঁছামাত্র বঙ্গবন্ধু মনি ভাইকে ডেকে পাঠালেন। তিনি আমাকে সঙ্গে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর কক্ষে ঢুকলেন। ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে হাস্যোজ্জ্বল বঙ্গবন্ধু ‘জয় বাংলা’ বলে আমাদের গ্রহণ করলেন। তিনি আমাদের একটি ধাঁধায় ফেললেন। ধাঁধাটি ছিল নিম্নরূপ-
‘তোমরা কি এমন কোনো সেনাপতি দেখেছ যে কোনো গুলি খরচ না করেও যুদ্ধে জয়ী হয়েছে?’
এ ব্যাপারে মনি ভাই নীরব থাকলেও আমি বললাম ‘আমার তো মনে সেই সেনাপতি আমাদের সামনেই আছেন’। তিনি উচ্চস্বরে হাসলেন এবং বললেন, ‘সব ঠিক হয়ে যাবে, চিন্তা করিসনে।’ তিনি ফারল্যান্ডের সঙ্গে আলোচনায় কতিপয় অংশ তুলে ধরার মধ্যেই একটা টেলিফোন এলো। বঙ্গবন্ধু টেলিফোনটি ধরেই আমাদের বললেন বাইরে গিয়ে বসতে, কেননা ফারল্যান্ড তাকে টেলিফোন করেছেন। আমরা তার নির্দেশ মতো বাইরে গিয়ে বসলাম।
মিনিট পাঁচেক পর তিনি আমাদের আবারো ডাকলেন। তার হাস্যোজ্জ্বল চেহারা বিলীন। চেহারায় এক ধরনের রুক্ষতা ও কণ্ঠে একটা অতি কাঠিন্য ভাব ফুটে উঠেছে। তীক্ষèভাবে বললেন, ‘ওরা পেয়েছেটা কি? আমি কি স্বাধীনতার জন্য স্বাধীনতা বন্ধক দেব? শেখ মুজিব তা করতে পারে না এবং করবেও না। আমরা তার উষ্মার সম্পর্কে খানিকটা স্পষ্ট ও খানিকটা প্রচ্ছন্ন কারণ জানলাম।
অতি সংক্ষেপে বললে বলা যায় যে, টেলিফোনে ফারল্যান্ড বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিনিময়ে সেন্টমার্টিন দ্বীপটি লিজ চেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় বার চিন্তা না করেই তার প্রস্তাব বাতিল করে দেয়াতে ফারল্যান্ড তাকে একাই এগিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন।’ তিনি আমাদের বললেন, ‘কালকে যদি ইয়াহিয়া খান কোনো ভাষণ বা বিবৃতির মাধ্যমে ১ মার্চেই সংসদ অধিবেশন বাতিল ঘোষণা করে দেয়, তাহলে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ছাড়া দেশকে স্বাধীন করা সম্ভব হবে না।’ তিনি আরো বললেন, ‘আমি নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় অনেকটা মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরের মতো একটি সমাধান চেয়েছিলাম। গতকালকে ফারল্যান্ডের সম্মতি থাকলেও এখন সে শর্ত দিয়ে বসেছে। আমিও বলে দিয়েছি ঘড়ঃযরহম ংযধষষ মড় টহপযধষষবহমবফ. ‘তোমাদেরকে সশস্ত্র যুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতি নিতে হবে’। সেদিনই পূর্বাণী হোটেলে ঢোকার আগে তিনি একই কথা উচ্চারণ করেছিলেন। আজ থেকে ৫৩ বছর আগে বঙ্গবন্ধুর মুখে যেসব কথা উচ্চারিত হয়েছিল তা শেখ হাসিনার মুখে মনে হয় প্রতিধ্বনিত হলো। প্রসঙ্গ একই- দৃঢ়তাও অনুরূপ। প্রতিরোধের ঘটনাও অনুরূপ, যা ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছিল। হয়তো ইতিহাসের অপর অংশটিরও পুনরাবৃত্তি হবে। আমরা যে শেখ হাসিনাকে দেখে আসছি, সেই শেখ হাসিনা পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করেই আরো দৃঢ়ভাবে দাঁড়াবেন এবং সেন্টমার্টিন লিজ দিয়ে কিংবা বিক্রির প্রতিশ্রæতি দিয়ে ক্ষমতায় যাবেন না; এমনকি যে কেউ সে প্রয়াস চালালে তাদের প্রতিহত করবেন। বলতে বাধ্য হচ্ছি ঐরংঃড়ৎু ৎবঢ়বধঃং রঃংবষভ. অর্থাৎ ইতিহাস পুনরাবৃত্তি ঘটায়।
অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী : বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও বীর মুক্তিযোদ্ধা।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়