প্রিপেইড মিটার স্থাপনে আর্থিক লেনদেন না করার আহ্বান

আগের সংবাদ

হাটে পর্যাপ্ত গরু, দাম চড়া : কেনাবেচা আজ থেকে > শর্ত মানছেন না ইজারাদার > ট্রাক নিয়ে টানাটানি

পরের সংবাদ

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর : গাইবান্ধায় উদ্ভট প্রকল্প

প্রকাশিত: জুন ২৪, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ২৪, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

ফেরদৌস জুয়েল, গাইবান্ধা থেকে : গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে ২৬টি পুকুর পুনঃখনন ও পুকুরের পাড়ে পানি বিশুদ্ধকরণের জন্য ফিল্টারের আদলে পন্ড স্যান্ড ফিল্টার (পিএসএফ) ট্যাংক স্থাপন করা হয়। সোলার প্যানেল ও মোটরের (পানির পাম্প) সাহায্যে পুকুরের পানি ট্যাংকে উত্তোলন করে বিশুদ্ধ করার পর সুবিধভোগীদের মধ্যে সুপেয় পানি সরবরাহ করার কথা থাকলেও কেউ এক ফোঁটা পানিও সরবরাহ করেনি। অথচ ঠিকাদারকে পরিশোধ করা হয়েছে ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা। গাইবান্ধা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরে এমন একটি উদ্ভট প্রকল্পের খোঁজ পাওয়া গেছে।
দৃশ্যত এসব পুকুরের পানি পান দূরের কথা, কেউ ব্যবহারও করছেন না। উল্টো এগুলো ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। অনেক পুকুরে মাছ চাষ হচ্ছে। প্রকল্প বাস্তবায়ন না করেই ঠিকাদারকে বিলও প্রদান করা হয়। ফলে সরকারকে দেড় কোটি টাকা গচ্চা দিতে হয়।
গাইবান্ধা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর সূত্র জানায়, অধিদপ্তরের পুকুর খনন, পুনঃখনন ও পুনঃউদ্ধার প্রকল্পের আওতায় গোবিন্দগঞ্জ উপজেলায় সরকারি ২৬টি পুকুর পুনঃখনন করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর

বিশেষ উদ্যোগে ভূগর্ভস্থ পানির স্তরকে পুনরায় পূর্ণ করা, ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ কমানো, সুপেয় খাবার পানির ব্যবস্থা, ভূগর্ভস্থ পানি সংরক্ষণ, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা, ভূ-উপরস্থ পানি ব্যবহারে জনগণকে উৎসাহিত করতে এ প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয় সরকার। ২০১৮ সালে এসব পুকুর পুনঃখননে দরপত্র আহ্বান করা হয়। পুকুরগুলো হচ্ছে আলীগাঁও নয়া সরকারি পুকুর, এনায়েতপুর-১, ছাতিনছড়া, মোলাপাড়া, হাইতোর, ফেরুশা, চিয়ারগাঁও-১, রশিকনগর, বড়গাঁও, চিয়ারগাঁও-২, পাকা, কামদিয়া, ঘেয়া, শ্যামপুর, আশকুর, চালিথা, রেইল, বয়েলগাঁও, মাকলাইন, খারিতা, বানিহারা, আমগাঁও, রঘুনাথপুর, ধারচিলা, আরজি পিয়ারাপুর এবং শিহিগাঁও।
এ কাজ বাস্তবায়নে সরকার রাজস্ব তহবিল থেকে ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়। ২০১৯ সালে পুনঃখনন কাজ শুরু হয়। শেষ হয় ২০২০ সালে। ঢাকার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ইউনুছ এন্ড ব্রাদার্স কাজের দায়িত্ব পায়। প্রতিষ্ঠানের পক্ষে পাবনার শফিকুল ট্রেডার্স এবং গাইবান্ধার শহিদুল ইসলাম পুকুরগুলো পুনঃখনন করে।
প্রতিটি পুকুর পুনঃখনন ও সংরক্ষণে চারদিকে ইট বিছানো রাস্তা, কাঁটাতারের বেড়া, প্রবেশপথে লোহার গেট, অধিদপ্তরের বিলবোর্ড স্থাপিত হয়।
বিলবোর্ডে লেখা ভূ-উপরস্থ পানি ব্যবহারের লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগে পুনঃখনন করা সংরক্ষিত পুকুর। পুকুরে গোসল করা, কাপড় কাঁচা, হাত-পা ধোঁয়া ও মাছ চাষ সম্পূর্ণ নিষেধ।
পুকুরের পাড়ে নির্মিত হয় ইটের তৈরি দৈনিক ২ হাজার ৫০০ লিটার পানি ফিল্টার করার ক্ষমতা সম্পন্ন পন্ড স্যান্ড ফিল্টার (পিএসএফ) ট্যাংক। সেখানে বালু ও পাথর দিয়ে পানি পরিশোধন ব্যবস্থা রাখার কথা। ট্যাংকে সংযুক্ত সোলার প্যানেল চালিত বৈদ্যুতিক মোটরসহ পানির পাম্প দিয়ে পুকুর থেকে ট্যাংকে পানি তোলার কথা। ট্যাংকে পানি পরিশোধনের পর ট্যাংকের টেপ দিয়ে যাতে ৪০-৫০টি পরিবারের মানুষ এই পানি পান ও নানা কাজে ব্যবহার করতে পারেন সেই ব্যবস্থা করা।
এদিকে ঠিকাদারের পক্ষ থেকে দুই-একটি ট্যাংকে টিউবওয়েল বসালেও ২৬টি ট্যাংকে কোনোটিতেই সোলার প্যানেল, বৈদ্যুতিক মোটরসহ পানির পাম্প, পানি সরবরাহের ট্যাপকল লাগনো হয়নি। ফলে ২৬টি পুকুর পাড়ে স্থাপিত পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাংক থেকে উপকারভোগীদের মধ্যে আজ পর্যন্ত বিশুদ্ধ পানিও সরবরাহ করা সম্ভব হয়নি।
কিন্তু জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর ২০২১ সালের ২৭ জানুয়ারি কাগজে-কলমে পুকুর পুনঃখনন কাজ ও প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্পন্ন দেখায়। ওই দপ্তরের কর্মকর্তারা যোগসাজশ করে ঠিকাদারকে দেড় কোটি টাকার বিল পরিশোধও করেন। ঠিকাদারকে বিল পরিশোধ করা হলেও গৃহীত প্রকল্প থেকে মানুষ সুপেয় পানি ব্যবহারের সুফল পাওয়া দূরের কথা, প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়ন না করেই ঠিকাদার লাপাত্তা হয়ে যায়।
সরজমিন অন্তত ১০টি পুকুর ঘুরে দেখা গেছে, তদারকির অভাবে গত ২ বছরে কাঁটাতারের বেড়া, প্রবেশপথে লোহার গেট, বিলবোর্ড, নলকূপ, রাস্তার ইট খোয়া গেছে। নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে অধিকাংশ প্রকল্পের স্মৃতিচিহ্ন। এ সুযোগে স্থানীয় লোকজন কিছু পুকুরে মাছচাষ করছেন। অনেক পুকুরে ময়লা-আবর্জনা ফেলা ও মলমূত্র ত্যাগ করা হচ্ছে। এলাকাবাসী জানায়, সব পুকুরের একই অবস্থা।
গোবিন্দগঞ্জের আলীগাঁও গ্রামের চাকরিজীবী মোস্তফা সবুজ বলেন, এসব পুকুরের মধ্যে বেশকিছুর গভীরতা ছিল। এগুলো পুনঃখনন করা লাগেনি। কোনোটির অর্ধেক গভীরতা ছিল। সেটিতে যেনতেন পুনঃখনন করা হয়। প্রায় আড়াই বছর আগে পুকুরগুলো পুনঃখনন করা হয়। বর্তমানে এসব পুকুর মানুষের কোনো কাজে আসছে না। মানুষ সুফল না পেতেই প্রকল্পের অস্তিত্ব হারিয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রীর দেয়া দেড় কোটি টাকা এখন জলে ভাসছে।
গোবিন্দগঞ্জ নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক এম এ মতিন মোল্লা বলেন, এখানকার মানুষ ভূ-উপরস্থ পানি পানে অভ্যস্ত নয়। ব্যবহারেও আগ্রহ নেই। প্রকল্পের প্রয়োজনীয়তাও ছিল না। কারণ এখন মানুষের সক্ষমতা বেড়েছে। রুচির পরিবর্তন হয়েছে। পানির স্তর নিচে নামলেও নলকূপ স্থাপনের আর্থিক সামর্থ্য তাদের রয়েছে। তারপর স্থানীয় মানুষের চাহিদা ও প্রয়োজনীয়তা সমীক্ষা না করেই এ প্রকল্প বাস্তবায়ন দেখানো হয়। এমনকি লুটপাটের উদ্দেশ্যে যেনতেনভাবে পুনঃখনন করা হয়। ফলে ২৬টি পুকুর পাড়ে স্থাপিত পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাংক থেকে উপকারভোগীদের মাঝে আজ পর্যন্ত পানি সরবরাহ করা সম্ভব হয়নি।
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগেরই যদি এমন অবস্থা হয়, অন্য সব প্রকল্পের কি অবস্থা, তা বোঝাই যাচ্ছে। তদন্ত সাপেক্ষে সরকারি টাকা অপচয়কারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া দরকার।
তবে ঠিকাদার সোলার প্যানেল, বৈদ্যুতিক মোটরসহ পানির পাম্প, পানি সরবরাহের ট্যাপকল লাগায়নি। তারপরও ঠিকাদারকে বিল প্রদানের কারণ কি? সরকারের দেড় কোটি টাকা ব্যয় দেখানো হলেও ট্যাংক থেকে উপকারভোগীদের মাঝে আজ পর্যন্ত পানি সরবরাহ করা সম্ভব হয়নি কেন? এসব বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে, কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি গাইবান্ধা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ রেজওয়ান হোসেন। টাকা ভাগাভাগির অভিযোগ অস্বীকার করে নির্বাহী প্রকৌশলী আরো বলেন, ভূ-উপরস্থ পানির ব্যবহার বাড়াতে স্থানীয় জনগণকে সুপেয় পানি সরবরাহের জন্য পুকুরগুলো পুনঃখনন করা হয়। তিনি বলেন, দুবছর আগে কাজ শেষ করেছি। এখন এ বিষয়ে এর বাইরে কিছু বলতে পারব না।
মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করে এক ঠিকাদারের ফোন বন্ধ পাওয়া যায় এবং আরেক ঠিকাদার ফোন ধরেননি।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়