যাত্রী কল্যাণ সমিতি : ২৭ জুন সরকারি ছুটি ঘোষণার দাবি

আগের সংবাদ

রাজশাহীতে নজীরবিহীন নিরাপত্তা

পরের সংবাদ

সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অধঃপতন কওমি মাদ্রাসার প্রসার

প্রকাশিত: জুন ২০, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ২০, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

প্রাথমিক শিক্ষার জন্য সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভূমিকা একসময় উজ্জ্বল থাকলেও এখন আর তেমনটি নয়। সারাদেশে বর্তমানে ৬৫ হাজারের অধিক সরকারি প্রাথমিক স্কুল রয়েছে, যাতে বিনামূল্যে পাঠদানের ব্যবস্থা আছে। বাস্তবতা হলো সামান্য সঙ্গতি আছে এমন মানুষ তাদের সন্তানদের আর এসব স্কুলে পড়ান না। ভর্তি করান কিন্ডারগার্টেন বা বেসরকারি অন্য স্কুলে, উচ্চ বেতনের ভার মাথায় নিয়ে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিণত হয়েছে স্রেফ গরিবের প্রতিষ্ঠানে। সমাজের প্রতিটি স্তরে বৈষম্যের যে রমরমা অবস্থা এ যেন তারই এক বিস্বাদ চিত্র। তো গরিবরাও এখন আর সন্তুষ্ট নন এসব স্কুলের কার্যকলাপে। তারাও বিকল্পের সন্ধানরত। সাধ্যে কুলালে বেসরকারি কোনো স্কুল, নয়তো কওমি মাদ্রাসামুখী।
কওমি মাদ্রাসার প্রসার দেশের সর্বত্র ব্যাপক মাত্রায় ঘটছে। গ্রামাঞ্চলে তো বটেই শহরাঞ্চলেও যত্রতত্র এ ধরনের মাদ্রাসা গড়ে উঠছে। কোনো কোনো জায়গায় মসজিদে যুক্ত হয়েছে মাদ্রাসার পাঠ। রাজধানী ঢাকাও এর ব্যতিক্রম নয়, পাড়া-মহল্লায় মাদ্রাসা (কওমি) খোলার ধুম। এ ধারার মাদ্রাসা শিক্ষা কর্মসংস্থানমুখী নয়। মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিন কিংবা মাদ্রাসায় শিক্ষকতা ছাড়া শিক্ষার্থীদের জীবিকার অন্য সুযোগ বলতে গেলে নেই-ই। এদের অধিকাংশের ভাগ্যে জোটে দুর্দশাগ্রস্তের জীবন। একাংশ পড়াশোনা শেষ করে নিজেরাই নতুন নতুন মাদ্রাসা খুলে জীবিকার ব্যবস্থায় সচেষ্ট।
আলিয়া মাদ্রাসা অবশ্য কিছুটা ব্যতিক্রম ধাঁচের। সরকারি সহায়তা থাকায় সেখানে সরকার নির্ধারিত পাঠ্যক্রম মেনে চলতে হয়, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি কিংবা সরকারি চাকরির জন্যও এর শিক্ষার্থীরা চেষ্টা করতে পারে। অন্যদিকে কওমি মাদ্রাসা চলে মর্জিমাফিক। তারা সরকারের কোনোরকম নিয়ন্ত্রণ বা সরকারি সহায়তা চায় না। এ ধারার (কওমি) মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার জন্য কোনোরকম অনুমতিরও প্রয়োজন হয় না, কোনো নীতিমালাও নেই সরকারের তরফ থেকে। ফলে প্রয়োজনাতিরিক্ত মাদ্রাসা গড়ে উঠছে দেশের আনাচে-কানাচে সর্বত্র। এ অবস্থায় ছাত্র ধরার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত একেক মাদ্রাসা। ক্ষেত্রবিশেষে এর শিকার হচ্ছে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ও। এসব বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী কমছে, বাড়ছে মাদ্রাসায়। ধস ঠেকানোর কোনো উদ্যোগ এসব স্কুলের শিক্ষকদের যেমন নেই, তেমনি নেই তার কর্তৃপক্ষেরও। কোভিড-১৯ এর প্রাদুর্ভাবকালে সরকারি প্রাইমারি স্কুলসমূহ দীর্ঘদিন বন্ধ থাকলেও কওমি মাদ্রাসার কার্যক্রম অব্যাহত থাকে, সেসময় অনেক অভিভাবক স্কুল ছাড়িয়ে সন্তানদের ভর্তি করিয়েছেন মাদ্রাসায়। এরা আর স্কুলে ফিরে যায়নি। নতুন ছাত্র সংগ্রহের বেলায় মাদ্রাসা যতটা উদ্যোগী ততটা মোটেও নয় স্কুলসমূহ। মাস শেষে সরকারি কোষাগার থেকে বেতনের নিশ্চয়তাতেই শিক্ষকরা সন্তুষ্ট। আবার ভুয়া ছাত্র তালিকায় সন্তুষ্ট জেলা-উপজেলার শিক্ষা কর্মকর্তারা।
সরকারি প্রাথমিক স্কুলের হালফিল অবস্থা নিয়ে গণমাধ্যমে প্রায়ই খবর প্রকাশিত হয়। একজন ছাত্রও নেই স্কুলে এমন খবরও আসে। শিক্ষকের স্বল্পতা, অবকাঠামোগত সমস্যা, জায়গাজমি বেহাত হওয়ার মতো খবরাদি গা-সহা হয়ে গেছে যেন সবার। শিক্ষকদের যোগ্যতা ও মনোযোগ নিয়ে প্রশ্ন বহু পুরনো, এ প্রশ্ন এখনো সমান প্রাসঙ্গিক। একটা সময় ছিল যখন মূলত ম্যাট্রিক কিংবা দাখিল পাস করা ব্যক্তিরা সরকারি প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। তাদের মনোযোগের অর্ধেক থাকত স্কুলে, বাকি অর্ধেক চাষাবাদে। এখন উচ্চ শিক্ষিতরা এ পেশায় আসছেন। কিন্তু মান বা যোগ্যতার প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। আছে ফাঁকি দেয়ার প্রবণতাও। প্রশ্ন তোলা যায় রিক্রুটমেন্টের কোটা নিয়েও। ৬০ শতাংশ মহিলা ও ২০ শতাংশ পোষ্য- সব মিলিয়ে ৮০ শতাংশ কোটা কতটা গ্রহণযোগ্য এ সময়ে তা নতুন করে বিবেচনার দাবি রাখে। পোস্টিং নিয়েও আছে অন্যায্যতা। শহর ও শহরতলীর স্কুলে শিক্ষকের অভাব নেই, কিন্তু মারাত্মক অভাব আছে দুর্গম এলাকার স্কুলে। একজন মাত্র শিক্ষক দ্বারা স্কুল চালানোর ঘটনাও ঘটছে। পরিচ্ছন্নতার বালাই নেই কোথাও, নেই পর্যাপ্ত ওয়াশরুম, কিংবা পরিবেশ। আবার এমন অনেক এলাকা আছে যেখানে প্রয়োজন থাকলেও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দেখা মেলে না। প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা হচ্ছে শিক্ষার ভিত। এর গুরুত্ব বিবেচনা করে স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর সরকার একযোগে ৪০ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করে, কয়েক লাখ প্রাথমিক শিক্ষককে সরকারি মর্যাদা দেয়, ১১ হাজার নতুন প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করে, প্রাথমিক পর্যায়ে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণের কর্মসূচি হাতে নেয়। শিক্ষার এমন গুরুত্বপূর্ণ স্তর বর্তমানে হেলাফেলার শিকার। অব্যবস্থাপনার কারণে বিত্তবানরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ইতোমধ্যে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। এখন যদি গরিবরাও বিমুখ হয় তাহলে সেটি রাষ্ট্রীয় বড় ক্ষতির কারণ হবে। প্রাথমিক শিক্ষাকে ১৯৯০ সালে আইন করে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। একে কার্যকর করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো। কেননা মোট ৮৫ হাজার সরকারি-বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভেতর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সংখ্যায় অধিক (৬৫ হাজার)। পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটাতে না পারলে প্রাথমিক শিক্ষা শুধু নয়, সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। রাজধানী ঢাকার চিত্রও গুরুতর। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো দুরবস্থার কারণে গুরুত্ব হারিয়েছে। অভিভাবকদের ভেতর যাদের অন্য গতি নেই তারাই কেবল এসব বিদ্যালয়ে সন্তানদের পড়ানোর কথা ভাবেন। সারাদেশের মতো এখানকার সরকারি প্রাইমারি স্কুলগুলোও গরিব মানুষের অবলম্বন। তো গরিবদেরও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটছে। হাতের কাছে কওমি মাদ্রাসার দিকে ঝুঁকছেন তারা, খরচ দিয়ে হলেও। মাদ্রাসার শিক্ষক-উদ্যোক্তারা তাদের কাছে যান, অনুরোধ জানান ভর্তির। সরকারি চাকুরে শিক্ষকরা এমন তাগিদ বোধ করেন না। পতন ঠেকানোর দায় তাদের নেই। ওপর মহলের চাপ আছে বলেও বোধ হয় না।
ভারতের দিল্লিতে প্রাথমিক শিক্ষার প্রতিষ্ঠানসমূহ বাংলাদেশের মতো নাজুক অবস্থায় পড়েছিল। কেবল গরিবদের প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিল সরকারি স্কুলগুলো। কেজরিওয়ালের সরকার বিশেষ পদক্ষেপ নিয়ে সেগুলো আধুনিক ও মানসম্পন্ন করলে পরিস্থিতি বাদলে যায়, মধ্যবিত্তরাও সরকারি স্কুলমুখী হতে শুরু করে। বাংলাদেশ সরকার সে দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে ঢাকার ৩৪২টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে ‘দৃষ্টিনন্দন’ প্রজেক্টের আওতায় এনে আধুনিক ও মানসম্পন্ন করার ১ হাজার ১৫৯ কোটি টাকার কর্মসূচি হাতে নেয় ২০১৯ সালে। এই প্রজেক্টের আওতায় রাজধানীতে ১১টি নতুন প্রাইমারি স্কুল প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছিল। ২০২৫ সালের মধ্যে এ কর্মসূচি সমাপ্তের কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত অগ্রগতি সামান্য। পরিস্থিতির তেমন হেরফের হয়নি। সরকার পরিকল্পনা গ্রহণের ক্ষেত্রে যতটা পটু, বাস্তবায়নের বেলায় আদৌ ততটা নয়।
কেবল ঢাকা নয়, সারাদেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নিয়ে একটি বিশদ পরিকল্পনা প্রণয়ন প্রয়োজন। সমস্যাদি কমবেশি সবারই জানা। পরিকল্পনায় সেগুলো তুলে ধরে সুরাহার প্রচেষ্টা গ্রহণ একান্ত জরুরি। সংকট ক্রমান্বয়ে গভীর হচ্ছে। দৃষ্টি না দিলে ঐতিহ্য সূত্রে প্রাপ্ত ব্যবস্থাটির অস্তিত্ব বজায় রাখা কঠিন হবে। পরিবেশ ও মান নিশ্চিত করা গেলে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় দিল্লির মতো অন্তত মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে আকৃষ্ট করতে পারে। বর্তমানের যে-হালচাল তাতে শিক্ষক ও শিক্ষা কর্মকর্তার দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতার ঘাটতি আছে। এ ঘাটতি পূরণ করতে পারলেও পরিস্থিতির অনেক পরিবর্তন ঘটবে।

মজিবর রহমান : কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়