মশার লার্ভার ঘনত্ব পরিমাপ ও ম্যাপিং কার্যক্রম শুরু আজ

আগের সংবাদ

ভূ-রাজনীতির নতুন ক্ষেত্র ‘ব্রিকস’ : যুক্তরাষ্ট্রের ওপর চাপ বাড়াচ্ছে বাংলাদেশ, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে নতুন মাত্রা

পরের সংবাদ

৩২ বছর কারাবাসে ২৬ কুখ্যাত অপরাধীর ফাঁসি : যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি কার্যকর করে তৃপ্ত ‘জল্লাদ’ শাহজাহান

প্রকাশিত: জুন ১৯, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ১৯, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

কামরুজ্জামান খান, কেরানীগঞ্জ থেকে ফিরে : কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন আলোচিত ‘জল্লাদ’ শাহজাহান ভূঁইয়া। গতকাল রবিবার বেলা ১১টা ৪৬ মিনিটে কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে তাকে মুক্তি দেয়া হয়। দেশের বিভিন্ন কারাগারে ২৬ জনের ফাঁসি কার্যকর করেছেন তিনি। শাহজাহান নরসিংদীর পলাশ উপজেলার ইছাখালী গ্রামের মৃত হাছেন আলীর ছেলে। ৭৩ বছর বয়সি শাহজাহান ব্যক্তিগত জীবনে অবিবাহিত। মুক্তির আগ পর্যন্ত ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের এই প্রধান জল্লাদ থাকতেন মেঘনা ভবনের ৪ তলায় ৮ নম্বর ওয়ার্ডে। মুক্তি পেয়ে তিনি তার কোনো স্বজনের কাছে যাননি, কোনো স্বজন এতদিন তার খবরও নেয়নি। তিনি গেছেন ঢাকার নর্দায় রকি দেওয়ান ওরফে রিপন এবং দেওয়ান নজরুলের বাসায়। তারা দুজন বিভিন্ন সময় কারাগারে শাহজাহানের সান্নিধ্যে ছিলেন। সখ্যের সূত্রে শাহজাহান তাদের বাসায় উঠেছেন।
মুক্তি পাওয়ার পর কারা ফটকে গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে আলাপকালে আবেগ আপ্লুত শাহজাহান। প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটি বাড়ি চাইবেন জানিয়ে শাহজাহান বলেন, ৬ যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির কার্যকর করতে পেরে তিনি অনেক খুশি। মুক্তিযুদ্ধ দেখেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, স্বাধীনতার যারা বিরোধী ছিল তারা দেশের শত্রæ। আদালত তাদের ফাঁসির রায় দিয়েছে। তার (শাহজাহান) কিছু করার ছিল না। তিনি না করলেও অন্য কেউ তাদের ফাঁসি কার্যকর করতেন। যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি কার্যকর করে তিনি আনন্দ অনুভব করেন। শাহজাহান বলেন, কারাগারে (সাকা চৌধুরী) সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে তিনি কারা কর্মকর্তাদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচারণ করতে দেখেছেন। কিন্তু ফাঁসির রশিতে ঝুলানোর সময় তিনি শান্ত ছিলেন। কোনো উচ্চবাচ্য করেননি। জেএমবি নেতা সিদ্দিকুল ইসলাম ‘বাংলা ভাই’ ফাঁসিতে ঝুলানোর আগে বলেছেন,

মৃত্যুর পর তার ছবি যেন না তোলা হয়। কুখ্যাত এরশাদ শিকদার বলেছিলেন- তিনি নির্দোষ, কোনো অপরাধ করেননি। আর আলোচিত সেই মনির ফাঁসি কার্যকর করার আগে একটি সিগারেট খেতে চেয়েছিলেন। কোনো ফাঁসি কার্যকরেই তার খারাপ লাগেনি বলেন জানান শাহজাহান। শাহজাহান বলেন, ফাঁসি কার্যকর করা কারো মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়নি। ওজন মেপে সেই অনুযায়ী রশি দিয়ে ফাঁসি দেয়া হয়। তিনি কাশিমপুর কারাগারের অরো ১০ কয়েদিকে প্রশিক্ষণ দিয়ে জল্লাদ হিসেবে প্রস্তুত করেছেন। মুক্ত জীবনে তিনি বসবাসের জন্য একটি বাড়ি চাইবেন জানিয়ে বলেন, তার বেশকিছু সম্পত্তি ছিল, সেগুলো দখল হয়ে গেছে। সেই সম্পত্তি উদ্ধারের চেষ্টা করবেন। আর যাদের ফাঁসির রায় তিনি কার্যকর করেছেন তাদের কোনো স্বজন বা লোক যাতে তাকে শত্রæ না ভাবেন তা উল্লেখ করে শাহজাহান বলেন, তিনি না করলেও অন্য কোনো জল্লাদ রায় কার্যকর করতেন। এখানে তার কিছু করার ছিল না। শাহজাহান বলেন, সরকারের মন্ত্রী ও কর্মকর্তারা যখন কারাগার পরিদর্শনে গেছেন- তাদের কাছে তিনি দাবি জানিয়েছেন, তার দুটি সাজা একসঙ্গে কার্যকরের। কিন্তু তা করেননি।
ঢাকা কেন্দ্র্রীয় কারাগারের জেলার মাহবুবুল ইসলাম জানান, ১৯৯১ সালে গ্রেপ্তার হয়ে প্রথমে মানিকগঞ্জ জেলা কারাগারে ছিলেন শাহজাহান। সবশেষ তিনি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের কয়েদি ছিলেন। শাহজাহান ভূঁইয়ার মোট সাজা হয়েছিল ৪২ বছর। তার মধ্যে তিনি ১০ বছর ৫ মাস ২৮ দিন রেয়াত পেয়েছেন। প্রায় ৩২ বছরের সাজা শেষে তিনি মুক্তি পেয়েছেন। কিন্তু কারাগারের মধ্যে ভালো কাজ ও মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের ফাঁসির রায় কার্যকর করতে জল্লাদের দায়িত্ব পালনের জন্য তার সাজার মেয়াদ ১০ বছর মওকুফ (রেয়াত) করা হয়। পাশাপাশি শাহজাহানের পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভালো না হওয়ায় আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কারা কর্তৃপক্ষ তার জরিমানার ১০ হাজার টাকা পরিশোধ করেছে। এর ফলে দীর্ঘ ৩১ বছর ৬ মাস ২ দিন কারাগারের চার দেয়ালের মধ্যে বন্দি জীবন কাটানোর পর তিনি এখন মুক্ত। তার কয়েদি নম্বর ছিল ২৫৮৯/এ। ভালো এবং শান্ত স্বভাবের কারণে কারা কর্তৃপক্ষ তাকে ভালো চোখে দেখতো বলেও জানান জেলার।
শাহজাহানকে আশ্রয় দেয়া রকি দেওয়ান বলেন, বোন বা পরিবারের কেউ কাাগারে শাহজাহানের খবর নেয়নি। এক সঙ্গে কারাগারে থেকে তারাই তার আপন হয়ে উঠেছেন। দেওয়ান নজরুল ইসলাম বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার আবেদন করবেন শাহজাহান।
প্রসঙ্গত, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৬ ঘাতক, ৬ জন যুদ্ধাপরাধী, কুখ্যাত সন্ত্রাসী এরশাদ শিকদার, জঙ্গি নেতা বাংলাভাই, আতাউর রহমান সানী, শারমীন রীমা হত্যার আসামি মনির, ডেইজি হত্যা মামলার আসামি হাসানসহ বাংলাদেশের আলোচিত ২৬ জনের ফাঁসি কার্যকর করেছেন শাহজাহান। এর মধ্যে ১৯৯৩ সালের জুলাই মাসে শহীদ বুদ্ধিজীবী কন্যা শারমীন রীমা হত্যা মামলার আসামি খুকু-মুনির, ১৯৯৭ সালে বহুল আলোচিত ডেইজি হত্যা মামলার আসামি হাসান, ২০০৪ সালের ১০ মে খুলনা জেলা কারাগারে এরশাদ শিকদার, ২০০৪ সালের ১ সেপ্টেম্বর রংপুর জেলা কারাগারে ইয়াসমিন হত্যা মামলার আসামি এএসআই মইনুল হক ও আবদুস সাত্তার, ২০০৪ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর দিনাজপুরে ইয়াসমিন হত্যা মামলার আরেক আসামি পিকআপ ভ্যানচালক অমৃত লাল বর্মণ, ২০০৭ সালের ২৯ মার্চ কাশিমপুর ও ৩০ মার্চ ময়মনসিংহে জঙ্গি নেতা সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাই, আতাউর রহমান সানি, আবদুল আউয়াল, খালেদ সাইফুল্লাহ ও ইফতেখার মামুন, ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা মামলায় মুত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পাঁচ খুনি বজলুল হুদা, আর্টিলারি মুহিউদ্দিন, সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান ও ল্যান্সার মহিউদ্দিন আহমেদ, ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রথম যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লা, ২০১৫ সালের ১১ এপ্রিল মানবতাবিরোধী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত জামায়াত নেতা মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, ২০১৫ সালের ২২ নভেম্বর জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী, ২০১৬ সালের ১১ মে জামায়াতের আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, ২০১৬ সালের ৩ সেপ্টেম্বর জামায়াতে ইসলামীর নির্বাহী পরিষদের সদস্য মীর কাসেম আলী, ২০২০ সালের ৫ মে (কেরানীঞ্জে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রথম ও একমাত্র ফাঁসি) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মস্বীকৃত খুনি ও মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ক্যাপ্টেন আবদুল মাজেদের ফাঁসি উল্লেখ্যযোগ্য। প্রতিটি ফাঁসি কার্যকর করায় ২ মাস করে সাজা মওকুফ হয় শাহজাহানের। সে হিসেবে ২৬টি ফাঁসি কার্যকর করায় ৪ বছর ৪ মাস সাজা মওকুফ হয় তার।
উল্লেখ্য, শাহজাহান সেনাবাহিনীতে চাকরি করেন তিন বছর। ১৯৭৬ সালে নরসিংদী জেলা কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন তিনি। একবার তার গ্রামে নারীঘটিত একটি ঘটনা ঘটে। শাহজাহানের দুই বন্ধুসহ তার নামে অভিযোগ ওঠে। গ্রামে তাকে নিয়ে বিচারে বসা হয়। সেই বিচারে তাকে অপরাধী প্রমাণিত করে তাকে সাজা দেয়া হয়। এরপর থেকেই তার ক্ষিপ্ততা শুরু। তিনি অপমান সহ্য করতে না পেরে সিদ্ধান্ত নেন অপরাধ জগতে প্রবেশ করে এই অপমানের চরম প্রতিশোধ নেবেন। এরপর তিনি নানা অপকর্মে জড়িয়ে শীর্ষ সন্ত্রাসীর তালিকায় নাম লেখান। কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদানের পর থেকে যে কোনো অপারেশনে তার চাহিদা দিন দিন বাড়তে থাকে। তার মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য অপারেশন ১৯৭৯ সালে মাদারীপুর জেলায় এবং সেটি ছিল তার জীবনের শেষ অপারেশন। অপারেশন শেষ করে মানিকগঞ্জ হয়ে ঢাকায় ফেরার চেষ্টা করেন তিনি। পুলিশ জানতে পারে শাহজাহানের দল মানিকগঞ্জ হয়ে ঢাকায় যাবে। মানিকগঞ্জে পুলিশ চেক পোস্ট বসালে শাহজাহান তার ওই এলাকার বাহিনীর মাধ্যমে তা জেনে জান। সব জেনেই ওই এলাকা দিয়ে ঢাকায় ফেরার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। মানিকগঞ্জে পুলিশের সঙ্গে সঙ্গে গুলাগুলিও হয়। কিন্তু পুলিশ তাকে ধরতে পারেনি। এরপর ঢাকায় পৌঁছে নরসিংদীর উদ্দেশে রওনা হলে পথে পুলিশ তাকে আটক করে। ৩৬ মামলার অনেকগুলাতে তিনি খালাস হয়েছেন।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়