জিএম কাদের : স্বাধীনতার ৫০ বছরেও দেশে সাংবাদিকতা অনিরাপদ

আগের সংবাদ

রাজশাহীতে লিটনকে টেক্কা দেয়ার মতো প্রতিদ্ব›দ্বী নেই

পরের সংবাদ

লাঙ্গল নিয়ে দেবর-ভাবির টানাটানি : জাতীয় নির্বাচনের আগে জাপায় ভাঙনের আভাস

প্রকাশিত: জুন ১৮, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ১৮, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

এস এম মিজান : সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টিতে দীর্ঘদিন ধরে চলা দেবর-ভাবির শীতলযুদ্ধ এবার প্রকাশ্যে চলে এসেছে। ঢাকা-১৭ (গুলশান-বনানী) আসনের উপনির্বাচনে দলীয় প্রতীক লাঙ্গল নিয়ে এ লড়াই প্রকাশ্যে রূপ নেয়। এই আসনে সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা জাপার প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ ও পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের দুজনই আলাদাভাবে প্রার্থী ঘোষণা করেছেন। রওশন এরশাদ নির্বাচন কমিশনের কাছে তার দেয়া মনোনীত প্রার্থী কাজী মামুনুর রশিদের জন্য নির্বাচনী প্রতীক লাঙ্গল চেয়েছেন। জি এম কাদেরও অবসরপ্রাপ্ত মেজর আনিসের জন্য লাঙ্গল প্রতীক চেয়েছেন। পার্টির শীর্ষ দুই নেতার এই দ্ব›েদ্বর জেরে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই পার্টিতে ভাঙনের আশঙ্কা করছেন দলটির নেতারা।
জানা যায়, নির্বাচন কমিশনের তফসিল অনুযায়ী ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচন আগামী ১৭ জুলাই। আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য চিত্রনায়ক আকবর হোসেন পাঠান ফারুকের মৃত্যুতে শূন্য হওয়া আসনটিতে জাপার প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ দলের ও লাঙ্গলের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দিয়েছেন জাতীয় পার্টির সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী মামুনুর রশিদকে। আর দলীয় গঠনতন্ত্র মোতাবেক মনোনয়ন বোর্ডে সাক্ষাৎকার শেষে গত বুধবার জাপা দলীয় প্রার্থী হিসেবে মেজর (অব.) সিকদার আনিসুর রহমানের নাম ঘোষণা করেন দলটির চেয়ারম্যান জি এম কাদের। ঢাকা-১৭ আসনের এই উপনির্বাচনে যখন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগসহ প্রতিদ্ব›দ্বী অন্য দলগুলো বা সম্ভাব্য প্রার্থীরা জয়ী হওয়ার নকশা আঁকছেন, তখন জাতীয় পার্টিতে (জাপা) চলছে ভিন্ন খেলা। এই উপনির্বাচনকে উপলক্ষ করে জাপার নির্বাচনী প্রতীক ‘লাঙ্গল’-এর মালিকানার বিষয়টি সামনে চলে এসেছে। ২০০০ সালের ৯ মার্চ হাইকোর্টের দেয়া একটি আদেশের বিষয় উল্লেখ করে রওশনপন্থিরা দাবি করছেন- ওই রায় অনুযায়ী লাঙ্গলের যৌথ মালিক প্রয়াত এইচএম এরশাদ ও রওশন এরশাদ। তবে জি এম কাদেরের নেতৃত্বাধীন জাপার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বিষয়টি বর্তমানে অপ্রাসঙ্গিক।
একদিকে রওশন তার মনোনীত কাজী মামুনকে লাঙ্গল প্রতীক বরাদ্দ দিতে নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) চিঠি

দিয়েছেন, অন্যদিকে পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে জি এম কাদেরও ইসিকে চিঠি দিয়েছেন দল মনোনীত প্রার্থী মেজর আনিসকে লাঙ্গল বরাদ্দ দেয়ার জন্য। নির্বাচনী প্রতীক লাঙ্গল নিয়ে লড়াইয়ের ফলাফল আজ রবিবার অথবা কাল সোমবার স্পষ্ট হবে। এ সময়ের মধ্যে রিটার্নিং অফিসার ঢাকা-১৭ আসনে উপনির্বাচনের প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাই করে নির্বাচনী প্রতীক বরাদ্দ দেয়ার কথা রয়েছে। ইসিতে জমা দেয়া রওশন স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়- আমি জাপার প্রধান পৃষ্ঠপোষক। সংসদীয় দলের নেতা এবং বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে জাতীয় পার্টির দলীয় প্রার্থীর অনুকূলে দলীয় প্রতীক লাঙ্গল বরাদ্দের একমাত্র অধিকারী। এখানে উল্লেখ্য, ২০১৯ সালের ২৮ ডিসেম্বর কাউন্সিলে গৃহীত ও তৎকালীন মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গা স্বাক্ষরিত গঠনতন্ত্রের ধারা-২০-এর উপধারা ১ অনুযায়ী আমি রওশন এরশাদ দলের পতাকা বহন ও সর্বময় ক্ষমতা সংরক্ষণ করি। বিষয়টি ইতোপূর্বে হাইকোর্টে দায়েরকৃত রিট পিটিশনের (নং-১১৫৩/২০০০) পরিপ্রেক্ষিতে ২০০০ সালের ৯ মার্চের রায় ও আদেশ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। এ বিষয়ে হাইকোর্টের রায় অনুযায়ী লাঙ্গলের মালিকানা এবং দলীয় গঠনতন্ত্রে প্রধান পৃষ্ঠপোষকের ক্ষমতার বিষয়ে জাপা মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, যখন এই রায় হয় তখন কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর নিবন্ধনের বিষয় ছিল না। এখন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুযায়ী দল নিবন্ধন ও প্রতীক বরাদ্দের ক্ষমতা ইসির। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গঠনতন্ত্র অনুযায়ী জাপার ও সংসদীয় দলের প্রধান হলেন চেয়ারম্যান। মনোনয়ন দেয়ার ক্ষেত্রে মনোনয়ন বোর্ডের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। ফলে রওশন এরশাদ অন্য একজনকে মনোনয়ন দিয়েছেন বলে যেটা বলা হচ্ছে, সেটির সঙ্গে জাপার কোনো সম্পর্ক নেই।
এদিকে হঠাৎ ‘লাঙ্গল’ নিয়ে টানাটানির এই খেলার সূচনাটা রওশনের অনুসারীরা করেছেন বলে অভিযোগ করেছেন জি এম কাদেরপন্থিরা। তারা বলেন, দলের কোনো পর্যায়ে আলাপ-আলোচনা ছাড়াই গত ৫ জুন রওশনের পক্ষে সংবাদমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে জানানো হয়, ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে প্রতিদ্ব›িদ্বতার জন্য জাতীয় পার্টির প্রার্থী হিসেবে কাজী মো. মামুনুর রশিদের নাম আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেন বিরোধীদলীয় নেতা। রওশনের রাজনৈতিক সচিব গোলাম মসীহ্ স্বাক্ষরিত ওই সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, যা অবিলম্বে দলীয় সিদ্ধান্ত হিসেবে কার্যকরের নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে। দলীয় ফোরামে আলোচনা ছাড়া এ ধরনের প্রার্থী ঘোষণা করা দলের গঠনতন্ত্রের লঙ্ঘন। যা কোনোভাবেই রওশন এরশাদের কাছে দল প্রত্যাশা করে না।
অন্যদিকে, রওশনপন্থিরা বলছেন- স¤প্রতি খুলনা ও বরিশাল সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচনে রওশন এরশাদ জাতীয় পার্টির দলীয় প্রার্থী দেয়ার কথা থাকলেও তিনি দেননি। এ দুটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে রওশন এরশাদ জি এম কাদেরের সঙ্গে সমঝোতা করে প্রার্থী দেয়া থেকে বিরত থাকেন। রওশন এরশাদ জি এম কাদেরকে আগেই জানিয়ে দেন যে, ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে প্রার্থী দেবেন তিনি। তবে শেষ পর্যন্ত জি এম কাদের রওশন এরশাদের কথা রাখেননি। এ বিষয়ে জি এম কাদেরপন্থি এক নেতা বলেন, নির্বাচনী কৌশলের অংশ হিসেবে জি এম কাদের ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে প্রার্থী দিয়েছেন। তিনি প্রার্থী না দিলে, দলীয় প্রতীক লাঙ্গলের দাবি এবং দলে তার নেতৃত্ব প্রশ্নবিদ্ধ হবে। সে কারণেই জি এম কাদের বিদিশাপন্থি নেতা অবসরপ্রাপ্ত মেজর আনিসুর রহমানকে মনোনয়ন দিয়েছেন। এই মনোনয়ন চূড়ান্তের আগে বিদিশার সঙ্গে জি এম কাদেরের বৈঠক হয় বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।
এ বিষয়ে জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী গণমাধ্যমকে বলেছেন, আমি আপাতত পার্টির দুই সিনিয়র নেতার মধ্যে কোনো সমঝোতা দেখছি না। বরং পার্টি আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগেই আরেক দফা ভাঙতে পারে। এর পেছনে সরকারই মূল কারিগর হবে। কেননা রওশন এরশাদের বলয় সরকারের কাছ থেকে ইন্ধন পাচ্ছে। আর স¤প্রতি জি এম কাদের ক্রমাগত সরকারের সমালোচনা করে যাচ্ছেন। এতে সরকার যদি মনে করে, জি এম কাদের তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছেন, তখন নির্বাচনের আগে পার্টিকে দুই ভাগ করে দেবে। এক ভাগকে নিয়ে সরকার নির্বাচনে যাবে- এমন ষড়যন্ত্র এখনই শুরু হয়েছে।
এদিকে দেবর-ভাবির দ্ব›েদ্ব দলের বেশির ভাগ নেতাকর্মী ভাঙনের আশঙ্কা করলেও কিছুটা আশার আলো দেখাচ্ছেন জ্যেষ্ঠ নেতারা। দলীয় একটি সূত্র জানিয়েছে, রওশন এরশাদ ও জি এম কাদেরের মধ্যে দ্ব›দ্ব নিরসনের জন্য দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা সমঝোতার চেষ্টা করছেন। উভয়পক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের কঠোর অবস্থান থেকে নমনীয় করার চেষ্টা করা হচ্ছে। আগামী নির্বাচনের আগে পার্টির ভাঙন ঠেকাতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। সমঝোতা চেষ্টার সঙ্গে যুক্ত পার্টির একজন জ্যেষ্ঠ নেতা ভোরের কাগজকে বলেন, পার্টির এই দ্ব›দ্ব নিরসনে কাউকে না কাউকে তো এগিয়ে আসতে হবে। আমরা দুজনের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করছি। দেখি কী করতে পারি।
এ বিষয়ে রওশনপন্থি এক নেতা বলেন, মূলত কাজী মামুনুর রশীদকে প্রার্থী করা হয়েছে জি এম কাদেরকে সমঝোতায় আসতে চাপে রাখার অংশ হিসেবে। কারণ, দলের সাবেক কয়েকজন নেতাকে (রওশনপন্থি) দলে নিতে অস্বিকৃতি জানাচ্ছেন জি এম কাদের। এই নেতা বলেন, দলের এ পরিস্থিতিতে মানুষ হাসাহাসি করছে। আশা করি, আলোচনার মাধ্যমে এ বিরোধের একটি স্থায়ী সমাধান বের হয়ে আসবে। জি এম কাদের হয়তো দাবি মেনে নেবেন। ম্যাডাম রওশন এরশাদও বলেছেন দল নিয়ে টানাটানি না করতে। আমরা সবাই তো ঐক্যবদ্ধ জাতীয় পার্টি চাই। সমঝোতা হলে প্রয়োজনে মামুনুর রশীদ সরে দাঁড়াবে।
এর আগেও বেশ কয়েকবার ভাঙন ধরে সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচএম এরশাদের প্রতিষ্ঠিত এই দলে। এর মধ্যে ৩টি ভাঙন ছিল বড় ধরনের। তারা দল থেকে বেরিয়ে একই নামে আবার দল করেছেন। বড় ভাঙনগুলো হয়েছিল মূলত বিভিন্ন সময়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে-পরে। কখনো আওয়ামী লীগ-বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটে যাওয়া না-যাওয়া নিয়ে, আবার কখনো ভেঙেছে মন্ত্রিত্ব নিয়ে। ঘুরেফিরে এবারো সেই বিষয়টিই সামনে এসেছে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়