হাসপাতালে খালেদা জিয়া

আগের সংবাদ

অপরাধের স্বর্গরাজ্য রোহিঙ্গা ক্যাম্প

পরের সংবাদ

বায়ুদূষণে ভুগছে দেশের ১২ শতাংশ শিশু : হুমকিতে শিশুস্বাস্থ্য

প্রকাশিত: জুন ১৪, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুন ১৪, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

ঝর্ণা মনি : রাজধানীর উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী অক্ষর (ছদ্মনাম)। যে বয়সে শ্রেণিকক্ষে বন্ধুদের সঙ্গে হইহুল্লুড়ে মেতে থাকার কথা, খেলার মাঠে ফুটবল, ক্রিকেট ব্যাট নিয়ে দৌড়ে বেড়ানোর কথা, বাড়িতে কিংবা গল্পের আসরে কথার ফুলঝুরি বইয়ে দেয়ার কথা, এই বয়সে শুধু নির্জীব বসে থাকে অক্ষর। ঝিমধরা ভাব, দিন দিন শুকিয়ে যাওয়া, মাঝেমধ্যে পেটের পীড়ায় ভোগা, জ¦র-সর্দি-শ্বাসকষ্ট লেগে থাকা, পড়াশোনায় মনোযোগ হারানো- একমাত্র সন্তানের এমন অবস্থায় মুষড়ে পড়েন মা। সন্তানের চিন্তায় উদ্বিগ্ন সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এই মা ছেলেকে নিয়ে যান শিশু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চিকিৎসক জানালেন, তার সন্তান বায়ুদূষণজনিত ভাইরাসে আক্রান্ত।
শুধু অক্ষর নয়, জাতিসংঘের শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) সহযোগিতায় ‘ক্লিয়ার দ্য এয়ার ফর চিলড্রেন’ শীর্ষক এক গবেষণার তথ্যমতে, বায়ুদূষণে প্রতি বছর বিশ্বে শূন্য থেকে পাঁচ বছর বয়সি শিশু মারা যায় ৬ লাখ। অত্যধিক দূষিত বায়ু এলাকায় বাস করে ৩০ কোটি শিশু। বেসরকারি সংস্থা ‘সুস্থ শিশু, সুস্থ জীবন’-এর জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে বায়ুদূষণে আক্রান্ত হয়ে নানা রোগে ভুগছে ১২ শতাংশ শিশু। অন্যদিকে ১৮০টি দেশের শিশুদের বেঁচে থাকা, শিক্ষা ও পুষ্টি বিষয়ে র?্যাংকিং নিয়ে ‘দ্য ল্যানচেট’ মেডিকেল জার্নালে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নি¤œ ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে ৫ বছর বয়সের নিচে ঝুঁকিতে রয়েছে প্রায় ২৫ কোটি শিশু। তারা বসবাস করছে অপুষ্টি ও দারিদ্র্যে। একই সঙ্গে বিশ্বে মোটা হয়ে যাওয়া শিশুর সংখ্যা ১৯৭৫ সাল থেকে ১১ গুণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২ কোটি ৪০ লাখে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার এক প্রতিবেদনে বায়ুদূষণকে অদৃশ্য ঘাতক হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়েছে। সংস্থার মহাপরিচালক টেডরোস আধানম ঘেব্রেয়েসাস বলেছেন, বিশ্ব এখনকার শিশু ও তরুণদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হচ্ছে। তাদের স্বাস্থ্যের যতœ নিতে ব্যর্থ হচ্ছে। তাদের অধিকার রক্ষায় ব্যর্থ হচ্ছে। তাদের এই গ্রহকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হচ্ছে।
দূষণ যেভাবে ক্ষতিকারক : সা¤প্রতিক সময়ে বিশ্বের দূষিত

বায়ুর শহরগুলোর মধ্যে প্রথমসারিতে রাজধানী ঢাকা। শুধু তাই নয়, বিশ্বের যে পাঁচটি দেশের শতভাগ মানুষ দূষিত বায়ুর মধ্যে বসবাস করে, তার একটি বাংলাদেশ। চলতি বছরের এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে প্রকাশিত বৈশ্বিক বায়ুদূষণের ঝুঁকি বিষয়ক ‘দ্য স্টেট অব গেøাবাল এয়ার-২০১৯’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়। প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানমাত্রার চেয়ে অনেক নিচে বাংলাদেশের বায়ুর মান। এমন অবস্থায় বায়ুদূষণের কারণে নানাবিধ রোগের পাশাপাশি শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ঢাকার বাতাসে সালফার ডাই অক্সাইড, কার্বন ডাই অক্সাইড ও কার্বন মনোক্সাইড বেড়ে গেছে। তার সঙ্গে রয়েছে অন্যান্য বিষাক্ত গ্যাস। এমনকি এর সঙ্গে যোগ হয়েছে প্লাস্টিক কণাও। শুধু তাই নয়, ঢাকার বায়ুতে ক্ষতিকর বস্তুকণার মধ্যে সিসাও রয়েছে। ফলে বাড়ছে বায়ু দূষণ। যা মারাত্মক ক্ষতি করছে মানবদেহের। রাজধানী ঢাকা ও আশপাশে বায়ুদূষণের অন্যতম প্রধান উৎস ইটভাটা, যানবাহনের জীবাশ্ম জ্বালানি দহন ও শিল্পকারখানার দূষিত ধোঁয়া, স্টিল ও রিরোলিং, সিরামিকস, প্লাস্টিক কারখানা ও সিমেন্ট ফ্যাক্টরি। রাজধানী ঢাকা, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জ শহর বায়ুদূষণে আক্রান্ত সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশ ইউনির্ভাসিটি আরবান ল্যাবের তথ্যমতে, প্রতি মাইক্রোগ্রাম বাতাসে ১-১২ মাইক্রোমিটার বস্তুকণা থাকার কথা। রাজাধানী ঢাকাতে এর মাত্রা ১৮৪ থেকে ২২৫ মাইক্রোমিটার। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে প্রায় ৭০ লাখ হাঁপানি রোগী রয়েছে; যাদের ৭৫ ভাগ শিশু। রোগ-জীবাণু মিশ্রিত ধুলাবালি শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে ফুসফুসে ঢুকে ক্যান্সার, শ্বাসজনিত কষ্ট, হাঁপানি ও য²াসহ নানা জটিল রোগের সৃষ্টি করে। যেসব শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, তারা বেশি আক্রান্ত হচ্ছে।
বায়ুদূষণ নিয়ে কাজ করা সুইজারল্যান্ডের প্রযুক্তি কোম্পানি আইকিউএয়ারের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১ সালে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর দেশ ছিল বাংলাদেশ। ২০২০ সালেও বাংলাদেশ এই তালিকায় শীর্ষে ছিল। আর ‘পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন’-এর তথ্য মতে, রাজধানীর ৯০ শতাংশ মানুষ ভয়াবহ ধুলা দূষণের শিকার। প্রতি ঘনমিটার বাতাসে ১৫০ মাইক্রোগ্রাম পর্যন্ত ধূলিকণা থাকলে সহনীয় হিসেবে ধরা হয়। কিন্তু শীতের সময় রাজধানীর বাতাসে এর পরিমাণ থাকে ২২০ থেকে ৩০০ মাইক্রোগ্রাম বা তারও বেশি। ফলে শীত মৌসুমে ঢাকার বাতাস হয়ে পড়ে চরম অস্বাস্থ্যকর।
জানতে চাইলে প্রিভেনটিভ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী ভোরের কাগজকে বলেন, বায়ুদূষণের কারণে সব বয়সের মানুষেরই সমস্যা হয়। তবে শিশুদের একটু বেশি সমস্যা হয়। তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তিনি বলেন, সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ে শ্বাসযন্ত্রের ওপরে। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় প্রদাহ, হাঁচি-কাশি দীর্ঘায়িত হওয়া, ভাইরাসজনিত জ্বর ছাড়াও ফুসফুসের ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে। এছাড়া দূষিত বাতাসে থাকা নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড ব্রঙ্কাইটিস, বায়ুতে থাকা ক্যাডমিয়াম, প্রোমিয়ামসহ আরো কিছু ক্ষতিকর উপাদান লিভার, কিডনি সংক্রান্ত রোগের ঝুঁকিও বাড়ায়। দূষিত বায়ুতে যে সিসা থাকে তার প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিশুর স্নায়ুবিক বিকাশও।
পরিবেশবিদদের মতে, বায়ুদূষণ অন্যতম জনস্বাস্থ্য সমস্যা। এর কারণে শিশুস্বাস্থ্য ও শিশুর বেড়ে ওঠা ভীষণভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এ ব্যাপারে পবার (পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন) চেয়ারম্যান আবু নাসের খান ভোরের কাগজকে বলেন, নিয়মনীতি না মেনেই যেখানে সেখানে গড়ে তোলা হচ্ছে শিল্পকলকারখানা, অটোমোবাইল ওয়ার্কশপ, ইটভাটা ও মোবাইল ফোনের টাওয়ার। দূষিত বায়ুতে থাকা সীসা মারাত্মকভাবে লিভার, কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত করা থেকে শুরু করে মস্তিষ্কেও প্রভাব ফেলে। এর প্রভাব পড়ে শিশুদের ওপরও। এই সিসার কারণে শিশুদের মানসিক বিকাশ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, এমনকি শারীরিক বিকাশের হারও কমে যেতে পারে।
বেড়েছে শিশু মৃত্যুহার : ২০২১ সালে, ৫ বছরের কম বয়সি শিশুদের মৃত্যুর হার ছিল প্রতি হাজারে ২৮ জন। ২০২২ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩১ জনে। একইভাবে, এ সময়ের মধ্যে এক বছরের কম বয়সি শিশুর মৃত্যু প্রতি হাজারে ২২ থেকে বেড়ে ২৫ হয়েছে। গতকাল বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিত বাংলাদেশ শ্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকসে (বিএসভিএস) এই তথ্য উঠে এসেছে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম বলেন, শিশুমৃত্যুর হার বাড়া প্রত্যাশিত নয়। এর পেছনে অনেকগুলো কারণ থাকতে পারে। এটা কমাতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ব্যবস্থা নেয়া উচিত।
উপেক্ষিত আদালতে ৯ দফা : ঢাকার বায়ুদূষণ রোধে হাইকোর্টে একটি রিট করা হয়েছিল ২০২০ সালের জানুয়ারিতে, ওখানে ৯ দফা নির্দেশনা দেয়া হয়। তবে এসব নির্দেশনা বাস্তবায়নে কার্যকরী কোনো অগ্রগতি নেই বলে মন্তব্য করেছেন আদালত পক্ষের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, না থাকার পেছনে অনেক কারণ আছে। আদালত তার রায় বাস্তবায়নের জন্য শক্ত অবস্থান নিচ্ছেন না। আদালতের ৯ দফা বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিইে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সেই নির্দেশনা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। যার কারণে বারবার দূষণের শীর্ষে আমরা। ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, হাইকোর্টে একটি রিট করা হয়েছিল ২০২০ সালের জানুয়ারিতে, ওখানে ৯ দফা নির্দেশনা দেয়া হয়। পরের বছর আরো তিন দফা বাড়িয়ে ১২ দফা করা হয়। ওই নির্দেশনার এক দুটি ব্যতিরেকে বেশির ভাগই মানা হয়নি। আদালতকে ক্রমাগত অবমাননা করা হচ্ছে। দায়িত্বশীলরা বোধহয় এ ব্যাপারটি বুঝতে পারছেন না।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়