১ মিনিট ‘ব্ল্যাকআউট’ : আলোর মিছিলে গণহত্যার স্বীকৃতি দাবি

আগের সংবাদ

পাঠ্যবই কেলেঙ্কারি : গোয়েন্দা নজরদারিতে ৪ কর্মকর্তা

পরের সংবাদ

মালাকারটোলা গণহত্যা : শহীদের মর্যাদা পাননি কেউ

প্রকাশিত: মার্চ ২৭, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ২৭, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

দেখতে দেখতে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার ৫২ বছর পেরিয়ে গেল। এই ৫২ বছরেও আমরা যারা ঐহিত্যবাহী পুরান ঢাকার মালাকারটোলা মহল্লার অধিবাসী তারা ভুলতে পারিনি মালাকারটোলায় একাত্তরে পাকিস্তান বাহিনীর গণহত্যার দুঃসহ স্মৃতি। ৫২ বছর ধরে সেই ভয়াবহ গণহত্যার স্মৃতি প্রতিনিয়ত আমাদের তাড়া করে বেড়ায়। একদিকে স্বজন হারানোর বেদনা, অন্যদিকে পাকিস্তান বাহিনীর হাতে জীবন দিয়েও স্বাধীন দেশে শহীদের মর্যাদা না পাওয়ার মনোকষ্ট- একে এক দুঃসহ জীবনযাপন বললেও কম বলা হয়।
একাত্তরের ২৫ মার্চ পাকিস্তান বাহিনী গণহত্যা শুরুর পর পুরো ঢাকা শহরকে মৃত্যুপুরীতে পরিণত করেছিল। ঢাকার পাড়ায় পাড়ায় ঢুকে নির্বিচারে মানুষ হত্যার উৎসবে মেতে উঠেছিল পাকিস্তানিরা। পুরান ঢাকায় তারা বেছে বেছে হিন্দুপাড়ায় বেশি হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। পুরান ঢাকার সূত্রাপুরের মালাকারটোলার হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন সবচেয়ে বেশি হত্যা-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। একাত্তরের ২৭ মার্চ রাতে এই মালাকারটোলার প্রতিটি হিন্দু বাড়িতে হামলা করে পাকিস্তানিরা। বাড়ি বাড়ি তল্লাশি করে হিন্দু নিশ্চিত হওয়ার পর তাদের ধরে নিয়ে যায় ঢাকার ঐহিত্যবাহী লোহার পুলে। সেখানে ব্রাশফায়ারে হত্যা করে তাদের। সেদিন পাকিস্তানিরা একলাইনে দাঁড় করিয়ে ১৫ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করে। কয়েকজন আহত হন, কয়েকজন গুলির মধ্যেও মৃত্যুর মুখ থেকে সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে আসেন।
২৭ মার্চের সেই মৃত্যুপুরী মালাকারটোলায় আমাদের পৈতৃক বাড়ি। সেদিনের গণহত্যার পর মৃত্যুর মিছিলে যোগ হয় আমার দুই ভাইয়ের নাম। আর আমার বাবা গুলি খেয়েও বেঁচে যান। এখনো সেই দুঃসহ স্মৃতি আমাকে তাড়া করে। ২৭ মার্চ ঠিক রাত ১১টার দিকে একদল আর্মি এসে আমাদের বাড়ি ঘেরাও করে। এভাবে হিসাব করে আমাদের বাড়িতেই আর্মি হামলা করবে আমরা ভাবতেই পারিনি। দরজা ভেঙে তারা ঘরে ঢুকে আমার বাবা কালিপদ দে, ভাই দলুল দে ও বিপ্লব দেকে ধরে নিয়ে যায়। ধরে নিয়ে যাওয়ার আগে পাকিস্তান আর্মি সবাইকে জেরা করে এবং কাপড় খুলে দেখে নিশ্চিত হয় যে, তারা সবাই হিন্দু। ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় আমার ভাই বিপ্লব করুণকণ্ঠে বাবার কাছে জানতে চায়, বাবা আমাদের তারা কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। বাবা কোনো উত্তর দিতে পারেননি, শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলেন। এসব কথা বাবা পরে আমাদের বলেছেন।
আমাদের বাড়ি হামলা করার আগে-পরে আর্মি আরো কয়েকটি বাড়িতে হামলা করে অনেক লোককে ধরে নিয়ে যায়। রাত দুপুরে তাদের সবাইকে নিয়ে যাওয়া হয় লোহারপুলে, সেখানে সবাইকে লাইন দিয়ে দাঁড় করিয়ে একসঙ্গে সবার দিকে মেশিন গান উঁচিয়ে গুলি করে। গুলি খেয়ে সবাই লুটিয়ে পড়ে। তবে সৌভাগ্যক্রমে আমার বাবাসহ আরো দু’তিন জন বেঁচে যান। আমার বাবার হাতে ও বুকের পাশে গুলি লাগে। দু’একজনের গায়ে একেবারেই গুলি লাগেনি। তবে তারা ধোলাইখালের ময়লা পানিতে মরার মতো পড়ে থাকেন। পাকিস্তান আর্মি গুলি করার পর আহত শরীর নিয়ে আমার বাবাও মাটিতে শুয়ে থাকেন।
মালাকারটোলা হত্যাকাণ্ডের পর অনেক বছর কেটে গেছে। আমার বাবা সেই গণহত্যার দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে ৩ বছর বেঁচে ছিলেন। তখন একটি বিষয় আমি লক্ষ্য করি, তা হলো বাবা প্রায় প্রতিদিন রাতে কাউকে না জানিয়ে লোহার পুলে যে স্থানে পাকিস্তান আর্মি তাদের দাঁড় করিয়ে মেরে ফেলার জন্য গুলি করেছিল, ঠিক সে জায়গায় গিয়ে বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতেন। তিনি সম্ভবত সেই দুঃসহ স্মৃতি ভুলতে পারতেন না। বাবাকে এভাবে দেখে প্রায়ই আমার চোখে জল আসত। আমিও এক ধরনের কষ্ট বুকে নিয়ে বাবার সেই অবস্থা অনুধাবন করার চেষ্টা করতাম। সেই হত্যাকাণ্ড থেকে রক্ষা পাওয়া কয়েকজন কয়েক বছর বেঁচেছিলেন। তাদের সঙ্গে প্রায় দেখা হতো মহল্লার বিভিন্ন বাড়িতে। সবাই অত্যন্ত দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে সেই সময়ে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠতেন। তারা আক্ষেপ করতেন, তাদের যে স্বজনরা সেদিন জীবন দিয়েছেন, তাদের কথা কেউ মনে রাখেনি। তারা কেউ শহীদের মর্যাদা পাননি। সরকারও তাদের সম্পর্কে কোনো খোঁজখবর নেয়নি। মালাকারটোলা গণহত্যায় শহীদদের মর্যাদা দিতে প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ জানাই।

বাবুল দে : গেণ্ডারিয়া, ঢাকা।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়