১ মিনিট ‘ব্ল্যাকআউট’ : আলোর মিছিলে গণহত্যার স্বীকৃতি দাবি

আগের সংবাদ

পাঠ্যবই কেলেঙ্কারি : গোয়েন্দা নজরদারিতে ৪ কর্মকর্তা

পরের সংবাদ

গড়ে উঠুক বঙ্গবন্ধুর দর্শন ও নীতির উত্তরাধিকার-প্রজন্ম

প্রকাশিত: মার্চ ২৭, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ২৬, ২০২৩ , ১১:৫৩ অপরাহ্ণ

স্বাধীনতাহীনতার মধ্যে হাজার বছর বেঁচেছিল আমাদের পূর্বপুরুষরা। সে বাঁচাকে নিশ্চিতভাবে বেঁচে থাকা বলে না। শরৎচন্দ্রের বিলাসী গল্পে সেভাবে বেঁচে থাকাকে বলা হয়েছে- অতিকায় হস্তি লোপ পাইয়াছে কিন্তু তেলাপোকা টিকিয়া আছে। তেমনভাবে বেঁচে থাকায় গৌরব ছিল না, মুক্ততার সৌরভ ছিল না; ছিল শুধু গøানি আর নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার জন্য অনিশ্চিত কালের অপেক্ষা। কখনো ঘুরি-খিলজি কখনো মোগল, কখনো ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কখনো ব্রিটিশ শাসন; এভাবেই বিবর্তিত হতো বাঙালির পরাধীনতার ভাগ্যচক্র। এমন স্বাধীনতাহীন প্রাগৈতিহাসিক পরিস্থিতিতে বাঙালি জাতির জন্য আশীর্বাদের ফল্গুধারা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর আবির্ভাব। তার সারাজীবনকে যদি একটি শিরোনামবদ্ধ করা হয় সেটি হতে পারে- মুক্তি ও শান্তির পথে সংগ্রামযাত্রা। কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার কলমে বঙ্গবন্ধুর সেই সংগ্রামযাত্রা বিমূর্ত হয়েছে এভাবে- রবীন্দ্রনাথের মহামানবের তুমি ধ্রæব মহাকণ্ঠস্বর,/তুমি মহাবিদ্রোহীর মহাবরাভয়, চিরঅমর চিরঅজর;/তুমি ৭ মার্চ, বাঙালি জাতির পিতা,/বজ্রকণ্ঠ শেখ মুজিবুর:/তুমি ব্যক্তিবন্ধু, জাতিবন্ধু, বঙ্গবন্ধু, বিশ্ববন্ধু আর/সর্বমানবের প্রমুক্ত স্বাধীনতার/শুদ্ধ স্বরগ্রাম:/ ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম;/এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ বাইগার নদী তীরের টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেও সময়ের পথপরিক্রমায় তার কর্ম ও নেতৃত্বের কথা দেশ ও উপমহাদেশের গণ্ডি পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়ে ইয়াংসিকিয়াং থেকে নীলনদ, ভলগা থেকে মিসিসিপি-মিসৌরি, টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস থেকে টেমস ও হাডসন নদী পাড়ের মানুষের মাঝে। মুক্তিকামী ও অধিকারকামী বিশ্ববাসীর মধ্যে বঙ্গবন্ধুর নীতি ও দর্শন সৃষ্টি করে জনজোয়ার। বাঙালি জাতির হাজার বছরের পরাধীনতার কালোমেঘ দূর করে পূর্বগগনে এঁকে দিলেন স্বাধীনতার লাল সূর্য।
বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির মুক্তির অভিপ্রায়ে এবং সামজিক ন্যায্যতা ও মানবিক প্রাপ্যতা নিশ্চিতের মানসে যে রাজনৈতিক দর্শন ও নীতি পরিগ্রহ করেছিলেন তার ভিত্তিমূলে ছিল sincerity of purpose and honesty of purpose. পিতার দেয়া এই উপদেশবাণী তিনি আজীবন অনুসরণ করেছেন। বঙ্গবন্ধুর সেই বিজয়মন্ত্র আমাদের জন্যও সমূহ প্রাসঙ্গিক। কেননা আমাদের প্রত্যেকের ব্যক্তিজীবন যেমন আছে, আমাদের স্বদেশ-জীবনও আছে। স্বদেশ ও স্বদেশবাসীর প্রতি দায়বদ্ধতা আছে। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক তথা মানবিক উত্তরণের জন্য sincerity of purpose and honesty of purpose-এর কোনো বিকল্প নেই। তাই পরিবর্তিত ও নয়া বিশ্বব্যবস্থায় বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে আমাদের যাপিত জীবনে বঙ্গবন্ধু-চর্চা হতে হবে নিত্যকার।
বঙ্গবন্ধু মানুষের কর্মমুখরতাকে খুব প্রাধান্য দিতেন। কাজের ক্ষেত্রে অতিচিন্তা এবং ভুলের শঙ্কাকে প্রতিপক্ষ ভাবতেন। তিনি বলতেন, ‘যারা কাজ করে তাদেরই ভুল হতে পারে, যারা কাজ করে না তাদের ভুলও হয় না।’ বঙ্গবন্ধুর কর্মমুখরতাকে মূল্যায়ন করে মওলানা ভাসানী একবার বলেছিলেন, ‘আমার রাজনৈতিক জীবনে অনেক সেক্রেটারি এসেছে, কিন্তু মুজিবুরের মতো যোগ্য সেক্রেটারি অন্য কাউকে পাইনি।’ বঙ্গবন্ধুর উত্তরাধিকার হিসেবে তার স্বপ্ন-বিধৃত আগামীর বাংলাদেশ নির্মাণ-অভিযাত্রায় একটি কর্মোদ্যমী প্রজন্ম বড় প্রয়োজন যারা সংশয় আর শঙ্কাকে পদদলিত করে মেতে উঠবে বিপুল কর্মযজ্ঞে। কেউ রাজনীতি করবে, কেউ গবেষণা করবে, কেউ উদ্যোক্তা হবে, কেউ স্বেচ্ছাসেবী সামাজিক সংগঠন করবে। মোদ্দা কথা স্ব-স্ব কর্মক্ষেত্রে নতুন প্রজন্মকে হতে হবে আলোকবর্তিকাবাহক। উদ্ভাবন, উন্নয়ন ও প্রগতির ক্ষেত্রে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে হবে নেতৃত্বের আসনে। বঙ্গবন্ধুর নীতি ছিল মানুষকে ভালোবাসার নীতি। তিনি বলতেন, ‘মানুষকে ভালোবাসলে মানুষও ভালোবাসে। যদি সামান্য ত্যাগ স্বীকার করেন, তবে জনসাধারণ আপনার জন্য জীবন দিতেও পারে।’ এই দর্শন শুধু রাজনীতির মাঠেই প্রাসঙ্গিক নয়, এটি জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে, প্রতিটি বাঁকে চরমতম সত্য-দর্শন। বঙ্গবন্ধু সব হারাতে প্রস্তুত ছিলেন শুধু বাংলাদেশের মানুষের ভালোবাসা ছাড়া। নিজ দেশের মানুষের সঙ্গে যুক্ততার এমন ব্যাকুলতা আমাদের মধ্যেও থাকা উচিত; তাহলেই সৃষ্টি হবে পারস্পরিক সহযোগিতা ও সহকর্মের পরিবেশ; অর্জিত হবে সমন্বিত উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা। হ্রাস পাবে মেধাপাচার। ফরেন রেমিট্যান্স এসে অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগের নতুন নতুন দ্বার উন্মোচন করবে। সরকারি-বেসরকারি সব ক্ষেত্রে শুদ্ধাচার ও জবাবদিহিতার চর্চা হবে। বঙ্গবন্ধু দেশকে এগিয়ে নেয়ার জন্য একটি জনশক্তি প্রত্যাশা করেছিলেন, যারা স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি ও আত্মপ্রবঞ্চনার ঊর্ধ্বে থেকে আত্মসমালোচনা ও আত্মসংযমের মধ্য দিয়ে আত্মশুদ্ধি অর্জন করবে। প্রকৃতপক্ষে টেকসই উন্নয়ন ও সুশাসন নিশ্চিতকল্পে আত্মশুদ্ধ জনশক্তির সূচকটা ঊর্ধ্বমুখী হওয়া বড় প্রয়োজন। তাছাড়া জনগণের দুর্দশাকে মূলধন করে যারা মুনাফা লোটে, সেইসব মজুতদার, চোরা-ব্যবসায়ীদেরও বাংলার মাটি থেকে উৎখাত করার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। আমরা দেখেছি করোনাকালে এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকালীন সংকটে এমন একশ্রেণির অতিমুনাফাখেকো ব্যবসায়ীর নগ্ন আস্ফালন। এদের রুখতে হবে। আমাদের সচেতন ও সচেষ্ট হতে হবে। প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে এসব ক্ষেত্রে zero tolerance Ges zero mercy নীতি অবলম্বন করতে হবে।
বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন শোষণ ও বিচারহীনতামুক্ত একটি সমাজ নির্মাণ করতে। পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে অগণতান্ত্রিক শক্তির শোষণ ও বিচারহীনতার ভয়াবহ কালো রূপ বাংলার মানুষ দেখেছে। জাতির পিতা হত্যার বিচারের পথ রুদ্ধ করতে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ পর্যন্তও জারি হয়েছে। সেই বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বাংলাদেশ উত্তরণের পথ খুঁজে পায় সপরিবার বঙ্গবন্ধুকে হত্যার বিচার এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মধ্য দিয়ে। আমাদেরকে আরো বহুদূর যেতে হবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা নির্মাণে। বিশেষ করে যারা রাষ্ট্রের কর্মচারী তাদের আরো বেশি জনসম্পৃক্ত হতে হবে, সেবা সহজীকরণ করতে হবে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অনুযায়ী সরকারি কর্মচারীদের জনগণের সঙ্গে মিশে যেতে হবে, কেননা তারা জনগণের খাদেম, সেবক ও ভাই। পাশাপাশি বিচারপ্রাপ্তির দীর্ঘসূত্রতা দূর করতে হবে। কথায় আছে- justice delayed is justice denied. বাঙালি জাতিসত্তাকে অনন্য উচ্চতায় সমাসীন করতে বঙ্গবন্ধু নিরন্তর লড়াই করেছেন আমাদের চিরায়ত সংস্কৃতির শুদ্ধ চর্চা ও বিকাশের পরিবেশ সৃষ্টিতে; সংগ্রাম করেছেন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও ধর্ম-সমঅধিকার নিশ্চিতে। তিনি বিশ্বাস করতেন সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা ছাড়া রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্থহীন। তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাস্নাত বাহাত্তরের সংবিধানের মাধ্যমে বাংলাদেশকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে রূপ দিয়েছেন। পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার না করতে বারবার সতর্ক করেছেন। পরিতাপের বিষয় স্বাধীনতার বায়ান্ন বছরে পদার্পণ করেও সাংস্কৃতিক মুক্তি ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ নির্মাণের সংগ্রামটা এখনো আমাদের করতে হচ্ছে। সাম্প্রদায়িক শ্বাপদগুলো নানারূপে নানাসময়ে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। সাম্প্রদায়িক সেসব শকুনের থাবায় ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে রমনা বটমূল, উদীচী, রামু, নাসিরনগর; প্রকাশ্যে হুমকি দেয়া হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভেঙে ফেলার। এটি সাম্প্রদায়িক অপশক্তির একধরনের ethnic cleansing process. সময় এসেছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী ও সাম্প্রদায়িক দুর্জনদের বিরুদ্ধে নতুন প্রজন্মকে স্বাধীনতার চেতনা-ব্যূহ হয়ে দাঁড়ানোর। বাঙালি সংস্কৃতিকে ধারণ ও বহন করে জনসচেতনতা, জনসম্পৃক্ততা, মুক্তবুদ্ধির চর্চা এবং যুক্তির ক্ষুরধারে উপড়ে ফেলতে হবে সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষ।
বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘সোনার বাংলা গড়তে হলে সোনার মানুষ চাই।’ বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার মানুষ হওয়ার রূপরেখা খুবই সরল। যে দেশপ্রেমিক-উদ্যমী-সাহসী-সৎ-বুকে ও মুখে এক, যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও প্রেরণায় উদ্ভাসিত, যে স্বপ্ন দেখে এবং স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথ খোঁজে, সর্বোপরি যে মানুষের জন্য নিবেদিত সে-ই সোনার মানুষ। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কর্মসমূহকে এগিয়ে নিতে এমন এক স্বর্ণ-প্রজন্মের প্রয়োজন; যারা তাদের অধিত শিক্ষা, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার সঙ্গে বাঙালি সংস্কৃতিকে ধারণ করে দেশ ও দেশের মানুষকে এগিয়ে নেবে। স্বাধীনতা দিবসের অভীপ্সা- গড়ে উঠুক বঙ্গবন্ধুর দর্শন ও নীতির উত্তরাধিকার-প্রজন্ম।

শেখ ফয়সল আমীন : কর্মকর্তা, বাংলা একাডেমি।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়