কাতার নাগরিক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী : প্রবাসে অপরাধে জড়ালে দায় নেবে না সরকার, দালালের মাধ্যমে কেউ বিদেশমুখী হবেন না

আগের সংবাদ

বিপর্যয় সামালের সক্ষমতা কম : ইঞ্জিনিয়ার ও প্যারামেডিকেল টিম নেই, প্রয়োজন উন্নত প্রশিক্ষণ ও সরঞ্জাম

পরের সংবাদ

সব নারী ঘুরে দাঁড়াক

প্রকাশিত: মার্চ ১০, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ১০, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

আন্তর্জাতিক নারী দিবস ছিল ৮ মার্চ। শহরের নারী ও পুরুষ দিবসটি সম্পর্কে বেশ সচেতন। আয়োজন ও আনুষ্ঠানিকতা চলে সেইসঙ্গে। গ্রামাঞ্চলের নারী ও পুরুষ ততটা সচেতন নয় দিবসটি নিয়ে। তবে নারীর ক্ষমতায়ন ও অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা বেশ বেড়েছে গ্রামাঞ্চলে। প্রায় প্রতিটি ঘরের নারীরা বিভিন্ন ধরনের আয়মূলক কাজে জড়িয়ে পড়েছে এবং পড়ছে। সংসারের সচ্ছলতায় নারীদের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। গ্রামাঞ্চলে কোনো সমস্যায় সে সিদ্ধান্ত দেয়ার ক্ষমতা অর্জন করেছে। প্রায় প্রতিটি পরিবারের কন্যাসন্তানরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে পড়াশোনা করছে। ভালো ফলাফল অর্জিত হচ্ছে। কুসংস্কার ও ধর্মীয় গোঁড়ামি কিংবা কোনো ধরনের সামাজিক প্রতিবন্ধকতা নারীদের দমিয়ে রাখতে আর পারছে না। গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলের কিশোরী মেয়েদের হাফপ্যান্ট পরিধান করে ফুটবলে লাথি দিতে শেখাটাও সব প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে এক চরম প্রতিবাদও বটে। গ্রাম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে নারীদের এই সচেতনতা সৃষ্টি ও অদম্য শক্তি অর্জনের জন্য স্থানীয়ভাবে কর্মরত সরকারি ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা, ব্যক্তি-গোষ্ঠী যতটা না অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে, তার অধিক ভূমিকা নারীর নিজের, যা তার ভেতর থেকে জাগ্রত এবং সেটা নানা প্রতিকূলতার মধ্য থেকেই জাগ্রত। অভিজ্ঞতা একজন ব্যক্তির জীবনে মস্তবড় শিক্ষা, যা তাকে সাহস জোগায়, পথ দেখায়। গ্রামাঞ্চলের একজন নারীর বাস্তব অভিজ্ঞতাই তাকে সামনে এগোতে সহায়তা করে, কথাটা মোটেও অযৌক্তিক নয়। কেউ বলতে পারবে কিনা যে, নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা, তার মেধার বিকাশ ও দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য গ্রাম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ব্যাপকভাবে কাজ করেছে। সম্ভবত সন্তোষজনক উত্তর মিলবে না। আয়োজন ও আনুষ্ঠানিকতা কিংবা উদ্যোগ বাস্তবায়নের পরিকল্পনার অধিকাংশই শহরকেন্দ্রিক।
দেখেছি, জাতীয় পর্যায়ে এবং শহরের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে আন্তর্জাতিক নারী দিবসটিকে স্মরণীয় করতে রাখতে নানা আয়োজন ও আনুষ্ঠানিকতা চলে। বিভিন্ন করপোরেট অফিসও এগিয়ে থাকতে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করে। সবকিছুতে যেন লোক দেখানো একটা সুপ্ত প্রতিযোগিতা চলে। বর্ণিল ও বর্ণাঢ্য হয়ে উপস্থাপিত হয়। প্রতিষ্ঠানের নারী সদস্যকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানানো কিংবা উপহার সামগ্রী তুলে দিয়ে ভালোবাসা ও আন্তরিকতা প্রকাশের চেষ্টা চলে। মালিক বা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের হাত থেকে নারী সদস্যদের হাতে এসব তুলে দেয়া হয়। হয়তো দেখা যাবে, এই পুরুষ মালিক বা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ দ্বারাই প্রতিষ্ঠানের নারী সদস্যদের কেউ কেউ কখনোবা নির্যাতন বা নিপীড়নের শিকার হয়েছে। অথচ এই দিবসকে কেন্দ্র করে সেই পুরুষ মালিক বা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ তাদের চেহারা বদলে ফেলে। কারণ নারী বিষয়টি এখন সমাজে একটা সংবেদনশীল অবস্থানে আছে। নারী নির্যাতনবিরোধী অনেক আইন তৈরি হয়েছে। নারীর অধিকার নিয়ে ও নির্যাতনবিরোধী কথা বললে মর্যাদা ও জনপ্রিয়তা বাড়ে চরিত্রে তার যতই কালিমা থাকুক না কেন। প্রচার জনপ্রিয়তাও বাড়ে। অনেকে বলে, চরিত্রের কালিমা ঢেকে রাখার এ এক উত্তম কৌশল। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের কর্ণধাররা এমন কৌশলে নিজেদের আবৃত করে চলে। এক কথায়, আয়োজন ও আনুষ্ঠানিকতার মোড়কেই দিবসটির শুরু ও শেষ হয়। নারীর অধিকার, নিরাপত্তা ও মর্যাদা এখনো অনেক জায়গায় প্রতিষ্ঠিত হয় না, অনুপস্থিত থাকে।
এ কথা না বললেই নয় যে, ব্যবসায়িক জগতে নারীকে পণ্য হিসেবে উপস্থাপনের মাত্রা কমেনি, বরং বেড়েছে। কৌশল বদলেছে কেবল। আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে একটা টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানির বিজ্ঞাপনে দেখা গেল যে, একজন সুন্দরী নারী বলছে, ঘর সামলাই, ব্যবসাও সামলাই। পাঠক বা দর্শক অনেক কিছুই ভেবে নিতে পারে এই বিজ্ঞাপন দেখে। একটা শ্রেণি এই ভেবে আনন্দিত হবে যে, নারীরা ঘর ও ব্যবসা একসঙ্গে সামলে চলছে। এটাই যেন নারীর ক্ষমতায়ন এবং তার উপযুক্ত মূল্যায়ন। কিন্তু এটা যে, ঘুরেফিরে নারীর পায়ে শেকল পরিয়ে দেয়ারই নামান্তর, সেটা কে বুঝল। একজন নারীকেই কেন ঘর সামলাতে হবে, আর সেটা বিজ্ঞাপনে এনে নারীকে ঘরবন্দি করার কৌশল প্রদর্শনের মানেইবা কী হতে পারে, বুঝতে হবে। নূপুরের আদলে শেকল পরিয়ে রাখার পাঁয়তারা না বুঝতে পারলে বলারইবা কী থাকে। যখন নারী ও পুরুষ, উভয়ই আয়মূলক কাজে সম্পৃক্ত থাকবে তখন কেন একজন নারীকে শুধু ঘর সামলাতে হবে! পুরুষ কেন ঘর সামলাবে না। নারী কি অতিরিক্ত কোনো দায় নিয়ে জগতে ভূমিষ্ঠ হয়েছে? হয়নি। সমাজই নারীকে জোর করে দায় চাপিয়েছে। সংসার নারীকেই সামলাতে হবে- এই ধারণা সমাজই দাঁড় করিয়েছে। যুগ যুগ ধরে সমাজে প্রচলিত ধর্মীয় কুসংস্কার ও পুরুষতন্ত্র নারীর ওপর উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এমন দায় চাপিয়েছে। এই দায়টাই সমাজ সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। কমবেশি প্রায় সবাই সেটাই চর্চা করে, করছে এবং করে আসছে। এটাই প্রচলিত নিয়ম হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। নারী বিষয়ে যতই সচেতনতামূলক কথা বলা হোক না কেন, খুব কৌশলে নারীকে পুরুষের অধীন করে রাখা হয়েছে, রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। আর এমন বিজ্ঞাপন কি কখনো তৈরি হয়েছে যেখানে বলা হয়েছে, পুরুষ ঘরও সামলাবে, ব্যবসাও সামলাবে? কিংবা পুরুষ ও নারীর সমান অধিকার রয়েছে একটি পরিবারে কাজে ও চিন্তা-চেতনায়? সম্ভবত না। কারণ পুরুষ ঘর সামলাবে এমন কথা বলতে কেউ শেখেনি, তাকে শেখানো হয়নি। সমাজ কিংবা রাষ্ট্র সেই শিক্ষা দেয়নি। আর সমাজটা যখন ব্যবসায়ীদের পকেটে চলে যায় তখন এক ঢিলে তো অনেক ফায়দা হাসিল হয়। আর ঘর সামলাবার দায়টা পুরুষের হয় না বলেই পুরুষরা উন্মুক্ত স্বাধীনতায় অনৈতিক কাজে জড়িয়ে যায়, যাচ্ছে। পুরুষ হয়ে থাকে সমাজে ডানা মেলা পাখির মতো। মন চাইলে উড়ে বেড়ায়।
নারীকে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কীভাবে ব্যবহার করছে বা ব্যবহার করার সুযোগ পাচ্ছে, তা যদি স্বয়ং কোনো নারী, সমাজ ও রাষ্ট্র না বুঝে তাহলে সমস্যার সমাধান কোনোদিনও হবে না। নারীর সচেতনতা বেশি জরুরি এই ক্ষেত্রে। যেমন পণ্য বিক্রির বিজ্ঞাপনে নারীকে যাচ্ছেতাইভাবে পণ্য হিসেবেই উপস্থাপন করা হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে এমন বিজ্ঞাপনে কোনো নারী অংশগ্রহণ করবে কি করবে না সেই সিদ্ধান্ত তার। সিদ্ধান্ত এমন হওয়া উচিত, যেন তার সিদ্ধান্ত তার সম্মান ও অবস্থান অক্ষুণ্ন রাখে। একই কথা প্রযোজ্য সাহিত্য, নাটক, চলচ্চিত্রে নারী উপস্থাপনা নিয়ে। নারীর মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়, অসম্মানিত হয় এমন কিছু পরিবেশন থেকে বিরত থাকার বিষয়ে নজর দিতে হবে।
দেখা যায় যে, বিশ্বজুড়ে নারী বিষয়ে কাজ করছে একটি শ্রেণি। যারা নারীবাদী হিসেবে পরিচিত। সাধারণত নারীবাদীরা নারীর অধিকার নিয়ে বেশ সোচ্চার থাকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের প্রতিবাদ সভা, সেমিনার, ওয়ার্কশপ কিংবা ভিন্নতর কোনো মাধ্যমের ভেতর আবদ্ধ থাকে। সর্বজনীন হয় না। তারা সব ধরনের নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে কথাও বলে না কিংবা তৎপর থাকে না বলে অনেকেই মনে করে থাকে। প্রতিটি পেশার নারী যদি তার নিজস্ব জায়গা থেকে অন্যায়ের প্রতিবাদ করে তার অধিকার আদায়ে সোচ্চার হয়, অনড় থাকে এবং সাহসের পরিচয় দেয় তাহলে নারী নির্যাতন ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে শত আইনের প্রয়োজন পড়ে না। সমাজটাও আর পুরুষতান্ত্রিক থাকে না। হয়তো অনেকেই ভেবে বসতে পারে, এমন একটা সমাজ ব্যবস্থায় সেটা সম্ভব কিনা। সম্ভব, সব নারী ঘুরে দাঁড়ালেই সম্ভব।

স্বপ্না রেজা : কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়