মহাখালীতে অভিযান : তিন রেস্টুরেন্টকে তিন লাখ টাকা জরিমানা

আগের সংবাদ

শ্রমবাজারে সম্ভাবনার হাতছানি : সৌদি আরব ও মালয়েশিয়ায় সংকট দেখা দিলেও ইউরোপে সম্ভাবনার হাতছানি

পরের সংবাদ

একুশেতে ব্রিটেন : প্রয়োজন অন্য আয়োজন

প্রকাশিত: মার্চ ১, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: মার্চ ১, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

একুশে ব্রিটেনের বাঙালিদের এক উৎসবের সময়। একুশে ব্রিটেনের বাঙালিদের যতটা উৎসবমুখর করে তোলে, ততটা করতে পারে না অন্যান্য দিবসে। বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানগুলো এত সর্বজনীন হয় না, যতটুকু হয় একুশের অনুষ্ঠানমালায়। দিবসটাকে স্মরণ করে মানুষ একটা ভিন্ন আবেগ নিয়ে। একুশে ব্রিটেনে হয়ে গেছে ইতিহাসের এক বড় অংশ। কেননা এই একুশে ঘিরেই ব্রিটেনের বিভিন্ন শহরে নির্মিত হয়েছে বাংলাদেশের কোনো স্থায়ী স্মৃতিস্তম্ভ, যেখানে ভিনদেশি মানুষগুলো খোঁজ নেয়, জেনে নেয় সালাম, রফিক, জব্বারের রক্তভেজা শার্টের ইতিহাস।
আর এই ইতিহাস সৃষ্টি করে প্রথম নর্থওয়েস্ট ইংল্যান্ডের বাংলাদেশি মানুষ। লন্ডন থেকে দুই শতাধিক মাইল দূরত্বের গ্রেটার ম্যানচেস্টারের ওল্ডহ্যাম শহরে আছে বাংলাদেশি মানুষের আবাস। ওল্ডহ্যাম ইয়ুথ এসোসিয়েশন, ওল্ডহ্যাম কাউন্সিলসহ এখানকার মানুষগুলোই প্রথম উদ্যোগ নিয়ে নির্মাণ করে এ শহীদ মিনার। বাংলাদেশের বাইরে বায়ান্নর প্রথম স্থায়ী শহীদ মিনার ওল্ডহ্যামেই, উদ্বোধন করা হয় ১৯৯৭ সালের ৫ অক্টোবর। তারপর জেগে উঠেছে লন্ডন। আলতাব আলী পার্কে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে একুশের মিনার। এখন একে একে ব্রিটেনে স্থায়ীভাবে নির্মিত পাঁচটি স্থায়ী শহীদ মিনার মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আর তাই স্বাভাবিকভাবেই বাঙালি অধ্যুষিত এ এলাকাগুলো এখন ভিনদেশিদের যে কেউ জানে বাংলাদেশিদের গৌরবের অবস্থান। তাছাড়া একুশের প্রথম প্রহরে বাংলাদেশি অধ্যুষিত অনেক শহরেই এখনো নির্মাণ করা হয় অস্থায়ী শহীদ মিনার। অন্যদিকে এখানে একটা কথা উল্লেখ না করলেই নয়, তা হলো দেশীয় রাজনীতির কাদা ছোড়াছুড়ির কারণে বিশেষত ওল্ডহ্যাম শহীদ মিনারে জনসমাগম কমেছে। আগে যেখানে শত-সহস্র নারী-পুরুষ-কিশোর-কিশোরীর অংশগ্রহণে জমে উঠত ওল্ডহ্যাম শহীদ মিনার, সে জনসমাগম এখন আর নেই। আগেকার বছরগুলোতে হট্টগোল, মারামারি, শহীদ মিনার দখল প্রভৃতি কারণে প্রতি বছরই এ শহীদ মিনারে জনসমাগম কমছে, এ বছরটাও ছিল এ রকমই। আর সে কারণেই গ্রেটার ম্যানচেস্টারের অন্য শহরগুলোতে নিজস্ব উদ্যোগেই শহীদ মিনার বানিয়েছে একুশের উদ্দীপনায় উজ্জীবিত হওয়া বাঙালিরা।
বাংলাদেশি পরম্পরার এখন বলতে গেলে চলছে চতুর্থ প্রজন্ম। এই প্রজন্মেরও একটা অংশ জানে একুশের ইতিহাস। লন্ডন-ম্যানচেস্টারসহ বিলেতের বিভিন্ন শহরে চলে বাংলা ভাষা শিক্ষা। এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রাখছে শিশু-কিশোরদের মনে বাংলা এবং বাঙালিদের বীজ রোপণ করতে। একুশেটা বিলেতে জনপ্রিয় হওয়ার এটাও একটা প্রধান কারণ বলে আমরা মনে করতে পারি। অন্যদিকে বাংলা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পর ভাষার সংগ্রামের পরিচিতি ও বাঙালি জাতির বীরত্বটাও সামনে এসেছে ব্যাপক জনগোষ্ঠীর কাছে। শুধু ম্যানচেস্টারে বাংলা শেখানোর তিনটি স্কুল চালু থাকলেও ওল্ডহ্যামে একটা স্কুলও নেই। তবে গত কয়েক বছর থেকে ওল্ডহ্যামে একটা ভিন্নধর্মী আয়োজন চোখে পড়ার মতো। ‘মাতৃভাষা উদযাপন পরিষদ’ নামের একটা সংগঠন ৫ বছর আগে শুরু করে প্রভাতফেরির আয়োজন। যারা ওল্ডহ্যাম শহীদ মিনারকে বছরে একটা দিন সাজান, তারা এই উদ্যোগের অংশীদার নন। স্থানীয় ব্যাপকসংখ্যক মানুষের অংশগ্রহণ এতে না থাকলেও ওল্ডহ্যামের কিছু তরুণের এ উদ্যোগে শুরু হওয়া এ আয়োজনে নর্থ ইংল্যান্ডের পার্শ্ববর্তী শহর থেকেও অংশ নেন বাঙালি সংস্কৃতির কর্ষণ করা মানুষ। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে কাজটা করতে পেরেছে এই মাতৃভাষা উদযাপন পরিষদ, তা হলো ওল্ডহ্যামের একটা প্রাইমারি স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা এই প্রভাতফেরিতে অংশ নেয়। এবারের প্রভাতফেরিতেও ‘বার্নলি বো প্রাইমারি স্কুল’র প্রধান শিক্ষকের নেতৃত্বে শতাধিক ছাত্রছাত্রী অংশ নেয়, অংশ নেন স্কুলের আরো কর্মকর্তারা। উপস্থিত হন স্থানীয় কাউন্সিলের দুজন জনপ্রতিনিধিও। এ বছর গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণাটি এসেছে স্কুলের প্রধান শিক্ষক মিস হেলেন এটকিনসনের কাছ থেকে। তিনি বলেছেন, এ বছর থেকে তার স্কুলের বার্ষিক শিক্ষা ক্যারিকুলামে দিনটি (২১ ফেব্রুয়ারি) সংযুক্ত করবেন এবং দিনটি ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষার একটা অংশ হিসেবেই থাকবে। অর্থাৎ ছাত্রছাত্রীদের জন্য প্রতি বছর এই দিনটা স্কুলের শিক্ষার একটা অংশই হয়ে গেল। ওল্ডহ্যামে শহীদ মিনার নির্মাণে যেমনি ইতিহাস রচিত হয়েছে, ঠিক তেমনি স্কুলের ক্যারিকুলামে ২১ ফেব্রুয়ারি একটা উৎসবের দিন হিসেবে চিহ্নিত করার মধ্য দিয়ে আরেকটা অধ্যায় সূচিত হলো ওল্ডহ্যামে।
বাংলা ভাষার প্রসারে এবং সমৃদ্ধিতে মাতৃভাষা উদযাপন পরিষদের এ উদ্যোগ নিঃসন্দেহে একটা মাইলফলক। বাংলাদেশের বিভিন্ন জাতীয় দিবসে অসংখ্য মানুষ বক্তৃতা দিয়ে থাকেন এবং প্রায় প্রতি বক্তাই একটা কথা সবসময় বলেন আর তা হলো নতুন প্রজন্মকে বাংলা ভাষা শেখানোর কথা। কিন্তু যারা এটা বলেন, তাদের হাতেগোনা দু’একজন ছাড়া কেউই তাদের স্ত্রী-সন্তানদের এসব অনুষ্ঠানে নিয়ে আসেন না। অর্থাৎ এক ধরনের সহজ-মুখস্থ বুলি ছুড়েন। বাংলা ভাষা চর্চার কথাতো দূরের ব্যাপার, এমনকি ভার্চুয়ালিও বাংলাদেশ সম্পর্কে জেনে নিতে উদ্বুদ্ধ করেন কি-না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। আর এই জায়গাটাতেই ওল্ডহ্যামের মাতৃভাষা উদযাপন পরিষদ বক্তৃতা নয়, তারা নতুন প্রজন্মের শিকড়েই এ নিয়ে একটা বদ্ধমূল ধারণা দিতে প্রথম পদক্ষেপে উত্তীর্ণ হতে পেরেছে। একটা স্কুলকে অন্তর্ভুক্ত করার মধ্য দিয়ে এ শহরের অন্য স্কুলগুলোর ছাত্রছাত্রীও আগামীতে এই দিনটির কর্মসূচিতে অংশ নেবে সে বিশ্বাস আমাদের দৃঢ় হয়েছে। তাদের এই পথ ধরে ব্রিটেনের অন্যান্য স্কুলেও বিশেষত সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ছাত্রছাত্রীদের স্কুলে এ প্রথা চালু করতে সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো ভূমিকা রাখতে পারে। এমনকি কমিউনিটিতে কাজ করা মানুষগুলোও এ কাজটি করতে পারেন।
সত্যি কথা হলো বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো, যারা দেশের রাজনীতি করেন, তাদের কোনো বড় ভূমিকা এতে পরিলক্ষিত হয় না। আওয়ামী লীগ দায়সারা গোছের গোলটেবিল আলোচনা করে। বিএনপিকে তো কোনো উদ্যোগ নিতেই দেখিনি আমরা নর্থওয়েস্ট ইংল্যান্ডে। সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো এ দিবসটাকে তোলে ধরতে আয়োজন করে ভিন্নভাবে। যেমন চেতনা ইউকের আয়োজন ছিল শুধুই কবিতায় বাংলা ভাষা। সংস্কৃতি অঙ্গনের ব্যাপক মানুষের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠানটি ছিল মুখর। প্রায় তিন ঘণ্টাব্যাপী এ অনুষ্ঠান সবাই যেন ডুব দিয়েছিলেন বায়ান্নের সেই মুখর দিনগুলোতে। পরবর্তীতে এরা অংশ নিয়েছে শহীদ মিনারে ফুলেল শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাতে, গ্রেটার ম্যানচেস্টার বাংলাদেশ এসোসিয়েশনের (বাংলাদেশ সেন্টার) নির্মিত অস্থায়ী শহীদ মিনারে। ‘এলসিবি ম্যানচেস্টার’ তাদের বাংলা স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের অর্থাৎ নতুন প্রজন্মদের নিয়ে আয়োজন করছে অনুষ্ঠান। বাংলাদেশ হাইকমিশন আগামীতে যদি শুধুই বক্তৃতা কিংবা দলীয় ছায়া থেকে সরে এসে অন্যকিছু করতে পারে, তবেই হয়তো ব্যাপক বাংলাদেশির অংশগ্রহণে কোলাহলময় হয়ে উঠবে ম্যানচেস্টারের সহকারী হাইকমিশন চত্বর।
সর্বোপরি ব্রিটেনে বাংলা ভাষাটা বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ছাত্রছাত্রীদের কাছে পৌঁছে দিতে সর্বাগ্রে প্রয়োজন বাঙালি সংস্কৃতি নিয়েই কাজ করা। মূল ধরেই আগাতে হবে। তবেই হয়তো ভাষার প্রতি একটা ভালোবাসা সৃষ্টি হতে পারে ব্রিটেনে বেড়ে ওঠা বাংলা ভাষাভাষি প্রজন্মের মাঝে।

ফারুক যোশী : কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়