শহীদ মিনারে লাখো মানুষের ঢল : একুশের প্রথম প্রহরে রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রীর শ্রদ্ধা নিবেদন

আগের সংবাদ

অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে জোর : হালনাগাদ তথ্য নেই দেড় লাখ বৈধ অস্ত্রের, র‌্যাব, পুলিশ ও বিজিবির বিশেষ অভিযান

পরের সংবাদ

ভাষাকে সযত্নে লালনপালন করুন

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২২, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ২২, ২০২৩ , ১:১৯ পূর্বাহ্ণ

আমাদের ভাষা সংগ্রামের বয়স সত্তর বছর। কিন্তু আজ আমাদের কাছে এই প্রশ্নটি বড় মারাত্মকভাবে প্রকটিত হয়ে উঠেছে যে, যে ভাষার জন্য এত আত্মবিসর্জন, এত সংগ্রাম সেই ভাষাটিকে আমরা কীভাবে বা কতখানি নিজেদের ব্যক্তিগত ও জাতীয় জীবনে প্রতিফলিত হয়ে উঠতে দেখেছি। এর উত্তর কম-বেশি আমরা সবাই জানি, আর সেটা হলো আমরা আমাদের মাতৃভাষাকে এখনো জাতীয় ভাষা হয়ে উঠতে দেখিনি। মাতৃভাষার ব্যাপারে আজ আমরা একটা জগাখিচুড়ি পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। অথচ ভাষার অধিকার আদায়ের মূল লক্ষ্য ছিল তো এই যে ভাষাকে কেন্দ্র করে নিজের অধিকার লড়াইয়ে শামিল হওয়া। নিজের ভাষাকে একেবারে আত্মস্থ করে নিয়ে এবং তার মাধ্যমেই নিজের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে ঠিকমতো বুঝে নিয়ে তবে পৃথিবীর অপর ভাষার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করা এবং সর্বজনীন আবহাওয়ায় বাঙালি হিসেবে বিশ্বকে অনুভব করা। এবং এই ভাষার ভেতর দিয়েই পরিপূর্ণভাবে মাতৃভূমিকে অনুভব করা এবং প্রমিত বাংলা ভাষার চর্চা করা। এর কোনোটাই যেন এখন পর্যন্ত ঠিকমতো হলো না। এবং তার কারণও বহুবিধ। তার একটি কারণ এবং বিশেষ কারণ এই যে, বাংলাদেশটির জন্মলগ্ন থেকে দেশটিকে থিতু না হতে দেয়ার ষড়যন্ত্র। দেশটির ভেতরে চরম অরাজকতার সৃষ্টি করা। দেশের সংবিধানকে ইচ্ছেমতো ছিঁড়ে-ছুটে ফেলা।
জন্মলগ্ন থেকে যে অস্থিতিশীলতা দেশটিকে আঁকড়ে ধরে তার ফলশ্রæতিতে এই দেশ ত্যাগ করার ব্যাপারে দেশবাসীর ভেতরে এক ধরনের তাড়াহুড়ো পড়ে যায়। সবাই দেশ ত্যাগে উৎসাহী হয়ে ওঠে। এই নতুন জন্ম নেয়া দেশটি যে মানুষকে কোনো নিরাপত্তা দিতে পারবে না, সে ব্যাপারে দেশবাসী সবাই মোটামুটি নিশ্চিন্ত হয়ে বসে। ফলে নিম্নবিত্ত থেকে মধ্যবিত্ত সবারই চোখ পড়ে যাবে বিদেশের দিকে। বিদেশে ছেলেমেয়েকে ঠেলে পাঠানো এবং তারই ধারাবাহিকতায় নিজেরাও দেশ ছেড়ে অন্য দেশে পাড়ি দেয়া। এবং দেশ ছাড়তে গেলে প্রথমেই যে জিনিসটি জরুরি সেটা হলো আন্তর্জাতিক একটি ভাষা শিক্ষা করা, যার মাধ্যমে ছেলেটি বা মেয়েটি বিদেশে গিয়ে স্থায়ী হতে পারে। সুতরাং ইংরেজি ছাড়া আর কোনো ভাষা তাদের সামনে ছিল না। এবং দেশের নাড়ি বুঝে নতুন দেশের সদ্য জাগ্রত ব্যবসায়ীরাও একের পর এক কিন্ডারগার্টেন বা ইংরেজি স্কুল খুলে বসতে শুরু করল। এর সঙ্গে আরো কিছু মোহ ধীরে ধীরে যোগ হলো, সেটি হলো, অর্থনৈতিক সচ্ছলতা এবং আন্তর্জাতিকতার মোহ। আমার ছেলেটি বা মেয়েটি রাশিয়ায় পড়ে, বা জার্মানিতে পড়ে, বা ইংল্যান্ডে পড়ে, বা কানাডা বা আমেরিকা, নিদেন পক্ষে সুইডেন, বিরাট এক গর্ব হয়ে ধরা দিল বুভুক্ষু বাঙালির চোখে।
আগে পশ্চিম পাকিস্তানিদের দয়ার ওপরে নির্ভর করে যেসব দেশ চোখে দেখা যেত এবং প্রায়ই দেখাই যেত না, সেসব দেশ এখন সরাসরি নাকের ডগায় এসে ঝুলতে লাগল। কারণ মরা হোক, ঝরা হোক, দুর্ভিক্ষপীড়িত হোক, জাতির পিতা নিহত হোক, তবু স্বাধীন একটি দেশ, যার আছে একটি আলাদা পতাকা, আলাদা সংবিধান। এবং আছে সরাসরি বিদেশের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার ক্ষমতা।
ফলে ময়ূরের পালকের মতো একের পর এক দেশ বাঙালিদের নাকের সামনে সুখী, সমৃদ্ধশালী, গৃহযুদ্ধহীন, মৌলবাদের আধিপত্যহীন সোনার বাসস্থান হিসেবে দেখা দিতে লাগল। তারা একে একে তাদের ছেলেমেয়েদের সেসব দেশে পাঠাতে লাগল। আর যারা যেতে পারল না, তারা মন মরা হয়ে দিন কাটাতে লাগল। এবং যেসব ছেলেমেয়ে বিদেশে একবার পড়তে গেল তার চির জন্মের মতোই সে দেশে থেকে গেল। সে দেশের সভ্যতা তাদের চোখ ধাঁধিয়ে দিল। এবং পরবর্তীতে নিজেদের বাবা-মা এবং আত্মীয়স্বজনদেরও টেনে নিয়ে চলে গেল।
কিন্তু যেসব মানুষ এবং তাদের ছেলেমেয়েরা বাংলাদেশে থাকল এবং বাংলায় লেখাপড়া করতে লাগল, তাদের কী হলো? তারা আর কী করবে। দেশের কাজকর্মেই মন দিল। খুব যে ক্ষতি হলো তা কিন্তু না, পাকিস্তান আমলে যেখানে কেরানি হিসেবে বা বড়জোর সেকশন অফিসার হিসেবে রিটায়ার করতে হতো, সেখানে তারা সেক্রেটারি হিসেবে রিটায়ার করতে লাগল। দেশের অর্থে দেশ-বিদেশ করতে লাগল। বিদেশি ছেলেমেয়েদের মতো কাড়ি কাড়ি টাকা-পয়সার মালিক হলো না বটে, তবে দেশের সম্মান এবং ভালোবাসা বেশ ভালোভাবেই উপভোগ করল।
আর বাংলা ভাষারই বা কী হলো? যে বাংলা ভাষা আমাদের মাতৃভাষা। যে মাতৃভাষার কারণে আমাদের ২১ ফেব্রুয়ারির জন্ম, তার কী হলো? তার অবস্থা আগে যা ছিল তার চেয়ে আর বেশি কিছু হলো না। বরং বলতে গেলে আরো খারাপ হলো। আগে আমরা তাও বাংলায় কথাবার্তা বলতাম, কেউ শুদ্ধ বাংলায় কথা বলতাম, কেউ বা আঞ্চলিক বাংলায়, ধীরে ধীরে আমাদের মুখের ভাষা হয়ে উঠল শুদ্ধ ও আঞ্চলিক ভাষার একটি ককটেইল। যাকে বলে জগাখিচুড়ি। এই ভাষা ধীরে ধীরে আমাদের গণমাধ্যমগুলোকেও প্রভাবিত করতে শুরু করল। আমাদের সংস্কৃতির ভেতরেই ঢুকে গেল এই ভাষা। প্রেমিক-প্রেমিকার প্রেম নিবেদন থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের গালিখিস্তিও এই জগাখিচুড়ি ভাষায় চলতে শুরু করল। অথচ আমরা একবারও ভেবে দেখবার চেষ্টা করলাম না যে, মানুষের মুখের ভাষারও একটি আব্রু আছে। আমরা যদি ভাষা আন্দোলন করার জাতি হয়ে থাকি, তাহলে এই ভাষার আব্রু রক্ষার দিকেও আমাদের নজর দিতে হবে। তাকে ভালোবাসতে হবে। শুধু ভালোবাসা না, তাকে শ্রদ্ধাও করতে হবে।
ভাষাকে আমরাই সযতেœ লালন পালন করব। একটি বাচ্চা ছেলে যখন বাড়িতে ন্যাংটো হয়ে ঘুরে বেড়ায় তখন হঠাৎ করে সেই বাড়িতে বাইরের কেউ হাজির হলে মা বা বাড়ির মানুষ যেমন তাড়াতাড়ি বাচ্চাটিকে একটি প্যান্ট বা জামা পরিয়ে দেন, বাচ্চা বোঝেও না যে, বাইরের মানুষের সামনে মা তার সম্মান রক্ষা করছেন, তেমনি আমাদের মাতৃভাষারও একটি সম্মান আছে, সে ভাষা যত্রতত্র ইচ্ছা মতো ব্যবহার করবার জন্য নয়। ভাষাকে যদি আমরা ভালোবাসি, ভালো তো অবশ্যই বাসি, তাহলে তার সম্মানও আমাদের রাখতে হবে। প্রমিত বাংলার ভেতরে আঞ্চলিক বাংলা মেশানোর বা মিশিয়ে কথা বলবার প্রবণতাকে রোধ করতে হবে। আমরা অবশ্যই ভুলব না যে স্বাধীন এক জাতি হিসেবে আমরা পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে আজ দাঁড়িয়েছি। আমাদের আচার ব্যবহার ও কথাবার্তা বা চালচলনে বাইরের জগৎ যেন মনে না করে যে, আমরা ফকিরের জাত। অর্থাৎ যা আগে ছিলাম, সেই পাকিস্তান আমলে, এখনো তাই। আমাদের খুব কষ্ট লাগে যখন দেখি বিশ্ববিদ্যালয়পড়–য়া একজন মানুষ শুদ্ধ বাংলায় কথা বলতে পারেন না। তিনি নিজে ক্লাসে বাচ্চাদের পড়ান, কিন্তু তার নিজেরই মুখের ভাষার কোনো আগল নেই।
অনেকে আমার কথা শুনলে হয়তো কাঁধ উঁচিয়ে নাকচ করে দিয়ে বলবেন, এসব খামোখা অ্যারিস্টোক্রেসি দেখিয়ে আমাদের লাভ কী?। যদি তাই হয়, তাহলে সত্যি বলতে, কেন আমরা সে অ্যারিস্টোক্রেসি দেখাব না? আমরা তো অ্যারিস্টোক্রেসিরই বংশধর। কারণ বিশ্বের ইতিহাসে যা লিপিবদ্ধ নেই, তা আমাদের ইতিহাসে আছে, আর তা হলো মাতৃভাষার সম্মান রক্ষার্থে আত্মদান। যে আত্মদান আমাদের দেশের মানুষ ১৯৫২ সালে বুকের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করে সমাধা করে গেছেন। আমরা তো তাদেরই সরাসরি উত্তরসূরি। এর ভেতরে তো কোনো ভুল নেই। আমরা তো যারা এদেশে বসবাস করি এবং বাংলা মিডিয়ামে পড়ি তাদের কথাই বলছি। যারা বাঙালি হয়ে এদেশে বসবাস করেও ইংরেজি মিডিয়ামে বাচ্চাদের মানুষ করছেন তাদের কথা ভাবছি না, কারণ তাদের ছেলেমেয়েরা হাজার লেখাপড়া শিখলেও আমাদের কোনো লাভ নেই। দেশের কোনো কাজে লাগবে না, তারা সব ইউরোপ-আমেরিকার কাজে লাগবে। আমাদের ভরসা এসব বাংলা মিডিয়ামে পড়া বাঙালি ছেলেমেয়েরাই। তারাই এদেশে থাকবে, এদেশটিকে টেনে ওপরে তুলবে, দেশের সংগ্রাম-সংকটে তারাই বুকের রক্ত ঢেলে দেবে, তারাই দেশটিকে চালাবে শিল্প ও সমৃদ্ধির ক্রমবিকাশের দিকে। মাতৃভাষা আবার বিপদে পড়লে তারাই তো এগিয়ে আসবে। এই বোধ তাদের জন্মের ভেতরেই গ্রথিত হয়ে আছে। তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ আমি এখনো বদরুদ্দীন উমরের কালজয়ী গ্রন্থ ‘ভাষা আন্দোলন প্রসঙ্গ’ থেকে টেনে বের করতে পারি।
১৯৫২ সালে যখন ভাষা অন্দোলন হয় এবং রাজপথে ছাত্রদের বুকে গুলি চলে, তার প্রতিবাদে পরদিন সমগ্র তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানজুড়ে যে প্রতিবাদ হয়, তার একটি বিবরণ সেখানে লিপিবদ্ধ করা আছে। তখন খুলনা জেলার অতি প্রত্যন্ত অঞ্চল মোরেলগঞ্জে পূর্ব পাকিস্তান সরকারের রিলিফের খাল কাটা প্রোগ্রাম চলছিল। সেই খাল কাটার কাজে শ্রমিক হিসেবে ছিলেন সেখানকার ক্ষেতমজুররা। তারা দিনে মজুরি হিসেবে প্রতিদিন ছয় আনা বা বড়জোর আট আনা করে পেতেন। তো একুশে ফেব্রুয়ারির একদিন পর রিলিফ অফিসার খাল কাটা প্রেজেক্টে উপস্থিত হয়ে দেখেন সেখানে সেদিন কোনো মজুর দাঁড়িয়ে নেই!
কী ব্যাপার? রিলিফ অফিসার হতভম্ব। প্রতিদিন শত শত কঙ্কালসার মজুর দৈনিক কাজ পাওয়ার আশায় সেখানে দাঁড়িয়ে থাকেন আর সেদিন সেখানে কেউই নেই। রিলিফ অফিসার ব্যস্ত হয়ে খোঁজ নিয়ে দেখেন, সেদিন ‘মহাদুর্ভিক্ষপীড়িত অশিক্ষিত কঙ্কালরা বাংলা ভাষা আন্দোলনের শহীদদের মর্মবেদনায় হরতাল পালন করছে!’
এই খবর পেয়ে বাঙালি রিলিফ অফিসারের সেদিন যেন চৈতন্য উদয় হলো। তো এই হলো আমাদের বাংলা ভাষার আন্দোলনের ইতিহাস। এই হলো আমাদের সমগ্র বাঙালি জাতিরই চৈতন্যের ইতিহাস। এবং এই হলো দেশি বা বিদেশি বাঙালির সর্বজনীন সত্য। তাই আমাদের ভাষাকে আমরা ভালোবাসব। এবং সেই ভাষার সঙ্গেই গাঁথা হয়ে থাকবে আমাদের সংগ্রামের ইতিহাস।

আনোয়ারা সৈয়দ হক : কথাসাহিত্যিক।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়