কাগজ প্রতিবেদক : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর যে অবদান, সেই অবদানটুকু মুছে ফেলার চেষ্টা হয়েছিল। অনেক বিজ্ঞজন, আমি কারো নাম বলতে চাই না, চিনি তো সবাইকে। অনেকে বলেছেন, ওনার আবার কী অবদান ছিল? জাতির পিতা ভাষা আন্দোলনের জন্য বারবার কারাবরণ করলেও তার অবদান ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা হয়েছে।
রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে গতকাল সোমবার সকালে ‘একুশে পদক-২০২৩’ বিতরণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ এবার ১৯ জন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব ও দুুটি প্রতিষ্ঠানের মাঝে পদক বিতরণ করেন প্রধানমন্ত্রী। সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদের সভাপতিত্বে পদক বিতরণ পর্বটি সঞ্চালনা ও পদক বিজয়ীদের সাইটেশন পাঠ করেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন। স্বাগত বক্তব্য রাখেন সংস্কৃতি সচিব মো. আবুল মনসুর। মন্ত্রিপরিষদ সদস্য, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, সংসদ সদস্য, ঊর্ধ্বতন বেসামরিক ও সামরিক কর্মকর্তা, বিদেশি আমন্ত্রিত অতিথি এবং কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিল্পীসহ দেশবরেণ্য বিশিষ্ট ব্যক্তি ও বুদ্ধিজীবীরা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
এ বছর ভাষা আন্দোলন ক্যাটাগরিতে তিনজন, মুক্তিযুদ্ধে একজন, শিল্পকলায় আটজন (অভিনয়, সংগীত, আবৃত্তি, চারু ও চিত্রকলা), রাজনীতিতে দুজন, শিক্ষায় একজন ব্যক্তি ও একটি প্রতিষ্ঠান, সমাজসেবায় একজন ও একটি প্রতিষ্ঠান এবং সাংবাদিকতা, গবেষণা এবং ভাষা ও সাহিত্যে একজন করে একুশে পদকে ভূষিত হয়েছেন।
ভাষা আন্দোলন ক্যাটাগরিতে খালেদা মঞ্জুর-ই খুদা, বীর মুক্তিযোদ্ধা এ কে এম শামসুল হক (মরণোত্তর) এবং হাজী মোহাম্মদ মজিবুর রহমান। শিল্পকলা বিভাগে অভিনয়ে মাসুদ আলী খান ও শিমুল ইউসুফ এবং সংগীতে মনোরঞ্জন ঘোষাল, গাজী আবদুল হাকিম ও ফজল-এ-খোদা (মরণোত্তর), আবৃত্তি বিভাগে জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, শিল্পকলায় নওয়াজিশ আলী খান এবং চিত্রকলায় কনক চাঁপা চাকমা পুরস্কার পেয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধ বিভাগে মমতাজ উদ্দিন (মরণোত্তর), সাংবাদিকতায় মো. শাহ আলমগীর (মরণোত্তর), গবেষণায় ড. মো. আব্দুল মজিদ, শিক্ষায় অধ্যাপক ড. মযহারুল ইসলাম (মরণোত্তর), সমাজসেবায় মো. সাইদুল হক, এডভোকেট মঞ্জুরুল ইসলাম (মরণোত্তর) ও রাজনীতিতে আকতার উদ্দিন মিয়া (মরণোত্তর) এবং ভাষা ও সাহিত্যে ড. মনিরুজ্জামান পুরস্কার পেয়েছেন। শিক্ষায় বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর ও সমাজসেবায় বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন এ পুরস্কার লাভ করেছে। পুরস্কার হিসেবে প্রত্যেককে স্বর্ণপদক, সম্মাননা সনদ এবং চার লাখ টাকার চেক দেয়া হয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বঙ্গবন্ধু জেলে ছিলেন বলে ওনার কোনো অবদান নেই? তাহলে উনি জেলে ছিলেন কেন? এই ভাষা

আন্দোলন করতে গিয়েই তো বারবার কারাগারে গিয়েছেন। সেই গুরুত্ব কিন্তু কেউ দিতে চায়নি। আমাদের মাতৃভাষার অধিকার আদায়ের আন্দোলন সূচনা করেছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তারই উদ্যোগে ভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয় এবং আমাদের ভাষার জন্য আন্দোলন শুরু হয় ১৯৪৮ সাল থেকে। ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি।
পাকিস্তান ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের রিপোর্টে বঙ্গবন্ধুর ভাষা আন্দোলনে অবদানের কথা উল্লেখ আছে জানিয়ে তিনি বলেন, ইন্টেলিজেন্স রিপোর্টগুলো পাওয়ার পরে আমি একটা ভাষণ দিয়েছিলাম। তখন একজন বিদগ্ধজন আমাকে খুব ক্রিটিসাইজ করে একটা লেখা লিখলেন যে, আমি নাকি সব বানিয়ে বানিয়ে বলছি। গোয়েন্দা রিপোর্টগুলো নিয়ে আমি আর আমার বান্ধবী বেবি মওদুদ এম আর আক্তার মুকুলের কাছে যাই। মুকুল ভাইকে বললাম, আপনার কাছে এই যে সমস্ত রিপোর্ট দিলাম, কোন তারিখে কখন কী করেছেন এখানে সব বিস্তারিত আছে। আপনি এর জবাবটা লিখুন। তিনি সত্যিই লিখেছিলেন। কারণ, ওনারা তো (সমালোচক) অনেক উঁচু মাপের লোক। আমাদের মতো ছোট চুনোপুঁটিরা কিছু লিখলে তো হবে না সেজন্য। পরে অবশ্য সেগুলো ১৪ খণ্ডের পুস্তক আকারে প্রকাশের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। পাশাপাশি জাতির পিতার লেখা অসমাপ্ত আত্মজীবনীতেও তার ভাষা আন্দোলনের বিভিন্ন ভূমিকার উল্লেখ রয়েছে।
‘বঙ্গবন্ধুকে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার একটা প্রবণতা সব সময় ছিল’- উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, পঁচাত্তরে জাতির পিতাকে হত্যার পর আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান ‘জয় বাংলা’ নিষিদ্ধ করা হয়। ৭ মার্চের ভাষণ, যে ভাষণে গেরিলা যুদ্ধের সমস্ত নির্দেশনা এবং সে ঐতিহাসিক কথা ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম’, রেডিওতে প্রতিদিন এই বার্তাটা পৌঁছানো হতো। এই ভাষণের কারণে মুক্তিযোদ্ধারা যার যা কিছু ছিল তাই নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে আমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন। সেই ভাষণটাও নিষিদ্ধ। আসলে বঙ্গবন্ধুর নামই তো মুছে ফেলার চেষ্টা হয়েছিল।
তিনি বলেন, অনেক চড়াই উৎরাই পার হয়ে আমাদের আসতে হয়েছে, এখনকার প্রজন্ম যার অনেক কিছু জানেও না। উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রচেষ্টা, রোমান ও আরবি হরফে বাংলা লেখানোর প্রচেষ্টা, এমনকি রবীন্দ্র সংগীতও অন্যদের দিয়ে লেখানোর প্রচেষ্টা বাঙালি দেখেছে। আমরা তখন এসবের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-ছাত্রসহ সারা বাংলাদেশে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়েছে এবং এভাবেই আমাদের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম দানা বেঁধেছে। আর সেই সংগ্রামের মধ্য দিয়েই আমরা জাতির পিতার নেতৃত্বে আমাদের স্বাধীনতাও অর্জন করেছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভাষা ও সাহিত্যের ওপর এমন বারবার আঘাত আর কোনো দেশে আসেনি। অনেক দেশে যুদ্ধের মধ্যেও তাদের সাহিত্য সংস্কৃতি চলমান থাকে। ব্রিটিশ এবং ফ্রান্সের মধ্যে সারাজীবন শত্রæতা চললেও তাদের আর্ট, কালচার ও ভাষা-সাহিত্যচর্চা কোনোদিনই বন্ধ ছিল না। কিন্তু আমাদের পাকিস্তান নামের একই দেশে বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর বারবার আঘাত এসেছে। আওয়ামী লীগ সরকারে আসার পর থেকেই সব সময় আমাদের ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি সুন্দর ও সাবলীলভাবে বিকশিত করার উদ্যোগ নিয়েছে। আমরা বাঙালি এবং বাঙালি হিসেবেই বিশ্বদরবারে মাথা উঁচু করে চলব। আমরা বাংলাদেশকে আরো এগিয়ে নিয়ে যাব উন্নয়নের পথে।
তিনি বলেন, জাতির পিতা মাত্র ৩ বছর ৭ মাসে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ গড়ে তুলে তিনি জাতিসংঘের কাছ থেকে স্বল্পোন্নত দেশের স্বীকৃতি এনে দিয়েছিলেন। বিভিন্ন দেশের স্বীকৃতি ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্যপদ লাভ করে বাংলাদেশকে একটা উচ্চ মর্যাদায় নিয়ে গিয়েছিলেন। ’৭৫ এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার পর আমাদের সেই মর্যাদা ভূলুন্ঠিত হয়।
এরপর একুশ বছর পর ’৯৬ সালে আওয়ামী লীগ পুনরায় সরকার গঠন করলে দেশের স্তিমিত উন্নয়ন অগ্রযাত্রা গতি লাভ করে এবং বিগত ৩ মেয়াদে টানা সরকার পরিচালনার দায়িত্বে থাকায় বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা অর্জন করেছে। কাজেই এই দেশকে এখন আর কেউ পেছনে টানতে পারবে না।
একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি অর্জনে কানাডাপ্রবাসী বাংলাদেশি সালাম ও রফিক এবং ‘ভালবাসি মাতৃভাষা’ নামক সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাদের ও আওয়ামী লীগ সরকারের জোর প্রচেষ্টাতেই ইউনেস্কো অমর একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার স্বীকৃতি দিয়েছে।
একুশে পদকপ্রাপ্ত গুণীজনদের অভিনন্দন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এমন অনেক গুণীজন রয়েছেন যাদের অনেকে নামটি পর্যন্ত জানে না। এই পুরস্কারের মাধ্যমে তাদের অবদানকে সবার সামনে আনার চেষ্টা করেছি। আশা করি, আমাদের নতুন প্রজন্মও এভাবে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখবে। কারণ, গুণীজনদের পদাঙ্ক অনুসরণ করেই দেশকে ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা আমাদের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেব কিন্তু আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাব এবং আমাদের লক্ষ্য ২০৪১ সাল নাগাদ উন্নত সমৃদ্ধ ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ আমরা গড়ে তুলব।