মেয়েকে ধর্ষণ : ৯৯৯ এ ফোন করে বাবার আত্মসমর্পণ

আগের সংবাদ

শহীদ মিনারে লাখো মানুষের ঢল : একুশের প্রথম প্রহরে রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রীর শ্রদ্ধা নিবেদন

পরের সংবাদ

বিকৃতির ঝুঁকিতে বাংলা ভাষা

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২১, ২০২৩ , ১২:০৫ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ২১, ২০২৩ , ২:১৭ পূর্বাহ্ণ

তিনটি ক্ষেত্রে বিকৃত হচ্ছে বাংলা ভাষা : ইংরেজি বা আঞ্চলিক ঢঙে প্রমিত বাংলা উচ্চারণে, কথা বলার সময় বাংলা শব্দের পরিবর্তে ইংরেজি-হিন্দি-আঞ্চলিক শব্দ ব্যবহারে এবং বানান বিকৃতিতে
ঝর্ণা মনি : বায়ান্নর আগুনঝরা ফাগুনে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মাতৃভাষার স্বীকৃতি আদায়ের জন্য সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার জীবন দিয়েছিলেন- এর অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল বাঙালির জাতিরাষ্ট্রে বাংলা তার স্বমহিমা নিয়ে জাতির চেতনাকে ক্রমাগত সমৃদ্ধ করবে এবং বাংলা ভাষা হয়ে উঠবে পৃথিবীর অন্যতম প্রধান শ্রেষ্ঠ ভাষা। সুদীর্ঘ সাত দশকে বাংলাদেশ পৃথিবীর মানচিত্রে তার নিজস্ব জায়গা করে নিয়েছে। কিন্তু সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালুর যে স্বপ্ন, সেই স্বপ্ন এখনো অধরা। বরং সর্বত্র বিকৃতির ঝুঁকিতে পড়েছে বাংলা ভাষা। এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে, সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালুর ব্যাপারে নতুন করে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য কেন হাহাকার করতে হবে? কেন নতুন করে আদালতকে নির্দেশনা জারি করতে হবে? কেন ভাষানীতি এখনো কাগুজে স্বপ্ন?
বিশেজ্ঞদের মতে, ভাষার বিকৃতি ঠেকানো যাচ্ছে না। ইংরেজি ভাষার ধরনে বাংলা বলার প্রবণতা, বাংলা-ইংরেজি মিশিয়ে জগাখিচুড়ি ভাষায় কথা বলা ভাষাকে হেয় করছে। এই চর্চা উঠে এসেছে গণমাধ্যমেও। টিভি নাটকে ভাষার বিকৃতির অভিযোগ রয়েছে কয়েকজন নাট্যকার ও নির্মাতার বিরুদ্ধে। ফলে ভাষা আন্দোলনের ৭১ বছর পর প্রশ্ন উঠেছে, বাংলা ভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখার ক্ষেত্রে কতটা তৎপর আমরা?
এদিকে ১৯৯৯ সালের নভেম্বর মাসে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্বীকৃতি দেয় ইউনেস্কো। এরপর থেকে সারা বিশ্বে নিজ নিজ ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। গবেষকদের মতে, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেলেও নিজ দেশে এখন পর্যন্ত পরিপূর্ণ মর্যাদা পায়নি বাংলা ভাষা। আমাদের মোট জনসংখ্যার প্রায় পাঁচ কোটির কাছাকাছি মানুষ বাংলা লিখতে পড়তে পারে না। যেটুকু চর্চা চলছে সেখানেও উপেক্ষিত বানানরীতি। বিপণি বিতান থেকে সাইনবোর্ড সবকিছুতে ইংরেজির দাপট, শিক্ষাঙ্গনে অস্তিত্ব হুমকির মুখে বাংলা, অশুদ্ধ ভাষায় বের হচ্ছে গল্প, কবিতা, উপন্যাস ও শিশুতোষ বই।
বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রধানত তিনটি ক্ষেত্রে বিকৃতি হচ্ছে- ইংরেজি

বা আঞ্চলিক ঢঙে প্রমিত বাংলা উচ্চারণে, কথা বলার সময় বাংলা শব্দের পরিবর্তে ইংরেজি-হিন্দি-আঞ্চলিক শব্দ ব্যবহারে এবং বানান বিকৃতিতে। অভিযোগের আঙুল উঠেছে এফএম রেডিওসহ বিভিন্ন বেসরকারি গণমাধ্যমের দিকে। তাদের মতে, বাংলা ভাষার প্রকৃত সমস্যা, সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রয়োগ নেই এবং ভাষাটির অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠা নেই। এ দুই সমস্যা সমাধানে- যে কোনো পণ্য বা সেবার বাজারজাতকরণের ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করা, সরকারি বেসরকারি নির্বিশেষে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার মাধ্যম প্রমিত বাংলা, তবে প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকেই ইংরেজি (এবং সম্ভব হলে আরবি, চীনা, জার্মান, ফরাসি ইত্যাদি ভাষা) শেখানোর ব্যবস্থা থাকবে (এর ফলে বিদেশমুখী জনগণের ভাষা প্রশিক্ষণ ও ভাষাশিক্ষকদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে); ১৯৮৭ সালের বাংলা প্রচলন আইন কার্যকর করা, এবং সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনের দাবির সপক্ষে জনমত গঠন করা প্রয়োজন। এ ব্যাপারে ভাষাবিদ ও কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. সৌমিত্র শেখর ভোরের কাগজকে বলেন, বিশ্বায়নের যুগে ব্যাপক হুমকির মুখে বাংলা ভাষা। অথচ সংশ্লিষ্টরা শীতনিদ্রা যাপন করছেন। ভাষাকে অর্থনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে না পারলে ভাষা হুমকির মুখে পড়ে তার উদাহরণ বাংলা ভাষা।
জাতিসংঘে বাংলা ভাষা : জাতিসংঘের কার্যক্রমে অদাপ্তরিক হিসেবে যোগ হয়েছে বাংলা ভাষা। বার্তা আদানপ্রদান ও যোগাযোগসহ সব কার্যক্রমে অদাপ্তরিক ভাষা হিসেবে হিন্দি ও উর্দু ভাষার পাশাপাশি বাংলা ব্যবহার হচ্ছে সংস্থাটির বৈশ্বিক যোগাযোগবিষয়ক বিভাগে (ডিপার্টমেন্ট অব গেøাবাল কমিউনিকেশনস)। গত বছরের ১০ জুন জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৬তম অধিবেশনে বহুভাষাবিষয়ক এই প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। এদিন মোট ছয়টি ভাষা যুক্ত করে প্রস্তাবটি উত্থাপন করে সংস্থার তিন সদস্য ভারত, অ্যান্ডোরা ও কলম্বিয়া। প্রস্তাবে হিন্দি ও উর্দুর পাশাপাশি বাংলা ভাষা উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া পর্তুগিজ, কিসওয়াহিলি ও পার্সি ভাষাও প্রস্তাবে যুক্ত করা হয়েছে।
প্রযুক্তিতে বাংলা ভাষা : সরকার বলছে, প্রযুক্তিতে এগিয়ে গেছে বাংলা। কম্পিউটারে লেখালেখি, বইপুস্তক ও পত্রপত্রিকা প্রকাশ, গবেষণা, ওয়েবসাইট নির্মাণ, তথ্য ও ছবি অনুসন্ধান, ই-মেইল, গুগল, ফেসবুক, মোবাইলে এসএমএস বাংলাতেই করা যাচ্ছে। ভিজ্যুয়াল ক্যাপিটালিস্ট ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের বর্তমান ভাষাভাষীর মধ্যে সপ্তম বৃহৎ মাতৃভাষা বাংলায় কথা বলেন ২৬ কোটি ৫০ লাখ ৪২ হাজার ৪৮০ জন। এছাড়া নিজ ভাষাসহ বিশ্বের অন্যান্য মাতৃভাষা রক্ষা, লালন, বিকাশের অঙ্গীকার নিয়ে আশার আলো দেখাচ্ছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট। বাংলা ভাষার উৎকর্ষের জন্য রয়েছে বাংলা একাডেমি। ডিজিটাল প্রযুক্তি খাতে বাংলা ভাষার ব্যবহার আরো বাড়বে বলে জানিয়েছেন ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার। বাংলা ভাষার ব্যবহার প্রযুক্তিতে বাড়াতে ১৬৯ কোটি টাকায় একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
উপেক্ষিত আইন : ১৯৮৭ সালের মার্চে পাস হয় বাংলা ভাষা প্রচলন আইন। আইন অনুযায়ী, দেশের সরকারি অফিস, আদালত, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান বিদেশের সঙ্গে যোগাযোগের প্রয়োজন ছাড়া অন্য সব ক্ষেত্রে বাংলা ব্যবহার করবে। নথি ও চিঠিপত্র, আইন-আদালতের সওয়াল-জবাব এবং অন্যান্য আইনানুগ কার্যাবলি অবশ্যই বাংলায় লিখতে হবে। দীর্ঘদিন ধরে অকার্যকর আইনটি কার্যকরের জন্য ২০১৪ সালে হাইকোর্টে একটি রিট করেন আইনজীবী ইউনুস আলী আকন্দ। ওই রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ওই বছরের ১৭ ফেব্রুয়ারি সর্বত্র বাংলা ভাষা ব্যবহারের নির্দেশ কেন দেয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে একটি রুল জারি করেন বিচারপতি কাজী রেজা-উল হকের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ। পাশাপাশি মন্ত্রিপরিষদ সচিব, জনপ্রশাসন সচিব, স্বরাষ্ট্র সচিব, আইন সচিব ও সংস্কৃতি সচিবকে এ আদেশ বাস্তবায়নের অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিল করতে বলেন। এরপর বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে একাধিকবার প্রতিবেদন দাখিল করা হয় হাইকোর্টে। কিন্তু মাঠপর্যায়ে ওই আদেশ বাস্তবায়নের দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি হয়নি। জানতে চাইলে রিটকারী আইনজীবী ইউনুস আলী আকন্দ ভোরের কাগজকে বলেন, আদালতের রায়ের কোনো বাস্তবায়ন হয়নি। পরে আদেশ বাস্তবায়ন না হওয়ায় আদালত অবমাননার একটি মামলা করা হয়েছে। সেটির শুনানি হয়নি। আদেশ বাস্তবায়ন না হওয়ার পেছনে রাষ্ট্রের অসহযোগিতা, বিদ্যমান দ্বিদলীয় রাজনীতি ও বাংলা ভাষার প্রতি জনগণের অবহেলাকে দায়ী করেছেন তিনি।
প্রয়োজন ভাষানীতি : বিশ্বের প্রায় ৩০ কোটি মানুষের ভাষা বাংলা। এদিকে বিজয়ের অর্ধশতকেও ভাষানীতি না হওয়াকে দুঃখজনক বলছেন বিশেষজ্ঞরা। অধ্যাপক ড. সৌমিত্র শেখর বলেন, ভাষানীতি না হওয়া অত্যন্ত দুঃখজনক। শ্রীলঙ্কা, নেপাল, মিয়ানমারে ভাষা কমিশন রয়েছে। স্বাধীনতার ৫১ বছর এবং ভাষা আন্দোলনের ৭১ বছর পরও আমরা ভাষানীতি করতে পারিনি। এটি আমাদের ব্যর্থতা। তিনি বলেন, ভাষানীতি হলে ভাষার প্রতি সবাই যতœশীল হবে, ভাষা নিয়ে গবেষণা বাড়বে। পাশাপাশি ভাষার বিকৃতি রোধে সব মানুষকে সচেতন হতে হবে এখনই।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়