জি এম কাদের : ইভিএম ভোট চুরির আধুনিক মেশিন

আগের সংবাদ

বিকৃতির ঝুঁকিতে বাংলা ভাষা

পরের সংবাদ

একজন অবিন্তা কবিরের মা যখন সচেতন নাগরিক

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২১, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ২১, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে সংঘটিত জঙ্গি হামলার ঘটনাটি বাংলাদেশে সংঘটিত রীতিমতো নৃশংস ও বর্বরোচিত একটি ঘটনা। নিঃসন্দেহে মর্মান্তিক ও লোমহর্ষক ঘটনা। কল্পনাতীত তো বটেই। যদিও তার পূর্বে জঙ্গিদের দ্বারা বেশ কিছু হত্যাকাণ্ডের ঘটনা দেশে বিভিন্ন সময়ে ঘটেছে। এ কথা বললে কতটা অযৌক্তিক হবে যে, এমন বর্বরোচিত জঙ্গি হামলার ঘটনার আগাম খবর না পাওয়াটা রীতিমতো বিস্ময়কর। কেননা ইতোপূর্বে বইমেলা, পহেলা বৈশাখ উদযাপন ইত্যাদিতে জঙ্গিদের অপতৎপরতা ছিল এবং এসব ঘটনার পরবর্তী অবস্থায় গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জঙ্গিবিরোধী তৎপরতাও বেড়ে যায়। এমন একটি অবস্থার মাঝে হলি আর্টিজানের নৃশংস ঘটনাটি থমকে দিয়েছিল বৈকি। বাংলাদেশে এমন বর্বরোচিত ঘটনা সেটাই প্রথম। বাংলাদেশি ও বিদেশি নাগরিকসহ মোট ২২ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। বাংলাদেশের ক’জন তরুণের মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটে। আচমকা এমন একটি নৃশংস ঘটনা জাতির বিবেককে প্রচণ্ড নাড়া দিলেও যারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে তারা কিন্তু আচমকা এমন ঘটনা ঘটায়নি। বরং দীর্ঘদিনের প্রস্তুতি ছিল, ছিল পরিকল্পনা, যা কাউকেই টের পেতে দেয়নি, বুঝতে দেয়নি। সবার অন্তরালে কতকিছু হয়, সেটাই বুঝিয়ে ছিল। যাই হোক, এমন মর্মান্তিক ও বর্বরোচিত ঘটনা কারোরই কাক্সিক্ষত ছিল না, এখনো কাক্সিক্ষত নয়। এ ঘটনা নিয়ে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়েছে এবং নির্মাতা পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের। সম্প্রতি চলচ্চিত্রের মুক্তির বিরোধিতা করেছে ঘটনায় নিহত অবিন্তা কবিরের মা রুবা আহমেদ। কন্যার মৃত্যুর পর এই প্রথম তিনি জনসমক্ষে আসেন সম্ভবত এবং মিডিয়ার সামনে কথা বলেন। তার কথাগুলো আবেগময় এবং একজন সন্তানহারা মায়ের। মা সন্তানহারা হলে যেভাবে কথা বলেন রুবা আহমেদ সেইভাবে তার কথা বলেছেন। অশ্রæসিক্ত হয়েছেন। রুবা আহমেদ ইতোপূর্বে ভারত আদালতে আইনের আশ্রয় নিয়েছেন, চলচ্চিত্রটি যেন মুক্তি না পায়। যতদূর জানা গেছে ভারতে মুক্তি পেয়েছে। বাংলাদেশে মুক্তির অপেক্ষায় আছে। রুবা আহমেদ ছবিটি বাংলাদেশে মুক্তি না দেবার জন্য আদালতে রিট করেছেন।
হলি আর্টিজানের ঘটনা নিয়ে নির্মিত ছবিটি বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করবে বলে রুবা আহমেদ মনে করছেন। বিষয়টি এমন হতে পারে যে, এই ছবিটি বাংলাদেশকে জঙ্গিবাদের আস্তানা কিংবা অবাধ বিচরণস্থল হিসেবে বিবেচনায় আনতে পারে, ভাবাতে পারে। বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশকে জঙ্গিমুক্ত রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত করবার ক্ষেত্রে বাধা হতে পারে। অথবা ধর্মীয় নিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে ভিনদেশীদের চিন্তার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে পারে। আফগানিস্তান, পাকিস্তানের মতোই অনেকে বাংলাদেশকে ভাবতে পারে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কাঠামোয় প্রভাব ফেলতে পারে। এই ভাবনাটার পেছনে বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিভাজন প্রভাবক হিসেবে কাজ করতে পারে। কারণ বাংলাদেশের রাজনীতি যতটা না দেশের স্বার্থে তার অধিক দলীয় স্বার্থে। বিশেষত রাজনীতির বিরোধিতার ধরনটা সার্বভৌমত্ব এর পক্ষে যেতে দেখা যায় না, যায়নি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকেও কাঠগড়ায় দাঁড় করাতেও এরা দ্বিধাবোধ করে না। এমনকি সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। রুবা আহমেদ বলেছেন, ছবির নির্মাতা তাদের সঙ্গে কোনোরকম যোগাযোগ করেনি। তাছাড়া এমন একটি সংবেদনশীল ঘটনাকে উপজীব্য করে ছবি নির্মাণের বিষয়টিকে তিনি ভালো চোখে দেখেননি। তার মতে, ছবির নামকরণ করা হয়েছে ফারাজ। ফারাজকে হিরো বানানো হয়েছে। যে তার বান্ধবী অবিন্তাকে বাঁচানোর জন্য মৃত্যুবরণ করেছে। তাকে হত্যা করা হয়েছে। ছবির গল্পে অবিন্তার পরিবারও এসেছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কে জেনেছে, দেখেছে অবিন্তাকে বাঁচানোর জন্যই ফারাজকে হত্যা করা হয়েছে। ফারাজ, অবিন্তাকে চরিত্র বানিয়ে যে ছবির গল্প সাজানো হয়েছে, তা দর্শকদের উপভোগ করার জন্য, ছবির ব্যবসার জন্য। অবিন্তার মা রুবা আহমেদ চান না, সন্তান হারানোর ঘটনাটি কেউ উপভোগ করুক, কেউ ব্যবসা করুক। হলি আর্টিজানে যে ২২ জন হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন, রুবা আহমেদের মতে তারা প্রত্যেকেই হিরো। নিশ্চয়ই তারা প্রত্যেকেই জীবন রক্ষার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন, বাঁচতে চেয়েছেন। সেখানে কী করে একজন হিরো হয় ঘটনার একটা চরিত্রকে কেন্দ্র করে যে গল্প তৈরি করা হয়েছে, সেখানে কল্পনার আশ্রয়টাই বড়। নির্মাতা, চিত্রনাট্যকার তাদের মতো করে গল্প বানিয়েছে। এতে একটা সত্য ঘটনার সঙ্গে অনেক কাল্পনিক বিষয়াদি যুক্ত হতে পারে যা মৃত ব্যক্তি ও তাদের পরিবারের প্রাইভেসি, সম্মান ক্ষুণ্ন হবার সম্ভাবনা রয়ে যায়। যেহেতু হলি আর্টিজানে সংঘটিত ঘটনাকে কেন্দ্র করে ছবিটি নির্মাণ করা হয়েছে সেহেতু পূর্ণাঙ্গ ছবির গল্প তৈরিতে নিহতদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে চরিত্র চিত্রায়নের পথটা অনুসরণ করার দরকার ছিল বলে রুবা আহমেদের মতো অনেকেই মনে করেন। এমন একটি সংবেদনশীল ঘটনায় চরিত্র বানোয়াট কতটা যুক্তিযুক্ত ও সেইসঙ্গে নিহতদের পরিবারের অনুমতি না নেয়াটা নিহতের ও তাদের পরিবারের কতটা মানবাধিকার সংরক্ষণ করে, তা খতিয়ে দেখার দরকার ছিল ভারতস্থ বাংলাদেশ হাই কমিশনের। বিশেষ করে ভারত আদালতে ফারাজ ছবি নির্মাণের বিরোধিতা করে রুবা আহমেদ যে আপিল করেছিলেন, সেটা নিয়ে বাংলাদেশ হাই কমিশন বিষয়টি দেখতে পারত। যদিও আমরা তেমন কিছু জানি না যে, আদৌ বাংলাদেশ হাই কমিশন বিষয়টি দেখেছে কিনা। মায়ের মন অনেক কিছুই চাইবে না, যা সন্তান হারানোর কষ্টকে আরো তীব্র করে। নিশ্চয়ই আইনে সেই পথ আছে যেখানে এমন মায়ের কষ্ট লাঘবের সুযোগ আছে।
হলি আর্টিজানের অংশটুকুর সঙ্গে যা যুক্ত করা হয়েছে, তা কতটুকু সত্য বা কাল্পনিক সেই বিষয়ে প্রশ্ন বা সংশয় থাকতেই পারে। হলি আর্টিজানের ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে জায়গা পেয়েছে। কাজেই তাকে নিয়ে বানোয়াট কোন কিছু যেমন কাম্য নয়, ঠিক তেমনই এ ঘটনার উপস্থাপন কতটা সতর্কতার সঙ্গে করা হয়েছে যেখানে কিনা বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হবার সম্ভাবনা নেই, সেটাওতো দেখা দরকার, অনুমতির দরকার। আর এমন একটি ঘটনাকে পুঁজি করে ব্যবসা সফল হবার পাঁয়তারাও আমাদের কাম্য হতে পারে না। একজন প্রশ্ন করছিলেন, ভারতে দাঙ্গা, ধর্মীয় উগ্রবাদ, চরম মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা আছে। এত কিছু থাকতে হলি আর্টিজানের ঘটনাকে চলচ্চিত্রের জন্য বেছে নেয়ার কারণ কী হতে পারে এটা কী বাংলাদেশকে জঙ্গিবাদের আস্তানা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবার এক ধরনের অপচেষ্টা এমনিতেই রাজনৈতিক ইস্যুতে সংখ্যালঘুদের ওপর আঘাতের ঘটনা ঘটছে। দুর্গাপূজার সময়ে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটছে। মন্দিরে গিয়ে দেবী মূর্তির পাদদেশে পবিত্র কোরান শরিফ রেখে আসার উদ্দেশ্য-প্রণোদিত ঘটনাও আছে। এমন এক অবস্থায় এ ধরনের ছবি নির্মাণ বাংলাদেশকে নতুন কোনো প্রশ্নের সম্মুখীন করে কিনা, করবে কিনা, কেউ কী তা ভেবেছে।
প্রতিটি রাষ্ট্রের প্রাইভেসি থাকে, থাকতে হয়। এই প্রাইভেসি কেবল সীমান্তের প্রাচীর নয়। এই প্রাইভেসি কূটনৈতিক পর্যবেক্ষণ, সিদ্ধান্ত ও হস্তক্ষেপ, যা রাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষা করে। বাংলাদেশের সংবেদনশীল একটি ঘটনা নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণের পূর্বে নির্মাতা বাংলাদেশ হাই কমিশনের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ ও আলাপ করেছিল কিনা, জানা নেই। আবার ভারতের বাংলাদেশ হাইকমিশনও নজরদারি করেছে কিনা, সেটাও জানা নেই। নিসংকোচে বলতে পারি, জানা দরকার। বাংলাদেশের ভাবমূর্তি, স্বার্থ ক্ষুণ্ন হয় এমন কোনো প্রচেষ্টা, উদ্যোগ যেমন কাম্য নয়, তেমন কাম্য নয় কারোর উদাসীনতা, অমনোযোগিতা কিংবা দায়িত্বহীনতা। পরিশেষে বলব, ফারাজ ছবির বিরোধিতা করে একজন রুবা আহমেদ আজ কেবল অবিন্তা কবিরের মা-ই নন, তিনি বাংলাদেশের একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছেন। প্রতিটি নাগরিকের উচিত, রাষ্ট্রের স্বার্থে এভাবেই দাঁড়িয়ে যাওয়া।

স্বপ্না রেজা : কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়