২৫ ফেব্রুয়ারি সব জেলায় পদযাত্রা করবে বিএনপি

আগের সংবাদ

একুশে পদক বিতরণ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী : ভাষার জন্য কারাবরণ করতে হয় বঙ্গবন্ধুকে

পরের সংবাদ

সারাহ ইসলামকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মান জানানো হোক

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২০, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ২০, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

২০ বছর বয়সি সারাহ ইসলাম দুরারোগ্য টিউবেরাস স্কে¬রোসিস রোগে ভুগছিলেন। মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া এ রোগের আর কোনো চিকিৎসা নেই। ২০ বছরের ছোট্ট জীবনের প্রায় ১৯ বছর তাকে রোগ যন্ত্রণায় কাতর থাকতে হয়েছে। এমন অসহায় অবস্থার ভেতরই মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার গণ্ডি পার হন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করতে না করতেই এসে যায় অন্তিম সময়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে তার ব্রেন ডেথ বা মস্তিষ্ক মারা যায়। ব্রেন ডেথের রোগীর হৃৎপিণ্ড ও ফুসফুস হাসপাতালের আইসিইউতে কৃত্রিম উপায়ে সচল রাখার ব্যবস্থা থাকে। যন্ত্রপাতি সরিয়ে নিলে কৃত্রিম সেই সচলতার অবসান ঘটে, শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ তখন আর কোনো কাজে লাগে না। কাজে লাগে ব্রেন ডেথে থাকা অবস্থায় অঙ্গ খুলে নিতে পারলে। চিকিৎসকরা চাইলেই ব্রেন ডেথে পতিত কারো অঙ্গ সরিয়ে নিয়ে অন্যের শরীরে প্রতিস্থাপন করতে পারেন না, আইন অনুযায়ী সম্মতি লাগে। সম্মতি দিতে হয় নিজের অথবা আইনস্বীকৃত আত্মীয়র। সারাহর মা শবনম সুলতানা বিএসএমএমইউর চিকিৎসকদের সেই সম্মতি দেন। অতঃপর গত ১৮ জানুয়ারি সারাহ ইসলামের দুই কিডনি ও দুই কর্নিয়া প্রতিস্থাপন করা হয় অপর চার জনের দেহে।
সারাহর মা তার ইচ্ছাকেই মূল্যায়িত করেছেন। যন্ত্রণাক্লিষ্ট কন্যা তার মাকে বলে গিয়েছিলেন, মৃত্যু হলে তার সবকিছু দান করে দিতে। তার ব্রেন নিয়ে অ্যানালাইসিসের কথাও বলেছিলেন। মেয়ের কথামতো কাজ করেছেন মা, কিডনি ও কর্নিয়া দান করেছেন। সারাহ ইসলাম এভাবে ইতিহাস গড়লেন। এমন নজির দেশে এই প্রথম। এর আগে কেউ এমন মহৎকর্মে এগিয়ে আসেননি। শবনম সুলতানা তার কন্যা সম্পর্কে পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলেন, ‘ও ছিল মানবপ্রেমী, পশুপ্রেমী। জীবনমুখী চেতনা ওকে অসহায় মানুষদের প্রতি মমতাময়ী করে তুলেছিল। ওদের কিছু দিতে পারা, সেবাশুশ্রƒষা দিয়ে ওদের কাছে টানা, ভালোবাসায় সিক্ত করা- এগুলো ছিল ওর নিত্যদিনের কাজের অংশ। কে কোন বিপদের মধ্যে আছে, কাদের পাশে দাঁড়াতে হবে, কাদের জন্য প্রয়োজনে রাস্তায় আন্দোলনে নামতে হবে সেটি তার জানা, তার প্রতি মুহূর্তের চেতনা।’ হয়তো জীবনের এই শিক্ষাই তাকে অপরের জীবন বাঁচাতে উদ্বুদ্ধ করেছে।
সারাহ ইসলাম কতটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করলেন বোঝা যায় সারাহর দান করা কিডনি প্রতিস্থাপন দলের প্রধান অধ্যাপক ডা. হাবিবুর রহমানের ‘ছোট্ট মেয়েটাই পথ দেখাল’ শিরোনামের নিবন্ধ থেকে। তার ভাষায়, ‘অঙ্গের অভাবে বাংলাদেশে প্রতি বছর হাজার হাজার রোগী মারা যায়। ৩০ বছর ধরে আমরা ব্রেন ডেথ রোগীর কাছ থেকে অঙ্গ নেয়ার চেষ্টা করছি, কিন্তু কোনোভাবেই সফল হতে পারছিলাম না। অনেক সময় রোগীর আত্মীয় রাজি হয়েও শেষ মুহূর্তে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছেন। ফলে উদ্যোগ আর সফলতার মুখ দেখেনি। সারাহর মাধ্যমে একটি নবদিগন্তের সূচনা হলো’। [প্রথম আলো, ২৮ জানুয়ারি ২০২৩] তিনি তার নিবন্ধে আরো জানাচ্ছেন, ‘শুধু সারাহর ঘটনার কারণে আরো দুজন ব্রেন ডেথ রোগী এখন তৈরি হয়ে গেছেন, যে কোনো মুহূর্তে আমরা সম্মতি পেতে পারি। সামনের দিনগুলোতে বিষয়টি নিয়ে আমরা প্রচারে নামব। সামাজিক ও ধর্মীয় নেতা, সমাজকর্মী, বিভিন্ন গণমাধ্যম এবং তারকাদের নিয়ে আমরা ওয়ার্কশপ করব। একটা গণকর্মসূচিতে যাব আমরা। অঙ্গ দান নিয়ে মানুষের মধ্যে যে কুসংস্কার, এভাবে সেটা দূর হয়ে যাবে। বলা যায়, সারাহ আমাদের এমন পথ দেখিয়ে গেছে, যেখান থেকে পিছিয়ে আসার কোনো সুযোগ আর নেই।’
চিকিৎসকরা মনে করেন, দেশে অঙ্গ প্রতিস্থাপন নিয়ে যে জট লেগে ছিল তা খুলে দিলেন সারাহ ইসলাম ও তার মা শবনম সুলতানা। বিএসএমএমইউ সংবাদ সম্মেলন করে ঘোষণা দিয়েছে, কৃতজ্ঞতার নিদর্শনস্বরূপ বিশ্ববিদ্যালয়ে সারাহ ইসলামের নামে একটি কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হবে। সারাহর পরিবারের সদস্যরা এই প্রতিষ্ঠানে বিনামূল্যে চিকিৎসা পাবেন। সারাহকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মান ও কৃতজ্ঞতা জানানোর দাবি জানিয়েছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ও দলের কেন্দ্রীয় নেতা মাহবুব-উল আলম হানিফ। ২ ফেব্রুয়ারির সংসদ অধিবেশনে তিনি বলেন, তাকে সম্মান ও কৃতজ্ঞতা জানালে অনেকে মরদেহ দিতে এগিয়ে আসবেন। মানব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আইন সংশোধন করে কঠোর নজরদারির মাধ্যমে স্বেচ্ছায় অঙ্গদানের সুযোগ তৈরি করার পরামর্শ দেন এই সংসদ সদস্য।
জানা যায়, দেশে দুই কোটির বেশি মানুষ কিডনি জটিলতায় ভুগছেন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে সব ধরনের মৃত্যুর মধ্যে কিডনি জটিলতায় মৃত্যুর স্থান ৮ নম্বরে। কিডনির অকার্যকারিতা এক ভয়াবহ রোগ। প্রতিস্থাপনই [কিডনি] বলতে গেলে এর একমাত্র চিকিৎসা। সাময়িক যে চিকিৎসা তা হলো ডায়ালাইসিস। সপ্তাহে ২-৩ বার হাসপাতালে গিয়ে করাতে হয়। ডায়ালাইসিসের খরচ এত বিপুল যে জোগান দিতে গিয়ে রোগী কিংবা তার আত্মীয়স্বজনকে নিঃস্ব হয়ে যেতে হয়। সরকারি ভর্তুকিতে ডায়ালাইসিস-ব্যবস্থা খুবই অপ্রতুল। বেসরকারি হাসপাতালে গিয়ে প্রতি সপ্তাহে এ বাবদ হাজার হাজার টাকা ব্যয় করা ছাড়া উপায় থাকে না। অধিকাংশের পক্ষে তা সম্ভবও হয় না, মৃত্যুকেই নিয়তি মানতে হয়। সরকারি সুবিধার সম্প্রসারণ হলো কিডনি রোগে আক্রান্ত রোগীর পাশে দাঁড়ানোর একমাত্র উপায়। আসল চিকিৎসা কিডনির প্রতিস্থাপন। এর বেচাকেনা আইন দ্বারা নিষিদ্ধ। যে কেউ কিডনি দান করতে পারেন না। নির্দিষ্ট কিছু নিকটাত্মীয় টিস্যুর ম্যাচিং হলে রোগীকে তার কিডনি দান করতে পারেন। বিশ্বের অনেক দেশেই কিডনি কেনাবেচা হয়। অবৈধ হলেও বাংলাদেশে এই ব্যবসা প্রচলিত। কোনো কোনো জায়গায় দরিদ্র মানুষ তাদের একটি করে কিডনি বিক্রি করেন অর্থের বিনিময়ে। দালালের মাধ্যমে এ বেচাকেনার কাজ সম্পন্ন হয়, ফলে বিক্রেতা তার অঙ্গ বিক্রির পুরো অর্থও পান না। অভিযোগ আছে, বিদেশে গিয়ে এই প্রতিস্থাপনের কাজটি করা হয়। গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী জয়পুরহাটের কালাইয়ে দরিদ্র অনেক মানুষ এই অবৈধ কিডনি ব্যবসার শিকার। বিক্রেতার জীবনটাও আর স্বাভাবিক থাকে না, বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় ভোগেন অনেকেই।
সমস্যা সমাধানের একটি উপায় ‘ক্যাডাভেরিক ট্রান্সপ্লান্ট’ বা মৃত ঘোষিত মানুষের অঙ্গ অন্যের দেহে প্রতিস্থাপন। সম্মতি দিয়ে সারাহ ইসলাম ও তার মা শবনম সুলতানা পথ দেখিয়ে গেছেন। এ পথ প্রশস্ত হলে অনেক মানুষের জীবন বাঁচবে। ঘটনাটি ব্যাপক প্রচার পেলে অনেকেই উদ্বুদ্ধ হবেন। সেই প্রচারের কাজটি সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে করা একান্ত কর্তব্য। মাহবুব-উল আলম হানিফ জাতীয় সংসদে যে দাবি উত্থাপন করেছেন তার সঙ্গে সহমত পোষণ করে সরকারের প্রতি আহ্বান জানাই- সারাহ ইসলামকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মানিত করা হোক, সেই সঙ্গে তার মা শবনম সুলতানাকেও। তাতে অনেক মানুষ অনুপ্রাণিত হবেন, দেশের চিকিৎসা জগতে পরিবর্তন আসবে। ইতোমধ্যে [১৩.০২.২০২৩] বিএসএমএমইউর উপাচার্যসহ ৭ জন তাদের অঙ্গদানের প্রতিশ্রæতি দিয়েছেন, তাদের প্রতি রইল শ্রদ্ধা।

মজিবর রহমান : কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়