যৌতুকের জন্য স্ত্রী হত্যার মামলায় স্বামীর মৃত্যুদণ্ড

আগের সংবাদ

বিদেশিদের নজর ঢাকার দিকে : ব্যস্ত সময় পার করলেন ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কোরিয়ার শীর্ষ কূটনীতিকরা

পরের সংবাদ

বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

দৈনিক ভোরের কাগজ এই মুহূর্তে বাংলাদেশের অন্যতম সংবাদপত্র যারা একাত্তরের চেতনা ও ধর্মনিরপেক্ষতা বুকে নিয়ে প্রকাশিত হয়। আমি যে কয়েকটি বিষয়ে শ্লাঘা অনুভব করি তার অন্যতম হলো আমি এই পত্রিকায় নিয়মিত লিখি এবং আজ ৩১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে এই পত্রিকার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা জানিয়ে একটু অন্যভাবে শুরু করি আজকের কথকতা।
প্রথমেই বলি যে আমার মধ্যে একটি গর্ব সবসময় বিদ্যমান তা হলো আমি একাত্তর দেখেছি। আমি মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি। আমি শেখ মুজিবকে দেখেছি। আমার বয়স তখন ৯ বছর মাত্র। কিন্তু পারিবারিক অনুশাসনের কারণে সংবাদপত্র নিয়মিত পড়ার অভ্যাস তৈরি হয়ে গেছে। একাত্তরের পূর্ববর্তী সময়ে পূর্ব পাকিস্তান ছিল আমাদের কাছে নিষিদ্ধ শত্রæদের দেশ। বাস্তুচ্যুত হিন্দু পরিবাররা তখনো ছিটকে আসছে এপারে। তাদের বর্ণনায় তীব্র ধর্মীয় নিষ্পেষণের কাহিনী আমার শিশুমনকে ভীষণভাবে আহত করত। সত্যতা যাচাইয়ের সুযোগ না থাকলেও সরল মনে বিশ্বাস করতাম সেসব কাহিনী। কিন্তু খবরের কাগজ অন্যকথা বলত। ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭০-এর নির্বাচন নিয়ে কলকাতার ৫টি সংবাদপত্র বঙ্গবন্ধুর পক্ষাবলম্বন করেছিল। এই ৫টি সংবাদপত্র হলো আনন্দবাজার, যুগান্তর, বসুমতী, দ্য স্টেটসম্যান ও অমৃতবাজার পত্রিকা। তখন অন্য কোণ গণমাধ্যম না থাকায় মুদ্রিত পত্রিকার গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে তদানিন্তন পাকিস্তান প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর বৈঠক চলাকালীন সম্ভবত ২১ বা ২২ মার্চ আনন্দবাজার একটি ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে ‘বাংলার স্বাধিকার’ শিরোনামে। এতে বঙ্গবন্ধুর বাণী প্রকাশিত হয় যেখানে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের ৭ কোটি মানুষের সার্বিক মুক্তির জন্য আমাদের এ সংগ্রাম। অধিকার আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমাদের সংগ্রাম চলবে। বুলেট-বেয়নেট দিয়ে বাংলাদেশের মানুষকে আর স্তব্ধ করা যাবে না। কেননা জনতা আজ ঐক্যবদ্ধ।’ সম্ভবত এটা তার ৭ মার্চ ভাষণের সংক্ষিপ্ত রূপ। তখন ওপারের সংবাদ এপারের মানুষ খুব একটা জানতে পারতেন না। তাই ৭ মার্চের ভাষণের কথা এপারে এসেছে ২৫ মার্চের পরে। ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি বাহিনী অপারেশন সার্চলাইট নামে যে পৈশাচিক নিধনযজ্ঞ চালায় তাতে আক্রান্ত হয় ‘দ্য পিপল’ সংবাদপত্রের অফিস এবং নিহত হন ৬ জন সাংবাদিক। পত্রিকাটির অপরাধ ছিল তার দিন দুয়েক আগে ‘অবরুদ্ধ বাংলাদেশ : কণ্ঠরুদ্ধ সংবাদপত্র’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
পরে যখন একাত্তরে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ও পরবর্তী সময়ের বাংলাদেশের সংবাদপত্রের ভূমিকা নিয়ে জ্ঞানলাভের চেষ্টা করি তখন কয়েকটি বিষয় চোখে পড়ে। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ থেকে শুরু করে ২৫ মার্চ পর্যন্ত প্রকাশিত সংবাদপত্রগুলোতে শেখ মুজিবুর রহমানের বক্তব্য প্রাধান্য পেয়েছে। সেই সময় পাকিস্তান সরকারের প্রতি শেখ মুজিবের আল্টিমেটাম, ৭ মার্চের জনসভা এবং মুজিব-ইয়াহিয়া আলোচনার নানা খুঁটিনাটি প্রকাশিত হতো সংবাদপত্রে। এক অর্থে বলা যায়, সংবাদপত্রগুলো ছিল বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের পক্ষে বেশ উচ্চকণ্ঠ। দৈনিক আজাদ পত্রিকায় ৮ মার্চ শিরোনাম ছিল ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম।’ সে সমাবেশের নানা খবরাখবর এবং ছবি ছাপা হয় বিভিন্ন সংবাদপত্রে। সেখানেও শেখ মুজিব এবং আওয়ামী লীগের বক্তব্য ফলাও করে প্রকাশ করেছে সংবাদপত্রগুলো। ২২ মার্চ দৈনিক আজাদ পত্রিকায় শেখ মুজিবুর রহমানকে উদ্ধৃত করে শিরোনাম করা হয়- আন্দোলন শিথিল হইবে না : মুজিব। আওয়ামী লীগ নেতা তাজউদ্দীনের বক্তব্যকে উদ্ধৃত করে ২৫ মার্চ প্রকাশিত দৈনিক আজাদ পত্রিকায় শিরোনাম করা হয়- আলোচনা দীর্ঘ করিতে প্রস্তুত নহি। কিন্তু এই পর্বে কোন সংবাদপত্র কল্পনাও করতে পারেনি যে এমন নারকীয় হত্যাকাণ্ড কোনো প্রশাসন ঘটাতে পারে, তাও নিজ দেশের নিরস্ত্র নাগরিকদের ওপরে। ২৫ মার্চ রাতের হত্যাযজ্ঞ এবং এরপরই শেখ মুজিবুর রহমানকে আটকের বিষয়টি পূর্ব পাকিস্তান থেকে প্রকাশিত সংবাদপত্রে দেখা যায়নি। ২৫ এবং ২৬ মার্চে ঢাকায় কয়েকটি পত্রিকা অফিস আক্রান্ত হওয়ার পর অনেক সাংবাদিক আত্মগোপনে ছিলেন। ঢাকা থেকে প্রকাশিত কয়েকটি বড় পত্রিকা বন্ধ হয়ে যায় এবং বাকিরা চলে যায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। ২৬-৩০ মার্চ পর্যন্ত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে (সদ্য স্বাধীন ঘোষণা করা বাংলাদেশ) কোন সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়নি। এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে কিছু সংবাদপত্র সীমিত আকারে বের হয়। তবে সেসব সংবাদপত্রের খবর দেখলে মনে হয়, সংবাদপত্রগুলো ছিল পাকিস্তান সরকারের মুখপাত্র। এপ্রিল মাসের শুরুতে প্রথম যেদিন পত্রিকা প্রকাশিত হয় তখন এমনভাবে খবর তুলে ধরা হয় যে পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি খুব স্বাভাবিক রয়েছে। ২ এপ্রিল, ৭১ দৈনিক পাকিস্তানের প্রধান শিরোনাম ছিল- আজ ব্যাংকে লেনদেন শুরু। সরকারি প্রেসনোটের বরাত দিয়ে সে খবরে বলা হয়, ‘পূর্ব পাকিস্তানের সব প্রধান প্রধান শহর ও সমগ্র পল্লী অঞ্চল গতকাল শান্ত ছিল এবং কোন জায়গা থেকে কোন ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি।’ ৩ এপ্রিল, ৭১ দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকার প্রধান শিরোনাম ছিল- ভারত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অস্ত্র জোগাচ্ছে। ৫ এপ্রিল, ৭১ দৈনিক আজাদ পত্রিকায় প্রকাশিত অন্যতম প্রধান শিরোনাম ছিল- ভারতের রণ পাঁয়তারা। সে খবরে বলা হয়, ‘ভারতীয় সৈন্যগণ বেসামরিক পোশাক পরিধানপূর্বক সীমান্ত অতিক্রম করিয়া পূর্ব পাকিস্তানে প্রবেশ করিয়াছে।’ এদিকে ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল বৈদ্যনাথতলায় (বর্তমান মুজিবনগর) বাংলাদেশ অস্থায়ী সরকার বা প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার শপথ গ্রহণ করেন। কিন্তু সে খবর তখন বাংলাদেশের কোনো পত্রিকায় প্রকাশিত হয়নি। কিন্তু প্রথম ২৩ এপ্রিল দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকা শিরোনাম করল তথাকথিত বাংলাদেশ সরকারকে ভারত স্বীকার করে না। সে খবরে উল্লেখ করা হয়, ‘ভারত পাকিস্তানকে আশ্বাস দিয়েছে যে তারা তথাকথিত বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকার করে না এবং কলকাতায় পাকিস্তানের সাবেক ডেপুটি হাই কমিশনার হোসেন আলীকে কোনো কূটনৈতিক সুবিধা দেয়া হবে না।’
এদিকে ২৫ মার্চ ঢাকাবাসীর ওপর আক্রমণের খবর যাতে দেশের বাইরে প্রচারিত না হয় সেজন্য বন্দুকের মুখে সব বিদেশি সাংবাদিককে ঢাকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল আটকে রাখা হয় এবং ধরে করাচি পাঠিয়ে দেয়া হয়। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতের ঢাকার পরিস্থিতি ও শেখ মুজিবকে আটকের ঘটনা ২৭ মার্চেই বিশ্বের অন্তত ২৫টি দেশের পত্রিকা বা সংবাদ সংস্থার খবরে প্রকাশিত হয়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর চোখ এড়িয়ে ব্রিটেনের ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকার ২৬ বছর বয়সি সাইমন ড্রিং পূর্ব পাকিস্তান থেকে ব্যাংককে গিয়ে যে প্রতিবেদন পাঠান সেটি ১৯৭১ সালের ৩০ মার্চ ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় ছাপা হয়। তিনি লেখেন ‘ঢাকা এখন ধ্বংস এবং ভীতির নগরী। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঠাণ্ডা মাথায় ২৪ ঘণ্টাব্যাপী অবিরাম শেল বর্ষণে সেখানে ৭ হাজারেরও বেশি লোক নিহত হয়েছে। ছাত্রাবাসে নিজেদের বিছানাতেই ছাত্রদের হত্যা করা হয়েছে। বাজারগুলোতে কসাইদের নিজেদের দোকানের পিছনে হত্যা করা হয়েছে’। কিন্তু একই সংবাদপত্রে ২৭ মার্চ ‘সিভিল ওয়ার ফ্লেয়ারস ইন ইস্ট পাকিস্তান : শেখ এ ট্রেইটর, সেইস প্রেসিডেন্ট শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদে শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীন ঘোষণা ও ইয়াহিয়া খান তার বেতার ভাষণে শেখ মুজিবকে বিশ্বাসঘাতক বলার কথা উল্লেখ করা হয়। এটা ছিল এজেন্সি নিউজ। কিন্তু তারাও সাইমন ড্রিংয়ের রিপোর্টের আগে বিশ্বাস করতে পারেনি যে এমনটাও হতে পারে। দিল্লির দি স্টেটসম্যানের খবর ছিল : ‘বাংলাদেশ স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে, সামরিক অভিযানের প্রতিবাদে শেখ মুজিবুর রহমানের পদক্ষেপ। একটি গোপন বেতার থেকে প্রচারিত ভাষণে শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের পূর্বাংশকে স্বাধীন বাংলাদেশ হিসেবে নতুন নামকরণ করেছেন।’
মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ ছিল বিদেশি সাংবাদিকদের জন্য নিষিদ্ধ অঞ্চল। আর কলকাতা মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী দপ্তর ও লাখ লাখ বাংলাদেশের শরণার্থীর আশ্রয়স্থল। এসব কারণেই ১৯৭১ সালের মার্চ থেকেই কলকাতা আন্তর্জাতিক সংবাদ সংগ্রহের কেন্দ্রে পরিণত হয়। বিশ্বের প্রথম শ্রেণির নিউজ এজেন্সি থেকে শুরু করে ইউরোপ, আমেরিকা ও জাপানের সংবাদ মাধ্যমের প্রতিনিধিরা প্রায়ই কলকাতায় যেতেন বাংলাদেশের খবর সংগ্রহের জন্য। ব্রিটেনের টেলিগ্রাফ, টাইমস, গার্ডিয়ানও বাদ যায়নি। সংবাদমাধ্যম, শরণার্থী, ত্রাণপ্রতিষ্ঠান, কূটনীতিক, রাজনীতিবিদ, আমলা-মন্ত্রী গোয়েন্দাসহ সবাই কলকাতায়। সোভিয়েত ইউনিয়নের ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী, আমেরিকান সিনেটর, জাতিসংঘের মহাসচিব থেকে আগা খান পর্যন্ত যুদ্ধের অবস্থা জানতে কলকাতায় এসেছেন। বাংলাদেশের যুদ্ধ সংক্রান্ত বিষয়ে ইন্দিরা গান্ধী কলকাতা প্রেস ক্লাবে কমপক্ষে চারবার এসেছেন এবং দুবার সংবাদ সম্মেলন করেছেন। ইতোমধ্যে ঘটল আরেক ঘটনা। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের (১৯৬৭-৬৯) সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে সদ্য-উত্তীর্ণ, কৃতী, সাহসী, উদ্যমী তরুণ দুই ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক দীপক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সুরজিৎ ঘোষাল ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গন থেকে সরাসরি খবর সংগ্রহের তাগিদে সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধরত বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঢোকেন। এরপর তাদের আর খোঁজ মেলেনি। ধারণা করা হয়, তারাও শহীদ হয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে। শুধু এই দুজন নয়, মুক্তিযুদ্ধের খবর সংগ্রহে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন কলকাতার অনেক সাংবাদিক। বরুণ সেনগুপ্তের আনন্দবাজারে প্রকাশিত নিয়মিত প্রতিবেদন ‘রণাঙ্গন থেকে’ সেই সময়ে তুমুল জনপ্রিয় হয়েছিল। তবে এগুলো লেখা হতো আগত শরণার্থী ও বেশিটা মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে প্রাপ্ত সংবাদের ভিত্তিতে। ভারতীয় সেনাবাহিনী কখনই কোনো সাংবাদিককে সীমান্ত অতিক্রম করার অনুমতি দেয়নি।
তবে মুক্তিযুদ্ধ বা স্বাধীনতার যুদ্ধ জেতার পেছনে কলকাতার সংবাদপত্র ও রেডিওর ভূমিকা ছিল অসীম। বিশ্ব জনমত গঠনে ও পশ্চিমবঙ্গের মানুষের মনকে বাংলাদেশের পক্ষে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে তারা সফল। কলকাতায় বিভিন্ন ছাত্র সংস্থা ২৯ মার্চ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার দাবিতে ও মুক্তিবাহিনীকে অস্ত্র সরবরাহের দাবিতে দুপুর ১টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত কলকাতায় অবস্থিত পাকিস্তান ডেপুটি হাইকমিশনারের অফিসের সামনে বিক্ষোভ দেখিয়েছিল। একইদিন কলকাতার পৌর বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক ও কর্মীসংঘ এক বিবৃতির মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনের দাবি জানিয়েছিল। বাংলাদেশকে স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে কূটনৈতিকভাবে স্বীকৃতি দেয়ার দাবিতে ও মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর হানাদারদের বর্বর আক্রমণের প্রতিবাদে পশ্চিম বাংলায় ৩১ মার্চ রাজ্যের ছাত্র সংগঠনগুলো, ট্রেড ইউনিয়নগুলো একযোগে ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিল। সেদিন সমগ্র পশ্চিমবঙ্গবাসী স্বতঃস্ফূর্তভাবে হরতাল পালন করেছিলেন। সেদিন কলকারখানা, স্কুল-কলেজ, যানবাহন, আনন্দ-অনুষ্ঠান বাতিল করে দিয়ে বাংলাদেশের দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়েছিল। কলকাতার একদল ছাত্র ‘শেখ মুজিবুর রহমানের জয়’ এই ধ্বনি তুলে পাকিস্তানের হাইকমিশনারের অফিসের সামনে ১২ ঘণ্টার জন্য অনশন করেছিলেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে ও অবিলম্বে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার দাবিতে বিদ্যাসাগরের সান্ধ্য কলেজের ছাত্র-শিক্ষক, অধ্যাপক, শিক্ষাকর্মী মিলিত হয়ে ১ এপ্রিল সত্যকুমার চট্টোপাধ্যায়ের সভাপতিত্বে এক কনভেনশন অনুষ্ঠিত করেছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের অধ্যাপকরা বাংলাদেশে পাকিস্তানি সৈন্যের দ্বারা পরিচালিত ব্যাপক গণহত্যার প্রতিবাদে সুবোধ মল্লিক স্কোয়ারে প্রতিবাদ সভা করেছিলেন। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিয়ে ভারতজুড়ে একটি কমিটি তৈরি হয়েছিল। এই কমিটির অর্থভাণ্ডারে প্রথম দাতা ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. সত্যেন সেন। ২৮ মার্চ দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় বাংলাদেশের গণহত্যার প্রতিবাদে সম্পাদকীয় কলমে পশ্চিমবঙ্গের লেখক ও বুদ্ধিজীবীদের তরফে এক বিবৃতি পেশ করা হয়েছিল যার শিরোনাম ছিল আমরা প্রতিবাদ জানাই, আমরা তীব্র নিন্দা করি’ এর মাধ্যমে বিশ্ববোধ জাগ্রত করার জন্য সমগ্র বিশ্ববাসীর কাছে বুদ্ধিজীবীরা আবেদন করে লিখেছিলেন, ‘পৃথিবীতে আজ বহু দেশ আছে, বহু জাতি আছে, যারা নিজেদের সুসভ্য বলে দাবি করে। সে দাবি অনেকাংশে স্বীকার্য। তাদের বিবেক কি আজ সাড়া দেবে না? আমরা পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতিকর্মীরা বিশেষ করে আবেদন জানাই পৃথিবীর সব দেশের শিল্পী, স্রষ্টা, জ্ঞানী ও তপস্বীদের কাছে। আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্রের এই বীভৎস বিরাট নরহত্যার সংবাদ তারা পেয়েছেন নিশ্চয়। তাদের সবার তীব্র প্রতিবাদ ঘোষিত হোক, তাদের সরকারকে তারা উদ্বুদ্ধ করুন এই অর্থহীন নৃশংসতার নিন্দা করতে, প্রতিরোধ করতে, এ বিষয়ে তাদের যথোচিত কর্তব্য পালন করতে।
ছবি কথা বলে। অ্যাসোসিয়েট প্রেস এর ফটোগ্রাফার মাইকেল লরেন্ট সারা ঢাকা ঘুরে ঘুরে পাকিস্তানি বর্বরতা-নৃশংসতার ছবি তোলেন। যা পরবর্তীতে পত্রিকায় প্রকাশ করে বিশ্ববাসীকে পাকিস্তানি বর্বরতার খবর জানায়। ৫ এপ্রিলে নিউজ উইক পত্রিকায় চধশরংঃধহ চষঁহমবং রহঃড় ঈরারষ ধিৎ শিরোনামে দীর্ঘ প্রতিবেদনে এবং ১২ এপ্রিলে টাইম ম্যাগাজিন- এ পূর্ব পাকিস্তানের হত্যাযজ্ঞ ও গণকবরের বিস্তারিত খবর প্রকাশ করে। ১৯ এপ্রিল নিকোলাস টোমালিন দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকায় ঋধৎ ঋৎড়স ঞযব ঐড়ষড়পধঁংঃ শিরোনামে পাকিস্তানি নৃশংসতার বিবরণ তুলে ধরেন। সিঙ্গাপুরের দ্য নিউ নেশন পত্রিকায় এবং সুইডেনের দ্য এক্সপোরটেশন পত্রিকাসহ ইউরোপের বিভিন্ন পত্রিকায় পাকিস্তানি ধ্বংসযজ্ঞের সংবাদ পরিবেশন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের যৌক্তিকতা তুলে ধরা হয়। ওয়াশিংটন থেকে প্রকাশিত দ্য ডেলি নিউজ লেখে, ‘পাকিস্তানের সঙ্গে থাকা কিংবা নিশ্চুপ থাকা দুটোর মানেই বাঙালি নিধনে সহায়তা করা। ‘বিবিসি’র সাংবাদিক মার্ক টালির নিরপেক্ষ সংবাদের মাধ্যমে বিশ্ববাসী প্রতিদিন মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত তথ্য তথা পাকিস্তানি বর্বরতা-নৃশংসতার খবর জানতে পেরেছে। এতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সমর্থন বেড়েছে। মার্ক টালির মতো জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সিডনি শনবার্গ, অ্যান্থনি মাসকারেনহাস প্রমুখ সাংবাদিক সংবাদ সংগ্রহ ও পরিবেশন করেছেন।
এসময়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কি কোন পত্রিকা কি স্বাধীনতার সপক্ষে কণ্ঠ তোলেনি? স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র তাদের স¤প্রচার শুরু করে ২৬ মার্চ। তৎকালীন রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত বেতারের চট্টগ্রামের কয়েকজন কর্মী শহর থেকে অনেকটা দূরে নিরাপদ জায়গা হিসেবে কালুরঘাটে বেতারের ছোট্ট একটি কেন্দ্রে তাদের প্রথম অনুষ্ঠান করেন। ওই অনুষ্ঠানেই স্বাধীনতার সেই ঘোষণা প্রথম স¤প্রচার হয়। বঙ্গবন্ধুর নামে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ হান্নান স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধকালে ঢাকাসহ সারাদেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ৬৪টি পত্রিকা প্রকাশের তথ্য পাওয়া যায়। এগুলোর মধ্যে কয়েকটি দৈনিক এবং বেশির ভাগ সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, মাসিক, সাময়িক, বুলেটিন, ম্যাগাজিন, নিউজলেটার ইত্যাদি। এসব পত্রিকার মধ্যে মুজিবনগর সরকারের পক্ষ থেকে প্রকাশিত ও আওয়ামী লীগের মুখপাত্র জয় বাংলা পত্রিকাটির সম্পাদকীয়গুলোতে মুক্তযুদ্ধকালীন বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বর গণহত্যা, নারী ধর্ষণ, ধ্বংসযজ্ঞের তীব্রনিন্দা ও ঘৃণা প্রকাশ করা হয়। বঙ্গবাণী পত্রিকা পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মম হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংসযজ্ঞ তুলে ধরে এর বিচার দাবি করে। স্বদেশ পত্রিকায় মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, পাকিস্তানের বৈষম্যনীতি ইত্যাদি বিষয় উল্লেখ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার যৌক্তিকতা তুলে ধরে। বাংলাদেশ পত্রিকার বিভিন্ন সংখ্যায় বঙ্গবন্ধুর প্রহসনের বিচারের সমালোচনা, নারীদের প্রতি পাকিস্তানি বাহিনীর নির্যাতন-নিপীড়ন, ধর্ষণ ইত্যাদি বিষয় উল্লেখ করা হয়। এ পত্রিকায় বাংলাদেশের
স্বাধীনতার সপক্ষে অবস্থানের জন্য বিশ্বের ২৪টি দেশের প্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর আবেদন প্রকাশ করা হয়। রণাঙ্গন পত্রিকার সম্পাদকীয়তে ইয়াহিয়া খানের বিশ্বাসঘাতকতা, বঙ্গবন্ধুর বিচারের সমালোচনা, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর বক্তব্যসহ মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণাদায়ক বিভিন্ন বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরা হয়। স্বাধীন বাংলার বিভিন্ন সংখ্যায় বাংলার নারীসমাজকে বাঁচানোর জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। উল্লিখিত পত্রিকাগুলো ছাড়াও মুক্তিযুদ্ধ, সোনার বাংলা, বিপ্লবী বাংলাদেশ, নতুন বাংলা, জাগ্রত বাংলা, অগ্রদূত, আমার দেশ, অভিযান, মুক্তি, দুর্জয় বাংলা, বাংলার মুখ, জন্মভূমি, সাাপ্তাহিক বাংলা, দাবানল, স্বাধীন বাংলা, ঞযব ইধহমষধফবংয, ঞযব ঘধঃরড়হ, ইধহমষধফবংয ঞড়ফধুসহ অনেক পত্রিকা-সংবাদমাধ্যম নিজ নিজ অবস্থান থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। মুক্তিযুদ্ধকালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত এম আর আখতার মুকুলের ‘চরম পত্র’ এবং তেজোদ্বীপক গান-কবিতা, রম্য রচনা এ দেশের জনগণ ও মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসাহ-উদ্দীপনায় ব্যাপক ভূমিকা পালন করেছে।
১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর শুরু হয়ে যায় ভারত-পাকিস্তান সর্বাত্মক যুদ্ধ। মাত্র ১৩ দিনের যুদ্ধে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয় পাকিস্তান। ৪ ডিসেম্বর দৈনিক ইত্তেফাক শিরোনাম করে- পশ্চিম পাকিস্তান আক্রান্ত। ৫ ডিসেম্বর ইংরেজি দৈনিক মর্নিং নিউজের শিরোনাম ছিল- ৪৬টি ভারতীয় বিমান ধ্বংস। একই দিন দৈনিক পূর্বদেশ শিরোনাম করেছিল- আক্রমণ স্তব্ধ করে পাল্টা আঘাত শুরু। এমনকি ডিসেম্বরের ১৩ তারিখ পর্যন্ত প্রকাশিত সংবাদপত্রগুলোতে যুদ্ধে পাকিস্তানের সাফল্য তুলে ধরা হয়। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি ছিল পুরোপুরি উল্টো। ভারতীয় বিমান আক্রমণে দিশাহারা পাকিস্তানি বাহিনী তখন আত্মসমর্পণের চিন্তা করছে। ডিসেম্বর মাসের ১৩ তারিখের পর কয়েকদিন পূর্ব পাকিস্তান থেকে আর কোনো সংবাদপত্র প্রকাশিত হওয়ার রেকর্ড পাওয়া যায়নি। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের পরে সংবাদপত্রগুলোর নতুন এক চেহারা নিয়ে আবির্ভূত হয়। ডিসেম্বরের ২০ তারিখ দৈনিক পূর্বদেশ লাল কালিতে শিরোনাম করে- রক্তস্নাত বাংলাদেশ কাঁদো। একই দিন দৈনিক পাকিস্তান তাদের পত্রিকার নাম পরিবর্তন করে দৈনিক বাংলা করে। ডিসেম্বরের ২০ তারিখ দৈনিক বাংলা লিখেছে হানাদার বাহিনীর সহযোগীদের বিচারের জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হবে। জাতি গঠনে আত্মনিয়োগ করার জন্য আওয়ামী লীগ নেতাদের আহ্বান।
যে কথাটা একাত্তরের বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ নিয়ে বলার তা হলো এই যুদ্ধের বিভিন্ন অঙ্গনে সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা ছিল সম্মুখ সারির যোদ্ধাদের ঠিক পরেই। গত ৫০ বছরে গণমাধ্যমের গুণগত, মানগত ও চরিত্রগত পরিবর্তন যাই হোক না কেন এখনো সংবাদমাধ্যম সমাজ পরিবর্তন ও ধর্ম নিরপেক্ষতার একমাত্র হাতিয়ার। আজ বিভিন্ন কারণে তাদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও একটা কথা মনে রাখা প্রয়োজন তা হলো সংবাদমাধ্যম হলো সমাজের দর্পণ এবং একইভাবে তারাই জনমত গঠন করে। সেজন্য অনেক সময় তারা শাসকের রোষের শিকার হয়। কিন্তু শাসককে মনে রাখতে হবে যে গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে সংবাদমাধ্যম স্বীকৃত। তাকে দমন নয় রক্ষা করতে হবে গণতন্ত্রের স্বার্থে।

অমিত গোস্বামী
কবি ও লেখক

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়