যৌতুকের জন্য স্ত্রী হত্যার মামলায় স্বামীর মৃত্যুদণ্ড

আগের সংবাদ

বিদেশিদের নজর ঢাকার দিকে : ব্যস্ত সময় পার করলেন ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কোরিয়ার শীর্ষ কূটনীতিকরা

পরের সংবাদ

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন ১৭ মার্চ। ১৯২০ সালের এই দিনে ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু মুজিব বর্তমান গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। ২০০৪ সালে বিশ্বব্যাপী বিবিসির বাংলাভাষী শ্রোতা জরিপে ‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি’ নির্বাচিত হন বাংলা ও বাঙালির মহান সন্তান শেখ মুজিব। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ বিশ্বের ১০টি শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক ভাষণের অন্যতম। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু মুজিবের অনন্য নেতৃত্বের জন্য ১৯৭১-এর ৫ এপ্রিল আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন ‘নিউজ উইক’ এই মহান নেতাকে ‘রাজনীতির কবি’ হিসেবে উল্লেখ করেন।
বাঙালির শতবর্ষের ইতিহাসে গৌরবময় অর্জন হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। ভারত-পাকিস্তানের মতো আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়নি। এই স্বাধীনতার জন্য শত বছর আগে মাস্টারদা সূর্যসেন, প্রীতিলতা, ক্ষুদিরামসহ আরও অনেকে ফাঁসিতে জীবনদান করে গেছেন। অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়েই ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ হয়েছিল। ২৩ জুন পলাশীর যুদ্ধে মিরজাফর গংদের বিশ্বাসঘাতকতায় নবাব সিরাজুদ্দৌলা পরাজিত হলে বাংলার স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হয়। পলাশীর পরাজয়ের ২১৪ বছর পর ১৯৭১ সালে বাঙালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আমাদের স্বাধীন আবাসভূমি স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত ২৩ বছরের আন্দোলন সংগ্রামেও শত শত মানুষ মৃত্যুবরণ করেছেন। তবে ১৯৭১ সালে শুধু ৯ মাসের সশস্ত্র স্বাধীনতা যুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হয়েছেন এবং ৪ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানি ঘটেছে। ওই সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় নিজামীচক্র হাজার হাজার বাড়িঘর জ্বালিয়ে ছাই করে দিয়েছে। তবে দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে চার দশকেও স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদদের সঠিক সংখ্যা নিরূপণ করা হয়নি।
স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ইতিহাস গৌরবের। ’৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর বিশ্বের মধ্যে দুর্ধর্ষ সামরিক বাহিনী হিসেবে পরিচিত প্রবল পরাক্রমশালী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৯৩ হাজার সেনাসদস্য বাংলার দামাল মুক্তিবাহিনীর কাছে নাকে খত দিয়ে আত্মসমর্পণ করেছে। মুক্তিযোদ্ধারা জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু বলে সম্মুখ সমরে হাসতে হাসতে জীবন দিয়েছেন। একাত্তর বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে এক গৌরবময় হিরণ¥য় সময়। সে সময় সাড়ে সাত কোটি বাঙালি শেখ মুজিবের নেতৃত্বে যেভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন, এই ধরনের ঐক্যের কোনো দ্বিতীয় উদাহরণ হাজার বছরের ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যাবে না। ২৭ বছরের যুবক শেখ মুজিব ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় নেতৃত্ব দেন। আর সেই মুজিব আমেরিকা, চিনসহ বহু রাষ্ট্রের বিরোধিতা সত্ত্বেও মাত্র ২৩ বছরের মাথায় পাকিস্তান ভেঙে চুরমার করে দিলেন। মুজিবের অতিমানবীয় নেতৃত্ব বাঙালি জাতিকে শুধু ঐক্যবদ্ধ করেনি, বাঙালিকে বীরের জাতিতে পরিণত করে।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে কথা বলার মতো দেশে কোনো বিরোধী দল ছিল না। এই পরিস্থিতিতে যুবনেতা শেখ মুজিব পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ৪ মাস পর ১৯৪৮-এর ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেন। ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে ছাত্রলীগের মাধ্যমে মুজিব বাংলার স্বাধিকার আন্দোলনকে ধীরে ধীরে কীভাবে চূড়ান্ত পরিণতির দিকে নিয়ে গেছেন। এই বাঙালি নেতা পূর্বপাকিস্তানকে সবসময় পূর্ববাংলা নামে উল্লেখ করেছেন। পাকিস্তান পার্লামেন্ট এমএনএ হিসেবে তিনি সবসময় পূর্ববাংলার বঞ্চিত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন। পূর্ব পাকিস্তানকে (পূর্ববাংলা) সময়মতো তিনি যে স্বাধীন করতে চান, তা আকারে ইঙ্গিতে সবসময় বুঝিয়ে দিয়েছেন।
‘৭০-এর ডিসেম্বরে নির্বাচনের আগে ১২ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ¡াসে দক্ষিণাঞ্চলে লাখ লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটে। সপ্তাহব্যাপী ঘূর্ণিদুর্গত অঞ্চল ঘুরে ২৬ নভেম্বর ঢাকায় এক জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে বিদ্রোহী বাংলার বিদ্রোহী মুজিব একপর্যায়ে স্পষ্ট ভাষায় বলেন, ‘বাংলাদেশ আজ জেগেছে। বানচাল করা না হলে বাংলার মানুষ নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের রায় ঘোষণা করবে। আর যদি নির্বাচন বানচাল করা হয়, ঘূর্ণিঝড় ও সামুদ্রিক জলোচ্ছ¡াসে নিহত দশ লাখ লোক আমাদের উপর যে দায়িত্ব অর্পণ করে গেছে, তা সম্পাদনের জন্য স্বাধীন দেশের নাগরিকের মতো বাঁচার জন্য এবং আমরা যাতে নিজেরাই নিজেদের ভাগ্য নিয়ন্তা হতে পারি, এর জন্য প্রয়োজনবোধে আরও দশ লাখ বাঙালি প্রাণ বিসর্জন দেবে।’ এ সময় একজন বিদেশি সাংবাদিক জানতে চান, এই উক্তির মাধ্যমে কি আপনি পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ সৃষ্টির কথা বলছেন? ত্বরিত উত্তরে সাহসের বরপুত্র জাতীয় নেতা মুজিব বলেন, ‘ঘড়ঃ ুবঃ’ (এখনই নয়)। অর্থাৎ এই বক্তব্যের মাধ্যমে শেখ মুজিব বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিলেন, প্রয়োজনে তিনি স্বাধীনতার ডাক দেবেন। ’৭১-এর ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিব ‘৬৯-এর ২৬ নভেম্বরের রেশ ধরেই আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে বলেছিলেন, ‘বাংলার মানুষকে আর দাবায়া রাখতে পারবা না। রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, স্বাধীনতা সংগ্রামকে ত্বরান্বিত করার জন্যই ’৬৬ সালে শেখ মুজিব ৬ দফা দিয়েছিলেন। আইয়ুব-ভুট্টোসহ পশ্চিমা সামরিকচক্র ৬ দফার অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য বুঝেই মুজিবকে বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে আখ্যায়িত করেছিল। আর শেখ মুজিবও জানতেন, ‘ওরা ৬ দফা মানবে না আর তখনই ৬ দফা এক দফায় পরিণত হবে।’ একইভাবে সামরিক বিধির বেড়াজালে ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের অনেকেই নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিপক্ষে ছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করে বলেছিলেন, ‘নির্বাচনে অংশ না নিলে বাংলার মানুষের পক্ষে কথা বলার অধিকার অর্জন করা যাবে না।’ তিনি এও জানতেন, ‘নির্বাচনে বাংলার মানুষ তাকে ও তার দলের পক্ষে রায় দেবেন। নির্বাচনী ফল মেনে না নিলে বাঙালি জাতি ব্যালটের রায় রক্ষার জন্য বুলেট হাতে নেবে।’ পরে মুজিবের ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে সঠিক প্রমাণিত হয়েছিল।
মার্কিন কূটনৈতিক অ্যার্চার ব্লাড তার গ্রন্থে লিখেছেন শেখ মুজিব ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের ‘মুকুটহীন সম্রাট’। মুজিব ১৯৬৯-এর জুনেই ব্লাডকে বলেছিলেন, ‘সামরিক বাহিনী যদি আমাকে বাধা দেয় তাহলে আমি স্বাধীনতা ঘোষণা করে গেরিলা যুদ্ধের ডাক দেব।’ ঐতিহাসিকদের মতে, সত্তরের নির্বাচনই হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূল ভিত্তি। এ নির্বাচনে পূর্ববাংলার ১৬৯ আসনের মধ্যে ১৬৭টি পেয়ে মুজিবের দল পাকিস্তান পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে।
তাছাড়া প্রাদেশিক নির্বাচনে পূর্ববাংলায় ৩০০ আসনের মধ্যে তার দল ২৮৮ আসন পায়। এমনিভাবে ৭ ডিসেম্বর ও ১৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত জাতীয় ও প্রাদেশিক নির্বাচনে পূর্ববাংলার জনগণের শতকরা ৯৮ ভাগ মানুষের সমর্থন পেয়ে আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিব পূর্ববাংলার জনগণের একমাত্র মুখপাত্র হয়ে গেলেন।
’৭১-এর ১ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান যখন ৩ মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের উদ্বোধনী অধিবেশন স্থগিত করেন, পাকিস্তান সেদিনই ভেঙে যায়। এরপর ১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগ স্বাধীন বাংলাদেশ পরিচালনা করেন। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দেন। তিনি বলেন, ‘আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমরা রাস্তাঘাট বন্ধ করে দিও।’ ‘আমরা ভাতে মারব, পানিতে মারব’ বলে তিনি গেরিলাযুদ্ধের দিকনির্দেশনা দেন। ১৫ মার্চ স্বাধীন দেশের সরকার প্রধানের মতো বঙ্গবন্ধু ৩৫টি নির্দেশ জারি করেন। ২৩ মার্চ ৩২ নম্বরের বাসভবনে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করেন। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সশস্ত্র যুদ্ধ শুরু করলে ২৫ মার্চ রাতে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তিনি ৯ মাস অনুপস্থিত থাকলেও তার নামেই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয় মনীষী আবুল ফজল বলেছেন, ‘অনুপস্থিত সেনাপতির এমন সেনাপতিত্ব সত্যিই অভিনব, ইতিহাসে এমন নজির বিরল।’
স্বাধীনতাবিরোধীরা যাই বলুক, ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে, ‘শেখ মুজিব ঘুমন্ত জাতির জাগরণের জন্য জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত ব্যয় করেছেন। দেশ ও জাতিকে তিনি আত্মশক্তিতে বীর্যবান করে স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। শেখ মুজিবের অপরিসীম আত্মত্যাগের ফসলই হচ্ছে স্বাধীন বাংলাদেশ।
শেখ মুজিব ও বাংলাদেশ একে অপরের অবিচ্ছেদ্য অংশ। একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটিকে কল্পনা করা যায় না। বঙ্গবন্ধু ছিলেন স্বাধীনতার প্রতীক ও জাতীয় বীর। তিনি ছিলেন খাঁটি দেশপ্রেমিক। তিনি বাংলার মাটি ও মানুষের জন্য অকাতরে নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়েছিলেন। বাংলার জনগণের ভাগ্যোন্নয়নের জন্য আজীবন সংগ্রাম করেছেন। রাজনীতিতে আদর্শ ও মূল্যবোধের চর্চায় এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব বঙ্গবন্ধু। অন্য রাজনীতিবিদদের তিনি রোল মডেল। তাই ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু একটি হিরণ¥য় নাম।

মোহাম্মদ শাহজাহান
সাংবাদিক ও লেখক

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়