যৌতুকের জন্য স্ত্রী হত্যার মামলায় স্বামীর মৃত্যুদণ্ড

আগের সংবাদ

বিদেশিদের নজর ঢাকার দিকে : ব্যস্ত সময় পার করলেন ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কোরিয়ার শীর্ষ কূটনীতিকরা

পরের সংবাদ

নৃপেন্দ্র স্যারের হারিয়ে যাওয়া এবং ধর্ম-বর্ণ-জাত

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

এখন থেকে প্রায় চল্লিশ/বিয়াল্লিশ বছর আগে, তখন মনে হয় অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি। সে সময় আমরা কয়েকজন সহপাঠী এক শিক্ষকের কাছে অঙ্ক শিখতাম। অর্থাৎ তার বাসায় গিয়ে আমরা শিক্ষা নিতাম। শিক্ষককে আমি ব্যক্তিগতভাবে ভয় করতাম। কারণ তিনি ছিলেন এক রাশভারী লোক। কদাচিৎ হাসতেন। যখন হাসতেন, তখন আমরা সাহস নিয়ে মাঝে মাঝে দু-একটা কথাও জিজ্ঞেস করতাম। তার বাসায় যখন আমরা সহপাঠীরা শিক্ষা নিতে শুরু করি, তখন কিছুটা হলেও আমাদের সেই ভয় ভেঙে যায়। অত্যন্ত মেধাবী এই শিক্ষক তার সাবজেক্টে ছিলেন অন্যরকমের প্রাজ্ঞ।
শিক্ষা জীবনের সে এক ভিন্ন অধ্যায়। আলোচনাটা আমার স্যারকে নিয়েই। আমরা তাকে ‘নৃপেন্দ্র স্যার’ বলেই সম্বোধন করতাম আমাদের মাঝে। তার নাম নৃপেন্দ্র সেন না দাস না ভট্টাচার্য্য, সেটা আমি কোনোদিন খেয়ালই করিনি। কারণ তিনি ছিলেন আমাদের নৃপেন্দ্র স্যার। তার এক চাচাত ভাই ছিল, জগদীস। সে-আমরা একই ক্লাসে পড়তাম। কথা কম বলত। তার চোখে কী জানি একটা সমস্যা ছিল। সব সময় উদাস থাকত। মাঝে মাঝে তাকে আমরা হাসাতাম। কিন্তু কোনো সময়ই হৈ-হুল্লায় ছিল না।
সেই স্যারের কাছে আমাদের পড়ার শেষ দিনটি আমার স্মৃতিতে এখনো জ্বলজ্বল করে। অর্থাৎ কয়েক মাস পর আমরা যখন অঙ্ক পরীক্ষায় মোটামোটি ভালো ফলাফল করার আশায়, তখন প্রাইভেট পড়া শেষ করতে স্যারই আমাদের উপদেশ দেন। এবং এ হিসেবে একটা দিন আমাদের নির্ধারিত করে বলেন, ঐ দিনটিতে তিনি তার শেষ সেশন দেবেন আমাদেরকে।
আমরা ঐ শেষ দিনটিতে এসেছি তার কাছে, যথারীতি তার নির্ধারিত সময়ে সেশন শেষ করতে যাব, তখন তিনি আমাদের বসতে বললেন এবং গল্প-গুজবে মেতে উঠলেন। একসময় তার কিচেন থেকে আমাদের জন্য তাদের ঘরে বানানো মিষ্টিসহ ট্র্যাডিশনাল বেশ কিছু খাবার আমাদের জন্য এলো। আমরা বিস্ময় নিয়ে একে অপরের দিকে তাকাই। স্যার আমাদের খেতে বলেন এবং নিজেও আমাদের সঙ্গেই মিষ্টি যোগে অংশ নেন।
সময় গড়িয়ে যায়, মিনিট-ঘণ্টা চলে যায়। একসময় আমরা সবাই তার কাছ থেকে বিদায় নেই। সবাই তখন আমরা বাইসাইকেল চালক। কিন্তু আমরা কেউই সাইকেলে উঠতে পারিনি। স্যার আমাদের সঙ্গে হেঁটে হেঁটে দীর্ঘ পথ আসেন। গ্রামের রাস্তাটি গাছ-গাছালিতে ছায়া দেয় আমাদের প্রতিটি সময়। অথচ সে ব্যাপারটা আমি কখনো বুঝিনি, কিন্তু কেন যেন স্যারের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে মনে হলো একজন মানুষ আমাদের ছায়া দিচ্ছেন, পথের নির্দেশনা দিচ্ছেন। একসময় তিনি দাঁড়ান। বলেন তোমরা যাও। আমি তার মুখের দিকে তাকাই, কেন জানি তাকে বড় বিষণ্ন দেখায়। আমরাও একরাশ খুশি আর দুঃখবোধ নিয়ে একে একে সাইকেলে চড়ি। কিন্তু স্যার আমাদের বিদায় বলে ফিরে যাননি। একে একে যখন সবাই সাইকেলে উঠেছে, তখনই তিনি ফিরে যান।
এরপর স্কুলে তার ক্লাসে আমরা যথারীতি পিনপতন নীরবতার মধ্য দিয়েই ক্লাস করছি। কিন্তু স্যারকে কেন জানি আগের মতো আর ভয় করিনি। স্যারও মাঝে মাঝে হাসতেন।
একদিন ক্লাসে গেছি, শুনি নৃপেন্দ্র স্যার ক্লাস নেবেন না। কারণ তিনি চলে গেছেন। কোথায়, অন্য কোনো স্কুলে? না, শুনলাম তিনি চিরতরেই হারিয়ে গেছেন তার-আমার প্রিয় পঞ্চখণ্ড হাইস্কুল (বিয়ানীবাজার) থেকে। তিনি ভারতে চলে গেছেন। কেউ কিছু জানল না, না স্কুল কর্তৃপক্ষ, না ছাত্ররা। শুধু আমি আমার কিশোর বেলায় তার সেই আপ্যায়নের কথা মনে করলাম আর ভাবলাম কোন এক অদম্য ভালোবাসায় হয়তো তার হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছিল তার কিছু ছাত্র, যাদের মধ্যে আমি কিংবা আমরা ছিলাম। যাদের বিদায় দিয়েছিলেন হেঁটে হেঁটে গ্রামের পথ দিয়ে।
নৃপেন্দ্র স্যারের অধ্যায় এভাবেই শেষ হয়, যদিও এর আগে জগদীশরা চলে গিয়েছিল। শুনেছিলাম তারা ফিরে আসবে। কিন্তু কেউই ফিরে আসেনি। আসবেও না কোনোদিন। এভাবেই জমিদার বাড়ির মিহিরও চলে গেছে। দেখা হয়নি, হবেও না হয়তো কোনোদিন।
নৃপেন্দ্র স্যার কোথায় আছেন জানি না, জগদীশ, মিহির কে কোথায় আমি তার কিছুই জানি না। এভাবে আমাদের এলাকা থেকে অনেকেই চলে গেছে, নীরবে, না জানিয়ে। তাই একটা বিস্ময় মাখানো কৌতূহল এখনো আমার মাঝে কাজ করে, কারণ মানুষগুলো আমাদের স্বজন ছিল। এরা আমাদেরকে ভালোবাসত, আমরাও তাদেরকে বন্ধু ভেবেছি, নৃপেন্দ্র স্যারকে ভেবেছি আমাদের পরম প্রিয় শিক্ষক।
নৃপেন্দ্র স্যারের বন্ধু কলেজে রসায়নের শিক্ষক প্রেমানন্দ স্যার নিশ্চয়ই এখনো আছেন। কলেজে আমাদের সিনিয়র দাদা আমাদের স্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে অবসর নিয়েছেন, আমার অনেক শিক্ষক, বন্ধু-অগ্রজ-অনুজ এই জনগুষ্ঠির এখনো আছেন আমাদের পাশাপাশি। স্থানীয় মন্দিরে এখনো উলুধ্বনি ওঠে। পূজাপার্বণে প্রজ¦লিত হয়ে উঠে উৎসব। সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে একচুলও স্পর্শ করেনি আমাদের এলাকা। কিন্তু তারপরও সমাজ বাস্তবতায় কেন জানি তাদের কাছে আপন হয়ে উঠেনি চারপাশ। তাই ভাবি এক অজানা শঙ্কায় এখনো কাটে কি অহর্নিশ?
কী এক বিস্ময়কর বিশ্বাসহীনতা যেন আমাদের হৃদয়ের গভীরে বিদ্ধ হয়ে আছে। শুধুমাত্র ধর্ম আমাদের বিশ্বাস-বন্ধুত্ব-শ্রদ্ধা-প্রতিবেশীকে করেছে বিভাজিত। যেমন আমার সহপাঠী জগদীশ-মিহিরেরা আমাদের ওপর আস্থা রাখতে পারেনি, ঠিক তেমনি পারেননি নৃপেন্দ্র স্যার, যিনি আমাদের বিদায় দিয়েছিলেন কোন এক অপরাহ্ণে। দীর্ঘদিনের তার পাঠদানে শিক্ষার্থীদের প্রতি তার জন্মেছিল হয়তো এক অন্যরকম অনুভূতি। কিন্তু কিছুই বলতে পারেননি। তিনি জানতেন তিনি যাচ্ছেন, তবুও তিনি আমাদের বলতে পারেননি ‘বিদায়’। বিষণ্নতার মধ্য দিয়েই তিনি শুধু আমাদের সাইকেলে চড়াটুকু দেখেছেন। নৃপেন্দ্র স্যারের দেশ-ছাড়ার মতো কঠিন সিদ্ধান্তটা ছিল না কোনো ক্ষণিকের আয়োজন। ছিল দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ভয়-শঙ্কায় আড়ষ্ট হওয়া মানসিকভাবে বিধ্বস্ত একজন মানুষ কিংবা একটা পরিবারের নিশ্চিত নিরাপত্তার সন্ধান। কোথায়? ভারতে।
ভারতে গিয়ে নৃপেন্দ্র স্যার শুধু তার ধর্মবিশ্বাসকেই কাজে লাগিয়ে হয়তো তার পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পেরেছেন, কিন্তু সেই ধর্মেরই আবরণে ভারতের ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরাওতো সেই একই শঙ্কায় এখনো কাটায় তাদের প্রতিদিন। তারা যাবে কোথায়? কোটি কোটি মুসলমানদের আছে সেই একই দীর্ঘশ্বাস, কারণ এক সময়ের একটা ধর্মনিরপেক্ষ দেশ ভারতে এখন চলছে ধর্মকে ইস্যু করে ক্ষমতাসীন শক্তির সাম্প্রদায়িকতা জিইয়ে রাখার নিরন্তর প্রয়াস। অথচ সেখানেও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে মানুষের গর্জে ওঠা আছে, আছে ধর্মীয় উন্মাদনার বিরুদ্ধে দেশের কোটি কোটি মানুষের সংগ্রাম।
দেশ হিসেবে বাংলাদেশ অসাম্প্রদায়িক। রাষ্ট্র হিসেবে আমরা উগ্রতার ধারেকাছেও নেই। পৃথিবীর সব দেশেই কোনো না কোনোভাবে উগ্র একটা গ্রুপ থাকতেই পারে। ব্রিটেনেও উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী মাঝে মাঝে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, এরা জাতিগত বিদ্বেষ ছড়ায় কিন্তু রাষ্ট্রই তা সামাল দেয়। কারণ এ দেশগুলোর সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষই সাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাস করে না। সে হিসেবে বাংলাদেশও ধর্ম নিয়ে রাজনীতি আছে ঠিকই, কিন্তু পঁচান্নব্বই শতাংশ মুসলমান হয়েও মানুষ সম্প্রীতি রক্ষা করেই চলছে। যেখানে পাশের দেশ ভারত, মিয়ানমার কিংবা পাকিস্তান রাজনীতিতে ধর্মকে উসকে দিয়ে দেশ নিয়ন্ত্রণ করছে।
ধর্ম তখনই বর্ম হয়, যখন রাজনীতিতে শক্তি বাড়াতে হয়, ধর্ম তখনই সামনে আসে, যখন প্রতিপক্ষকে আটকাতে হয়। বিজয়ী হতে হয়। ধর্ম-বর্ণ-জাত এ এক অদৃশ্যমান অস্ত্রের নাম, যা দিয়ে খুব সহজেই একটা শহর উজাড় করে দেয়া যায়, সশস্ত্র সন্ত্রাসী দিয়ে নৃশংসতায় রক্তাক্ত করা যায় জনপদ। ভারত-পাকিস্তান ভাগ হতে যেমন ছিল সেই তথাকথিত ধার্মিক (হিন্দু-মুসলিম) নেতৃত্বের ধর্মীয় খেলা, ঠিক তেমনি এখনো সে রকম খেলায় রক্তাক্ত উৎসব হয় পৃথিবীর দেশে দেশে। এই খেলার শেষ হবে কবে, কোন সে কালে?

ফারুক যোশী
কবি ও লেখক

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়