যৌতুকের জন্য স্ত্রী হত্যার মামলায় স্বামীর মৃত্যুদণ্ড

আগের সংবাদ

বিদেশিদের নজর ঢাকার দিকে : ব্যস্ত সময় পার করলেন ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কোরিয়ার শীর্ষ কূটনীতিকরা

পরের সংবাদ

অপমানিত হয়ে লিখতে এসেছি

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

কেন লিখি বা লিখতে এলাম কেন? এই প্রশ্নটির উত্তর বয়সভেদে নানারকম হবে। তরুণ বয়সে একরকম হবে, বিয়াল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে একরকম হবে। আবার প্রবীণ বা বৃদ্ধ বয়সে ভিন্নরকম হবে।
তরুণ বয়সে মানুষ আবেগতড়িত হয়ে লিখতে বসে। আত্মপ্রচারটা সে সময় প্রধান অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে। উন্মোচিত হওয়ার কম্পনটা তো থাকেই।
তরুণ বয়সে লেখার ব্যাপারটা কী, তেমন করে মাথায় ঢুকেনি। দু’চারজন ক্লাসমেট লিখত। তখন অনার্সে পড়ি, চট্টগ্রাম কলেজে। সঞ্জীব চৌধুরী আর শেখর দস্তিদার ক্লাসমেট ছিল। সঞ্জীব ছড়া লিখত। লম্বা চুল। পাঞ্জাবি-পাজামা পরত সঞ্জীব। কম কথা বলত, একটু তোতলা ধরনের। কিন্তু ভীষণ ভালো ছড়া লিখত সে। চট্টগ্রামের সকল পত্রিকা-ম্যাগাজিনে তার ছড়া ছাপানো হতো। শেখর দস্তিদার লিখত গদ্য। কবিতাও লিখত মাঝে মধ্যে। তবে তার গদ্যের হাত ছিল খুব ভালো। তবে সঞ্জীব সেরকম ধারাবাহিকভাবে লিখে যেত, লেখায় শেখর সেরকম ধারাবাহিক ছিল না। রাজনীতি করত সে। কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় কর্মী ছিল। রাজনীতিতেই তার সময় যেত বেশি। সাহিত্যে তেমন সময় দিত না শেখর। কম হলেও সে যা লিখত, চমকে দিত আমাকে। এক বসাতে এক একটি কবিতা বা গল্প লিখে ফেলত সে। তখন তার বাঁ হাতে সিগারেট জ¦লত। সঞ্জীবও খুব সিগারেট খেত।
এ দুজনকে আমার দেবদূত বলে মনে হতো তখন। কী আশ্চর্য, কী করে লেখে তারা! কোন মন্ত্রবলে তাদের কলম দিয়ে গোটা গোটা অক্ষরগুলো বেরিয়ে আসে! ভেবে কূল পাই না। তাহলে কি সিগারেট খেলে লিখতে পারা যায়? কতই-বা বয়স আমার তখন। অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হয়েছি মাস ছয়েক মাত্র পেরিয়েছে। লেখক হতে পারার আশায় হাতে সিগারেট তুলে নিলাম। এ ব্যাপারে শেখর দস্তিদারই আমার দীক্ষাগুরু। সে বলল, লেখক যদি হতে চাস সিগারেট ধর, পান খাওয়া শুরু কর। মাঝে সাঝে গাঁজার কল্কিতে টান দে। এই শেখর দস্তিদার পরে চট্টগ্রাম কলেজের প্রিন্সিপাল হয়েছিল। তাকে জিজ্ঞেস করেছি, আচ্ছা ওই সময় আমাকে তুই ওই রকম দুর্বুদ্ধি দিয়েছিলি কেন? সে হাসতে হাসতে বলেছে, আরে, তুই তো গাঁইয়া ভূত ছিলি তখন। তোকে নিয়ে একটু খেলেছি আর কি। কিন্তু ওই সময়, ওই তরুণবেলায় শেখরের কথাকে বেদমন্ত্র বলে মনে হয়েছিল আমার।
আমি আমার ঊর্ধ্বতন তিন পুরুষের ইতিহাস জানি। বাবা যুধিষ্ঠির পাতর, তার বাবা চন্দ্রমণি পাতর, তার পিতা বলরাম পাতর। কেউ বিড়ি-তামাক খেতেন না। বলরাম পাতরের পরবর্তী জেনারেশনের কেউ ধূমপান করতেন না। ওই বংশধারার একজন হয়ে আমি বংশপ্রথা ভেঙেছি। লেখক হতে পারার প্রলোভনে সিগারেট হাতে তুলে নিয়েছিলাম আমি। লেখক হতে পারা তো দূরের কথা, বন্ধুদের সামনে যখনই সিগারেট খেয়েছি, বিবমিষা জেগেছে সঙ্গে সঙ্গে। মাথাটাও ভীষণ রকমের ঝিম ঝিম করত। শেষ পর্যন্ত লেখক হওয়ার স্বপ্ন ভেঙেছে, কিন্তু সিগারেটের কবল থেকে মুক্তি পেয়েছি।
ওই সময়ের পরের সময়ে বান্ধবীকে দু’চারটা যে চিঠি দিইনি, এমন নয়। তবে সেই লেখায় আমার যতটুকু থাকত, তার চেয়ে অনেক বেশি থাকত বিখ্যাত কবিদের কবিতার কোটেশন। গদ্যের অংশগুলোতে কবিদের প্রেমের কবিতার গদ্যানুবাদ থাকত। একবার একটা কবিতা লিখেছিলাম বটে। কবিতার সুষমা ছিল না সেটাতে। ব্যঙ্গ ও হুল ছিল বেশি। শেখর-সঞ্জীবদের উদ্যোগে বাংলা বিভাগ থেকে একটা দেয়ালিকা বের করা হয়েছিল। আমাকে বলা হয়েছিল কিছু একটা লিখতে। কী লিখব, কী লিখব? হঠাৎ সিরাজ উদ-দৌলা স্যারের কথা মনে পড়েছিল। অসম্ভব রকমের সুপুরুষ ছিলেন তিনি। ফর্সা, দীর্ঘদেহী। বরিশাল বা যশোরের দিকে বাড়ি ছিল তার। ছাত্রদের অপছন্দ করতেন তিনি। তার যত টান ছাত্রীদের দিকে। ক্লাসে কারণে অকারণে ছাত্রদের বড় অপমান করতেন। সিনিয়র ক্লাসের ছাত্র হয়ে সহপাটিনীদের সামনে কতটুকু হেনস্থা সহ্য করা যায়? শেখররা গরজাতো। ভেজাবেড়াল হরিশংকর পেছনের বেঞ্চিতে অধোবদনে বসে থাকত।
তো ওই ভেজাবেড়ালই লিখে ফেলল একটা কবিতা, ব্যঙ্গ কবিতা। উপজীব্য- সিরাজ-উদ-দৌলা চৌধুরী স্যার। সরাসরি নাম নেই, কিন্তু পাঠকদের বুঝতেও অসুবিধা হলো না যে, এই কবিতার লক্ষ্য কে?
দেয়াল পত্রিকাটি যখন বের হলো, বাংলা বিভাগের ছাত্র-ছাত্রীরা হুমড়ি খেয়ে পড়ল পত্রিকাটির ওপর। পঠিতব্য-ভেজাবেড়ালের ব্যঙ্গ কবিতাটি। দীর্ঘদিন ক্লাসে আসা বন্ধ করে দিতে হয়েছিল আমাকে। সিরাজ স্যার নাকি হন্যে হয়ে খুঁজছিলেন আমায়। এই ঘটনার মাসখানেক পরে বিয়ে করেছিলেন সিরাজ স্যার। শেখর পরামর্শ দিয়েছিল- ক্লাস করা শুরু কর তুই। নতুন বিয়ে করেছেন। মন নরম এখন। তার বউটিও ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্রী। হাউকাউ করার সাহস করবেন না স্যার। ওর কথাই সঠিক হয়েছিল। ক্লাস করা শুরু করেছিলাম। তবে দীর্ঘদিন সিরাজ স্যার আমাকে না চেনার ভান করে গেছেন। এই ঘটনাটি আমার লেখার ইচ্ছেটাকে একেবারে গলা টিপে মেরেছিল। এরপর অনেকটা বছর গড়িয়ে গেল আমার জীবন থেকে। অনার্স-মাস্টার্স কমপ্লিট করে একটা হাইস্কুলে ঢুকলাম হেড মাস্টার হিসেবে। স্কুলটির নাম ছিল দক্ষিণ হালিশহর হাইস্কুল। আমার জন্মগ্রাম উত্তর পতেঙ্গার পাশের গ্রাম দক্ষিণ হালিশহর। নামে শহর হলে কী হবে, গ্রাম্যতা ওই গ্রামের প্রধান ভূষণ। ওদের তখন একজন শ্রমিক প্রধান শিক্ষক দরকার। নতুন প্রতিষ্ঠিত স্কুল। শ্রমিক হেড মাস্টার না হলে দাঁড় করাবে কে? ওই স্কুলে চারশ টাকা বেতনে শ্রমিক হরিশংকর প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিযুক্তি পেল। বছর তিনেক বেশ খেটেছিলাম। স্কুলটা দাঁড়িয়েও গিয়েছিল। মুসলমান প্রধান গ্রাম ছিল এটি। স্কুল পরিচালনা কমিটির সভাপতি ছিলেন মোহাম্মদ আলী। তিনি আবার সাধারণ জীবন বীমার করপোরেশনের চেয়ারম্যান ছিলেন। ওই দক্ষিণ হালি শহরেরই লোক তিনি। তিনি অন্য একজন কমিটি মেম্বারকে দিয়ে ধোয়া তোলালেন- জেলের ছেলেকে দিয়ে স্কুল চালালে গুনাহ হবে। স্কুলে গেলে হরিশংকর জলদাসকে তো আদাব-সালাম দিতে হয়। একজন জেলের ছেলেকে মুসলমান হয়ে সালাম দেয়া নাকি নাজায়েজ, শেষ পর্যন্ত কৌশলে বিতাড়িতই করেছিলেন ওরা আমাকে। আমার জায়গায় একজন মুসলমানকে নিয়োগ দিয়ে বড়ই তৃপ্তি পেয়েছিলেন মোহাম্মদ আলী সাহেব।
এরপর বাবার সঙ্গে মাছ ধরা। মাছ আমি ছোটবেলা থেকেই ধরা শুরু করেছিলাম। আট-নয় বছর বয়স থেকে বাবার সঙ্গে বঙ্গোপসাগরে যেতে শুরু করেছি। মাছ ধরার ফাঁকে ফাঁকে আমার লেখাপড়া করা। ত্রিশ বছর বয়স পর্যন্ত আমি বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরার কাজ চালিয়ে গেছি। বিসিএস দিয়ে সরকারি কলেজে চাকরিতে ঢুকেছিলাম। চট্টগ্রাম সরকারি সিটি কলেজে পড়াতে পড়াতেও মাছ ধরার কাজ আমি চালিয়ে গেছি। রাতে মাছ ধরা, দিনে অধ্যাপনা। সাড়ে সাতশ টাকা বেসিকের চাকরি। ঘরে হাঁ-করা এগারো জন। বাবা একা কুলিয়ে উঠতে পারছিল না। ভাইদের মধ্যে আমি বড়। অন্য ভাইয়েরা তখন ছোট ছোট।
ওই রকম ঘামঝরা জীবনের একদিনের ঘটনা। মহি মুহম্মদ আর টিপু সুলতান তখন অনার্স থার্ড ইয়ারের ছাত্র। ওই দিন বিভাগে বসে আছি। রাতে সমুদ্রে বড় পরিশ্রম গেছে আমার। কলেজে এসে তিন তিনটি ক্লাস করতে হয়েছে। আরো দুটো ক্লাস করতে হবে। ক্লান্তি আর বিষণ্নতায় শরীর আর মন বড় জ¦র জ¦র। জালে ভালো মাছ ধরা পড়েনি গেল রাতে। ওই সময় মহি-টিপু ঢুকল বিভাগে। বিনীতভাবে বলল, স্যার একটা পত্রিকা বের করব, লেখা দেন একটা। আমি তো অবাক! বলে কি ছোকরারা? দিলাম এক ধমক- কোনো দিন দেখেছো আমাকে লিখতে? পেটে বোমা মারলে একটা লেখা বেরোবে আমার? ধমক খেয়ে পালাল ওরা। ওখানেই আমার মধ্য বয়সের লেখা সমাপ্তি।
চল্লিশ-বিয়াল্লিশের কাউকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়- কেন লিখেন, কেন লিখতে এলেন? ওই বয়সের লেখকরা লম্বা ফিরিস্তি তুলে ধরবেন। সমাজচৈতন্য বলে একটা কথা আছে না? মানুষের প্রতি কর্তব্যবোধ? রাজনীতি চেতনা, ধর্মবোধ, সংস্কারচিন্তা- এসব থেকে কি বিচ্ছিন্ন আমি? তাছাড়া মানুষের সঙ্গে মানুষের, মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির একটা সম্পর্ক তৈরির দায়িত্বও তো আমার ঘাড়ে! এসব দ্বারা তাড়িত হয়েই তো আমি লিখি। এই ধরনের কোনো একটার অজুহাত দেখাবেন চল্লিশ-বিয়াল্লিশের লেখকরা।
আমি যখন লিখতে এলাম, তখন আমি তরুণও না, আবার চল্লিশ-বিয়াল্লিশেরও না। তখন আমার বয়স সাতচল্লিশ। ওই বয়সের লোককে কি প্রবীণ বলে? ওই বয়সে মানুষ মনে মনে হলেও বানপ্রস্থে যাওয়ার উদ্যোগ নেয়। প্রাচীন শাস্ত্র তা-ই বলে। জীবন তো চার পর্যায়ে বিভক্ত ছিল- ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ্য, বানপ্রস্থ ও সন্ন্যাস। ব্রহ্মচর্য অর্থাৎ পাঠগ্রহণ প্রক্রিয়া শেষ হলেই ছেলেকে বিয়ে করিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নিত পিতা-মাতা। পুত্র পিতা হয়ে গেলে পিতা-মাতা বানপ্রস্থে যাওয়ার প্রস্তুতি নিত। কতই বয়স তখন তাদের। মেরে কেটে পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন। তো বানপ্রস্থের জীবন ছুঁই ছুঁই সময়ে আমাকে হাতে কলম তুলে নিতে হয়েছিল। প্রাণের টানে, সাহিত্যপ্রীতির প্রাবল্যে, সমাজচেতনার তীব্রতায় আকুল হয়ে যে আমি লিখতে বসলাম, তা কিন্তু নয়। হ্যাঁ, এক ধরনের খরস্রোত আমি আমার মধ্যে অনুভব করেছি বটে। সে আনন্দের নয় মোটেই। অপমানে জর্জরিত হয়েই লিখতে এলাম আমি। অপমানের ঝাঁটার বাড়িটা যখন আমার মাথায় এসে পড়ল, তখন ওই সাতচল্লিশ বছর বয়সে আমি লেখার জন্য মনস্থির করলাম।
প্রবীণ বা বুড়ো লেখকদের যদি জিজ্ঞেস করা হয়- কেন লিখেন? উত্তরদাতা যদি স্পষ্টভাষি হন, বলবেন- টাকার জন্য লিখি। লুকানো চুপানোর লোক হলে বলবেন, বয়স তো আর কম হলো না, জীবনের অনেকটা পথ হাঁটা হয়েছে আমার। অভিজ্ঞতার ঝুড়িটাও ভরপুর। অন্যদের জানাতে বড় ইচ্ছে করে ওই অভিজ্ঞতার কথাগুলো। তাই লিখি এবং এখনো লিখে যাচ্ছি।
সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও লিখা থামিয়ে দেওয়ার লোকও আছেন কিন্তু। মাহমুদুল হকের কথা তো কারো ভুলবার নয়। কী অসাধারণ লিখিয়ে! জীবনকে খুলে মেলে দেখার কী অভূতপূর্ব চোখ ছিল তার। ভাষাটা ছিল যেন তার আদেশের গোলাম। কথাসাহিত্যকে কী অপূর্ব মহিমায় উজ্জ্বল করে তুলছিলেন তিনি। মধ্য বয়সেই লেখা থামিয়ে দিলেন। শত অনুরোধেও কলমের মুখটি খোলেননি আর। কলম খোলেননি, মুখও খোলেননি। কেন আর লিখছেন না, তার কোনো জবাব দেননি মাহমুদুল হক। তবে একজন জবাব দিয়েছিলেন। তিনি রমাপদ চৌধুরী। অতুলনীয় কথাসাহিত্যিক। তার এক একটি গল্প যেন মানবতন্ত্রের এক একটি তারের ঝংকার। তার উপন্যাসগুলো ছোট ছোট। কিন্তু প্রতিটি উপন্যাসে মানবজীবনের এক একটি অধ্যায়কে উন্মোচিত করেছেন তিনি। তো এই রমাপদ চৌধুরী বয়সের একটা সীমানায় পৌঁছে লেখা বন্ধ করে দিলেন। তিনি যে শারীরিকভাবে অক্ষম হয়ে পড়েছিলেন বা তার স্মৃতিশক্তি যে তার সঙ্গে প্রতারণা করছিল, এমন নয়। তার পরও তিনি লেখালেখি বন্ধ করে দিলেন। হয়তো তিনি তার যা লেখার, তা লিখে ফেলেছেন অথবা আর লিখলে পুনরুক্তি হবে নতুবা লিখতে লিখতে এমন একটা ক্লান্তি এসেছিল তার মনে, আর কলম ধরতে চাননি তিনি। প্রিয়তম লেখকের এরকম থেকে যাওয়া পাঠকরা মানবেন কেন? কিন্তু শত অনুরোধেও টললেন না রমাপদ চৌধুরী। এক সাক্ষাৎকারে এক সাংবাদিক পাঠকের হয়ে পুনরায় লেখা শুরু করার জন্য চাপাচাপি করলে রমাপদ চৌধুরী বলেছিলেন, ‘কলম ধুয়ে তোরঙ্গে তুলে রেখেছি।’ ফাউন্টেনপেন দিয়ে লিখতেন তিনি।
প্রকৃতপক্ষে আমি পড়–য়া ছিলাম। খুব ছোটবেলায় দেখেছি- বাবা খুব যতœ করে তিনটে বই বাড়িতে রেখেছে। একটা নিজেদের ঘরে, দুটো দেবতার ঘরে। বাবা সচ্ছল ছিল না। থাকবার জন্য আমাদের একটি ঘরই ছিল। ওই ঘরে ঢালা বিছানা। আটজন ভাইবোন মাটির মেঝেতে পাশাপাশি শুতাম। আমার পাশে শুতো আমার ঠাকুমা পরানেশ্বরী। ঠাকুমার ভাগ অন্য ভাইবোনদের দিতে চাইতাম না আমি। গোটা দিন ঘুরে ঘুরে মাথায় খাড়াংভর্তি মাছ নিয়ে গ্রামের গলিতে গলিতে বেচত আমার ঠাকুমা। মাছের আঁশটে গন্ধ ঠাকুমার গায়ে-কাপড়ে লেগে থাকত। পুকুরের জলে যতই হাত-মুখ ধোক না ঠাকুমা, মাছের গন্ধটা যেত না। আমার আবার রাতে ঠাকুমার গায়ের আঁশটে গন্ধটা নাকে না লাগলে ঘুম আসত না। তাই ঠাকুমা ছিল আমার একার। তার ভাগ নিয়ে ভাইবোনেরা যুদ্ধ করে করে একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। তো বাবা-মা ওই ঘরেই একটু আড়াল মতন জায়গায় শুতো। শোয়ার ঘর যা-ই হোক, মন্দির ছিল আমাদের একটা। ছোট্ট, মাটি দিয়ে তৈরি। ওখানে নানা রকম দেবতা সপরিবারে বাস করত। ছোট্ট মন্দিরটিতে বাবা খুব যতœ করে দুটো বই রাখত। বই দুটো হলো- কৃত্তিবাসের ‘রামায়ণ’ আর কাশীদাসী ‘মহাভারত’। ধর্মগ্রন্থ মনে করেই রাখত বাবা ওই বই দুটোকে। প্রায় প্রতি সন্ধ্যায় ধোয়া কাপড় পরে পবিত্রমনে ‘রামায়ণ’ অথবা ‘মহাভারত’ পড়ত। পড়ত আর নিজের ভাষায় অনুবাদ করত। বাবার কাছে শুনে শুনে রামায়ণ-মহাভারতের কাহিনী আমার মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল সেই ছোটবেলায়। তারপর যখন পড়তে শিখলাম, পড়ে বুঝতে শিখলাম, ও দুটো আমার নিত্য পাঠ্য হয়ে গেল। আরেকটা বই রাখত ঘটে। সে রামসুন্দর বসাকের আদি বাল্যশিক্ষা। বড়ই মান্য করত বাবা বইটিকে। সময় পেলেই বাল্যশিক্ষা পড়ত বাবা। বলত, এখানে আমাদের দেননি জীবনের সব কথা আছে। সৎভাবে বেঁচে থাকার অনেক পরামর্শ আছে। বাল্যশিক্ষায়। তারপর বাবা বলত, এই বইটিতেই আছে- ভাবনা যত যাতনা তত, বয়ঃ বাড়ে পয় ছাড়ে। আমিও বাবার মতো ‘বাল্যশিক্ষা’কে নিত্যসঙ্গী করে রেখেছি, এখনো। এরপর তো যখন যা পেতাম, গো-গ্রামে গিলতাম। তখন আমি এইটে কি নাইনে পড়ি। বাবা মাছ ধরা থামিয়ে দিয়ে চাকরি নিল। চিটাগাং স্টিল মিলে সুইপারের চাকরি। ১৯৬৫/৬৭-এর দিকে জাপানি ইঞ্জিনিয়াররা স্টিল মিলের দেখভাল করত। বাবা ওদের গু-মুত পরিষ্কার করত।
একদিন এক জাপানি যুধিষ্ঠিরের পরিবারটি দেখতে চাইলেন। বাবা আমাদের বাড়িতে নিয়ে এলো তাকে। ভাঙা ভাঙা ইংরেজি বাংলা মিশিয়ে কথা বলেন তিনি। যুধিষ্ঠিরের জীর্ণ পরিবার, তার অর্ধনগ্ন শীর্ণদেহের সন্তানদের দেখে জাপানিটির ভাবান্তর হলো যেন। তিনি আমার প্রতি বেশ কৌতূহলী হয়ে উঠলেন। আমাকে কিছু দিতে চাইলেন তিনি। গরিব পরিবারের ছেলে আমি। টাকা-পয়সা চাওয়াই তো আমার কর্তব্য। তা কিন্তু আমি চাইলাম না। চেয়ে বসলাম বই। বললাম- বই পড়তে আমার খুব ভালো লাগে। আপনি আমাকে বই কিনে দিন। বাবা সেদিন খুব মিষ্টি একটা হাসি হেসেছিল। গাড়িতে করে জাপানিটি আমাকে চট্টগ্রাম শহরে নিয়ে এসেছিলেন। নীহাররঞ্জন গুপ্তের ‘কিরীটি অমনিবাস’ই কিনেছিলাম সেদিন। তো ছোটবেলাকার এ-ই আমার বইস্মৃতি।
পড়তাম বটে, যা পাই তা-ই পড়তাম। লিখবার চিন্তা করিনি কখনো। পেরিয়ে গেল দীর্ঘ বছরগুলো। লেকচারার থেকে অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর হলাম। ঠাকুমা মারা গেছে, বাবা মারা গেছে। মায়ের চারদিকে পুত্র, পুত্রবধূ আর নাতি-নাতনিদের ছড়াছড়ি। বেতনও বেড়েছে আমার। ’৯১-র বন্যার পরে মাও মারা গেল লিভার সিরোসিসে। ভাইদের মধ্যে স্বার্থপরতা মাথাচাড়া দিল। এক বিকালে নিজ বাসভূমি উত্তর পতেঙ্গা ছাড়তে বাধ্য হলাম আমি। চলে এলাম চট্টগ্রাম শহরে। পুত্রকন্যা স্ত্রী নিয়ে উঠলাম পাথরঘাটার সিরাজ বিল্ডিং-এ। বছর চার-পাঁচ পরে এলাম নুরজাহান ভবনে। পাঁচতলা বিল্ডিংয়ের নিচ তলায় থাকি। দুটো বেড রুম, গোটা তিনেক জানালা। ছেলেমেয়েদের ভালো রুমটায় থাকতে দিলাম। আমাদের থাকতে হলো বাড়িওয়ালার সার্ভেন্টদের খোলা পায়খানার পাশের রুমটিতে। তা যাই হোক শহরে তো থাকছি। পড়ি আর লেকচার দিই।
২০০৩-এর দিকে আমি পড়াচ্ছি চট্টগ্রাম সরকারি মহিলা কলেজে। বিভাগে নয়জন শিক্ষক-শিক্ষিকা। শিক্ষিকার সংখ্যা বেশি। বিভাগীয় চেয়ারম্যান ড. দিল আফরোজ বেগম। দোর্দণ্ড প্রতাপী, দম্ভান্ধ তিনি। পিএইচডির অহংকারে মাটিতে পা পড়ে না তার। ছাত্রীদের সঙ্গে সাংঘাতিক দুর্ব্যবহার করেন। একদিন এম.এ ক্লাসে ছাত্রীদের ডেড হর্সেস ডেকে বসলেন তিনি। মেয়েরা বেশ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠল। আমি তাকে বললাম, ‘আপনি ঠিক বলেননি ম্যাডাম। এভাবে আপনার বলা উচিত হয়নি।’
গর্জে উঠলেন তিনি, ‘কোনটা উচিত আর কোনটা অনুচিত তা তোমার কাছ থেকে শুনতে হবে আমায়?’
এরপর আমার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করলেন তিনি। অপমানের ভয়ে আমি তার সামনে যাই না। ক্লাস করে অন্য বিভাগে বসে থাকি। এভাবে কেটে গেল অনেকটা দিন। একদিন বিভাগের ম্যাডাম তাহমিনা আক্তার নূর আমাকে বললেন, ‘দাদা, আর সহ্য করতে পারছি না।’
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী সহ্য করতে পারছেন না?’
উনি বললেন, ‘অপমান।’
আমি বললাম, ‘কী, অপমান? কার অপমান?’
তাহমিনা বললেন, ‘আপনার অপমান।’
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমার অপমান!’
‘হ্যাঁ, আপনার অপমান। আপনার অবর্তমানে দিল আফরোজ ম্যাডাম আপনাকে ‘জাইল্যার পোলা’ বলে গালি দেন। অনেক দিন সহ্য করেছি। আজ সহ্যের সীমা পেরিয়ে গেছে বলে আপনাকে বললাম।’ বলে তাহমিনা দ্রুত সে স্থান ত্যাগ করলেন। হয়তো সেদিন তিনি আমার কান্নাটা দেখতে চাননি বলে দ্রুত স্থানান্তরে গিয়েছিলেন।
বাঙালি সমাজে জাইল্যার পোলা, হাইল্যার পোলা, মেথরের বাইচ্যা গালিই তো। তো এই গালি শুনে শুনে সেদিন আমি কিন্তু কাঁদিনি বা দিল আফরোজের ওপর ফেটেও পড়িনি। বরং গভীর একটা ভাবনায় জড়িয়ে গেছি আমি। সত্যিই কি আমি গালিগালাজের যোগ্য? সত্যিই কি আমার বংশধারায় চোর-বাটপাড়-খুনি-বেশ্যা-লুচ্চা-ঋণখেলাপি আছে? যদি না থাকে তাহলে জাত তুলে গালি কেন? বরং জলদাস বংশকে সালাম জানানোই তো উচিত ছিল আফরোজের। কারণ এই বংশধারায় জন্মেছেন কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাস, বিব্যোক, অদ্বৈত মল্লবর্মণ, বিনয়বাঁশী, পবিত্র সরকার এরা। ভাবতে ভাবতে একদিন আমার খুব ইচ্ছে জাগল কৈবর্তদের বিকাশ-বিস্তার সম্পর্কে জানতে। তার জন্য চাই সুশৃঙ্খল গবেষণা। প্রফেসর ময়ুখ চৌধুরীকে অনুনয়-বিনয় করে রাজি করালাম আমার গাইড হতে। তিনি বিষয় ঠিক করে দিলেন- ‘নদীভিত্তিক বাংলা উপন্যাস ও কৈবর্ত জনজীবন।’ রাগের মাথায় তো গবেষণাকর্মটি আরম্ভ করলাম, কিন্তু শুরু করে বুঝলাম- কত ধানে কত চাল। এ গভীর বিষণ্নতা আর বিপন্নতা পেয়ে বসল আমায়। কিন্তু যেই না কাজটি ছেড়ে দেব ভাবি, অমনি দিল আফরোজের তর্জনীটা আমার নাকের ডগার সামনে এগিয়ে আসে। আমি শুনতে পাই দিল আফরোজের কর্কশ কণ্ঠের গালি- জাইল্যার পোলা। সাতচল্লিশ বছরের হরিশংকর আবার সচকিত হয়। পড়তে থাকে জেলেজীবন সংক্রান্ত উপন্যাসগুলো।
‘পদ্মা নদীর মাঝি’, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, ‘গঙ্গা’, ‘গহিন গাঙ’, ‘অবগাহন’- এসব উপন্যাস পড়তে পড়তে মনে হলো- আরে, এ-তো আমার জীবনের কথা, আমাদেরই সমাজের কাহিনী। এর সবকিছু তো আমার জানা, আমার দেখা! আমার ভেতরটা কী রকম কী রকম করতে লাগল। ভেতর থেকে কে যেন বলে উঠল, ‘তুমি যা ভাবছো, তা তো ঠিকই। তোমাদেরই তো কথা এগুলো। লেখো না তুমি, লেখো। পারবে তুমি। তোমার জীবনের কথাই তো লিখবে।’ ভাবলাম- জেলেদের কথা তো অনেকেই লিখেছেন। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, অদ্বৈত মল্লবর্মণ, সমরেশ বসু, সাধন চট্টোপাধ্যায়, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, ঘনশ্যাম চৌধুরী- এরা তো লিখেই গেছেন কৈবর্তদের কথা।
আমার ভেতরটা আবার কথা বলে উঠল, ‘ওরা তো লিখেছেন নদীপারের জেলেদের নিয়ে। তুমি তো লিখবে সমুদ্র পাড়ের জেলেদের নিয়ে। এদের নিয়ে আগে কেউ লিখেননি। তুমি যদি লিখো, তাহলে তুমিই হবে প্রথম জেলে, যে সমুদ্র পাড়ের জেলেদের নিয়ে লিখল।
এক রাতের দুটোর সময় লিখলাম ‘জলপুত্রে’র প্রথম লাইনটি। তারপর পাণ্ডুলিপি ‘যুগান্তরের পরীক্ষায় প্রথম হলো। ঈদ সংখ্যায় ছাপানো হলো। তারপর ২০০৮ সালে মাওলা ব্রাদার্স থেকে ছাপানো হলো। তারপর আলাওল সাহিত্য পুরস্কার পাঠকপ্রিয়তা, সপ্তম মুদ্রণ- এসব। গবেষণার কাজটি শেষ করেছিলাম আমি। কিন্তু এই ‘জলপুত্র’ আমার জীবনের ধরা পালটে দিল। মানুষের কাছে আমি পরিচিত হয়ে উঠতে লাগলাম কথাসাহিত্যিক হিসেবে। ‘জলপুত্রে’র পর ‘দহনকাল’, কসবি, মোহনা, রামগোলাম, ‘এখন তুমি কেমন আছ’, ‘প্রতিদ্ব›দ্বী’, ‘একলব্য’ পরপর বছরগুলোতে প্রকাশিত হতে লাগল।
এখন আমার অধ্যক্ষ পরিচয় লুপ্ত হয়ে গেছে। লেখক সত্তার কাছে শিক্ষক সত্তা বিলীন হয়ে গেছে বললেই চলে। যে হরিশংকর একদিন মহিউদ্দীন, টিপু সুলতানকে ধমক দিয়ে তাড়িয়ে ছিল, সেই হরিশংকর নাকি এখন সাহিত্যিক, কথাসাহিত্যিক।
ড. দিল আফরোজ বেগমের অপমান আমাকে লেখক বানিয়েছে। অমানিত হওয়ার কারণে কেউ যে লেখক হয়ে ওঠে, তার প্রধান উদাহরণ তো আমিই। এখন প্রশ্ন হতে পারে ওই ধরনের অপমানের হাত থেকে আমি কি এখন মুক্ত? অপ্রিয় হলেও আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি- না। মোটেই না। দিল আফরোজের অপমান আরও গাঢ় হয়ে এখনো আমাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। নইলে কেন এই সেদিন এক সমালোচক ঢাকার এক ম্যাগাজিনে ‘জলপুত্রে’র সমালোচনা লিখতে গিয়ে আমাকে জাতপাতের খোঁচা দিল। ওখানেই থামল না সেই সমালোচক। বলল- হরিশংকর মাছধরা থেকে অধ্যাপনায় এসেছে। অধ্যাপনায় এলো এলো, লিখতে এলো কেন? লিখতেই বা যদি এলো হাত পাকিয়ে এলো না কেন?
তো এইভাবেই বুক ঘষে ঘষে আমার জীবনের পথ ফুরানো। জেলের ঘরে জন্মানোর অপরাধে বংশপরম্পরায় অপমানিত হয়ে এসেছি আমরা। একটু লেখাপড়া করার পরও একটা দুইটা বই লেখার পরও নিচুজাতে জন্মানোর অপরাধ থেকে মুক্তি পেলাম না আমি।
আমার বাড়িটার নাম দিয়েছি- ‘জলপুত্র’। ওই ‘জলপুত্রে’ বাস করতে করতে এই আশায় বুক বাঁধি যে, একদিন কৈর্বতসমাজ ভদ্দরলোকদের গালিগালাজ থেকে রেহাই পাবে। আমরা মাথা উঁচু করে বলতে পারব- আমরা অপাঙ্ক্তেয় নই, আমরা নিচু জাত নই। আমাদের সম্প্রদায়ে আরেকজন ব্যাসদেব জন্মাবেন, আরেকজন অদ্বৈত মল্লবর্মণ জন্মাবেন। যাদের ঔজ্জ্বল্যে ঐশ্বর্যে কৈর্বতজাতিটা আরেকটু কোমর সোজা করে দাঁড়াতে পারবে।
আমি সুখে লিখতে আসিনি, দুঃখে লিখতে এসেছি; আনন্দে লিখতে আসিনি, অপমানে লিখতে এসেছি। আত্মতৃপ্তি পাওয়ার জন্য কলম ধরিনি, অপমানের জবাব দেয়ার জন্য কলম হাতে তুলে নিয়েছি। আরেকটা কারণে লিখি আমি। তা হলো এখন জেলেদের নিয়ে কেউ লিখে না বলে লিখি। অনেকে মিলে যেদিন জলদাসদের নিয়ে লিখতে বসবেন, সেদিন কলম ধুয়ে তোরঙ্গে তুলে রাখব আমি।

হরিশংকর জলদাস
কথাসাহিত্যিক

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়