যৌতুকের জন্য স্ত্রী হত্যার মামলায় স্বামীর মৃত্যুদণ্ড

আগের সংবাদ

বিদেশিদের নজর ঢাকার দিকে : ব্যস্ত সময় পার করলেন ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কোরিয়ার শীর্ষ কূটনীতিকরা

পরের সংবাদ

মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিকথা : নতুন প্রজন্মকে জানতে হবে

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

মুক্তিযুদ্ধের মহান বিজয়, বীর বাঙালির অহংকার। ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর, ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে যে চূড়ান্ত বিজয়ের গৌরব বাঙালি অর্জন করে তা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। দফারফা ও সমঝোতায় স্বাধীন দেশ পৃথিবীতে অনেক আছে, কিন্তু মরণপণ লড়াই করে লাখো শহীদের রক্ত ও সম্ভ্রমের বিনিময়ে শত্রæসেনাকে পরাজিত বিজয় অর্জনের গৌরব সবার নেই। যারা মরণপণ লড়াই করে এদেশের স্বাধীনতার সূর্যকে ছিনিয়ে এনেছিল, তাদের অধিকাংশই সময়ের আবাহনে অন্যলোকে পাড়ি জমিয়েছে। যারা এখনো জীবিত, তারাও এখন বয়ঃবৃদ্ধ হয়ে মৃত্যুর মিছিলে শামিল হচ্ছে একের পর এক। আর এক থেকে দেড় দশক পর হয়তো আর কোনো মুক্তিযোদ্ধা বেঁচে নাও থাকতে পারেন। আমাদের উচিত জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিকথাগুলো আরো গুরুত্বের সঙ্গে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা। এ ব্যাপারে সংবাদ মাধ্যমগুলো সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখতে পারে। এতে প্রজন্ম মুক্তিযোদ্ধাদের চিনতে পারবে, জানতে পারবে এবং মুক্তিযোদ্ধারাও এতে সম্মানিত হবেন, স্বস্তি পাবেন। আমরা জানি, ১৯৭৫-এর পর স্বাধীনতার মহান স্থপতি বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর স্বাধীনতার পরাজিত শত্রæর দোসররা রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। তারা দীর্ঘ ২১ বছর ধরে ক্ষমতায় থেকে বাংলাদেশের অভ্যুদয়, মুক্তি সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস থেকে জাতিকে দূরে সরিয়ে রেখে একটি প্রজন্মকে মৌলবাদী ভাবধারার গড়ে তুলতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছে। পুরোপুরি সফল না হলেও দীর্ঘ সময়ের সুযোগে এ ক্ষেত্রে তারা অনেকটাই সফল। ১৯৪৭ সালে ইংরেজ দুঃশাসকরা ভারতবর্ষ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল বটে, তাদের শাসনকালে আমাদেরকে দুর্বল করে রাখার কৌশল হিসেবে আমাদের মাঝে বারবার মৌলবাদকে উসকে দিয়ে যে বিভাজন রেখা টেনে রেখেছিল, ভারত ছাড়ার সময় তারা আরো গভীরে প্রোথিত করে দিয়ে গেছে। মাঝখানে হিন্দু অধ্যুষিত বিশাল ভূখণ্ডকে ভারত ও এর পূর্ব ও পশ্চিমের মুসলিম অধ্যুষিত দুটি অঞ্চলকে পাকিস্তান নামকরণ করে দুটি পৃথক রাষ্ট্র তারা সৃষ্টি করে দিয়ে যায়। প্রায় ১২০০ মাইল দূরত্বের দুটি পৃথক অংশকে একটি রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করা করা হয় শুধু এ দুই অংশের অধিকাংশ মানুষের ধর্মীয় সম্প্রদায়গত মিলের কারণে। শারীরিক অবয়ব, রুচি, খাদ্যাভ্যাস, ভাষা, সংস্কৃতি, প্রথা, ঐতিহ্য কোন দিক থেকেই এ দুই অংশের মানুষের মধ্যে কোনো প্রকার মিলই সেখানে ছিল না। কেবলমাত্র সাম্প্রদায়িক চিন্তাপ্রসূত পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান যে এক থাকতে পারবে না তার বহিঃপ্রকাশ হয় জন্মের পর পরই। পশ্চিমারা পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলার মানুষকে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক ভাবতে শুরু করে। নতুন দেশের ডাকটিকেট, মুদ্রা, মানি-অর্ডার বা টাকা পাঠানোর ফর্ম, ট্রেনের টিকেট, পোস্টকার্ড-সবগুলোতে শুধু উর্দু ও ইংরেজি ব্যবহৃত হচ্ছে। কোনো কিছুতেই বাংলাকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছিল না। সরকারি নিয়োগের পরীক্ষা নেয়া হচ্ছে উর্দূ ও ইংরেজিতে। পুলিশ, সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীতে প্রাধান্য পেতে লাগল অবাঙালিরাই। পূর্ব পাকিস্তানে কর্মরত পশ্চিম পাকিস্তানিদের দ্বারা বাঙালি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা প্রতিনিয়ত নিগ্রহের শিকার হচ্ছে দেখে ঢাকায় প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ মিছিল সমাবেশ করেছে ছাত্র ও বুদ্ধিজীবীরা। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখনো টগবগে যুবক। প্রতিবাদ কর্মসূচিতে তার ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন ছাত্রলীগ। এর দুমাস পর পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ৯ দিনের সফরে ঢাকায় আসেন। মার্চ মাসের ২১ তারিখে রমনার রেসকোর্স ময়দান তথা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের এক জনসভায় জিন্নাহ্ স্পষ্ট ঘোষণা দিলেন, ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু এবং অন্য কোনো ভাষা নয়। কেউ যদি আপনাদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে তাহলে সে আসলে পাকিস্তানের শত্রæ।’ এর কয়েক দিন পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে ছাত্রদের সামনে আরো একটি ভাষণ দিলেন তিনি। সেখানেও একই কথা বললেন। প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধুসহ কয়েকজন ছাত্র ‘না না’ চিৎকার করে প্রতিবাদ করলে জিন্নাহ্ অনেকটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। মিনিট খানেক চুপ থেকে তিনি আরেকটু কৌশলী হয়ে বললেন, পাকিস্তানের প্রদেশগুলো নিজেদের সরকারি কাজে যে কোনো ভাষা ব্যবহার করতে পারে- তবে রাষ্ট্রীয় ভাষা হবে একটিই এবং তা হবে উর্দু। সেদিনের সে ভাষণের পর ছাত্রলীগের নেতকর্মীরাসহ একদল ছাত্র জিন্নাহর সঙ্গে দেখা করেন। তারা বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি সম্বলিত স্মারকলিপি প্রদান করে। সেখানে তারা কানাডা, বেলজিয়াম ও সুইজারল্যান্ডের মতো একাধিক রাষ্ট্রভাষা আছে এমন কিছু দেশের উদাহরণ উল্লেখ করে। পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা বাংলা হওয়া সত্ত্বেও সরকার বাংলার ছাত্র ও বুদ্ধিজীবীদের দাবিকে অগ্রাহ্য করে। ১৯৫২ সালে খাজা নাজিম উদ্দিন পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধানমন্ত্রীর পদে অধিষ্ঠিত হয়ে তার এক বক্তৃতায় আবারো পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা উর্দুই হবে- এ কথা উল্লেখ করলে বিক্ষোভে ফুঁসে ওঠে বাংলার ছাত্র-যুব-জনতা।
রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলন তীব্রতা পেলে সরকার তা কঠোর পথে হাঁটে, ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষার দাবিতে আন্দোলনরত ছাত্ররা সরকারের জারিকৃত ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করতে মিছিল বের করলে নির্বিচারে গুলি চালায় পুলিশ, শহীদ হন রফিক, শফিক, সালাম, বরকত, জব্বার। এতেই হয়তো বাঙালির তাদের আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠার তাগিদ অনুভব করলেন শেখ মুজিবর রহমান। ’৫৪-র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ’৬২-র শিক্ষা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় বাংলার মানুষকে অধিকার সচেতন করে তোলার প্রয়াস নেন তিনি। এভাবে তিনি ১৯৬৬ সালে ঐতিহাসিক ৬ দফা ঘোষণা করেন এবং স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন এগিয়ে নিতে থাকেন। ছাত্র সমাজের ১১ দফা ও আওয়ামী লীগ তথা শেখ মুজিবের ৬ দফার ভিত্তিতে চলমান আন্দোলন চূড়ান্ত পরিণতি হিসেবে ১৯৬৯ সালে গণ-অভ্যুত্থানের রূপ লাভ করে, পুলিশের গুলিতে শহীদ হন আসাদ। বাংলার হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সবার মধ্যে বাঙালি জাতীয়তাবোধ সুদৃঢ় হয় এবং শেখ মুজিব হয়ে ওঠেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আওয়ামী লীগের আলোচনা সভায় বঙ্গবন্ধু পূর্ব বাংলার নামকরণ করেন ‘বাংলাদেশ’। তিনি বলেন, ‘এক সময় এদেশের বুক হইতে, মানচিত্রের পৃষ্ঠা হইতে ‘বাংলা’ কথাটির সর্বশেষ চিহ্নটুকু চিরতরে মুছিয়া ফেলার চেষ্টা করা হইয়াছে। একমাত্র ‘বঙ্গোপসাগর’ ছাড়া আর কোনো কিছুর নামের সঙ্গে ‘বাংলা’ কথাটির অস্তিত্ব খুঁজিয়া পাওয়া যায় নাই। জনগণের পক্ষ হইতে আমি ঘোষণা করিতেছি আজ হইতে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশটির নাম ‘পূর্ব পাকিস্তান’ এর পরিবর্তে শুধুমাত্র ‘বাংলাদেশ’ হবে।’
এইদিন তিনি সুকৌশলে বাংলার মানুষের কাছে তাদের পূর্ণ স্বাধীনতার সংগ্রামের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণের বার্তাটিই পৌঁছে দিয়েছিলেন।
বাঙালি জাতীয়তাবোধে জাগ্রত জনতা ১৯৭০ সালের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে ১৬৯ আসনের মধ্যে ১৬৭ আসনে নৌকা প্রতীকে ভোট দিয়ে আওয়ামী লীগকে নিরঙ্কুশভাবে বিজয়ী। এ বিজয়ের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ বাঙালির স্বাধিকারের ব্যাপারে জনগণের মেন্ডেট লাভ করে। কিন্তু পাকিস্তানিরা নির্বাচিত বাঙালির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি শুরু করে দেয়, পরিষদ অধিবেশনের তারিখ দিয়েও বার বার পিছুতে থাকে তৎকালীন ইয়াহিয়া সরকার। ফলে সারাদেশে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে, আসে ৭১-এর ৭ মার্চ। রমনার রেসকোর্সে বঙ্গবন্ধু রাখেন তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণ। তিনি ভাষণে বলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এ ভাষণে অনেক দিকনির্দেশনা ছিল, যা বাঙালিকে সশস্ত্র সংগ্রাম ও প্রতিরোধ যুদ্ধের জন্য চূড়ান্ত প্রস্তুতি গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করে। বঙ্গবন্ধু মূলতঃ এই ভাষণেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন। শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। পাকিস্তানি সরকার আলোচনার কথা বলে গোপনে বাঙালি নিধনের হীন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। ২৫ মার্চ রাতে অপারেশন সার্চলাইটের নামে নিরস্ত্র, ঘুমন্ত ও নিরহ বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, নির্বিচারে গুলি করে গণহত্যা চালিয়ে, বাড়ি ঘরে আগুন দিয়ে ও লুটপাট করে বিভীষিকাময় নারকীয় তাণ্ডবে মেতে ওঠে। ওই রাতেই অর্থাৎ ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। ঘোষণায় তিনি বলেন, ‘এই-ই হয়তো আপনাদের জন্য আমার শেষ বাণী হতে পারে।’ আজকে থেকে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ। আমি আপনাদের আহ্বান জানাচ্ছি- যে যেখানেই থাকুন, যে অবস্থাতেই থাকুন এবং হাতে যার যা আছে তাই নিয়ে দখলদার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলুন। ততদিন পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যান- য‘তদিন না দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর শেষ সৈনিকটি বাংলাদেশের মাটি থেকে বহিষ্কৃত হচ্ছে এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হচ্ছে।’ ঘোষণাটি তৎকালীন ইপিআর টান্সমিশনের মাধ্যমে সারাদেশে প্রচারিত হয় এবং আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। স্বাধীনতা ঘোষণার পরপরই পাকিস্তানি সৈন্যরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে করাচীতে নিয়ে যায়।
শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। বাংলার ছাত্র, যুবক, তরুণ, কিশোর, কৃষক, শ্রমিক, জনতা দলে দলে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে শুরু করে। ১৯৬৬ সাল থেকেই আমি বঙ্গবন্ধুর ডাকে চলমান সকল আন্দোলন সংগ্রামে অংশ নিতে থাকি। আমি ছিলাম সরকারি চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্র। ১৯৬৯ সালে আমি কলেজ ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হই এবং ১৯৭০-৭১ সালে আমি চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছিলাম। রক্তে আগুন ধরা মুক্তির নেশায় আমিও যুদ্ধে যাই, অস্ত্র চালনা প্রশিক্ষণ নিই এবং বিএলএফের ১নং সেক্টরের অধীনে চট্টগ্রাম শহরের পাঁচলাইশ ও কোতোয়ালি এলাকায় গেরিলা অপারেশনে সরাসরি অংশ নিই। দিনে দিনে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিসেনার সংখ্যা বাড়তে থাকে। দেশের সব স্থানে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী গেরিলা আক্রমণ ও সশস্ত্র প্রতিরোধের মুখে পড়ে বিপর্যস্ত হতে থাকে। এক পর্যায়ে ১৯৭১ সালের ২১ নভেম্বর বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সেনাবাহিনী নিয়ে যৌথবাহিনী গঠিত হয়। মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্র বাহিনীর মুহুর্মুহু আক্রমণের সামনে টিকতে না পেরে ১৬ ডিসেম্বর পাক হানাদাররা আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়, অর্জিত হয় গৌরবময় বিজয়। বাঙালির এ গৌরবের বিজয়ের কাঁটা হয়ে ছিল এদেশীয় কিছু পাকিস্তানের দালাল, রাজাকার, আলবদর, আলশামস। মুসলিম লীগ ও জামায়াত ইসলামী শান্তি কমিটি গঠন করে এবং রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনী গঠন করে পাকিস্তানিদের সহায়তা করে। তারা পাকিস্তানি হানাদারদের নিয়ে কী নির্মম বীভৎসতায় মেতে উঠেছিল, কীভাবে আমাদের মা বোনেদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন করেছিল, আগুন লাগিয়ে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়ে লুটপাট করেছিল, কীভাবে হাত-মুখ-চোখ বেঁধে স্বাধীনতার সপক্ষের লোকদের ধরে নিয়ে লাইনে দাঁড় করিয়ে পাখির মতো গুলি করে মেরেছিল- তা বর্তমান প্রজন্ম চিন্তাও করতে পারবে না। আমরা বিজয় দেখেছি, বিজয় এনেছি। আমরা এও দেখেছি আড়াই লাখ শহীদের আত্মবলিদান ও সমুদ্রসম রক্ত। আমরা দেখেছি সন্তান হারা মা ও সম্ভ্রম হারা বোনের আর্তনাদ। আমরা দেখেছি লাশের স্তূপ, পানিতে ভাসতে দেখেছি একমুঠো মাটি কিংবা আগুনের পরশ না পাওয়া ফুলে ফেঁপে ওঠা শহীদ বাঙালির লাশ। একাত্তরে যারা পাকিস্তানিদের দোসর হয়ে বাঙালির ওপর এমন বীভৎসতা চালিয়েছিল তারা পরাজিত হলেও, পরাজয়ের পূর্ব মুহূর্তে বাঙালিকে মেধাশূন্য করে দিতে ১০ থেকে ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবীদের ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করেছিল যাতে স্বল্প সময়ের মধ্যে বাংলাদেশকে পুনরায় পাকিস্তানি ভাবধারায় ফিরিয়ে নেয়া যায়। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পড়ে পাকিস্তানের কারাগারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে না পেরে স্বাধীনতার পর নতুন ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে পরাজিত শত্রæরা ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে, ৪ নভেম্বর কারাগারের ভেতরে জাতীয় ৪ নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজ উদ্দিন আহমদ, এ এইচ এম কামরুজ্জান, ক্যাপ্টেন মনসুর আলীকে হত্যা করে এবং হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা সেনা অফিসারদের হত্যা করে স্বাধীন বাংলাদেশকে নেতৃত্বহীন অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করার অপচেষ্টা চালিয়েছে। স্বাধীনতার শত্রæরা এখনো সাম্প্রদায়িকতা মোড়কে থেকে অদম্য বাংলাদেশকে থামিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা নতুন প্রজন্মকে ধর্মের অপব্যবহার করে বিভ্রান্ত করার ষড়যন্ত্র প্রতিনিয়ত করে যাচ্ছে। আমাদের তাদের ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে, আমাদের সন্তানরা যাতে কোনো দেশবিরোধী চক্রের খপ্পরে না পড়ে। সব ষড়যন্ত্রকে প্রতিহত করে জাতির জনকের কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অবিচল থাকতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের সব শক্তিকে স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। তাহলেই যে সোনার বাংলার স্বপ্ন নিয়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মহান মুক্তিযোদ্ধারা প্রাণপণ লড়াই করে এদেশের স্বাধীনতা এনেছিলাম- সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন হবে। এই দেশ হবে বিশ্বের অন্যতম উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ।
সবাইকে মুক্তিযুদ্ধের মহান বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। সবাই সুস্থ থাকুন, নিরাপদে থাকুন।
জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু
জয়তু শেখ হাসিনা, বাংলাদেশ চিরজীবী হোক।

মো. রেজাউল করিম চৌধুরী
মেয়র, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়