যৌতুকের জন্য স্ত্রী হত্যার মামলায় স্বামীর মৃত্যুদণ্ড

আগের সংবাদ

বিদেশিদের নজর ঢাকার দিকে : ব্যস্ত সময় পার করলেন ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কোরিয়ার শীর্ষ কূটনীতিকরা

পরের সংবাদ

শিক্ষকের দায় ও দায়িত্ব

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

শিক্ষকতার কাজটা কখনোই একপক্ষীয় নয়। শিক্ষক কেবল যে দেনই- তা নয়, তিনি পানও। যা তিনি পেয়ে থাকেন, তা সামান্য নয়। তিনি পান তারুণ্যের প্রবহমান সংস্পর্শ। এই সংস্পর্শ শিক্ষককে সজীব রাখে। শিক্ষার্থীরা চ্যালেঞ্জ নিয়েও আসে; সে চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে গিয়ে শিক্ষক তার নিজের জ্ঞানের সঞ্চয়কে এবং বিতরণের কৌশলকে উন্নত করতে পারেন। সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি অবশ্য চরিতার্থতা। শিক্ষার্থীরা শিক্ষা গ্রহণ করছে, গ্রহণ করে উদ্দীপ্ত ও সমৃদ্ধ হচ্ছে- এই উপলব্ধি শিক্ষককে চরিতার্থতা দেয়। এমন চরিতার্থতা অন্য কোনো পেশা থেকে পাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু প্রাপ্তিটা নির্ভর করে সমাজে শিক্ষার মূল্যের এবং শিক্ষককে সম্মান দানের আগ্রহের ওপর। যে সমাজ শিক্ষককে দীনহীন ও করুণার পাত্র করে রাখে, বুঝতে হবে তার নিজের মেরুদণ্ড শক্ত তো নয়ই, শক্ত যে হবে তারও আশা নেই।
সন্তানের কাছে পিতামাতা আদর্শ মানুষ হতে পারেন, হতে পারেন গর্বের বস্তু, কিন্তু শিক্ষার্থীর কাছে শিক্ষক একজন বীর। কারণ একাধিক। শিক্ষার্থী দেখে শিক্ষককে শিক্ষার্থীরা সবাই শ্রদ্ধা করে, সে শ্রদ্ধায় ভীতির কিছুটা সংমিশ্রণ যে থাকে না তা নয়। পিতামাতার সান্নিধ্য প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতা, দিনানুদৈনিকতা ও সাংসারিকতার চাপে, ব্যস্ততা ও দ্ব›েদ্বর কারণে তারা সন্তানের কাছে এমনকি আদর্শ হলেও বীর হতে অসমর্থ হন। বীরের পক্ষে নিকটের হয়েও দূরবর্তী হওয়া চাই এবং পারিবারিক নিত্যব্যবহার্য সম্পত্তিতে পরিণত হওয়াটা বীর ও বীরত্বের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর বটে। তরুণদের জন্য বীর অত্যাবশ্যক; তারা বীর চায়; বীরত্বের খোঁজ শিক্ষকদের ভেতর পাবে বলে আশা করে, না পেলে দমে যায়। সমাজের সব ক্ষেত্রেই আস্থাভাজন বহু বীরের প্রয়োজন; বীর না থাকলে ফাঁকফোকর দিয়ে স্বৈরাচারী দৈত্যদানব দুর্বৃত্তের প্রাদুর্ভাব ঘটে। বিকেন্দ্রীকরণের পরিবর্তে ক্ষমতা তখন কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ে এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক বিপদ ঘটিয়ে ছাড়ে। বীরের অপর নাম বুঝি দৃষ্টান্ত, কিন্তু দৃষ্টান্ত বললে ভাবমূর্তির সবটা বোঝানো যায় না, অসম্পূর্ণ রয়ে যায়।
শিক্ষকের সাফল্য তার ওই ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ন রাখার ওপর অনেকটা নির্ভরশীল। সে জন্য শিক্ষকের নিত্যসহচর হওয়া চাই দায়িত্ববোধ ও কর্তব্য জ্ঞান। অমনোযোগ, উদাসীনতা, পক্ষপাত, রূঢ়তা শিক্ষার্থীরা প্রত্যাশা করে না এবং ওই সবের উৎপাত শিক্ষার্থীদের সংবেদনশীল হৃদয়ে তৎক্ষণাৎ ধরা পড়ে। পক্ষপাতিত্ব খুবই দুঃসহ। সর্বাধিক ভীতিকর ও স্থায়ী ক্ষতির কারণ হচ্ছে নিষ্ঠুরতা। নিষ্ঠুরতার প্রকাশ নানাভাবে ঘটে। জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে, শিক্ষকেরা নিষ্ঠুর আচরণ করেন। সেটা দেহভঙ্গি, শব্দব্যবহার, শাস্তিদান- নানাভাবেই ঘটে থাকে। হয়তো ভুল বোঝেন, হতে পারে শিক্ষার্থীর ব্যর্থতা দেখে মেজাজ ঠিক রাখতে পারেন না; এমনও সম্ভব যে প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা বা অন্যসহকর্মীদের সঙ্গে দ্ব›দ্ব থাকে, সাংসারিক ঝামেলা যে থাকে না এমনও নয়। শিক্ষক আত্মবিজয়ী সন্ন্যাসী নন; তিনিও একজন সাংসারিক মানুষই; রাগ, বিরক্তি, অনুরাগ, ভ্রান্তি তার থাকতেই পারে, থাকেও; কিন্তু তার কাছ থেকে শিক্ষার্থীরা আশা করে এমন ধৈর্য ও সহনশীলতা যেমনটা তারা গৃহেও পায় না।
দৃষ্টান্ত আমরা প্রত্যেকেই দিতে পারব। আমার তহবিলেও আছে। একটির কথা বহুযুগ পরেও ভুলতে পারিনি। আমি তখন রাজশাহী লোকনাথ স্কুলের ছাত্র। পড়ি ক্লাস সেভেনে। আমার সঙ্গে খুব বন্ধুত্ব ছিল একটি ছেলের। ক্লাসে আমরা পাশাপাশি বসতাম। ওর ছিল সুন্দর একটি ব্যাগ, তাতে বই ও খাতাপত্র রাখত। ক্লাসের আর কেউ ব্যাগ আনত কিনা জানি ও আনত। একদিন টিফিন পিরিয়ডে দু’বন্ধু বাইরে গেছি, কিছু একটা কিনে খেয়েছিও ভাগাভাগি করে। ফিরে এসে ক্লাসে বসেছি। শিক্ষকের নাম মনে নেই। কি যে পড়াতেন তাও ভুলে গেছি। চেহারাটাও অস্পষ্ট হয়ে গেছে এতদিনে। কিন্তু তার কাজটা মনে আছে। নিয়ম ছিল তার ক্লাসে পাঠ্যবই নিয়ে আসতে হবে। আমরাও এনেছি। এমন সময় আমাদের দু’জনের ঠিক পেছনের বেঞ্চে বসা একটি ছেলে হইচই করে উঠল। তার বই পাওয়া যাচ্ছে না। চুরি গেছে। ছেলেটা ছিল দুষ্টু প্রকৃতির। নিরীহ ছেলেদের পেছনে লাগত। শিক্ষক একটা হুঙ্কার দিলেন, তুমি কি নিশ্চিত যে বই এনেছো। ছেলেটি বলল সে ১০০ ভাগ নিশ্চিত। এবার শিক্ষকের দ্বিতীয় হুঙ্কার, চোর নিশ্চয়ই ক্লাসের ভেতরেই আছে, যে নিয়েছে দিয়ে দাও, নইলে প্রত্যেককে সার্চ করা হবে। আমরা নিজ নিজ বইপত্র নেড়েচেড়ে দেখলাম, আমার বন্ধুটি হাত দিল তার ব্যাগে। দেখে সেখানে অন্য বইখাতার নিচে খোয়া যাওয়া বইটি পড়ে আছে। সে বলল, এই যে স্যার, পেয়েছি। পেয়েছো? বলে শিক্ষকটি তৃতীয় হুঙ্কারটি ছাড়লেন। কোথায়? ‘আমার ব্যাগে।’ বন্ধুটি উঠে দাঁড়িয়েছিল, বলবার চেষ্টা করল যে টিফিন পিরিয়ডে সে ক্লাসের বাইরে ছিল, আমাকে দেখিয়ে সাক্ষী মানল, বোঝাতে চাইল যে বই সে নেয়নি। ‘তাহলে ওখানে গেল কী করে?’ ‘আমি জানি না স্যার।’ ততক্ষণে তার কান্না কান্না অবস্থা।
শিক্ষক বললেন, বুঝেছি। আমি উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করলাম। ভাবলাম বলব সারাক্ষণ আমি ওর সঙ্গেই ছিলাম। কিন্তু স্যার আমাকে থামিয়ে বসিয়ে দিলেন। ক্লাসসুদ্ধ সবারই ধারণা হওয়ার কথা যে কাজটি দুষ্ট ছেলেটি করেছে, আমার নিরীহ বন্ধুটিকে জব্দ করবার জন্য বইটি সেই ওর ব্যাগে ঢুকিয়ে দিয়েছে, ওই টিফিন পিরিয়ডেই। ব্যাগ আনা নিয়ে সে ওকে ঠাট্টামস্করা করত। কেউ বলবে না আমার বন্ধুটি বই চুরি করেছে। কেন করবে? ওর তো নিজেরই বই রয়েছে, মলাট-বাঁধানো। বিক্রি করবে? কে কিনবে? কোনো কিছুই বিবেচনা করা হলো না। আমাকে সাক্ষী মানার চেষ্টা কার্যকর হলো না। সাক্ষ্যপ্রমাণ গ্রহণ নেই, বিনাবিচারে দ্রুত আদালতে নিরপরাধ বন্ধুটির শাস্তি হয়ে গেল। তাকে নীল ডাউন হয়ে থাকতে হবে। বন্ধুটি নীরবে উঠে গেল, টিচারের বসবার চেয়ারের নিচে যে ছোট চৌকিটি ছিল সেটা ধরে মাথা নিচু করে একপাশে সে হাঁটু-গাড়া অবস্থায় অসহায়ভাবে রইল। আমি চোখ তুলে তাকাতে পারিনি। হয়তো সে কাঁদছিল, হতে পারে তার চোখের পানি শুকিয়ে গিয়েছিল। টিচার কী পড়াচ্ছিলেন তার বিন্দুবিসর্গ আমার কানে ঢোকেনি, আমার সর্বক্ষণ মনে হচ্ছিল আমি একজন অপরাধী, আমি বন্ধুটির পক্ষে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে বলতে পারলাম না, সে নির্দোষ, বলতে পারলাম না যে ও অপরাধী হলে আমিও অপরাধী, কেননা সর্বক্ষণ আমরা একসঙ্গে ছিলাম। অপরাধের এই অসহায় বোধটার মাত্রা দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেল ক্লাস থেকে নির্গত হওয়ার সময় শিক্ষকটি যখন ঘোষণা দিয়ে গেলেন, আমার বন্ধুটি পরের পিরিয়ডেও ওভাবেই শাস্তি পেতে থাকবে, পরের পিরিয়ডের শিক্ষককে যেন সেটা জানিয়ে দেওয়া হয়। অপরাধের ওই বোধটা আমি এখনো বহন করি। এ নিয়ে আমি লিখেছিও আমার তাকিয়ে দেখি বইতে। এ ধরনের শিক্ষকের সংখ্যা অবশ্য বেশি নয়, কিন্তু যে দু’চারজন আছেন এবং থাকেন তাদের তৎপরতা শিক্ষা, শিক্ষকের ভাবমূর্তি ও সমাজের জন্য খুবই ক্ষতিকর। ‘দুষ্ট গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভালো’ কথাটা যারা চালু করেছেন, তারা ওকাজটি এমনি এমনি করেননি, গভীর হতাশা থেকেই করেছেন।
তবে ভরসার কথা এই যে, সম্পূর্ণ বিপরীত ধরনের শিক্ষকরা আছেন এবং আমরা জানি, তাদের সংখ্যাই অধিক। এদের একজনের সাক্ষাৎ তো ওই দিন ঠিক পরের পিরিয়ডেই পেয়েছিলাম। তিনি এলেন, ছাত্রটির দুর্দশা দেখলেন, কী ঘটেছে জানতে চাইলেন। তাকে জানানো হলো, আগের টিচার ওকে শাস্তি দিয়ে গেছেন এবং হুকুম করে গেছেন এই পিরিয়ডেও সে ওইভাবেই শাস্তি পেতে থাকবে। কী অপরাধ করেছে? চুরি। কী চুরি? বই চুরি। তাই? বই চুরিকে তিনি আমলের মধ্যেই নিলেন না। হয়তো তার দয়াও হয়েছিল ছেলেটির লজ্জিত, শঙ্কিত, কাতর অবস্থা দেখে। তাছাড়া শিক্ষকদের কারোই অজানা থাকবার কথা নয়, ছেলেটি ছিল একজন মেধাবী ও সুবোধ ছাত্র, ছিঁচকে চোর নয়। তিনি বললেন, না, না, যাও, নিজের জায়গায় গিয়ে বসো। জড়োসড়ো অবস্থায় বন্ধুটি এসে বসেছিল তার জায়গায়, আমার পাশে। আমরা একে অপরের সঙ্গে কথা বলতে পারিনি। ওরকম বাকবন্দি অবস্থা আমাদের জীবনে ওই প্রথম।
বাসায় ফেরার সময় আমাদের গন্তব্য ছিল দু’দিকে। আগে সেটাকে দুঃখের ব্যাপার মনে হতো, এবার মনে হলো ভালোই হয়েছে। আমি তাকে কী বলতাম, জানি না। আমার নিজেকেই মনে হচ্ছিল শাস্তিপ্রাপ্ত প্রধান আসামি।
এর কয়েক মাস পরই আমরা রাজশাহী ছেড়ে গেছি, আমার বাবা বদলি হয়ে গিয়েছিলেন। পরে দেশভাগের ঘটনা। আমার বন্ধুটি রাজশাহীতে স্থানীয় ছিল, তারা পশ্চিমবঙ্গে চলে গেছে সপরিবারে। সেটা অন্যের কাছে শুনেছি, তার সঙ্গে আমার আর দেখা হয়নি। ওই ঘটনার স্মৃতি থেকে তার অব্যাহতি পাওয়ার কথা নয়। পাবে কী করে, আমিই পাইনি।
ঘটনাটা মনে পড়লে দু’জন শিক্ষকের ভেতর পার্থক্যটা পরিষ্কার বুঝতে পারি। একের আলোকে অপরকে চেনা হয় আমার। প্রথমজন কোনো প্রকার তদন্ত করলেন না, অপকর্মটি যে দুষ্ট ছেলেটা নিজেই করে থাকতে পারে সে সম্ভাবনাকে আমলে নিলেন না অথচ এমন একটি শাস্তি দিলেন, যা ছেলেটিকে চোর হিসেবে চিহ্নিত করে দিল। ওই দাগ অন্যের স্মৃতি থেকে মুছলেও নিরীহ ছেলেটির মন থেকে কখনোই মুছে যাবে না। অপর শিক্ষক কিন্তু ব্যাপারটাকে কোনো গুরুত্বই দিলেন না, বই হারানো ও ফেরত পাওয়া যে চুরি নয়, দুর্ঘটনা কিংবা দুষ্টমি মাত্র এবং একটি সুবোধ ছাত্র যে আর যাই করুক অন্যের বই চুরি করতে যাবে না এ বিষয়ে নিশ্চয়ই তিনি নিশ্চিত ছিলেন। সেদিন মনে হয়েছিল যে দ্বিতীয় শিক্ষকটি হয়তো প্রথম শিক্ষকটিকে সামনে পেলে ধমকে না দিলেও সমালোচনা করতেন। বুঝেছিলাম এবং এখনো বুঝি, শিক্ষকতার পেশায় কাদের আসা উচিত, কাদের আসা উচিত নয়।
লোকনাথ স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিল গোষ্ঠবিহারী মজুমদার। তার কথা ছাত্রদের ভুলবার কথা নয়, আমিও ভুলিনি। অথচ তিনি আমাদের কখনো পড়াননি। উঁচু ক্লাসে অঙ্কের শিক্ষক ছিলেন। ছাত্ররা বলত এবং অন্যরাও জানত, তিনি অঙ্ক এমন পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে দিতেন যে, ম্যাট্রিকে কেউ ফেল করত না। লোকশ্রæতি ছিল, তিনি রোজ সকালে সাহেব বাজারে গিয়ে রুই মাছের মাথা কিনতেন, মুড়িঘণ্ট খাওয়ার জন্য। তার অঙ্কের মাথার সঙ্গে ওই খাদ্যের একটা সমীকরণের সমর্থনেই বোধ করি খবরটা চালু ছিল।
তাকে আমি সব সময়ই দেখেছি, কামরায় বসে থাকা অবস্থায়। যেন আশুতোষ মুখার্জি; ওই রকমের অবয়ব, মায় গোঁফটি পর্যন্ত, পোশাকও তাই। তার পেছনের দেয়ালে দেখতাম স্বামী বিবেকানন্দের একটি ছবি, বলদৃপ্ত, হাত দুটি বুকের ওপর রাখা। মনে হতো ছবির মানুষটিই বুঝি নিচে নেমে এসে বসেছেন। সবকিছু মিলিয়ে একটি অসামান্য ভাবমূর্তি। ক্লাসচলা সময়ে স্কুলের কোথাও কোনো শব্দ শোনা যেত না, গোষ্ঠবিহারী মজুমদার যখন হালহকিকত দেখতে বের হতেন, তখন নৈশব্দকে মনে হতো হাত দিয়ে ছোঁয়া যাবে। আমরা, স্কুলের ছাত্রশিক্ষক সবাই সেটা টের পেতাম।
দেশভাগের পরে ঢাকায় এসে সেন্ট গ্রেগরীজ স্কুলে হেডমাস্টার দেখেছি ব্রাদার জুডকে। সব সময়ই প্রসন্ন, কখনোই বসে নেই, চেয়ারে বসা অবস্থায় তাকে দেখেছি বলে মনে পড়ে না, যখনই দেখতাম মনে হতো কিছু না কিছু করছেন। সারা স্কুলজুড়ে ঘুরে বেড়াতেন। কোনো শিক্ষক অনুপস্থিত থাকলে সে ক্লাসে চলে যেতেন, ছাত্রদের ব্যস্ত রাখতেন। একবার আমাদের বাংলা ক্লাসে শিক্ষক ছিল না, আমরা বোধ হয় গোলমাল করেছিলাম, দেখি ব্রাদার জুড ঢুকছেন। কী পড়া হচ্ছিল জেনে নিয়ে ওই বিষয়ে আমাদের বলতে বললেন। পড়া হচ্ছিল জসীমউদ্দীনের ‘পল্লীজননী’ কবিতা, সে বিষয়ে আমরা যা যা বলার বললাম, ক্লাস শেষে তিনি বললেন, কবি জসীমউদ্দীনের সঙ্গে তার পরিচয় আছে, তাকে একদিন ক্লাসে নিয়ে আসবেন। এবং সত্যি সত্যি জসীমউদ্দীন আমাদের বাংলা ক্লাসে এসেছিলেনও। এমন বিখ্যাত একজন কবির সান্নিধ্য পাওয়া আমাদের জন্য আনন্দের অভিজ্ঞতা ছিল; ভাগ্যিস বাংলা শিক্ষক একদিন ক্লাসে অনুপস্থিত ছিলেন।
ভালো স্কুল, ভালো কলেজের কথা শুনি। তখনো শোনা যেত। যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভালো তারা ভালো কেন? একটা কারণ সেখানে ভালো রেজাল্টের ছেলেমেয়েরা পড়তে আসে; আর যারা ভালো রেজাল্ট করে তাদের প্রায় সবাই অপেক্ষাকৃত সম্পন্ন পরিবারের সন্তান। অভিভাবকরা তাদের পেছনে প্রচুর টাকা খরচ করে থাকেন। এর বাইরে প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা কতটা? অবশ্যই আছে। প্রাতিষ্ঠানিক পরিবেশ, শৃঙ্খলা, নিয়মানুবর্তিতা, শিক্ষকদের নিষ্ঠা, শিক্ষার্থীদের উৎসাহদান এসব খুব বড় ভূমিকা যে পালন করে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এটা বলা অন্যায় হবে যে ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা সবাই অসাধারণ রকমের জ্ঞানী ও দক্ষ। এমন নয় যে, তাদের মানের শিক্ষক যেসব সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এখন আর তত ভালো বলে পরিচিত নয় সেখানে পাওয়া যাবে না, অবশ্যই পাওয়া যাবে। কিন্তু ‘ভালো’ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের যে আগ্রহ ও শিক্ষা দানের
যে পরিবেশটা পান, সেটা সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এখন আর পাওয়া যায় না।
ভালো বলে পরিচিত দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র হওয়ার সুযোগ আমার হয়েছে, একটি সেন্ট গ্রেগরীজ স্কুল, অপরটি নটর ডেম কলেজ। এর শিক্ষকদের কেউই জ্ঞানের দিক থেকে অসাধারণ ছিলেন না, হওয়ার কথাও নয়; কিন্তু তারা প্রায় সবাই ছিলেন তাদের পেশার প্রতি অনুরক্ত এবং শিক্ষার্থীদের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ। স্কুলে ব্রাদার লরেঞ্জো পড়াতেন ইংরেজি, বাংলা তার মাতৃভাষা নয়, কিন্তু তিনি ভালো বাংলা জানতেন। স্কুলের গ্রন্থাগারটি ছিল তার পরিচালনাধীন। আমি একদিন বই খুঁজছিলাম, তিনি আমাকে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আদর্শ হিন্দু হোটেল উপন্যাসটি দেখিয়ে বলেছিলেন, সেটি আমি পড়েছি কিনা। আমার পড়া ছিল না, বইটি নিয়ে এসে অন্য এক বিভূতিভূষণকে আবিষ্কার করেছিলাম। ব্রাদার লরেঞ্জো হঠাৎ হঠাৎ আমাদের লিখতে দিতেন। টুকরো টুকরো কাগজ নিয়ে আসতেন সঙ্গে করে। ওই কাগজে আমাদের লিখতে হতো, পরের দিন তিনি লালকালিতে ভুলগুলো শুদ্ধ করে দিয়ে কাগজগুলো ফেরত দিতেন। আমাদের ইংরেজি শিক্ষায় তাঁর এই কাজটা যে কাজে লেগেছিল তখন যতটা না বুঝেছি এখন বুঝি তার চেয়ে বেশি।
ক্লাসে বিতর্ক সভা হতো। একবার হয়েছিল বিজ্ঞান বনাম সাহিত্য বিষয়ে। আমি সাহিত্যের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলাম। কী বলেছিলাম মনে নেই, কিন্তু দাঁড়িয়ে বলতে যে পেরেছিলাম, কথা যে হারিয়ে যায়নি, সেই অভিজ্ঞতা আমার আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়েছিল। মনে হতো শিক্ষকরা আমাদের বলছেন, ভয় পেয়ো না, এগিয়ে যাও, আমরা আছি তোমাদের সঙ্গে। আমরা হাতেলেখা পত্রিকা বের করতাম। স্কুলে আয়োজন ছিল নানা ধরনের খেলার, যেমন ইনডোর, তেমনি আউটডোর। আমরা দল বেঁধে হেঁটে হেঁটে স্কুলে যেতাম, ফিরতাম দল বেঁধে; স্কুল বন্ধ থাকলে আমাদের মন খারাপ লাগত।
বাংলার শিক্ষক ছিলেন দু’জন। রায় স্যার পড়াতেন ব্যাকরণ, চক্রবর্তী স্যার শেখাতেন প্রবন্ধ লেখা। চক্রবর্তী স্যার হাতে ধরে শেখাননি, কিন্তু যেসব প্রবন্ধ পড়িয়ে শুনিয়েছেন সেগুলো পড়ে বুঝেছি প্রবন্ধ রচনার ক্ষেত্রে শাস্ত্রী ও বাগচীর রচনা বইটি শেষ কথা নয়, আরও আছে। চক্রবর্তী স্যার ছিলেন বুদ্ধদেব বসুর সমসাময়িক ও অনুরাগী, বুদ্ধদেব বসুর ব্যক্তিগত প্রবন্ধগুলোর প্রতি ছিল তাঁর সবিশেষ অনুরাগ ও আকর্ষণ। চৌধুরী স্যার পড়াতেন আবশ্যিক অঙ্ক এবং অতিরিক্ত অঙ্ক। আরবির বদলে আমি অতিরিক্ত অঙ্ক নিয়েছিলাম। স্যারকে দেখতাম আর ভাবতাম ওঁর মতো যদি অঙ্ক পারতাম, তাহলে আমার আর বেশি কিছু চাইবার থাকত না। কিন্তু তাঁর দক্ষতার প্রতি যত সশ্রদ্ধ হয়েছি, ততই বুঝেছি ওই পথ আমার নয়; আমি যে বিজ্ঞান পড়ব বলে ভাবিনি তার একটা কারণ অঙ্কভীতি।
কলেজেও সেই একই রকম পরিবেশ পেয়েছি। শিক্ষকরা যে অসাধারণ ছিলেন, তা নয়। কিন্তু তারা যতœ নিতেন। সেটা সহজও ছিল, কেননা ছাত্রসংখ্যা ছিল খুবই কম। কিন্তু পরে যখন কলেজ অনেক বড় হয়েছে, তখনও শুনেছি যতœ নেয়ার ঐতিহ্যটা অক্ষুণ্ন রয়েছে।
ফাদার মার্টিন পড়াতেন ইংরেজি সাহিত্য। তখন তার বয়স অল্প, উৎসাহ প্রচণ্ড। কবিতা পাঠদানে তার বিশেষ আগ্রহ ছিল। কবিতা জীবন্ত হয়ে উঠত তার হাতে পড়ে। ব্যাখ্যা দিতেন প্রাঞ্জলভাবে, নিজের ভাবনাও যোগ করতেন কখনো কখনো। ফাদার মার্টিন ঠিক করেছিলেন শেকসপিয়রের নাটক মঞ্চস্থ করাবেন আমাদের দিয়ে। অসম্ভব মনে হয়েছিল কাজটা। কলেজে ছাত্রসংখ্যা তখন পঞ্চাশের বেশি হবে না। কিন্তু নাটক হলো। একদিন নয়, পরপর দু’দিন। স্কুলের পুরনো ভবনের একটি বারান্দাকে মঞ্চ হিসেবে ব্যবহার করে সামনের মাঠে সামিয়ানা টানিয়ে দর্শকদের আসন বসানো হয়েছিল। দর্শকে ভরে গিয়েছিল। একদিনের জায়গায় নাটক দু’দিন ধরে হলো দর্শকদের আধিক্য দেখে। টেমপেস্ট নাটকটা ছোট, সে জন্যই বুঝি সেটিকে বেছে নেওয়া হয়েছিল। নারী চরিত্র একটি, তাতে অভিনয় করেছে একজন ছাত্র। আমরা সবাই অংশ নিয়েছি। কেউ মঞ্চে, কেউ মঞ্চের বাইরে। মনে আছে কী উৎসাহে আমরা সংলাপ মুখস্থ করেছি, কীভাবে তা দর্শকদের তা শোনাব সেটা ঠিক করেছি। শেকসপিয়র আমাদের নিকটের মানুষ হয়ে গিয়েছিলেন। আমি নিয়েছিলাম ক্যালিবানের ভূমিকা। আমার নিজের উচ্চারণে ক্যালিবানের মুখের সেই সব অসামান্য পঙ্ক্তি, তার আর্তনাদ, তার ক্রোধ এখনো আমার কানে বাজে।
খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে বাংলা পড়াতেন অজিত কুমার গুহ। প্রথম ক্লাসেই মেঘনাদবধ কাব্য থেকে পড়ে শুনিয়েছিলেন। ওই কাব্যটি দুর্বোধ্য বলেই জানতাম, তাতে যে এমন উপমার অভিনবত্ব, ভাষার ঔদার্য্য ও ছন্দের প্রবহমানতা রয়েছে তা হয়তো ওভাবে আমার জানাই হতো না, ওর পাঠদানে উপস্থিত থাকবার সুযোগ না পেলে।
কলেজটি শুরু হয়েছিল স্কুল ভবনেই। সকালে বসত। পরে যখন কাছেই দোতলা একটি বাড়িতে স্থান পেলাম আমরা, তখন দেখি কর্তৃপক্ষ দুটি বিশেষ আয়োজনের দিকে খেয়াল রেখেছেন। গ্রন্থাগার ও খেলাধুলা। স্থানের অভাব ছিল, তাই ভবনটির একতলাতে কয়েকটি আলমারি এনে গ্রন্থাগারের এবং বারান্দা ও উঠানে টেবিল টেনিস ও ব্যাডমিন্টনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। গ্রন্থাগারের জন্য বাংলা বই বাছাই করার দায়িত্ব নিয়েছিলেন অজিত স্যার। আমাদের কৌতূহল ছিল- কী কী বই আসে দেখবার, গল্প-উপন্যাস পাব আশা ছিল। দেখলাম প্রথমেই এলো রবীন্দ্র রচনাবলি, তারপরে অন্যান্য রচনাবলি। এর যথার্থ্যটা পরে বুঝেছি। ফাদার মার্টিন ভাইস প্রিন্সিপাল, তিনি ঠিক করলেন কলেজের একটা ম্যাগাজিন থাকা দরকার। ছাপাখানায় যাওয়ার সামর্থ্য নেই, প্রয়োজনও নেই, তাই ঠিক হয়েছিল টাইপ করে ও হাতে লিখে স্টেনসিলে ছাপানো হবে। তাই হয়েছিল। ওতে আমার একটা গল্প ছিল। বাংলা লেখাগুলো দেখে দিয়েছিলেন অজিত স্যার।
মোট কথা, ভালো স্কুল ও কলেজগুলো ভালো ছিল সুশৃঙ্খল পরিবেশ ও শান্ত কর্মমুখরতার কারণে। শিক্ষকরা উৎসাহ দিতেন, আমরা উৎসাহিত হতাম, লেখাপড়ায় খুবই আগ্রহী বোধ করতাম। মনে হতো আমাদের জন্য অনেক কিছু করবার আছে। সাংস্কৃতিক জীবন আমাদের প্রস্তুত করে দিত শিক্ষাকে গ্রহণ ও ধারণ করার জন্য। শিক্ষকরা অসাধারণ ছিলেন না, কিন্তু তাদের অধিকাংশই বীর ছিলেন, আমাদের কাছে। আমরা বীরের সন্ধান পেয়েছিলাম কিছু কিছু শিক্ষকের মধ্যে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মান এখন আর আগের মতো নেই বলে অভিযোগ, নাকি অনেক নেমে গেছে। নেমেছে যে তা মিথ্যা নয়। বস্তুগত উন্নতির অন্তরালে সংস্কৃতির সাধারণ মান দেশজুড়েই নেমেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম ঘটেনি। সাতচল্লিশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটা ধাক্কা খেয়েছিল। তখন ও তার পরবর্তী কয়েক বছরে অনেক শিক্ষক চলে গেছেন, তাদের জায়গায় যারা এসেছেন, তারা অনেকেই প্রস্তুত ছিলেন না, কেউ কেউ ভাবেনওনি যে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবেন; আর যারা আগে থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলেন তারা হঠাৎ করে এমন বড় বড় দায়িত্ব পেয়ে গেছেন, যেগুলো পালন করা তাদের পক্ষে সহজ হয়নি। ওই সময়ে সরকারি চাকরি অনেক বেশি আকর্ষণীয় ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরির তুলনায়। কেউ কেউ চলে গেছেন সরকারি চাকরিতে। দ্বিতীয় ধাক্কাটা এলো একাত্তরে। বেশ কয়েকজন শিক্ষক প্রাণ হারালেন, স্বাধীনতার পর কেউ কেউ চলে গেলেন সরকারি কাজে, কারো পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকা সম্ভব হলো না পাকিস্তানি হানাদারদের সঙ্গে সহযোগিতা করেছিলেন বলে। কিন্তু এক ঝাঁক তরুণ এসেছিলেন। দেশপ্রেমের যে প্রবাহ তৈরি হয়েছিল তার স্রোতেই তাদের ওই আসা; তাদের সবাই কিন্তু থাকেননি, চলে গেছেন। দেশে ও বিদেশে সুযোগ ছিল এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরের পরিবেশ উন্নত হচ্ছিল না, ক্রমেই নিম্নগামী হচ্ছিল। অন্য অনেক ক্ষেত্রে, বিশেষ করে রাজনীতির ক্ষেত্রে যেমন যোগ্য নেতৃত্ব পাওয়া যায়নি এবং যারা নেতৃত্ব পেয়ে গেছেন তারা যোগ্যতার পরিচয় দিতে পারেননি, বিশ্ববিদ্যালয়েও ঠিক তেমনটি ঘটেছে। শিক্ষার্থীদের পক্ষে শিক্ষকদের ভেতর বীরের সন্ধান পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান নেমে যাওয়ার কয়েকটা কারণের তিনটির কথা বিশেষ করে উল্লেখ করতে হয়। প্রথমটি হচ্ছে যথোপযুক্ত শিক্ষকের অভাব। দ্বিতীয়টি শিক্ষার্থীদের ভেতর আগ্রহের অভাব। তৃতীয়টি সাংস্কৃতিক জীবনের সংকোচন। উপযুক্ত শিক্ষকের অভাবের পেছনে একদিকে রয়েছে শিক্ষক নিয়োগে দলীয় পক্ষপাতিত্ব এবং অপরদিকে শিক্ষকদের যথোপযুক্ত বেতন-ভাতা ও মানসম্মান দানে রাষ্ট্রীয় অনীহা।
শিক্ষার্থীদের আগ্রহের অভাবের মূল কারণ শিক্ষার সঙ্গে জীবিকার বিচ্ছিন্নতা। দেখা যাচ্ছে, দেশে বেকার সমস্যা ভয়াবহ, শিক্ষিত বেকার সমস্যা দুঃসহ। শিক্ষা যেহেতু কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা দেয় না, তাই শিক্ষার ব্যাপারে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ কমছে। তদুপরি তারা এমন শিক্ষক খুব বেশি সংখ্যায় পায়নি, যারা তাদের আগ্রহান্বিত ও অনুপ্রাণিত করতে পারবে। শিক্ষার্থীদের জন্য আরও একটি সমস্যা রয়েছে, সেটি হলো শিক্ষাগ্রহণে সামর্থ্য।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আসে উচ্চ মাধ্যমিকের সীমানা পার হয়ে। ওই স্তরে শিক্ষার মান বাড়ছে না, বরঞ্চ কমছে। ইংরেজি তো বটেই বাংলা ভাষাও শিক্ষার্থীরা ভালোভাবে জানে না। কথা ছিল মাতৃভাষার মাধ্যমে উচ্চ শিক্ষার যথোপযুক্ত ব্যবস্থা করা হবে। তৎপরিবর্তে যা করা হয়েছে, তা একটা গোঁজামিল। অনেক বিভাগেই বাংলায় বক্তৃতা করা হয়, শিক্ষার্থীরাও বাংলাতেই লেখে। কিন্তু বাংলায় প্রয়োজনীয় বইপত্র নেই- রেফারেন্স বই তো পরের কথা, টেক্সট বইও নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারগুলোতে শতকরা পাঁচ ভাগ বইও বাংলায় লিখিত নয় এবং ইংরেজি বইগুলো স্বভাবতই শিক্ষার্থীদের নাগালের বাইরেই রয়ে যায়।
শিক্ষা গ্রহণ করার জন্য ছাত্রদের ক্ষমতা হ্রাস পাওয়ার আরেকটি কারণ সাংস্কৃতিক জীবনের সংকোচন। বিশ্ববিদ্যালয় তো বিশ্ববিদ্যালয়ই নয়, যদি তার সাংস্কৃতিক জীবন না থাকে। সংস্কৃতির অনুশীলন শিক্ষার্থীদের সজীব রাখে, তাদের শিক্ষাগ্রহণে কৌতূহলী ও সক্ষম করে তোলে। এটা কী অবিশ্বাস্য নয় যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গত দুই যুগেরও অধিক সময় ধরে কোনো ছাত্র সংসদ নেই। প্রশাসনিকভাবে নির্বাচন দেওয়া মোটেই কঠিন ব্যাপার নয়। কিন্তু কোনো সরকারই ছাত্র সংসদ নির্বাচন দেয় না, কারণ তারা ছাত্রদের রাজনৈতিক মতকে ভীষণ ভয় পায় এবং তার কণ্ঠরোধ করায় সচেষ্ট থাকে। প্রবণতাটা স্পষ্টই ফ্যাসিবাদী।
নিজেকে যেহেতু সাক্ষী হিসেবে দাঁড় করাচ্ছি, তাই এই ক্ষেত্রেও এ কাজটি করা দরকার। আমার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে সবচেয়ে আনন্দদায়ক প্রাপ্তি যেটা ছিল, সেটা হলো উন্নততর সাংস্কৃতিক জীবন এবং সে জীবনের অনেকটাই ছিল ছাত্র সংসদকেন্দ্রিক। প্রতি বছর আবাসিক হলের নির্বাচন হতো; সে ছিল মস্ত এক উৎসব। মনে পড়ে ভর্তির প্রথম বছরেই আমি সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ছাত্র সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিলাম। জোটবদ্ধ প্রার্থীদের পরিচয়পত্র ছাপিয়ে আনা, প্রার্থী হিসেবে ক্লাসে ক্লাসে গিয়ে পরিচিত হওয়া, নির্বাচনী সভায় বক্তৃতা করা, নির্বাচনের দিন মাইক্রোফোনের সদ্ব্যবহার করা- এসবের ভেতর দিয়ে নিজের সাংস্কৃতিক উন্নয়ন ঘটেছে। তারপর ছিল বার্ষিক নাটক, বিতর্ক, সাহিত্য সভা, সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা- শান্ত বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে অন্তঃসলিল মুখরতা থাকত সতত প্রবহমান। হল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিকীতে আমি লিখেছি, সম্পাদনার সঙ্গেও যুক্ত থেকেছি। আমার জন্য সেটা ছিল সুবর্ণ যুগ।
রাষ্ট্রীয় স্বৈরাচারের অধীনে থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব গণ্ডিতে পরিবেশটা ছিল আপেক্ষিকরূপে গণতান্ত্রিক। যদিও শিক্ষকদের সঙ্গে সম্পর্কটাই ছিল কিছুটা সামন্ততান্ত্রিক, তবু আমরা নির্ভয়ে তাদের কাছে যেতাম। সাংস্কৃতিক ও আলোচনা অনুষ্ঠানে দেখা হতো, গ্রন্থাগারে যাতায়াতের সময় সাক্ষাৎ পাওয়া যেত।
কিন্তু কারা যথার্থ শিক্ষক এবং কারা নন, সেটা টের পেতে কষ্ট হয়নি। টের স্কুলে যেমনটা পেয়েছিলাম তেমনি বিশ্ববিদ্যালয়েও পেয়েছি। সৈয়দ আলী আশরাফ তখন সদ্য ফিরেছেন ক্যামব্রিজ থেকে। সেকালে সাহিত্য সমালোচনায় প্র্যাকটিক্যাল ক্রিটিসিজমের খুব তোড়জোড়। সে বিষয়ে আমরা গুঞ্জন শুনেছি, অভিজ্ঞতা হয়নি। সেটা পেলাম আশরাফ স্যারের ক্লাসে তার সঙ্গে ‘ওড টু এ নাইটিঙ্গল’ কবিতাটি পড়ে। কীটসের ওই কবিতাটির বিষয়ে মোটামুটি ধারণা ছিল আমাদের, কিন্তু তিনি যেভাবে লাইনের পর লাইন ধরে, অনুষঙ্গ, রূপক, দার্শনিক চিন্তা ও এমনকি ধ্বনির ব্যাখ্যা দিলেন, তাতে কবিতাটি এমনভাবে জীবন্ত হয়ে উঠল, যাতে ওটি বারবার পড়বার ইচ্ছা জাগে এবং প্রতিবারই নতুন মনে হয়। পরে পুনরায় ছাত্র হয়ে আমি ইংল্যান্ডে গেছি, অধ্যাপকদের কবিতা পাঠদান শুনেছি এবং বুঝেছি আশরাফ স্যার যে নতুন জগতের সন্ধান দিয়েছিলেন, সেখানে অনেক কিছু পাওয়ার আছে।
কিন্তু তিনি বেশিদিন থাকলেন না, চলে গেলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। তার বিদায় উপলক্ষে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলাম আমরা। কয়েকজন মিলে যতœ করে একটি মানপত্র লিখেছিলাম। অনুষ্ঠানে সেটা বিতরণ করা হয়েছে, পড়া হবে- এমন সময় বিভাগের প্রধান যিনি তিনি আমাদের ওপরের শ্রেণির এক ছাত্রকে ডেকে বললেন, এমন পচা ভাষায় একটা মানপত্র লিখেছ তোমরা? মানপত্রটি অবশ্য পড়া হয়েছিল এবং কারো কাছেই সেটা খারাপ লাগেনি, কিন্তু ওই যে তার মন্তব্য তাতে অনুষ্ঠানের উজ্জ্বলতা কিছুটা হলেও ¤øান হয়ে গিয়েছিল। এরা উভয়েই ছিলেন সদ্য বিলাতফেরত। কিন্তু দু’জনের ধরন-ধারণ ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। আশরাফ স্যার আমাদের সাহিত্যপাঠ থেকে আনন্দলাভের পথ দেখিয়েছিলেন; বিভাগীয় প্রধান সে আনন্দ কেড়ে নেয়ার আয়োজন করেছিলেন। সেটা ঘটেছিল যেভাবে তিনি শব্দের উচ্চারণের ওপর জোর দিতেন তার দরুন। এ করতে গিয়ে পাঠ বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ত, অন্তর্লীন অর্থটা পাত্র হতো উপেক্ষার। আশরাফ স্যার আমাকে স্নেহ করতেন। আমি তার টিউটোরিয়াল করার সুযোগ পেয়েছি। রাজশাহীতে যাওয়ার পরও তার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। টি এস এলিয়টের ওপর তার কিছু নোটস আমাকে পড়তে দিয়েছিলেন। একাত্তরে তিনি করাচিতে; জানতেন ঢাকায় আমি ঝুঁকির মধ্যে আছি, আমাকে বিপদমুক্ত করার জন্য সদ্যপ্রতিষ্ঠিত কোয়েটা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার জন্য চাকরির ব্যবস্থা করেছিলেন, একেবারে বিভাগীয় প্রধানেরই। আমার পক্ষে যাওয়া সম্ভব হয়নি, তিনি হতাশ হয়েছেন আমি ঝুঁকির মধ্যে রয়ে গেলাম ভেবে।
ছিলেন জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা। অত্যন্ত প্রাণবন্ত ও গণতান্ত্রিক; ঝকমক করত তার ঔজ্জ্বল্য। এই স্যারের একটি পাঠদানের কথা আমি ভুলব না। সুইনবার্নের একটি কবিতা আছে প্রেমের দেবী অ্যাফ্রোডাইটিসের ওপরে, তার সঙ্গে তিনি তুলনা করছিলেন রবীন্দ্রনাথের ‘উর্বশী’র। ওই তুলনায় তিনি বললেন না, কিন্তু আমাদের বুঝতে বাকি রইল না যে রবীন্দ্রনাথের কবিতাটি অনেক উঁচু স্তরের। সাহিত্যের তুলনামূলক পাঠের শিক্ষাটা তার কাছ থেকেই প্রথমে পাই।
এদের ঠিক বিপরীতে ছিলেন বিভাগীয় প্রধান, যার কথা ওপরে উল্লেখ করেছি। তিনি বিদ্যান ছিলেন, প্রচুর বই পড়তেন। বইয়ের খবর রাখতেন। ইংরেজি বিভাগের উদ্যোগে সমকালীন বাংলা সাহিত্যের ওপর ৮টি সেমিনারের আয়োজন করেছিলেন একবার, সেগুলোতে অনেকের সঙ্গে আমারও সুযোগ হয়েছিল অংশগ্রহণের। কিন্তু শিক্ষকের প্রাথমিক যে কাজ, শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করা, সেটা করতে পারতেন না। ওই কাজে উৎসাহ দান তার ভেতর থেকেই আসত না। ভুল উচ্চারণে বা ভুল বাক্যে কেউ ইংরেজি বললে মর্মাহত হতেন। কখনো বা এমন ভঙ্গি করতেন, যেন শুনতে পাচ্ছেন না। গ্রাম্য নাম নিয়ে ইংরেজি বিভাগে কেউ ভর্তি হতে এলে প্রার্থীর অন্য যোগ্যতা থাকলেও নামের অযোগ্যতার বিষয়টি বলতে ছাড়তেন না। পরামর্শ দিতেন আদালতে গিয়ে নাম বদল করে আসতে।
নিরুৎসাহিতকরণের ঘটনা নানাভাবে ঘটত। অনার্স পরীক্ষার আগে থার্ড ইয়ারের ছেলেমেয়েদের তিনি নিজের বাড়িতে ডাকতেন, চা খাওয়ার জন্য। আমাদেরও ডেকেছিলেন। আমরা সবাই মিলে বোধ হয় ছিলাম ১১ জন, তার ভেতর মেয়ে মাত্র একজন। চায়ের আসরে নানা রকমের খাবার ছিল, বিলেতি পনিরও ছিল। একটি ছেলে উপাদেয় ওই পনির খেতে খেতে স্যারকে জিজ্ঞেস করেছিল, স্যার এটা কি? স্যার যেন আকাশ থেকে পড়লেন। ‘ওহ, ইউ ডু নট নো চীজ!’ ভঙ্গিটা ছিল এই রকম চীজ চেনো না তাহলে ইংরেজি সাহিত্য পড়তে এসেছ কোন সাহসে? ছেলেটি দমে গিয়েছিল। খুবই দমে গিয়েছিল। আমার মনে হয়েছিল এ ঘটনার সাথে আমার সেই নিরাপরাধ বাল্যবন্ধুটিকে লোকসমক্ষে চোর বলে চিহ্নিত করে দেয়ার একটা মিল আছে। পরিমাণে পৃথক, গুণে অভিন্ন।
আরো ঘটনা আছে আমার এই জ্ঞানী শিক্ষককে জড়িয়ে। সেকালে অনার্স ফাইনাল পরীক্ষাটি ছিল বাস্তবিক অর্থেই এক কুরুক্ষেত্র। আমি নিজে তো অসুস্থ হয়েই পড়েছিলাম। ভেবেছিলাম ও বছর থাক, পরের বছর দেব। আমাদের এক সহপাঠী ঠিক ওই কাজটিই করে ফেলেছিল। মেধাবী ছাত্র, কিন্তু ভালো করতে পারবে না ভেবে দুই পেপার দিয়েই সে থেমে গেল। সে যে এ কাজ করেছে সেটা জানতে পেরে বিভাগীয় প্রধান সলিমুল্লাহ হলে চলে এসেছিলেন, আরেকজন শিক্ষককে সঙ্গে নিয়ে, ছেলেটির খোঁজখবর নেবেন বলে। ছেলেটি ছিল তার স্নেহধন্য। খবর পেয়ে আমাদের অন্য তিন সহপাঠী যারা হলে থাকত এবং পরীক্ষা দিচ্ছিল তারা গিয়ে হাজির হয়েছে। স্যার তাঁর প্রিয় ছাত্রটিকে সান্ত¡না দিলেন শেষ পর্যন্ত এ কথা বলে, তার আক্ষেপ করার কোনো কারণ নেই, কেননা যারা পরীক্ষা দিচ্ছে তারা সবাই যে সেকেন্ড ক্লাস পাবে এমনটা মনে করবার কোনো কারণ নেই। আমি উপস্থিত ছিলাম না, আমি হলে থাকতাম না, পরের দিন বিকেলে হলের রেস্টুরেন্টে গিয়ে বিবরণ শুনলাম। বড়ই বিষণ্ন কণ্ঠে জানাল বন্ধুদের মধ্যে দু’জন। তৃতীয়জন সম্ভবত এতই ভয় পেয়ে গিয়েছিল যে রেস্টুরেন্টে আসেনি, কামরায় বসে বইপত্র নাড়াচাড়া করছিল এবং ভাবছিল সেকেন্ড ক্লাস পাবে কি না। সেকালে ইংরেজি বিভাগে সেকেন্ড ক্লাস পাওয়া ছিল মস্ত বড় অর্জন।
আরেকজন শিক্ষক ছিলেন খুবই নম্র-ভদ্র। কিন্তু ভালো হতো যদি তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্য না পড়িয়ে কলেজে ইংরেজি ভাষা পড়াতেন। ফার্স্ট ইয়ারে তার সঙ্গে এক বছর টিউটোরিয়াল করেছি। ক্লাসে ছাত্র ছিলাম দু’জন। প্রথম সাক্ষাতেই ইংরেজিতে কি একটা লিখতে দিলেন। আমি তবুও পাস করলাম কোনোমতে; আমার সহপাঠীটা পারল না। সে এসেছে গ্রাম থেকে, আইএতে ভালো ফল করেছে, তার জোরেই ভর্তি হয়েছে। আমাদের ওই নম্র-ভদ্র শিক্ষক তাকে উৎসাহ দেবেন কী, মন্তব্য করলেন- ‘এই ইংরেজি নিয়ে তুমি অনার্স ডিগ্রি পাবে কিনা সন্দেহ আছে।’ সেই পুরনো ঘটনা, ছাত্রকে চোর বলে চিহ্নিতকরণের। স্যারের ওই মন্তব্য শুনে বন্ধুটির মুখের দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারিনি। তার অর্থনৈতিক সমস্যা ছিল, নানা কারণে সে দমে গিয়েছিল, বিভাগীয় প্রধানের অফিসে যেতে সে ভয় পেত, পাছে ইংরেজি শব্দের ভুল উচ্চারণ করে ফেলে। পড়ত খুব, কিন্তু ভেতরে যে একটা হীনমন্যতা ঢুকে গিয়েছিল, তা থেকে মুক্তি পায়নি; অনার্স ডিগ্রি পেয়েছিল ঠিকই, কিন্তু সেই যে দুর্লভ বস্তু সেকেন্ড ক্লাস সেটা সংগ্রহ করতে পারেনি। এই কয়েক বছর আগে সে মারা গেছে। তার মৃত্যু সংবাদ পেয়েছিলাম সংবাদপত্রের শোক সংবাদ স্তম্ভে।
ছিলেন বি সি রায়, অত্যন্ত উঁচু মাপের পণ্ডিত। গ্রন্থাগারে যখনই যেতাম দেখতাম তিনি আছেন। ক্লাসে তিনি বইয়ের লাইন ধরে ধরে পড়াতেন। অকৃতদার ছিলেন, থাকতেন জগন্নাথ কলেজের এইচ পি রায়ের সঙ্গে, ওয়ারীতে। পেছনে তাকিয়ে মনে হয় বি সি রায় স্যারের বিজ্ঞান পড়া উচিত ছিল, তাহলে শিক্ষক হিসেবে অনেক বেশি চরিতার্থতা পেতেন, যেমনটা পেয়েছিলেন তার বন্ধু এইচ পি রায়।
আরেকজন ছিলেন, যিনি বিভাগীয় প্রধানের মতোই উচ্চ ডিগ্রি নিয়ে এসেছিলেন বিলেত থেকে। ইনি ছিলেন সাহিত্যের যথার্থ অনুরাগী এবং সতর্ক শিক্ষক। এক সময়ে বিভাগীয় প্রধানের সঙ্গে তার অলঙ্ঘনীয় দূরত্ব দেখা দেয় জাতীয়তাবাদের প্রশ্নে। বিভাগীয় প্রধান আঁকড়ে ধরেছিলেন পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদকে; আর ইনি ছিলেন বাঙালি জাতীয়তাবাদের পরিপূর্ণ সমর্থক। আমি যখন শিক্ষকতা শুরু করি, ১৯৫৭ সালে, তখন কিন্তু এদের দু’জনের ভেতর খুব মিল ছিল। উভয়েই ইউরোপীয় সংস্কৃতির অনুরাগী ছিলেন। পার্থক্যটা প্রকাশ পেয়েছে ছয় দফা আন্দোলনের পরে; তখন দু’জন চলে গেছেন দুদিকে। ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকারটা কিন্তু রইলই, দু’জনের ক্ষেত্রেই। তবে সেটা স্তিমিত হয়ে এসেছিল কিছুটা, দু’জনের বেলাতেই; কারণ দেশের পরিস্থিতি ঔপনিবেশিকতাকে তেমন গুরুত্ব দিচ্ছিল না।
কিন্তু গত শতাব্দীর ষাটের দশকের প্রথম দিকেও উত্তরাধিকারটা বেশ দাপটের সঙ্গেই প্রকাশিত দেখেছি আমার ওই দুই জাতীয়তাবাদী শিক্ষকের ভেতর, যাদের প্রথমজন ছিলেন রক্ষণশীল, এবং দ্বিতীয়জন উদারনৈতিক। ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকারটা দেখা যেত বিশেষ করে তাদের পোশাক-পরিচ্ছদে। তারা ইউরোপীয় পোশাকের পক্ষপাতী ছিলেন। একটা ঘটনার কথা আমার খুব মনে পড়ে। ১৯৬৪ সালে খুব বাজে রকমের একটা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়। বি সি রায় তাতে বিপন্ন বোধ করছিলেন। তিনি ধুতি পরতেন। প্রতিবেশীরা তাকে পরামর্শ দিয়েছিল- কিছুদিনের জন্য হলেও প্যান্ট শার্টের ছদ্মবেশ ধারণ করতে। সে পরামর্শ অমান্য করা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। প্রথম যেদিন অনভ্যস্ত প্যান্ট-শার্ট পরে স্যার বিশ্ববিদ্যালয়ে এলেন, তখন আমরা যতজন তাকে দেখেছি আমার ধারণা তারা প্রত্যেকেই অপরাধী মনে করেছি নিজেদের, রায় স্যারের সম্মান রক্ষা করা গেল না দেখে। এরপর অবশ্য বেশি দিন তিনি ঢাকায় থাকেননি, তার আপনজনরা সবাই পশ্চিমবঙ্গে থাকতেন, তার অবসর গ্রহণ করার সময় হয়েছিল, তিনি অবসর নিয়ে চলে গেলেন।
তার চলে যাওয়া উপলক্ষে তখনকার শাহবাগ হোটেলে বিভাগ থেকে একটা বিদায়ী ভোজের আয়োজন করা হয়েছিল। তখন শীতের দিন, স্যার তার নতুন পোশাকের ওপর একটি চাদর জড়িয়ে এসেছিলেন। আমার গায়ে ছিল একটি জ্যাকেট। আমার স্মৃতি, বলা যাবে খারাপ স্মৃতি, ওই জ্যাকেটটার অসম্পূর্ণতা নিয়ে। অনুষ্ঠান তো খুব আন্তরিকতাপূর্ণ হলো। বিষণ্ন মুখে আমরা সবাই বিদায় নিলাম স্যারের কাছ থেকে। পরের দিন সকালে বিভাগের অফিস কামরায় গেছি, বিভাগীয় প্রধান এবং আমাদের যে উদারনৈতিক শিক্ষকের কথা ওপরে উল্লেখ করেছি তারা উভয়েই সেখানে ছিলেন। গত রাতের অনুষ্ঠানটি আমার অনেক দিন মনে থাকবে, এ ধরনের কিছু একটা বলবার চেষ্টা করেছিলাম। আমার উদারনৈতিক শিক্ষক কিন্তু কিন্তু করে উঠলেন। বললেন ইংরেজিতে, ‘বাট ইওর অ্যাবসেন্স অব এ টাই ওয়াজ নোটিশড লাস্ট নাইট।’ আমি নিশ্চয়ই আহত ও বিস্মিত হয়েছিলাম, নইলে এতকাল ধরে ব্যাপারটাকে মনে রাখব কেন? কথাটা দ্বিতীয়জন বললেন, প্রথমজন সম্মতিসূচক হাসি দিলেন। আমার বলবার কথা ছিল। অন্তত ওটা বলতে পারতাম যে স্যার, বিলেতে কিন্তু খুব বড় বড় অধ্যাপককে দেখেছি যারা তাদের গলায় টাই আছে কিনা খেয়াল করেন না। তারা নিজেরা ও বিষয়ে মাথা ঘামান না, ছাত্ররা যে খেয়াল করে এমনটা কখনো মনে হয়নি। উল্লেখ করতে পারতাম বিলেতে প্রায় স্থায়ীভাবে অবস্থান নেয়া আমার সহপাঠীরা ঠাট্টা করে বলেছে, স্যারদের স্যুট-টাইয়ের দাপট থেকে বের হয়ে বিলেতে এসে দেখি বিশ্ববিদ্যালয়ে ওসব নিয়ে কারো কোনো মাথা ব্যথা নেই, শিক্ষকরা ব্যাংকের ক্লার্ক বা ইন্স্যুরেন্স এজেন্ট নন যে তাদের স্যুট-টাইয়ে কেতাদুরস্ত থাকতে হবে। আরো একটা কাজ করেছিল ওই বন্ধুদের একজন। আমাকে দেশীয় অনুপস্থিত শিক্ষকদের প্রতিনিধি হিসেবে দাঁড় করিয়ে বলেছিল, তোমরা শিক্ষকরা ছাত্রদের শেখাতে চাও না, তাদের ভয় দেখাতে চাও। কেউ ভয় দেখায় বেত উঁচিয়ে, কেউ দেখায় খাতায় কাটাকুটি করে, কেউ হাতের কাছে অন্যকিছু না পেয়ে স্যুট-টাই দেখায়, বলে দেয়, দেখো তোমরা শিক্ষার্থীরা কত গ্রাম্য, আমরা কত আধুনিক। এসব কথা কি নিজের শিক্ষকদের বলা যায়, মুখের ওপর?
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কিছু বিবরণ দেওয়া গেল; দৃষ্টান্ত হিসেবে। এই দেওয়ার পেছনে উপলব্ধিটা এই যে রাষ্ট্র ও সমাজে অনেক পরিবর্তন এসেছে ঠিকই, কিন্তু শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সম্পর্কে কোনো মৌলিক পরিবর্তন ঘটেনি। তার কারণ একটাই, সেটা হলো সমাজে কোনো বিপ্লব ঘটেনি; বরঞ্চ অন্য বিপ্লবগুলো সামাজিক বিপ্লবের প্রয়োজনীয়তাকে চাপা দিয়ে রেখেছে।
তবে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্কটা দ্বিপক্ষীয় বটে। শিক্ষার্থীদের যেমন প্রত্যাশা থাকে শিক্ষকদের কাছ থেকে, শিক্ষকদেরও তেমনি প্রত্যাশা থাকে শিক্ষার্থী এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছ থেকে।
একেবারে প্রাথমিক প্রত্যাশাটা শিক্ষার্থীদের কাছেই, যার কথা আরো উল্লেখ করেছি। সেটা হলো আগ্রহ। শিক্ষার্থীর আগ্রহ শিক্ষককে সচল রাখে, তাকে চরিতার্থতা দেয়। এটা প্রত্যেক শিক্ষকই অনুভব করেন। ছাত্র যদি আগ্রহী না হয়, তাহলে শিক্ষক এগোতে পারেন না। আবারও নিজেকে দাঁড় করাতে পারি দৃষ্টান্ত হিসেবে। আমি দেখতাম ছাত্রছাত্রীরা যখন আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছে, নোট নিচ্ছে, তখন আমার মনে হতো এর চেয়ে বড় পাওনা বুঝি আর নেই। আমার ধারণা সব শিক্ষকের ক্ষেত্রেই এই বোধটাই চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করে, অনেক অপ্রাপ্তির ক্ষতিপূরণ হয়ে দাঁড়ায়।
আগ্রহই প্রাথমিক বটে, কিন্তু কেবল আগ্রহই কি যথেষ্ট, তাতেই কি চলে? না, চলে না। দরকার হয় সম্মান। এই সম্মানটা কেবল যে শিক্ষার্থীদের পক্ষেই দেয়া সম্ভব, তা নয়। আসতে হয় সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছ থেকে। আর সম্মানটা শুধু মৌখিক হলে কুলায় না, তাকে বস্তুগত হওয়া চাই। বস্তুগত সম্মাননার বেশ কয়েকটি নিরিখ রয়েছে। প্রাথমিক নিরিখটি হচ্ছে রাষ্ট্রীয়ভাবে শিক্ষাকে কতটা গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে সেই বিষয়টি। এটা এখন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত যে জাতীয় আয়ের শতকরা ৬ ভাগ শিক্ষা ক্ষেত্রে বরাদ্দ করা ন্যায়সঙ্গত। এ ক্ষেত্রে আমাদের বরাদ্দ প্রায় অর্থ বছরে থাকে শতকরা ২.০৬ ভাগ; সেটা নেমে দাঁড়িয়েছে ১.৮৮ ভাগে। শিক্ষার ব্যাপারে ভারত যে আদর্শ তা হয় তো বলা যাবে না, কিন্তু ভারতের বরাদ্দ যে শতকরা ৩.৫০ ভাগ সেটা তো লক্ষ্য করবার মতো। বাংলাদেশ যে তার বরাদ্দের পরিমাণ কমাল তা নিশ্চয়ই কোনো দুর্ঘটনা নয়, এটি রাষ্ট্রীয় নীতিরই প্রতিফলন। রাষ্ট্রের চোখে শিক্ষা কতটা গুরুত্বপূর্ণ বরাদ্দের এই নিম্নগতি থেকে সেটার ধারণা পাওয়ার চেষ্টা মোটেই অন্যায় নয়। শিক্ষামন্ত্রী স্বয়ং এ নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু রাষ্ট্র তার দুঃখে কোনো প্রকার সহানুভূতি প্রকাশ করেনি। কাতর হওয়া দূরের কথা। স্বাস্থ্য খাতেও অবশ্য একই দশা। গত বছর সেখানে বরাদ্দ ছিল জাতীয় আয়ের ৪.৮১ শতাংশ, এবার নেমে গিয়ে ভয়ে ভয়ে স্থির হয়েছে ৪.৩০ শতাংশে। রাষ্ট্র তার নাগরিকদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের বিষয়ে কতটা উদ্বিগ্ন এই নিম্নগমন তার চমৎকার উন্মোচন। ভারত তার বার্ষিক বাজেটে শিক্ষার জন্য বরাদ্দ রেখেছে মোট খরচের ২০ শতাংশ, বাংলাদেশের বাজেটে শিক্ষার ভাগে গত বছর বরাদ্দ ছিল ১২ শতাংশ, এবার নেমে দাঁড়িয়েছে ১১ শতাংশে।
শিক্ষা ক্ষেত্রে ব্যয় আসলে ব্যয় নয়, বিনিয়োগ। বাংলাদেশে জনসংখ্যা বিপুল এবং অন্যান্য সম্পদ এখন পর্যন্ত অত্যন্ত সীমিত। সে জন্য মানুষকে দক্ষ ও উৎপাদনশীল করতে না পারলে এ দেশের ভবিষ্যৎ খুবই অন্ধকারাচ্ছন্ন। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয় বরাদ্দ কিন্তু সবেগে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে সামরিক খাতে বরাদ্দ তো অপ্রতিহত। এই ব্যয় দেশকে কী উপহার দিচ্ছে তা বলা মুশকিল। বিভিন্ন মহল থেকে দাবি উঠেছে বাজেটের শতকরা ২৫ ভাগ শিক্ষা খাতে ব্যয় করা উচিত। এটা মোটেই কোনো অযৌক্তিক দাবি নয়।
শিক্ষকদের বেতনের দিকেও তাকানো যেতে পারে। না তাকালে শিক্ষার মান কেন বাড়ছে না সেটা বোঝা যাবে না। অভাবে ও অসম্মানে পীড়িত শিক্ষক মাথা উঁচু করে দাঁড়াবেন কি করে? কি করেই বা বীরের ভাবমূর্তি অক্ষত রাখবেন? শিক্ষকদের বেতনের ব্যাপারটা তাই শিক্ষার মানোন্নয়নের অত্যাবশ্যকীয় শর্ত। ভারতের অধ্যাপকদের সর্বোচ্চ বেতন ১ লাখ ৩৫ হাজার রুপি, তার বিপরীতে ক্যাবিনেট সেক্রেটারির বেতন, যেটা সরকারি কর্মচারীদের সর্বোচ্চ, তা হলো ৯০ হাজার রুপি। সম্প্রতি আমাদের জাতীয় বেতন স্কেল সংশোধন করা হয়েছে, তাতে অধ্যাপকদের সর্বোচ্চ বেতন নির্ধারিত হয়েছে ৮০ হাজার টাকা।
সরকারি কর্মচারীদের অনেকের জন্যই আবাসনের ব্যবস্থা আছে। শিক্ষকদের জন্য বাসস্থানের ব্যবস্থা করাটাকে কোনো সরকারই গুরুত্ব দেয় না। তারা কোথায় থাকে, কীভাবে থাকে, কীভাবে কর্মস্থলে যাতায়াত করে, তা নিয়ে কারোই উদ্বেগ নেই। দেশের সর্বাধিক মেধাবানদের শিক্ষাক্ষেত্রে নিয়ে আসা দরকার। তারা আসছে না। অধিকাংশ শিক্ষকই শিক্ষক হয় অন্য পেশায় সুযোগ না পেয়ে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার চেয়ে সরকারি অফিসের পিওন হওয়াটা অধিক মর্যাদার ব্যাপার, এই মনোভাব আগে ছিল, এখনো বদলায়নি।
এরকম অবস্থায় শিক্ষকদের মানসম্মান বাড়বে কী করে? বাড়ছে না, বরং কমছে। রাষ্ট্র কেবল যে উপেক্ষা করে তাই নয়, অপমানও করে। বহু দৃষ্টান্তের দরকার পড়ে না, যে কোনো একটি ঘটনাই সত্য-উন্মোচনের জন্য যথেষ্ট। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা চলছিল পিরোজপুরে। সরকারি কলেজের একজন সহকারী শিক্ষক কর্তব্য পালন করছিলেন একটি কক্ষে। সেখানে উপজেলা নির্বাহী অফিসার আসেন পরিদর্শনে। দু’জনের মধ্যে অধিকার অনধিকার নিয়ে বাদানুবাদ হয়, বিরোধ বাধে। পরিণামে কলেজের অধ্যক্ষের সামনে এবং প্রকাশ্যে কলেজ শিক্ষকটিকে সরকারি কর্মচারীটির পা ছুঁয়ে ক্ষমা চাইতে হয়। খবরটা খবরের কাগজে এসেছে। দু’জনেই সরকারি কর্মচারী, পদমর্যাদার একজন অপরজনের চেয়ে খাটো হওয়ার কথা নয়। তদুপরি নির্বাহী অফিসার সহকারী অধ্যাপকের তুলনায় পাঁচ বছরের জুনিয়র। খবরে এও প্রকাশ পেয়েছে, অপমানিত শিক্ষকটি আত্মহত্যার কথা চিন্তা করেছিলেন। পারেননি নিজের কন্যা সন্তানটির কথা ভেবে।
হয়তো এটি একটি চরম ঘটনা। কিন্তু নানা মাত্রায় প্রকাশ্যে অপ্রকাশ্যে শিক্ষকের মানহানি প্রতিনিয়ত ঘটছে। শিক্ষকদের নত করা হচ্ছে। তাদের শিরদাঁড়া দুর্বল করে দেওয়া হচ্ছে। শিক্ষকের মেরুদণ্ড না থাকলে শিক্ষার মেরুদণ্ড ঠিক থাকবে কি করে? থাকবে না, থাকছেও না; এবং না থাকার প্রমাণ সর্বত্র দৃশ্যমান।
শিক্ষার্থীদের আগ্রহের কথা বলছিলাম। আগ্রহকে প্রণোদনাও বলা চলে। প্রণোদনাটা ক্রমাগত কমছে। কারণ বেকারত্ব ভয়ংকরভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। পরিসংখ্যান বলছে দেশে এখন শতকরা ৪৭ জন গ্র্যাজুয়েট বেকার। যারা কাজ পেয়েছে, তাদেরও একটা কাজে সংসার চলে না, অতিরিক্ত কাজ খুঁজতে হয়, এবং পারলে আশ্রয় নিতে হয় দুর্নীতির। শিক্ষা তাই দামি ঠিকই, তার জন্য খরচপাতি করতে হয়, কিন্তু শিক্ষা মূল্যবান নয়, শিক্ষা জীবিকার নিশ্চয়তা দেয় না।
শিক্ষা ও চিকিৎসা দুটিই মানুষের মৌলিক চাহিদা এবং দুটিই এখন পণ্যে পরিণত, দুটিই ক্রয়-বিক্রয়ের সামগ্রী। শিক্ষক যদি দোকানদার হন, তবে তিনি তো আর শিক্ষক থাকেন না; অথচ ব্যাপারটা সে রকমেরই দাঁড়াচ্ছে। ‘সফল’ শিক্ষকরা এখন সফল দোকানদার। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের আয়ের ওপর ভ্যাট বসানো হয়েছে। এটা একটা চমৎকার স্বীকৃতি এই বাস্তবতার যে এসব প্রতিষ্ঠান এখন পুরোপুরি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। বাণিজ্যিক স্বীকৃতিটি সরকারি। কিন্তু তাদের ভুক্তভোগী হবে কারা? হবে শিক্ষার্থীরা, তাদের জন্য শিক্ষা আরো ব্যয়বহুল হয়ে পড়বে। এ ক্ষেত্রেও শিক্ষার প্রতি সরকারি দৃষ্টিভঙ্গি বেশ সরলভাবেই বেরিয়ে এসেছে।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়