যৌতুকের জন্য স্ত্রী হত্যার মামলায় স্বামীর মৃত্যুদণ্ড

আগের সংবাদ

বিদেশিদের নজর ঢাকার দিকে : ব্যস্ত সময় পার করলেন ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কোরিয়ার শীর্ষ কূটনীতিকরা

পরের সংবাদ

দক্ষিণ চট্টগ্রামের ভাষা

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

উপভাষা আলোচনায় হাস্যরস আস্বাদন আর উপভাষা নিয়ে উপহাস বাঙালির আজন্ম। মধ্যযুগে শ্রীচৈতন্যও নাকি নবদ্বীপে কিংবা উড়িষ্যায় পূর্ববঙ্গের মানুষ পেলে : ‘বঙ্গদেশি বাক্য অনুকরণ করিয়া।/বাঙালেরে কদর্থেন হাসিয়া হাসিয়া\’ সমকালে অনেক শিক্ষিত বাঙালির কথোপকথনে এবং অনলাইন লেখালেখিতে পাই: ‘বাংলা ভাষা আহত হয়েছে সিলেটে, শয্যাশায়ী নোয়াখালীতে আর নিহত হয়েছে চট্টগ্রামে।’ চলিত বাংলা ভাষারীতির প্রবর্তক প্রমথ চৌধুরীর নামে প্রচলিত একথা যে তিনি বলেননি- তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবু আঞ্চলিক ভাষা, নারী-পুরুষের ভাষা, হিন্দু-মুসলমানের ভাষা এবং বিভিন্ন পেশাগত ভাষার বৈচিত্র্য আমাদের মুগ্ধ করে। বিশেষত আঞ্চলিক ভাষার বৈচিত্র্য-ব্যবধান নিয়ে সৃষ্ট বাক্চাতুর্য বাঙালির কৌতুকের খোরাক জোগায়। প্রকৃত অর্থে বাংলাদেশে সিলেট-নোয়াখালী ও চট্টগ্রামের ভাষাই প্রমিত বাংলা ভাষা থেকে সবচেয়ে দূরবর্তী; অনেকটা প্রান্তীয় অঞ্চলে অবস্থানের কারণে। বিশেষত সিলেট-চট্টগ্রামের সাধারণ জনগণ নিজেদের ভাষাকে বাংলার উপভাষা বলতে নারাজ। তারা অসিময়া ভাষার সাথে তুলনা করেন, বিদেশি বিভিন্ন মিউজিয়মে প্রদর্শিত ভাষার তালিকা আর অন্তর্জালের বিভিন্ন তথ্য থেকে নিজ নিজ আঞ্চলিক ভাষার ভাষাত্ব প্রমাণের পক্ষে যুক্তি দাঁড় করান। অবশ্য অস্বীকার করবার কোনো সুযোগ নেই- বাংলা ভাষার সাথে আসামের অসমিয়া ভাষার যে পার্থক্য, ঠিক সেই একই মাত্রার পার্থক্য সিলেটের ভাষার সাথে, আর চট্টগ্রামের ভাষার সাথে এই পার্থক্য আরো বেশি। এদিক দিয়ে এগুলো একেকটি স্বতন্ত্র ভাষা বটে। এদের নিজস্ব বিশাল সমৃদ্ধ শব্দভাণ্ডার রয়েছে, বাক্যরীতিতেও বেশ পার্থক্য বিদ্যমান। তবে মনে রাখতে হবে যে, দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হয় এমন মাত্র দুইশ’ ভাষা আছে দুনিয়ায়। এসব বিকাশমান ভাষার মধ্যে নেই আলোচ্য উপভাষা দুটির কোনোটি। এমনকি প্রমিত বাংলা ভাষাও তার সাংবিধানিক স্বীকৃতি নিয়ে সর্বস্তরে সমাসীন হতে পারছে না। অন্যদিকে চট্টগ্রামের ভাষা-আলোচনায় দক্ষিণ চট্টগ্রাম বলতে কক্সবাজারের অন্তর্ভুক্তি নিয়ে ভিন্নমত সচেতন মহলকে ভাবনায় ফেলে। গ্রিয়ার্সন মায়ানমারের উত্তর-আকিয়াব অঞ্চলের ভাষাকেও বাংলার উপভাষা বলেছেন। বর্তমান প্রবন্ধে আপাতত দক্ষিণ চট্টগ্রামের ভাষা বা চাটগাঁ ভাষা নিয়েই আলোচনা থাকবে।
বাংলাদেশ ভূখণ্ডের টেকনাফ থেকে ফেনী নদীর দক্ষিণ তীর পর্যন্ত এলাকায় প্রচলিত বাংলা কথ্য ভাষাকে বলা যেতে পারে চাটগাঁ ভাষা। চাটগাঁ ভাষার বোধগম্যতা প্রসঙ্গে মনিরুজ্জামান যথার্থই মনে করেন যে এটি সাধারণ বাঙালির জন্য একটি দূরবর্তী (অন্ত্য-প্রান্তিক) ভাষা। তার অব্যর্থ অবলোকন: ‘অন্যান্য উপভাষাভাষী যে কেউ একজন অপরিচিতের সামনে নিজের উপভাষায় কথা বলতে সংকোচ বোধ করবেন। চট্টগ্রামের লোকের সে কমপ্লেক্স নেই। উপভাষাকে যে জন্য স্ল্যাং বলা হয়, এরা যেন তা কাটিয়ে উঠেছেন।’ তবে ভাষা না উপভাষা এ বিতর্কে মত্ত না থেকে আমাদের মনে রাখতে হবে যে, ‘ভাষা হচ্ছে সামরিক শক্তিতে সমৃদ্ধ একটি উপভাষা’। এই উক্তিটি সমাজবিজ্ঞানী এবং ইহুদী পন্ডিত ম্যাক্স ওইয়েনরিচ জনপ্রিয় করেছিলেন। উপভাষা ও ভাষার পার্থক্যের প্রচলিত প্রকৃতি সম্পর্কে এটি একটি অ্যাফরিজম। এটি ভাষা-উপভাষার স্থিতি সম্পর্কে একটি সম্প্রদায়ের ধারণার ওপর সামাজিক এবং রাজনৈতিক অবস্থার যে প্রভাব থাকতে পারে সর্বোপরি, ভাষাবিজ্ঞানীর প্রভাব যে এতে নেই বললেই চলে- তা নির্দেশ করে। আর তাই ভাষাবিজ্ঞানী পবিত্র সরকার লিখেন : ‘বাংলা বনাম নোয়াখালী উপভাষা বনাম চট্টগ্রামী উপভাষা’র তুলনাতে ‘বাংলা’ কথাটির বদলে ‘প্রমিত বাংলা’ পদবদ্ধকে গ্রহণ করতে সুপারিশ করি, কারণ তাতে প্রমিত বাংলাও যে একটি উপভাষা, হয়তো বিশেষ আধিপত্যকারী
উপভাষা- তা প্রতিষ্ঠিত হবে। এতে করে আমরা রাজনৈতিক পরিচয়ে বাংলাদেশি বা বাঙালি হয়েও রাষ্ট্রভাষা বাংলাকে যেমন লালন করবো তেমনি আমাদের আঞ্চলিক ভাষাকেও চর্চায় রাখব। এ ভাষার অনুশীলন-গবেষণার মাধ্যমে বাংলা ভাষারও উন্নয়ন ঘটাতে নিজেদের সক্রিয় রাখতে পারব।
শত বছর আগে বাংলা আঞ্চলিকভাষা চর্চার প্রবাদপুরুষ জর্জ আব্রাহাম গ্রিয়ার্সন তার ‘দ্যা লিংগুইস্টিক সার্ভে অব ইন্ডিয়া’ গ্রন্থের ৫ম খণ্ডে বাংলা উপভাষা অঞ্চল বলতে আসাম (অসম) সীমান্ত থেকে বিহার (পুর্নিয়া) সীমান্ত ও দক্ষিণে একদিকে (দক্ষিণ-পূর্ব) পার্বত্য চট্টগ্রাম ও মিয়ানমারের নাফ নদীর কূল, ও অন্যদিকে (দক্ষিণ-পশ্চিম) ওড়িশা-সীমান্ত ও (পশ্চিমে) সাঁওতাল পরগনার আরম্ভ-সীমা পর্যন্ত বিস্তৃত ভূ-অঞ্চলে ও অধুনা রাজনৈতিকভাবে দ্বিধান্বিত-দ্বিখণ্ডিত দুটি আধুনিক রাষ্ট্রে যে ভাষা-অঞ্চল বিস্তৃত তাকে বুঝিয়েছেন। তিনি বাংলার উপভাষাকে সাতটি শ্রেণিতে বিশ্লেষণ করেন। আর দক্ষিণ-প্রাচ্য বঙ্গ শ্রেণিকে আরো চারটি উপশ্রেণিতে ভাগ করেন। গ্রন্থের ৭ম পরিচ্ছেদে ‘সাউথ-ইস্টার্ন বেঙ্গলি’ বা দক্ষিণ-প্রাচ্য বাংলা সম্পর্কে তিনি লিখেন : ‘বঙ্গোপসাগরের পূর্ব তীর বরাবর নোয়াখালী জেলা (স›দ্বীপসহ যেখানে পূর্ববঙ্গীয় ভাষা প্রচলিত), চট্টগ্রাম জেলা এবং আকিয়াব জেলার উত্তরাংশ যা বার্মা (বর্তমান মায়ানমার) রাজ্যের অন্তর্গত, অঞ্চলগুলোতে যে-স্বাতন্ত্র্যসূচক (পিকিউলিয়ার) বাংলা উপভাষা কথিত হয় তাকে আমি বলেছি দক্ষিণ-প্রাচ্য। এখানে বিশেষত চট্টগ্রামে এবং আকিয়াবে প্রচলিত অপভ্রংশের বিকাশ প্রাচ্যবঙ্গীয় ভাষার চূড়ান্ত সীমায় অগ্রসর হয়েছে। ভাষার দৃশ্যমান ব্যবধান এত বেশি যে, বাংলার অন্য কোনো অঞ্চলের বাঙালি সচরাচর এ ভাষা বুঝতে পারেন না। চট্টগ্রামীর কাছে এই উপভাষা চাটগাঁইয়া নামে পরিচিত, …পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমারা একটি উপ-উপভাষায় কথা বলেন, …পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিকাংশ এলাকায় দক্ষিণ-প্রাচ্য বাংলা ভাষাটি একটি সংযোগকারী ভাষা (লিঙ্গুয়াফ্রাংকা) রূপে ব্যবহৃত হয়, এছাড়াও অনেক তিব্বতি-বর্মি ভাষা স্রোত এই অঞ্চল দিয়ে প্রবাহিত।’ গ্রিয়ার্সন দক্ষিণ-প্রাচ্য বাংলা ভাষার চারটি অঞ্চল : নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, আকিয়াব এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের (চাকমা) কথা বললেও আকিয়াবের ভাষার কোনো নমুনা সংকলন করেননি। চাকমা সাব-ডায়েলেক্টের দুটি নমুনা এবং নোয়াখালী অঞ্চলের হাতিয়া, ছাগলনাইয়া ও রামগঞ্জ নিয়ে পাঁচটি নমুনা সংকলন করেন। অথচ চট্টগ্রামের ভাষাকে তিনি সমগ্র দক্ষিণ-প্রাচ্য বাংলার লিঙ্গুয়া-ফ্রাংকা বলে স্বীকার করে নেবার পরও একজন ব্যক্তি দ্বারা সংগৃহীত মাত্র দুটো নমুনা সংকলন করেন। গ্রিয়ার্সন পূর্ববঙ্গীয়তে স›দ্বীপের তিনটি নমুনা সংকলন করেন, কিন্তু দক্ষিণ-প্রাচ্য বাংলার মহেশখালী-কুতুবদিয়ার ভাষার কোনো নমুনা কেন সংকলন করেননি? তা আজও এক বিস্ময়।
গ্রিয়ার্সনের আগে এবং সমকালেই বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা ভাষার বিবরণমূলক আলোচনা শুরু করেন। কবিগুরু উপলব্ধি করেন : ‘বাংলাদেশের ভিন্ন ভিন্ন অংশে যতগুলো উপভাষা প্রচলিত আছে তাহারই তুলনাগত ব্যাকরণই যথার্থ বাংলার বৈজ্ঞানিক ব্যাকরণ।’ মাতৃভাষা প্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে বিশ শতক জুড়ে চাটগাঁ ভাষা নিয়ে প্রবন্ধ লিখেছেন বসন্তরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়, চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং আরো অনেকে। তবে চট্টগ্রামী উপভাষা নিয়ে আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদের আগে কেউ বিস্তৃত আলোচনা করেননি। সাহিত্য বিশারদের আলোচনাটি ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে সওগাতে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হলেও ইসলামাবাদ নামে গ্রন্থরূপ পায় ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে। আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদের ভাষায় : ‘চট্টগ্রাম ভারতের বা বঙ্গের বাহিরে নহে, হাজার অপভ্রষ্ট হওয়া সত্ত্বেও চট্টগ্রামের কথ্য ভাষাও তেমনি বাঙ্গালা ভাষার বাহিরে নয়। …চেষ্টা করিলে আসামিদের মতো আমরাও অনায়াসে একটা পৃথক ভাষা সৃষ্টি করিতে পারিতাম।’ চট্টগ্রামের ভাষা নিয়ে দুটো বই প্রকাশিত হয় ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে। আবদুর রশিদ ছিদ্দিকীর চট্টগ্রামী ভাষাতত্ত্ব আর ড. মুহম্মদ এনামুল হকের চট্টগ্রামী বাঙ্গালার রহস্য-ভেদ। ফটিকছড়ির সন্তান এনামুল হকের গ্রন্থে চট্টগ্রামী ভাষাতত্ত্ব-র উল্লেখ প্রমাণ করে গ্রন্থটি আগে প্রকাশিত। চকোরিয়ার সন্তান আবদুর রশিদ ছিদ্দিকীর গ্রন্থের প্রারম্ভিক বাক্যেই তার দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশিত : ‘উর্দ্দুই চট্টগ্রামী ভাষার বাহন, আরবী ইহার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, পার্শি ইহার অঙ্গরাগ এবং বাঙ্গালা ইহার নয়নাঞ্জন।’ বিশেষত আবদুর রশিদ ছিদ্দিকীর আলোচনায় ভাষাতাত্ত্বিক আলোচনার নিয়ম পূর্ণমাত্রায় অনুসৃত নয়। তবে কাল বিবেচনায় বলতে হয়: তিনি যথেষ্ট সাহসিকতার পরিচয় রেখেছেন। এনামুল হকের গ্রন্থনামেই স্পষ্ট হয় তিনি বাংলার উপভাষা হিসেবে চট্টগ্রামের ভাষার রহস্য উদঘাটনে ব্রতী হন এবং এভাষার নমুনা হিসেবে গ্রিয়ার্সনের সংগৃহীত গল্পের সাথে একটি মুসলিম ভাষারীতির যে গল্পটি সংকলন করেন তাও ফটিকছড়ি অঞ্চলের ভাষার নমুনা। তিনি দেখান চট্টগ্রামী ভাষায় বাঁআল বা বাঙাল মানে-মূর্খ; অভদ্র; ছোটলোক। এ থেকে সহজেই অনুমেয় বর্তমান চট্টগ্রামে যেমন ‘বৈঙ্গা’ গালি, তেমনি আগেকার দিনেও চট্টগ্রামে ‘বাঙাল’ বা ‘বাআঁল’ বলতে বহিরাগত বা গালি বোঝাত। সিলেটেও বাঙ্গাল গালি অর্থে ব্যবহৃত। উভয় অঞ্চলেই বাঙালি থেকে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য রক্ষায় সাধারণ জনগণ সদা সচেতন।
জানামতে চট্টগ্রামের ভাষা নিয়ে তিনটি পিএইচডি গবেষণা-সন্দর্ভ রচিত হয়েছে। গবেষকগণ হলেন: নারিহিকো উচিদা, রবীন্দ্র কুমার দত্ত এবং যুবাইর মুহম্মদ এহসানুল হক। এর মধ্যে কেবল রবীন্দ্র কুমার দত্তের গবেষণাটি ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়ে সাধারণ পাঠকের হাতে পৌঁছায়। চাটগাঁ ভাষা পরিষদ আয়োজিত ১৮ ডিসেম্বর ২০১০ ও ৫ মার্চ ২০১১ তারিখে অনুষ্ঠিত দু’দিনের সেমিনারে পঠিত ৯টি প্রবন্ধ এবং প্রবন্ধগুলোর ওপর ১৯ জন আলোচকের আলোচনা নিয়ে চাটগাঁ ভাষার রূপ-পরিচয় (২০১২) নামে একটি সম্পাদিত গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এতে আঞ্চলিক ভাষাটির কোনো ক্ষেত্রকর্মভিত্তিক প্রবন্ধ উপস্থাপিত না হলেও উঠে আসে কিছু বিশেষজ্ঞজনোচিত প্রস্তাব-সিদ্ধান্ত। সে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগ অবশ্য দেখা যাচ্ছে না; তবে আশার আলো এখনও কোথাও কোথাও জ্বলছে।
চট্টগ্রামের উপভাষা বিষয়ক সর্বশেষ প্রকাশিত গবেষণাগ্রন্থে ভাষাবিজ্ঞানী মনিরুজ্জামান চট্টগ্রামের অধিবাসীদের ভাষা-ব্যবহারের সংশ্লিষ্ট (সামাজিক) তথ্য উপস্থাপন করেছেন ‘কক্সবাজার ব্যতিরেকে’। তিনি চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক প্রভাবের কারণে যে চতুরাঞ্চলে বিভক্ত করেছেন তাতেও কক্সবাজার কিংবা মহেশখালী-কুতুবদিয়া নেই। তার ভাষায়, ‘সর্ব দক্ষিণ ভূ-ভাগের কক্সবাজারের প্রান্তীয় পরিস্থিতি বাদ দিলে চট্টগ্রামের ভাষার (উপভাষার) ক্ষেত্রে যে বৈচিত্র্য লক্ষ করা যায় সাধারণভাবে তা ‘উত্তরের’ ও ‘দক্ষিণী’ রূপে বর্ণিত হলেও আসলে তা এই চারভাগের বৈশিষ্ট্যকেই ধারণ করে আছে।’ অথচ ভাষাবিজ্ঞানী মাত্রেই স্বীকার করেন যে, ভাষা বলতে কেন্দ্রীয় ও প্রান্তীয় সমস্ত উপভাষার মিলিত সম্ভার বোঝায়। বরেণ্য এই ভাষাবিজ্ঞানী তার আলোচ্য গ্রন্থে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলার পৃথক বর্তমান মানচিত্র ব্যবহার করেছেন। তিনি অর্ধশতব্দী (১৯৬২-২০১২) চট্টগ্রামে বসবাস ও ভাষাবিজ্ঞানে অধ্যাপনা-অভিজ্ঞতায় জারিত হয়ে লিখলেন: ‘চট্টগ্রামের উপভাষা বাংলাভাষার প্রাচ্য বিভাগের পূর্ব প্রান্তিক উপভাষা (দ্র. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ১৯৬৫)। সুকুমার সেন, পরেশচন্দ্র মজুমদার, গোপাল হালদার, আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ ও অন্যান্য গবেষকগণ চট্টগ্রামের উপভাষাকে স্বতন্ত্রভাগে না ফেলে পূর্ববঙ্গীয় অথবা পূর্ববঙ্গীয় উপভাষার দক্ষিণ-পূর্ব উপভাষার অন্তর্গত উপভাষারূপে (দ্র. গ্রিয়ার্সন ১৯০৩: ২৯১) শ্রেণিভাগ করেছেন। সেই হিসেবে আমরা এখানে চট্টগ্রামের উপভাষার তথা ভাষা-বৈচিত্র্যটির একটি সাংগঠনিক বিবরণ লক্ষ্য করার চেষ্টা করব।’ এখানে উপমহাদেশের প্রখ্যাত এই ভাষাবিজ্ঞানী গ্রিয়ার্সনের উপভাষা শ্রেণিকরণকে মেনে নিয়ে ‘সেই হিসেবে’ সাংগঠনিক আলোচনায় অগ্রসর হলেন কিন্তু গ্রিয়ার্সনের সমগ্র চট্টগ্রামকে আলোচনায় রাখলেন না। অন্যদিকে মুনীর চৌধুরী, মুহম্মদ আবদুল হাই, আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ, পবিত্র সরকার ও মহাম্মদ দানীউল হক প্রমুখ ভাষাবিজ্ঞানীগণের সাংগঠনিক আলোচনায় চট্টগ্রামের উপভাষা স্বতন্ত্র হিসেবে শ্রেণিকরণ সমীচীন মনে করেছেন। সে-প্রসঙ্গে তিনি নীরব। অবশ্য আশার কথা তিনি মেনে নেন যে চট্টগ্রামী উপভাষার বৈচিত্র্য ও উপআঞ্চলিক বিচিত্রতার সামগ্রিক পরিচয় একটি আলোচনায় আনা আসলেই দুরূহ। তবু তিনি তার বইয়ের দেড় পৃষ্ঠা জুড়ে ‘উত্তর-চট্টগ্রামী’, ‘দক্ষিণ-চট্টগ্রামী’ এবং ‘কক্সবাজার রূপ’ এর ধ্বনিগত ভেদ এর একটি সাধারণ চিত্র আমাদের উপহার দেন। কক্সবাজার বা দক্ষিণ-চট্টগ্রামের ভাষা বিষয়ে এটিও আমাদের কম প্রাপ্তি নয়।
ড. মাহবুবুল হকও তার আলোচনায় চট্টগ্রামের উপভাষা বলতে কক্সবাজার জেলাকে বাদ দিয়েছেন। তিনি স্থানভেদে চট্টগ্রামি উপভাষায় ধ্বনিরূপগত পার্থক্য দেখিয়েছেন এভাবে: ‘উত্তর চট্টগ্রামে : বুইজ্জা কুইজ্জাত্তুন গোইজ্জাই গোইজ্জাই দোইজ্জাত্ পোইজ্জে গোই। দক্ষিণ চট্টগ্রামে: বুইর্গা কুর্ইগ্যাাত্তুন গোর্ইগ্যাই গোর্ইগ্যাই দোর্ইগ্যাত্ পোর্ইগে গোই।’ অথচ ড. মনিরুজ্জামান দেখিয়েছেন কক্সবাজারে দুটো রূপই লভ্য। উপরন্তু তিনি সাম্প্রতিক প্রবন্ধে প্রমাণ করেছেন: ‘নদী বা প্রান্তর নয় বরং পাহাড়ই চট্টগ্রামী উপভাষার উপবিভাজনের ক্ষেত্রে নিয়ামক সে কথা কোথাও বলা নেই। অথচ সেটিই বাস্তব। সেই হিসেবে শুধু উত্তর-দক্ষিণ এইভাবে চট্টগ্রামী উপভাষার বিভাজন যথার্থ হয় না।’ সুতরাং কক্সবাজারের ভাষাকে বিবেচনায় নিয়ে সমগ্র চট্টগ্রামের ভাষাকে রূপান্তর ব্যাকরণের আলোকে শ্রেণিকরণ এখন সময়ের দাবি।
আরও আগে আবদুল হক চৌধুরী তার চট্টগ্রামের সমাজ ও সংস্কৃতির রূপরেখা গ্রন্থের অষ্টম পরিচ্ছেদে ‘চট্টগ্রামের ভাষা’ প্রসঙ্গে এর কারণ উল্লেখ করেন: ‘…শঙ্খ নদীর দক্ষিণ তীর হতে টেকনাফ পর্যন্ত দক্ষিণ চট্টগ্রামের এই অংশটি ১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দ অবধি আরাকান রাজ্যভুক্ত থাকায় সেখানকার কথ্য চট্টগ্রামী উপভাষা আরাকানী ভাষার ঢঙ্গে গড়ে উঠে, ফলে উচ্চারণ-ধ্বনি আরাকান ভাষার অনুসারী।’ তবে পার্থক্য কেবল ‘উচ্চারণ-ধ্বনি’ নয় শব্দ ও বাক্যরীতিতেও বিদ্যমান। পার্থক্য যতই থাকুক বোধগম্যতার দিক দিয়ে এটি চাটগাঁ ভাষা বৈ-অন্য নয়। এই পার্থক্য এবং ঐক্যের স্বরূপ উপলব্ধির লক্ষ্যে ড. মুহম্মদ এনামুল হক সংগৃহীত দুটো লোকভাষার গল্পকে উত্তর-চট্টগ্রাম (হাটহাজারি-ফটিকছড়ি ইত্যাদি), মধ্যচট্টগ্রাম (চট্টগ্রাম শহর-পটিয়া) এবং দক্ষিণ-চট্টগ্রামের (কক্সবাজার) আঞ্চলিক ভাষায় রূপান্তর করে দেখা যায়: ফটিকছড়ির সন্তান মুন্সী আহমদুর রহমান এর মুখে শোনা গল্পটি দক্ষিণ-চট্টগ্রামের রামু-টেকনাফে প্রায় ৪১ শতাংশ পরিবর্তিত রূপ লাভ করে। আবার, গ্রিয়ার্সনের গ্রন্থের জন্যে জে ডি এন্ডার্সন সংগৃহীত গল্পটি কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ পড়ে এসে- মধ্যচট্টগ্রামে প্রায় ২৫ শতাংশ পরিবর্তিত রূপ লাভ করে। আলোচনা থেকে অনায়াসে অনুধাবন করা যায় যে, মিরসরাই-ফটিকছড়ির ভাষা চট্টগ্রাম শহরে এসে উনিশ-বিশ ভাগ বদলে যায়। আনোয়ারা-বোয়ালখালীতে সে-বদল পঁচিশ ভাগ, আর কক্সবাজার-উখিয়ায় পৌঁছে সে-রূপান্তর চল্লিশ ভাগের ওপর হতে পারে। তবু তা চট্টগ্রামী বা চাটগাঁ ভাষা। এমনকি চট্টগ্রামের বাসিন্দাদের বুলি: ওবা ভাত্ ন খাইবা না? কণ্ডে যাইবা? আর চট্টগ্রামে বসবাসকারী রোয়াইঙ্গা মানুষদের বুলি: অবা, ভাত ন খাইব নে? কন্দে যাইব? দুটোই চাটগাঁ ভাষার সম্পদ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রণীত বাংলা বানানের নিয়মে (১৯৩৬) যেমন বিকল্প বানান স্বীকৃত ছিল, তেমনি চাটগাঁ ভাষাতেও আপাতত ‘হক্সবাজারর দইর্গার ফানি হরহইর্গ্যা’ কিংবা ‘কক্সবাজার্র দইজ্জার পানি হরহইয্যা’ এমন বিকল্প বাক্যের বা বিকল্প রূপের (যেমন: আঁই কর্গি/ কজ্জি, মার্গি/ মাজ্জি, ধর্গি/ ধজ্জি, কর্গিলাম/ কজ্জিলাম্ ইত্যাদি) ব্যবহারে স্বীকৃতি দিতে হবে। ভাষাবিজ্ঞানীগণ গবেষণা করে ভাষার মানরূপ, কেন্দ্রীয় অঞ্চল নির্ণয় করবেন। তবে সে-অপেক্ষায় বসে না থেকে চাটগাঁ ভাষায় দৈনিক পত্রিকা এখনি না হোক, একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ প্রয়োজন। অন্তত বৃহত্তর চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত প্রতিটি দৈনিক, সাপ্তাহিক ও সাময়িকীতে এক পৃষ্ঠা চাটগাঁ ভাষায় প্রকাশিত হোক। চট্টগ্রাম বেতারের মতো চট্টগ্রাম টেলিভিশনেও প্রতিদিন অন্তত একবার চাটগাঁ ভাষায় খবর প্রচারের জোর দাবি তোলা হোক।
চাটগাঁ-ভাষা কি ভাষা, না উপভাষা- সে বিতর্কে বৃথা সময় ব্যয় না করে চাটগাঁ ভাষা নিয়ে ব্যাপক মাঠকর্ম-ভিত্তিক উপাত্ত নিয়ে রূপান্তরমূলক সৃষ্টিশীল ব্যাকরণের আলোকে গবেষণায় চাটগাঁবাসীকে উত্তর-দক্ষিণ বিভাজন ভুলে একসাথে এগিয়ে আসতে হবে। চাটগাঁ ভাষাকে পাঠ্য বইয়ের ভাষায় উন্নীত করতে পারলে অদূর ভবিষ্যতে পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্রনৃগোষ্ঠীর জন্যেও আর পৃথক পৃথক ভাষায় প্রাথমিকের পাঠ্যবই পড়ানোর প্রয়োজন হবে না। যেহেতু চাটগাঁ ভাষাকে তারা লিঙ্গুয়াফ্রাংকা হিসেবে ব্যবহার করে আসছেন। তবে স্মরণ রাখতে হবে দক্ষিণ-চট্টগ্রাম তথা কক্সবাজারের ভাষা নিয়ে কোনো গবেষণা-কর্ম আমাদের হাতে আপাতত নেই। বিশ্বের দীর্ঘতম বালুকাময় সমুদ্রসৈকতের প্রতি যেমন বিশ্ববাসীর আগ্রহ, তেমনি কক্সবাজারের ভাষা-সংস্কৃতির প্রতিও আকর্ষণ কম নয়। কক্সবাজারে সংস্কৃতি তথা লোকসংস্কৃতির চর্চায়ও স্থানীয় ভাষাকে প্রাধান্য দিতে হবে। লোকভাষায় লোকসাহিত্যের চর্চায় আমাদের উদারনৈতিক সংস্কৃতির বিকাশ ঘটবে। এতে করে জঙ্গিবাদসহ যে কোনো উগ্রপন্থা-রক্ষণশীল মতবাদের প্রতি মানুষ আগ্রহ হারাবে। সাহিত্যের পাশাপাশি অনলাইন মিডিয়ায় আঞ্চলিক ভাষায় আলোচনামূলক অনুষ্ঠান বা টকশো আয়োজন করে আমাদের নতুন প্রজন্মকে আমাদের আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহারে আগ্রহী করতে হবে। ভুলে গেলে চলবে না চমস্কি প্রবর্তিত বিশ্বব্যাকরণের তত্ত্ব অনুয়ায়ী যে কোনো ভাষার ব্যাকরণ জানলে অন্য যে কোনো ভাষা শেখা সহজতর হয়। সুতরাং চাটগাঁ ভাষার ব্যাকরণ প্রণয়ন করতে পারলে আমাদের রাষ্ট্রভাষা বাংলা কিংবা অন্য কোনো ভাষা শেখাও সহজতর হবে।

ড. শ্যামল কান্তি দত্ত
লেখক ও গবেষক

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়