যৌতুকের জন্য স্ত্রী হত্যার মামলায় স্বামীর মৃত্যুদণ্ড

আগের সংবাদ

বিদেশিদের নজর ঢাকার দিকে : ব্যস্ত সময় পার করলেন ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কোরিয়ার শীর্ষ কূটনীতিকরা

পরের সংবাদ

চট্টগ্রাম জেলার সাহিত্য ও সংস্কৃতি

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বাংলার ইতিহাসে হরিকেল নামে একটি রাজ্যের বিবরণ পাওয়া যায়। এই হরিকেল চট্টগ্রামেরই অত্যন্ত প্রাচীন একটি নাম। চৈনিক পরিব্রাজক ইৎসিঙ-এর বিবরণে হরিকেল রাজ্যের উল্লেখ পাওয়া যাওয়ায় মনে হয়, সপ্তম শতকের শেষদিকে এই রাজ্যের অস্তিত্ব ছিল; যেহেতু এই শতকেরই শেষদিকে ইৎসিঙ সমতট পরিভ্রমণ করেন। হরিকেল রাজ্যের মুদ্রার প্রথম আত্মপ্রকাশ ঘটে ৭১৫ খ্রিস্টাব্দে। তা¤্রশাসনের মাধ্যমে এই রাজ্যের সর্বশেষ উল্লেখ আনুমানিক ১২০০ খ্রিস্টাব্দে পাওয়া যাওয়ার কারণে প্রতীয়মান হয়, রাজ্যটি কোনো না কোনোভাবে ৫০০ বছর টিকেছিল। হরিকেল রাজ্যটি বৃহদায়তনের ছিল এবং তার মূল ভূখণ্ড ছিল মধ্য চট্টগ্রাম। কর্ণফুলী ও শঙ্খ নদের মধ্যবর্তী ভূখণ্ডকে মধ্য চট্টগ্রাম বলা হয়। খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকে হরিকেল রাজ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল পণ্ডিত বিহার নামে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ঐতিহাসিক তারানাথ পণ্ডিত বিহার চট্টগ্রামে অর্থাৎ হরিকেলে অবস্থিত ছিল বলে বর্ণনা করেছেন। নালন্দা বিহারের মতো এই পণ্ডিত বিহারও ছিল তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের শিক্ষা ও মতবাদ প্রচারের কেন্দ্র। মধ্য চট্টগ্রামে পটিয়া উপজেলার চক্রশালা ও আনোয়ারা উপজেলার দেয়াঙ পণ্ডিত বিহারের দাবিদার। সীতাকুণ্ড উপজেলার চন্দ্রনাথ, চট্টগ্রাম মহানগরের জেনারেল হাসপাতাল সংলগ্ন পাহাড়ও পণ্ডিত বিহারের দাবিদার বটে। তবে ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে দেয়াঙ পাহাড়ের দক্ষিণাংশে অবস্থিত ঝিওরি ও হাজিগাঁও গ্রামের সীমান্ত থেকে পিতলের একটি বুদ্ধমূর্তিভাণ্ডার, যেখানে ৬৬টি বুদ্ধমূর্তি ছিল, পাওয়া যাওয়ার ফলে আমাদের মনে হয়, সেখানেই পণ্ডিত বিহার অবস্থিত ছিল। ঐতিহাসিক সুনীতি ভূষণ কানুনগো তার ‘প্রাচীন হরিকেল রাজ্য ও মধ্য চট্টগ্রামের ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থে লিখেছেন : ‘এই সুবৃহৎ বিহারটির পরিচালনা রাজকীয় পৃষ্ঠপোষণা ছাড়া সম্ভব ছিল না। সুতরাং হরিকেল রাজের তত্ত্বাবধানে পণ্ডিত বিহার পরিচালিত হতো এবং বিহারটিকে রাজকীয় বিহার বললে ভুল হবে না’। তিব্বতি সূত্রমতে, পণ্ডিত বিহারের অধ্যক্ষ ছিলেন হরিকেলের (চট্টগ্রামের) সন্তান প্রজ্ঞাভদ্র। তিনি তিলপাদ নামেও পরিচিত ছিলেন। তার হিন্দুজীবনের যোগসাধনসঙ্গিনী তিল পিষে জীবিকা নির্বাহ করতেন বলে তিনি তিলপাদ নামে পরিচিত হয়েছিলেন। তিনি তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা গ্রহণের পরে প্রজ্ঞাভদ্র নাম ধারণ করেন। তিনি মহাযান বিষয়ে অনেক গ্রন্থ রচনা করেন। তানজুর সংগ্রহশালা থেকে তাঁর রচিত কিছু মহাযান গ্রন্থের নাম পাওয়া গেছে, যেমন, ‘দোহাকোষ’, ‘ষড়ধর্মোপদেশ’, ‘অচিন্ত্য মহামুদ্রানাম’, ‘শ্রী সহজ সম্বরাধিষ্ঠান’ ও ‘চতুরোপদেশ’ প্রভৃতি। তিনি তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মে দীক্ষাও দিতেন। তিব্বতি পণ্ডিত নরোপা (নরপাদ) তার শিষ্যত্ব বরণ করেছিলেন। এ থেকে বোঝা যায়, তার সময়ে পণ্ডিত বিহারের খ্যাতি দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল।
পণ্ডিত বিহার বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদের স্মৃতিধন্য ছিল। চর্যাপদে তিলপাদ নাম প্রাপ্তি এক্ষেত্রে প্রমাণ। তাছাড়া চর্যাপদের ৫ নম্বর চর্যার চর্যাকার চাটিল্লকে চট্টগ্রামবাসী মনে করা হয়। ড. সত্যব্রত দে তার ‘চর্যাগীতি পরিচয়’ গ্রন্থে লিখেছেন : ‘চাটিল চট্টগ্রামবাসী হইতে পারেন’। ফলে মনে হয়, পণ্ডিত বিহার ও চর্যাপদেই চট্টগ্রামের সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চার আদি ইতিহাস বিদ্যমান।

দুই.
চর্যাপদের পরে একটা বিশাল সময় (১২০১-১৩৫০) অতিবাহিত হয়েছে, যখন বাংলা ভাষায় কোনো সাহিত্যকর্ম রচিত হয়নি। এই সময়কে ‘অন্ধকার যুগ’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই দেড়শ বছরে বাংলা সাহিত্যের কোনো চিহ্ন খুঁজে পাওয়া না যাওয়ার জন্য মুসলিম বিজয়কেই দায়ী করেছেন সুকুমার বাবু। এখানে উল্লেখ করা উচিত, মুসলিম বিজয়ের আগে সেন রাজত্বের সময়েও বাংলা ভাষায় একটা বাক্যও রচিত হয়নি। এ প্রসঙ্গে ড. দীনেশ চন্দ্র সেন লিখেছেন : “ব্রাহ্মণগণ প্রধানত, ভাষা গ্রন্থ প্রচারের বিরোধী ছিলেন। কৃত্তিবাস ও কাশীদাসকে ইহারা সর্বনেশে উপাধি দান করিয়াছিলেন এবং অষ্টাদশ পুরাণ অনুবাদকগণের জন্যে ইহারা রৌরব নামক নরকে স্থান নির্ধারিত করিয়াছিলেন। এদিকে গৌড়েশ্বরগণের (সেনরাজাদের) সভাতে সংস্কৃত পুরাণ পাঠ ও ‘ললিত-লবঙ্গলতা পরিশীলন-কোমল-মলয় সমীরে’র ন্যায় পদাবলী প্রতিনিয়ত ধ্বনিত হইত। সেখানে ‘তৈলাধার পাত্র কি পাত্রাধার তৈল’ প্রভৃতি ন্যায়ের কূট মীমাংসা হইত, এবং নৈষাদাধি কাব্যের অলংকার রহস্য ও দর্শনের সূ² গ্রন্থি মোচনের জন্যে বুদ্ধিজীবীগণ সর্বদা তৎপর থাকিতেন”।
প্রাগুক্ত দেড়শ বছরে বাংলা সাহিত্যের কোনো নিদর্শন না থাকার কারণ ব্যাখ্যা করেছেন ড. ওয়াকিল আহমদ তার ‘বাংলা সাহিত্যের পুরাবৃত্ত’ গ্রন্থে : “বাংলা সাহিত্যের কথিত ‘অন্ধকার যুগ’ মোটেই সাংস্কৃতিক বন্ধ্যাত্বের যুগ ছিল না। ধর্ম-শিক্ষা-শিল্প চর্চার দায়িত্ব যাদের উপর ন্যস্ত ছিল, তারা সীমিত আকারে হলেও শিক্ষা সাহিত্য চর্চায় নিয়োজিত ছিলেন। তবে, কি হিন্দু কি মুসলমান কেউ লোকভাষা বাংলাকে গ্রহণ করেননি। বাংলা সাহিত্যের নিদর্শন না থাকার এটাই মুখ্য কারণ”।
চতুর্দশ শতকের মধ্যভাগ থেকে ইংরেজ আমল পর্যন্ত বাংলা ভাষায় প্রচুর কাব্য রচিত হয়েছে। সে সময়ের অনেক কবি ও তাদের কাব্য মুনশী আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ, আবদুস সাত্তার চৌধুরী ও ইসহাক চৌধুরী প্রমুখ উদ্ধার করতে সক্ষম হওয়ায় আমরা অবাক হয়ে দেখি, চট্টগ্রামের অনেক কবি তখন বাংলা সাহিত্যে বিশাল অবদান রেখেছেন। এসব কবির মধ্যে রয়েছেন শাহ মুহম্মদ সগীর, মুজাম্মিল, আফজল আলী, সাবিরিদ খান, কবীন্দ্র পরমেশ্বর, শ্রীকর নন্দী, দৌলত উজীর বাহরাম খান, হাজী মোহাম্মদ, মুহম্মদ কবীর, শ্রীধর, সৈয়দ সুলতান, মুহম্মদ খান, মুহম্মদ মুকিম, মুন্সী মুকিম, মুজাফ্ফর, শেখ পরাণ, মোহাম্মদ নসরুল্লাহ, শেখ মুতালিব, নওয়াজিশ খাঁ, কমর আলী পণ্ডিত, আব্দুল নবী, মুহম্মদ নকী, শমশের আলী, শরীফ শাহ, রতি দেব, দ্বিজ রামদেব, দৌলত কাজি, মরদন, কোরেশী মাগন ঠাকুর, আলাওল, মুহম্মদ ফসিহ, মীর মুহম্মদ শফী, আশরাফ, পরাগল, আবদুল আলিম, ছৈয়দ আইনুদ্দিন, শেখ মনসুর, শেখ সেরবাজ চৌধুরী, রামজীবন বিদ্যাভূষণ, ভবানীশঙ্কর দাস, মুহম্মদ রজা, আবদুল হাকিম, আলী রজা, মুহম্মদ আলী, ছৈয়দ নূরুদ্দিন, মুহম্মদ উজির আলী, দ্বিজ রাধাকান্ত, নিধিরাম আচার্য, মুক্তারাম সেন, বদীউদ্দিন কাজী, বালক ফকির, মুহম্মদ দানীশ, শেখ তনু, আবদুস সমদ, হোসেন ফকীর, নূরুল্লাহ, আজমত উল্লাহ, কাইমুদ্দিন, চুহর, হামীদুল্লাহ খান, হাশমত আলী চৌধুরী, সৈয়দ নাসির উদ্দিন, মোশারফ আলী, উজির আলী মুন্সী, হায়দর আহমদ, আসাদ আলী চৌধুরী, সলিম উদ্দীন, ওয়াজিউদ্দীন চৌধুরী, তমিজী, হাজি আলী, লোকমান আলী, রহিমুন্নিসা, জামিরুন্নিসা, রহিমা, আস্কর আলী পণ্ডিত, নীলকমল দাস, শংকর ভট্ট, সদানন্দ ভট্ট, রঞ্জিৎরাম দাস, রামতনু আচার্য, রামলোচন দাস, ভৈরচ আইচ, কবিরাজ ষষ্ঠিচরণ মজুমদার, এরশাদুল্লাহ, শরফতুল্লাহ, মুহম্মদ হাশেম (হাশিম পণ্ডিত), সফর আলী ও আবদুল জলিল সিকদারসহ আরও অনেকে।
এই কবিদের মধ্যে সৈয়দ সুলতান, আবদুল হাকিম ও আলী রজা বাংলা ভাষায় সাহিত্যচর্চায় প্রতিবাদী ভূমিকা পালন করেছিলেন। সৈয়দ সুলতানের জন্মস্থান নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। তবে তিনি যে চট্টগ্রামে সাহিত্যচর্চা করেছিলেন, তাতে সন্দেহ নেই। ষোড়শ শতকে তিনি সাহিত্যচর্চায় এগিয়ে আসেন। তার ‘নবীবংশ’ কাব্য থেকে জানা যায়, বাংলার মুসলমানরা যাতে তাদের মাতৃভাষায় ইসলাম ধর্ম, কোরান ও হাদিসের কথা পড়তে ও বুঝতে পারে, সে কারণে তিনি বাংলা ভাষায় কাব্যচর্চায় নিয়োজিত হন। তৎকালে ও পূর্বে মুসলমান সমাজে বাংলা ভাষা হিন্দুয়ানী ভাষা হিসেবে চিহ্নিত ও পরিচিত ছিল। তিনি এই ভাষায় কাব্যচর্চা করায় তৎকালীন রক্ষণশীল মুসলমানরা তা ভালো চোখে দেখেনি। তারা তার কঠোর নিন্দা ও সমালোচনায় লিপ্ত হয়। ফলে সৈয়দ সুলতান তাদের ‘মুনাফিক’ গালি দিয়ে লিখেন :
যে সবে আপনা বোল না পারে বুঝিতে
পাঁচালী রচিলাম করি আছএ দুষিতে।
মুনাফিকে বলে আহ্মি কিতাবেতু কাড়ি
কিতাবের কথা দিলুঁ হিন্দুয়ানী করি।
… … …
আলিমে কিতাব পড়ি বাখানে যে কালে
হিন্দুয়ানী করি যদি না বাখানি বোলে।
বঙ্গদেশী সকলেরে কিরূপে বুঝাইব?
বাখানি আরব ভাষা এ বুঝাইতে নারিব।
যারে যেই ভাষে প্রভু করিছে সৃজন।
সেই ভাষ তাহার অমূল্য সেই ধন।
আল্লাএ বুলিছে, ‘মুঞি যে দেশে যে ভাষ
সে দেশে সে ভাষে কৈলুঁ রসুল প্রকাশ’।
সপ্তদশ শতকে আবদুল হাকিম ও অষ্টাদশ শতকে আলী রজাও বাংলা ভাষায় সাহিত্যচর্চা করায় রক্ষণশীল মুসলমান কর্তৃক ঠাট্টা, বিদ্রুপ, নিন্দা, সমালোচনা ও ঘৃণার শিকার হন। আবদুল হাকিম ক্ষুব্ধ হয়ে তাদের ‘জারজ’ আখ্যায়িত করে দেশ ত্যাগ করার পরামর্শ দেন :

যে সব বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী।
সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি \
মাতা পিতামহক্রমে বঙ্গেত বসতি।
দেশী ভাষা উপদেশ মনে হিত অতি \
দেশী ভাষা বিদ্যা যার মনে না যুয়ায়।
নিজ দেশ তেয়াগি কেন বিদেশে না যায় \
আলী রজা রক্ষণশীল মুসলমানদের অন্যায়ের জবাব দেন এভাবে :
বাংলাদেশের মাজে বাংলার বচন।
হিন্দুয়ানী শাস্ত্রের কথা জানে সর্বজন \
নানা দেশের নানা ভাষা আল্লার সৃজন।
সর্ব ভাষা শুদ্দ বুজে এক নিরঞ্জন \
নানা দেশে নানা ভাষা নানা শাস্ত্রে কহয়।
দেশি ভাসে প্রভূ সেবা ইশ্বর সদয় \
যে পণ্ডিতে না বুজিছে সর্ব্ব শাস্ত্র ভাষ।
সে সকলে অন্য শাস্ত্র করে উপহাস \

তিন.
চট্টগ্রামে প্রাচীনকাল থেকে বাংলা সাহিত্যের পাশাপাশি লোকসাহিত্যের চর্চা হয়েছে। লোকসাহিত্যের বিভিন্ন শাখা বিদ্যমান। বিশেষ করে আটটি শাখার কথা বিভিন্ন সময়ে উল্লেখ করা হয় : লোকসংগীত, লোকনাট্য, ছড়া, গীতিকা, লোককাহিনি, মন্ত্র, প্রবাদ-প্রবচন ও ধাঁধা। চট্টগ্রামে প্রতিটি শাখার অস্তিত্ব রয়েছে। লোকসাহিত্যের সবল শাখা হলো লোকসংগীত। বিভিন্ন ধরনের লোকসংগীত চট্টগ্রামে শোনা বা পাওয়া যায়। বারমাসী চট্টগ্রামের খুবই প্রাচীন লোকসংগীত। বারমাসী সম্পর্কে বলতে হয়, বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে চট্টগ্রামে তা অজ¯্র রচিত হয়েছে। বারমাসী গীতিকার চেয়ে প্রাচীন। উদ্ভবকালে তা গীতিকাহিনি হিসেবে লম্বা আকারে রচিত হতে শুরু করে বলে এখনও লম্বাগীতি নামেও পরিচিত। তাতে একটি মাত্র কাহিনি থাকে; বাংলা বারো মাসের নামের আশ্রয়ে কাহিনি বর্ণনা করা হয়। মধ্যযুগে ও পরবর্তী সময়ে চট্টগ্রামে রচিত হওয়া অধিকাংশ বারমাসীতে নারীর প্রেম-বিরহকাতরতা-সাংসারিক কারণে প্রাপ্ত বেদনা ও মানসিক দুর্দশা করুণ মধুর রূপে প্রকাশিত। ‘নীলার বারমাসী’, ‘বদিউজ্জামালের বারমাসী’ (আলাওল); ‘অথ সুশীলার বারমাস’ (দ্বিজ মাধব); ‘নিমাইর বারমাসী’ (দ্বিজমাধব); ‘রামের বারমাসী’ (দ্বিজ মাধব); ‘প্রবাসী যুবতীর বারমাসী’, ‘জৈগুনের বারমাসী’, ‘কামিনীর বারমাসী’, ‘রাধিকার বারমাসী’, ‘বিরহিনী যুবতীর বারমাসী’, ‘ছকিনার বারমাসী?’, ‘সখীর বারমাসী’, ‘সন্তীর বারমাসী’, ‘সামারোকের বারমাসী’, ‘বালির বারমাসী’, ‘গোলবানু তথা আসরফ মুন্সীর বারমাসী’, ‘কন্যার বারমাসী’ প্রভৃতি এক্ষেত্রে উল্লেখনীয়। আঠারো-উনিশ শতকে আলী রজা ওরফে কানুফকির (১৭৫৯-১৮৩৭), উনিশ-বিশ শতকে আস্কর আলী পণ্ডিত (১৮৪৬-১৯২৭), আবদুল জলিল সিকদার (১৮৫৭-১৯৩৪), সেকান্দর গাইন (১৮৬০-১৯৪২), খাদেম আলী, মোহাম্মদ নছিম, শোকর আলী প্রমুখ দরবেশি বা আধ্যাত্মিক বিষয়, কারবালার ঘটনা, পীরের মৃত্যু, পুত্রহারা পিতার বিলাপ, শিকারের কাহিনি প্রভৃতি নিয়ে বারমাসী রচনা করে তাতে বিষয়ের পরিবর্তনে ভূমিকা রাখেন।
লোকসাহিত্যের অন্যতম শাখা গীতিকাকে লোকসংগীত হিসেবেও বিবেচনা করা যায়। ইংরেজিতে এই গীতিকাকে বলা হয় ‘নধষষধফ’। গীতিকাহিনি রচনার দিক দিয়ে বারমাসীর সঙ্গে একমাত্র মিল রয়েছে গীতিকার। বারমাসীর মতো তাতেও থাকে একটি কাহিনি। চট্টগ্রামে তা পালাগান ও গাজির গান নামে ব্যাপক পরিচিত।
চট্টগ্রামে ষোলো শতক থেকে উনিশ শতকের মধ্যে প্রচুর গীতিকা বা পালাগান বা গাজির গান রচিত হয়েছে। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, ষোলো শতক থেকে উনিশ শতকের সৃষ্টি হলো গীতিকা। সম্ভবত ষোলো শতক থেকেই চট্টগ্রামে গীতিকা রচিত হচ্ছে। এখানের ‘ভেলুয়া’ গীতিকাটি ষোলো শতকের ঘটনা নিয়ে রচিত হয়। হামিদুল্লাহ খান প্রণীত ‘তারিখ-ই-হামিদী’ গ্রন্থে বলা হয়, ষোলো শতকে হোসেন শাহের পুত্র নসরত শাহের সময়ে এই ঘটনা ঘটে। চট্টগ্রামে প্রচুর গীতিকা রচিত হলেও অনেক গীতিকা বিলুপ্ত। আশুতোষ চৌধুরী ‘ভেলুয়া’সহ ৭৬টি গীতিকা, আবদুস সাত্তার চৌধুরী বাংলা একাডেমি নিয়োজিত সংগ্রাহক হিসেবে ১৯৬১-১৯৬৬-র মধ্যে ২১টি গীতিকা সংগ্রহ করেন। এই ২১টি গীতিকার ১৪টি বাংলা একাডেমির ‘বাংলা একাডেমী ফোকলোর সংকলন’ ও ‘লোকসাহিত্য’ সিরিজের মাধ্যমে প্রকাশিত। ১৪টির মধ্যে ‘খুলানা কন্যা’, ‘চানমনি ও সূর্যমনি’, ‘সূর্যমনি কন্যা’, ‘মানিক সওদাগর’ নামে ৪টি ড. মোমেন চৌধুরী সম্পাদিত ‘বাংলা একাডেমী ফোকলোর সংকলন : ৫৪ চট্টগ্রাম গীতিকা-১’ গ্রন্থে এবং ‘হীরালাল পদ্মমণি’, ‘পাঁচতোলা কন্যা’, ‘দুঃখরাজ ও সুখরাজ’ নামে ৩টি ‘বাংলা একাডেমী ফোকলোর সংকলন : ৫৫ চট্টগ্রাম গীতিকা-২’ গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত। শামসুল আরেফীনের ‘বাঙলাদেশের লোককবি ও লোকসাহিত্য’ গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে ‘ভেলুয়া’ (অন্য পাঠ) নামে একটি এবং দ্বিতীয়-চতুর্থ খণ্ডে ‘দুই সতীনের ঝগড়ার কবিতা’ নামে একটি গীতিকা সংকলিত। সংগ্রাহক শামসুল আরেফীন। আশুতোষ চৌধুরী সংগৃহীত ৭৬টি গীতিকার মধ্যে ৯টি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টর দীনেশচন্দ্র সেনের সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘পূর্ববঙ্গ গীতিকা’ গ্রন্থে সংকলিত হয়। ৭৬টি গীতিকার মধ্যে উল্লেখযোগ্য: ‘সুজা তনয়ার বিলাপ’, ‘কমল সওদাগর’, ‘হাতীখেদা’, ‘পরীবানুর হঁঅলা’, ‘নিজাম ডাকাতের পালা’, ‘কাফন চোরা’, ‘ভেলুয়া’, ‘নছর মালুম’, ‘মজুনা’, ‘নুরুন্নেহা ও কবরের কথা’, ‘দেওয়ান মনুহর’ ইত্যাদি।
চট্টগ্রামে গীতিকা বা পালাগান বা গাজির গান গেয়েছিলেন ওমর বৈদ্য, সেকান্দর আলী ওরফে সেকান্দর গাইন (গায়েন), পৈথানচন্দ্র দে, অলিয়র রহমান (অইল্যা আঁধা), নূর হোসেন, বেলায়েত আলী, নবচন্দ্র ধুপি, গুণা মিঞা, আঁধা মকবুল, হাকিম খাঁ, হায়দার আলী, ওজু পাগলা, জেবল হোসেন (রাউজান), ইসমাইল (লাম্বুর হাট) ও আরো অনেকে।
চট্টগ্রামে বারমাসী, গীতিকা বা পালাগান বা গাজির গান ছাড়াও হঁঅলা, মাইজভাণ্ডারি গান, জাহাঁগিরি সংগীত, জারি গান বা মর্সিয়া, কীর্তন, হাইল্যা সাইর ও পাইন্যা সাইর, ফুলপাঠ গান, হালদাফাডা গান, গোরব পোয়ার গান, চাটগাঁইয়া গান, কবিগান, বৃষ্টি ডাকার গান, রোদ ডাকার গান, কর্ণফুলীর গান, শঙ্খ নদের গান, ইলিশ মাছের গান, মাঝিমাল্লাদের গান, মুর্শিদি গান, পোনা নর্তকীর গান, রেঙ্গুন বিষয়ক গান, মারফতি গান, মোহছেন আউলিয়ার গান, ঋতুর গান, পুরাণ অবলম্বনে সৃষ্ট গান, নকশবন্দিয়া তরিকার গান, ভিক্ষুকের গান, আলী নগর দরবারের গান, দুর্ভিক্ষের গান, মুক্তিযুদ্ধের গান, ভাষা আন্দোলনের গান, জেলেদের গান ও ইসলামি গান প্রভৃতিও রচিত হয়েছে। চাটগাঁইয়া গান, মাইজভাণ্ডারি গান ও কবিগান চট্টগ্রামে খুবই জনপ্রিয়।
চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় রচিত গানকে চাটগাঁইয়া গান বলা হয়। এ-ভাষার শব্দ ও বাক্যের প্রভাবেও অনেক গান রচিত হয়েছে। এ-ধরনের গান ‘কাউয়া আঞ্চলিক গান’ নামে পরিচিত ছিল। এই গানে আদিরসও থাকতো। আস্কর আলী পণ্ডিত, তার পরে সেকান্দর গাইন (গায়েন), খায়েরজ্জমা মাস্টার প্রমুখ ‘কাউয়া আঞ্চলিক গান’ রচনা করেন। অবশ্য সাধারণ লোকের মুখে মুখে প্রচলিত থাকার কারণে তাঁদের অনেক ‘কাউয়া আঞ্চলিক গান’ এখন পুরোপুরি চাটগাঁইয়া গানে পরিণত হয়েছে।
রমেশ শীল, মোহাম্মদ নাসির প্রমুখ
চাটগাঁইয়া গান রচনা করেছেন। পরে তাদের অনুসরণ করে এ-গান রচনায় আত্মনিয়োগ করেন মলয় ঘোষ দস্তিদার, মোহনলাল দাশ, অচিন্ত্যকুমার চক্রবর্তী, অমলেন্দু বিশ্বাস, ইয়াকুব আলী, ফণী বড়–য়া, আবদুল গফুর হালী, এম.এন. আখতার, সৈয়দ মহিউদ্দিন (মহি-আল-ভান্ডারি), সৈয়দ ওয়াহিদুল আলম জুনু (জুনু পাগলা), আমানুল্লাহ্ গায়েন, শ্যামসুন্দর বৈষ্ণব, শাহ বাঙালি, সনজিত আচার্য্য, আহমদ কবির আজাদ, আহমদ বশির, রশিদ কাওয়াল, এম.এন. আলম, মো. নূরুল আলম, বাবুল আচার্য্য, রনজন চক্রবর্তী, স্বপন কুমার দাশ, ল²ীপদ আচার্য্য, দীপক আচার্য্য, গোপাল দাশ, কাজল দাস, ইকবাল হায়দার, অজিত বরণ শর্মা, শাহাদাত আলী, সোনামিয়া, আলাউদ্দিন কাওয়াল ও আরও অনেকে।
চাটগাঁইয়া গানে কণ্ঠ দেন মোহাম্মদ নাসির, মোহাম্মদ হারুন, শেফালী ঘোষ, শ্যামসুন্দর বৈষ্ণব, কল্যাণী ঘোষ, উমা খান, মানস পাল চৌধুরী, সনজিত আচার্য্য, কান্তা নন্দী, কল্পনা লালা, শিমুল শীল, সিরাজুল ইসলাম আজাদ, বুলবুল আকতার প্রমুখ। চাটগাঁইয়া গানকে দেশ-বিদেশে গ্রহণযোগ্য, জনপ্রিয় ও অমর করার ক্ষেত্রে শেফালী-শ্যামসুন্দরের অবদান অসীম। এ কারণে তারা মরণোত্তর রাষ্ট্রীয় একুশে পদক অর্জন করেন।
চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার মাইজভাণ্ডার গ্রামে জন্মগ্রহণকারী সাধক সৈয়দ আহমদুল্লাহ (১৮২৬-১৯০৬) ওই গ্রামে মাইজভাণ্ডারি তরিকার প্রবর্তন করলে, এ তরিকাকে কেন্দ্র করে মাইজভাণ্ডারি গানের সূচনা হয়। তরিকাটির প্রবর্তনকাল অর্থাৎ উনিশ শতকের শেষার্ধ থেকে আজ অব্দি অগণিত মাইজভাণ্ডারি গান রচিত হয়েছে। এ গানের সূচনাপর্বের গীতিকার হলেন আস্কর আলী পণ্ডিত, আবদুল গণি কাঞ্চনপুরী (?-১৯২৭), আবদুল হাদী কাঞ্চনপুরী, আবদুল্লাহ বাঞ্জারামপুরী, মাওলানা বজলুল করিম মন্দাকিনী প্রমুখ। আবদুল্লাহ বাঞ্জারামপুরীর (মোহাম্মদ আবদুর রহমান প্রকাশ ফকির শাহ আবদুল্লাহ দরবেশ) গানের চরণ ‘বাংলা গজল বাবার আদেশ, বুঝিবার কারণ’ থেকে বোঝা যায়, সৈয়দ আহমদুল্লাহর আদেশে সূচনাপর্বের গীতিকাররা বাংলা ভাষায় মাইজভাণ্ডারি গান রচনা শুরু করেন। মাইজভাণ্ডার দরবারে আবদুল হাদী কাঞ্চনপুরীকে এ-গানের উদ্ভাবক মনে করা হয়। এই দরবার সূত্রে জানা যায়, সৈয়দ আহমদুল্লাহর আমলে উর্দু-ফারসি শের চললেও, তাঁর কাছে হাদী রচিত গান পেশ ও পাঠ করা হতো। এছাড়া গুরুদাশ ফকির থেকেও তিনি বাংলা গান শুনতেন। এ কথাও জানা যায়, তিনি হাদীর গানকে ‘মসনবী’ অভিহিত করেন।
তার অনেক খলিফা ছিল। এদের শানে বা এদের দরবারকে কেন্দ্র করেও রচিত হয়েছে গান। এই গানগুলোও মাইজভাণ্ডারি গান নামে পরিচিত। শুধু চট্টগ্রাম নয়, চট্টগ্রামের বাইরের অঞ্চলেও মাইজভাণ্ডারি গান সৈয়দ আহমদুল্লাহর সময়কাল থেকে রচিত হয়ে আসছে।
গোলামুর রহমান মাইজভাণ্ডারি (মৌলানা কুতুবে রাব্বানী মাহবুবে ছোবহানী গাউছুল আজম বিল বেরাছত সৈয়দ গোলাম রহমান) সৈয়দ আহমদুল্লাহর খলিফায়ে আজম। তাকে কেন্দ্র করে রমেশ শীল প্রমুখ অজ¯্র গান রচনা করেন। আরও পরে দেলোওয়ার হোসাইন মাইজভাণ্ডারি, শফিউল বশর মাইজভাণ্ডারি ও জিয়াউল হক মাইজভাণ্ডারিকে নিয়ে আবদুল গফুর হালী, এম.এন. আকতার, সৈয়দ মহিউদ্দিন (মহি-আল-ভাণ্ডারি), মাহবুব উল আলম, সঞ্জিত আচার্য, বাদশাহ আলম, রুহুল আমিন (চন্দনাইশ), ফকির ফরিদ হোসেন প্রমুখ গান রচনা করেন।
উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ও বিশ শতকে চট্টগ্রামে কবিগানের জোয়ার ছিল। চট্টগ্রামে এসময়ের কবিয়াল হিসেবে অপর্ণা চরণ জলদাস, দুর্গাচরণ জলদাস, প্রাণকৃষ্ণ জলদাস, আজগর আলী, নবীন ঠাকুর, মোহনবাঁশি, চিন্তাহরণ প্রমুখের নাম প্রথমে উচ্চারণযোগ্য। আজগর আলী ছিলেন স›দ্বীপের লোক, থাকতেন খাগরিয়ায়। তাকে চট্টগ্রামের সবচেয়ে প্রাচীন কবিয়াল বলা হয়। এদের পরে কবিগানে অবস্থান সৃষ্টি করেন করিম বখশ (১৮৭৯-১৯৩৮), রমেশ শীল (১৮৭৭-১৯৬৭), নজু মিয়া, মনীন্দ্র সরকার (১৯০০-২০০০), হেদায়েত ইসলাম, রমনী মোহন দেব সরকার (১৯০৫-১৯৭১), ছাবের সরকার (১৯০৬-?), নিরঞ্জন দাশ (১৯১৩-?), নূর আহমদ সরকার (১৯১৪-১৯৮৫), ফণী বড়–য়া (১৯১৫-২০০১), শশাঙ্ক মোহন চৌধুরী (১৯১৭-?), রাই গোপাল দাশ (১৯১৮-১৯৮৭), আহমদুর রহমান (১৯২৪-), ইয়াকুব আলী (১৯৩১-১৯৯৫), সারদা বড়–য়া, বিভূতী রঞ্জন নাথ (১৯৩৪-), রাখাল মালাকার (১৯৩৫-), মোহাম্মদ সৈয়দ (১৯৩৬-?), রাখাল দাশ (১৯৪১-), মানিক শীল (১৯৪৩-), যজ্ঞেশ্বর শীল, খুকী রানী শীল, মোহাম্মদ নুরুল হক, জীবনকৃষ্ণ দাশ কানুনগো, সারদা শীল, দুদু মিয়া, রমেশ চন্দ্র নাথ, দুর্গাকুমার শীল, অবর্ণ শীল, রসিকচন্দ্র নাথ, রাইমোহন বড়–য়া, মহেন্দ্রলাল দাশ, মোহাম্মদ আবদুল মান্নান, কালামিয়া ফারুকী, এস এম নূর-উল-আলম (১৯৫২-?), কল্পতরু ভট্টাচার্য, মোহাম্মদ ইউসুফ, মোশতাক আহমদ, মাধুরী ভট্টাচার্য, বাবুল বিশ্বাস, চক্রপাণি ভট্টাচার্য, দিলীপ ভট্টাচার্য, ডা. এম আর আলী ও আরও অনেকে। করিম বখশকে চট্টগ্রামের কবিগানের দ্বার উন্মোচক বলা হয়। তিনি ছিলেন অপরাজেয় কবিয়াল। কবিগানের লড়াইয়ে তাকে কেউ কোনো দিন পরাজিত করতে পেরেছেন, এমন তথ্য নেই। চট্টগ্রামের কবিগানকে মার্জিত, সুন্দর ও শালীন করার ক্ষেত্রে এবং কবিগানে অঞ্চলপ্রীতির স্থলে স্বদেশপ্রীতি আনয়নে করিম বখশ হরিচরণ আচার্যের উত্তরসূরি হয়ে কাজ করেন। রমেশ শীল চল্লিশ দশকে কবিগানকে একেবারে বিকৃত রুচি, অশ্লীলতা ও গালি মুক্ত করে পৌরাণিক ও কাল্পনিক বিশ্ব থেকে মাটিতে নামিয়ে এনে তাতে নতুন মাত্রা সংযোজন করেন। এতে কমিউনিস্ট পার্টি চট্টগ্রামের নেতাকর্মীদের ভূমিকাও ছিল। এ ক্ষেত্রে রমেশ শীলের শিষ্য-সহচর ছাড়াও যেসব কবিয়াল প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তার সহযোগী ছিলেন মনীন্দ্র সরকার তাদের মধ্যে অন্যতম।

চার.
চট্টগ্রামের লোকসংগীতে বা তার শাখাসমূহে কালে কালে অনেক বাদ্যযন্ত্র ব্যবহৃত হয়েছে, এখনও হয়। যেমন- খোল, করতাল, বেহালা, একতারা, দোতারা, মুরলী, মোহন বাঁশি, ঢোল, কাশী, হারমোনিয়াম, হাত বাঁয়া, ভাবের বাঁয়া বা ডেবরি, কৃষ্ণকাঠি বা খঞ্জরি, মন্দিরা, তবলা, মারাক্কাস, ঢাক, দবর, নঅদা বা নহবত, সানাই, জোড় খাই, নাকাড়া, টিকারা, সারিন্দা ও মৃদঙ্গ প্রভৃতি। ‘ভেলুয়া’ গীতিকায় নাকাড়া, টিকারা, সারিন্দা ও মৃদঙ্গের উল্লেখ আছে। আস্কর আলী পণ্ডিতের বংশধরের কাছে সংরক্ষিত আছে তাঁর বেহালা ও মুরলী। চট্টগ্রামের বাদ্যযন্ত্রগুলোর মধ্যে সানাই, দবর ও ঢোলের মূল শিল্পী এখনও হাড়ি ও ডোম সম্প্রদায়ের লোক। তারা পরিচিত ঢাকি নামে। নানা সূত্রে জানা যায়, অনন্ত, ধনীরাম, জগৎ, দীনবন্ধু, উমাচরণ, হরিমোহন প্রভৃতি নামে কতিপয় লোক চট্টগ্রামে ঢোল, নঅদা (নহবত) ও সানাই বাদক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। বর্তমানে রমেশ শীলের কবিদলের বিনয় বাঁশী ঢোল বাদক হিসেবে উভয় বঙ্গে বিখ্যাত। তিনি মরণোত্তর রাষ্ট্রীয় একুশে পদক লাভ করেন।

পাঁচ.
চট্টগ্রামে আধুনিককালের সংগীতচর্চা শুরু হয় বিংশ শতকের প্রথম দশকে, আর্য্যসঙ্গীত সমিতির মাধ্যমে। ১৯০৬ সালে স্থানীয় কয়েকজন জমিদারের উদ্যোগে এই সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন এর অধ্যক্ষ নিয়োজিত হন দক্ষিণ কাট্টলির জমিদার প্রাণহরি দাশের পুত্র ওস্তাদ সুরেন্দ্রলাল দাশ। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁসহ অনেক সংগীতাচার্যের তিনি কাছের মানুষ ছিলেন, যার কারণে তারা আর্য্যসংগীত সমিতিতে এসে চট্টগ্রামকে ধন্য করেছিলেন। আর্য্যসংগীত সমিতির প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই প্রতিষ্ঠান থেকে অজ¯্র শিক্ষার্থী সংগীতশিক্ষা গ্রহণ করেছেন, আজও করছেন। এদের অনেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় কণ্ঠসৈনিকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। চট্টগ্রামের সংগীতজগতে এই প্রতিষ্ঠানটি তাই একটি ইতিহাস। আর্য্যসংগীত সমিতির পরে চট্টগ্রামে সংগীত পরিষদ (প্রতিষ্ঠাকাল : ১৯৩৯), সংগীত নিকেতন, চিটাগাং মিউজিক ক্লাব (প্রতিষ্ঠাকাল : ১৯৫২), ছন্দ-গীতিকা বা প্রাচ্য ছন্দ-গীতিকা (প্রতিষ্ঠাকাল : ১৯৫২) প্রতিষ্ঠিত হয়ে চট্টগ্রামের সংগীতচর্চায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পরবর্তীতে সংগীতচর্চার উদ্দেশ্যে চট্টগ্রামে সংগীত ভবন (প্রতিষ্ঠকাল : ১৯৬৬), শিল্পী নিকেতন (১৯৭২ সালে কার্যক্রম শুরু), বঙ্গশ্রী শিল্পী সংসদ (প্রতিষ্ঠাকাল : ১৯৭২), শাশ্বত ললিতকলা একাডেমি (প্রতিষ্ঠাকাল : ১৯৭২), অগ্রণী সংঘ সংগীত শিক্ষা কেন্দ্র (প্রতিষ্ঠাকাল : ১৯৭৫), সপ্তক সংগীত শিক্ষাকেন্দ্র (প্রতিষ্ঠাকাল : ১৯৮০), আনন্দধ¦নি (প্রতিষ্ঠাকাল : ১৯৮০), ইমন ললিতকলা, সুরসপ্তক, চট্টগ্রাম সংগীত নিকেতন, তানসেন (প্রতিষ্ঠাকাল : ১৯৯০), শ্রæতি অঙ্গন, জয়ন্তী, ফতেয়াবাদ সংগীত নিকেতন, বাণী মঞ্জুরী ললিতকলা একাডেমি, সপ্তসুর বিদ্যানিকেতন, গোধুলী সংগীত একাডেমি, সুর-সাধনা সংগীতালয়, গীতধ্বনি, ইমন কল্যাণ সংগীত বিদ্যাপীঠ, সৃজামি সাংস্কৃতিক অঙ্গন, সাধনা সংগীত একাডেমি, সপ্তস্বর সংগীত বিদ্যালয়, ছন্দানন্দ সাংস্কৃতিক পরিষদ, শহীদ মিলন সংগীত বিদ্যালয়, গুরুকুল সংগীত একাডেমি, গন্ধর্ব সংগীত বিদ্যালয় (পটিয়া), সপ্তক সংগীত বিদ্যালয় (পটিয়া), আলাউদ্দিন সংগীত একাডেমি (ধলঘাট, পটিয়া), চট্টগ্রাম লোকসংগীত শিল্পীগোষ্ঠী (পটিয়া), শিশু সংগীত একাডেমি, ছায়াবিথী সংগীত বিদ্যালয় (পটিয়া), আনন্দধারা সংগীত একাডেমি ও শিল্পীগোষ্ঠী (পটিয়া), গীতল সাংস্কৃতিক একাডেমি (পটিয়া), চন্দনা সাংস্কৃতিক একাডেমি (চন্দনাইশ), চন্দনাইশ সংগীত নিকেতন, ঝংকার (পটিয়া), নিবেদন (পটিয়া), সংগীতাঙ্গন (কালিয়াইশ, সাতকানিয়া), মধুবন্তি সংগীত নিকেতন (রাউজান), সপ্তসুর সংগীত নিকেতন (রাউজান), সুরবিতান (রাউজান), সরগম (রাউজান) ও সারেগামাপা (রাউজান) প্রভৃতি প্রতিষ্ঠিত হয়। এসব প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম এখনও চালু রয়েছে।
স্বাধীনতাত্তোরকালে চট্টগ্রামের ব্যান্ড সংগীতের চর্চাও উল্লেখ করার মতো। এ সময়ে যেসব ব্যান্ডের জন্ম হয়, সেগুলো হলো- সোলস, এলআরবি, রেঁনেসা, নগরবাউল, তৃর্ষ্ণাত, অসময়, প্লেজার রক, প্রান্তর, রিভার্ব, রিসেন্ট, রোজেস, ওয়্যারিওর, উইলস, ওয়াইআরবি, ফিউচার, নাটাই, অন্থিম, অন্বেষণ, আমুস, এ্যামিথিউর, এ-৯৯ বি.হর্নেট, সোলডার্স, বিন্দু, ব্ল্যাক হার্ট, বর্ণ, ব্ল্যাক ওয়ারিয়র্স, ব্লæ বার্ডস, সাসটেইন, স্ট্রীম, সোয়েভ, সরগম, স্লাক, স্যাডো, স্কাই টাচ, সীমান্তহীন, রুটস, রাইজিং ফোর্স, রেইনড্রপস, রিয়ার, রেইন, রেইন ম্যাকার, ফেরারী, ফেইথ, ফ্রিডম, জিপসী, হেভেন, ট্রাংগেল, উইংস, ব্লাক সিন, বিস্বর্গ, বনসাই, কেকটাস, কেসকাড, নেঙাস, ড্রীমস, দ্রাঘিমা, দিশারী, ডিবাইন, তেপান্তর, ডেজার্ট, ইস্কপ, আর্থ, এনার্জি সোল, হার্ট রিলেশান, ইন চিটাগাং, জোবিয়াল, ওয়্যারফেয়ার, সিক্রোসেন্ট, স্টীলার, এলএসবি, লাইনার্স, মুখোশ, মেনগ্রোব, মিলেনিয়াম, রেসিটাল, রেবিলিয়াস, ট্রিও, নভেম্বর-১১, অব ট্রাক, স্পাইডার, টানট্রিক, তিরন্দাজ, টিউন স্পার্ক, দ্বিতীয় পৃষ্ঠা, অরণ্য ও আর্তনাদ ইত্যাদি। অনেকগুলোর কার্যক্রম এখন আর নেই।
সংগীতের পাশাপাশি চট্টগ্রামে নাট্য, কবিতা আবৃত্তি ও নৃত্যচর্চা খুবই উল্লেখযোগ্য। সম্ভবত স্বাধীনতাত্তোরকালে চট্টগ্রামে গ্রুপ থিয়েটার চর্চার মাধ্যমে প্রকৃত নাট্যচর্চা শুরু হয়। সদরুল পাশা (১৫ জানুয়ারি ১৯৫৪-২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৯৫) কয়েকজনকে নিয়ে ১৯৭৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের প্রথম থিয়েটার দল ‘থিয়েটার ৭৩’ প্রতিষ্ঠা করে এই গ্রুপ থিয়েটার চর্চা শুরু করেন। ‘থিয়েটার ৭৩’ থেকে ‘ম্যাসাকার’, ‘ফলাফল নি¤œচাপ’, ‘স্পার্টাকাস বিষয়ক জটিলতা’ ও ‘শুভ্রা সুন্দর কল্যাণী আনন্দ’ মঞ্চস্থ হয়েছিল। প্রতিটি নাটকের প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন সদরুল পাশা। ‘থিয়েটার ৭৩’ থেকে তিনি বেরিয়ে ১৯৭৪ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর আবারও কয়েকজনকে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন ‘অরিন্দম নাট্য সম্প্রদায়’। এই নাট্যদল থেকে ‘যামিনীর শেষ সংলাপ’, ‘মল্লিকার চোখে জল’, ‘ভোলাময়নার বায়োস্কোপ’, ‘ফলাফল নি¤œচাপ’ ও ‘শনিবার’ প্রভৃতি নাটক মঞ্চস্থ হয়। ‘যামিনীর শেষ সংলাপ’ ও ‘ফলাফল নি¤œচাপ’ নাটকে সদরুল পাশার অসামান্য অভিনয় আজও নাটকদ্বয় যারা দেখেছেন, তাদের আবেগতাড়িত করে। এই দুইটি নাট্যদলের পরে চট্টগ্রামে আরও অনেক নাট্যদল প্রতিষ্ঠিত হয়। কতিপয় নাট্যদলের নাম : সমীকরণ থিয়েটার, নান্দিকার, চট্টল থিয়েটার, তির্যক নাট্যগোষ্ঠী, মঞ্চমুকুট নাট্য স¤প্রদায়, তির্যক নাট্যদল, থিয়েটার ওয়ার্কশপ চট্টগ্রাম, গণায়ন, কথক থিয়েটার (অভিষেক : ২০০০), অঙ্গন থিয়েটার, পূর্বালী সাংস্কৃতিক কেন্দ্র (নাটক বিভাগ), কথক নাট্য স¤প্রদায়, প্রতিনিধি নাট্য স¤প্রদায়, নান্দীমুখ, লোক থিয়েটার, অনন্য থিয়েটার, পদক্ষেপ নাট্য অঙ্গন, চট্টগ্রাম থিয়েটার, উত্তরাধিকার (প্রতিষ্ঠাকাল : ২০০২), আসর নাট্য স¤প্রদায়, কালপুরুষ নাট্যগোষ্ঠী, উচ্চারণ নাট্য স¤প্রদায়, থিয়েটার শ্লোগান চট্টগ্রাম, ভিশন প্যান্টোমাইম, কালপুরুষ নাট্য সম্প্রদায়, চট্টল থিয়েটার, প্রতিভাস, রণশিক্ষা নাট্য সম্প্রদায়, থিয়েটার ওয়ার্কশপ অব চট্টগ্রাম, উচ্চারণ, শব্দ নাট্যচর্চা কেন্দ্র, বিশ্ববিদ্যালয় থিয়েটার, শিকড়, পদক্ষেপ, থিয়েটার গিল্ড, শহীদনগর থিয়েটার, মুক্তধারা, রূপকার, ধ্রæপদী, দেশকাল, লোকালয়, দ্বৈরত, পদধ্বনি, নাট্যম, রঙ্গবদন, রেপার্টরি থিয়েটার, জিগীষা, এবং অতঃপর, প্রচ্ছায়া, দ্বীপায়ন, চেনামুখ, সন্দীপনা, বাতিঘর, থিয়েটার গণআন্দোলন, থিয়েটার লোহিত্য, আমরা পলাশ, আহ্বান, লোজেইত্তন, ত্রিতীর্থ, পূর্বাভাস, চতুরঙ্গ, প্রদীপ্ত, অনির্বাণ থিয়েটার ও স্বপ্নযাত্রা প্রভৃতি। এসব নাট্যদল এখনও সক্রিয়।
চট্টগ্রামের আবৃত্তিচর্চা অনেক প্রাচীন। এখানে প্রাচীনকালের পুথিপাঠ ছিল মূলত আবৃত্তি। বিশ শতকের প্রথমদিকে অর্থাৎ ১৯০৭ সালে রবীন্দ্রনাথ এবং ১৯২৬, ১৯২৯ ও ১৯৩৩ সালে নজরুলের আগমন ঘটেছিল চট্টগ্রামে। এছাড়া সুকান্ত ভট্টাচার্য, জসীম উদ্দীন ও সুভাষ মুখোপাধ্যায়ও চট্টগ্রামে এসেছিলেন। সে সময় তারা নিজেদের কণ্ঠে কবিতা আবৃত্তি করেছিলেন, যা চট্টগ্রামের আবৃত্তিচর্চাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। বিশ শতকের প্রথমদিক থেকে পঞ্চাশ-ষাট দশক পর্যন্ত রবীন্দ্র ও নজরুলজয়ন্তী ছাড়া মঞ্চে আবৃত্তি হতো না বললেই চলে। সত্তর দশক পর্যন্ত আবৃত্তির নামে যা হয়েছে, তা ছিল একক আবৃত্তি। তখন পর্যন্ত একটাও আবৃত্তি সংগঠন ছিল না। আশির দশকের মাঝামাঝি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে চট্টগ্রামের প্রথম আবৃত্তি সংগঠন ‘অভিব্যক্তি’ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এর মাধ্যমে নিয়মের মধ্যে আবৃত্তিচর্চা শুরু হয়। এই সংগঠন বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। চট্টগ্রামের দ্বিতীয় আবৃত্তি সংগঠন ‘বোধন আবৃত্তি পরিষদ’। ১৯৮৭ সালের ৯ জানুয়ারি এই সংগঠনের কার্যক্রম শুরু হয়। এই সংগঠনের স্বপ্নদ্রষ্টা অ্যাডভোকেট সুভাষ চক্রবর্তী, অ্যাডভোকেট বিশ্বজিৎ দাশ (ভুলু) ও অ্যাডভোকেট স্বপন চক্রবর্তী। প্রতিষ্ঠার পরের বছর ১৯৮৮ সালে ‘বোধন আবৃত্তি পরিষদ’ স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল; রাজপথে, অলিগলিতে আবৃত্তিচর্চাকে অবলম্বন করে প্রতিবাদে মেতে উঠেছিল। ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি লালদীঘির ময়দানে আওয়ামী জনসমাবেশে শেখ হাসিনার আগমনকে কেন্দ্র করে গণহত্যা হলে, পরদিন কতিপয় সাংস্কৃতিক কর্মী বাংলাদেশ ব্যাংক চত্বরে এই গণহত্যার প্রতিবাদ সমাবেশে মিলিত হয়। ‘বোধন আবৃত্তি পরিষদ’-এর কর্মীরাও পুলিশের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে এই সমাবেশে যোগ দিয়ে প্রতিবাদী কবিতা আবৃত্তি করেছিল। আবৃত্তিচর্চাকে হাতিয়ার করে ‘বোধন আবৃত্তি পরিষদ’-এর সমাজজাগানো কার্যক্রম দেখে পরে আরও অনেক আবৃত্তি সংগঠনের জন্ম হয় চট্টগ্রামে। কতিপয় সংগঠনের নাম : স্বরশ্রæতি, শব্দসড়ক, চর্চা, প্রমা, চারুবাক, দৃষ্টি, উদীরণ, ত্রিতরঙ্গ, মুক্তধ্বনি, কল্পন, শব্দাঙ্গন, উচ্চারক, অনার্র্য্য অন্যস্বর, তারুণ্যের উচ্ছ¡াস, স্বপ্নযাত্রী (প্রতিষ্ঠাকাল : ২০০৯), অঙ্গন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আবৃত্তিমঞ্চ, চট্টগ্রাম আবৃত্তি একাডেমি, একুশ, নির্মাণ, প্রমিতি, বিভাষ, স্বদেশ, প্রহর, পাণ্ডুলিপি, প্রত্যয়, শব্দনোঙর, স্বরনন্দন প্রমিত বাংলা চর্চা কেন্দ্র ও নরেন আবৃত্তি একাডেমি প্রভৃতি।
চট্টগ্রামের নৃত্যচর্চা খুবই পুরনো। আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের সংগৃহীত রাগতালনামা পুথিসমূহ থেকে প্রতীয়মান হয়, বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে চট্টগ্রামে উচ্চাঙ্গ নৃত্যের চর্চা ছিল। এছাড়া লোকনৃত্যের চর্চা তো ছিলই। সে সময়ে চট্টগ্রামের মুসলমান কবিদের রচিত পদাবলি প্রমাণ করে, তাদের অনেকে নৃত্যেরও চর্চা করতেন। প্রাচীনকাল বা মধ্যযুগ থেকে উচ্চাঙ্গ নৃত্য ও লোকনৃত্যের চর্চা কখনো থামেনি। বিশ শতকের প্রথম দশকে চট্টগ্রামে আধুনিক ধারার নৃত্যচর্চার সূচনা ঘটে আর্য্যসংগীত সমিতির মাধ্যমে। এই সমিতি সংগীতের নানা শাখার সঙ্গে নৃত্য শিক্ষাদানও শুরু করে তখন। এখানে যারা প্রশিক্ষিত হতেন তারা চট্টগ্রামের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে নৃত্য পরিবেশন করতেন। দেশভাগের পরে মুসলিম লীগের চরম সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী তৎপরতার কারণে মঞ্চে নৃত্য পরিবেশনের ক্ষেত্রে প্রতিকূল পরিস্থিতি সৃষ্টি হলেও চট্টগ্রামে তখন কিছু নৃত্যশিল্পী, যেমন- পান্না, আইভি, ডলি, জুবিলি ও রোকেয়া আফতাব সাহসের সঙ্গে নৃত্য পরিবেশন করেছিলেন। এরপর ১৯৫৪ সাল থেকে, বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি পাকিস্তানি হীন মানসিকতা ও অপতৎপরতা রোধকল্পে চট্টগ্রামের গণনাট্য আন্দোলনে নৃত্য পরিবেশনের রীতি চালু হয়। পাশাপাশি সুচরিত চৌধুরীর নৃত্যনাট্য মঞ্চায়নের মাধ্যমে লোকনৃত্যচর্চার জাগরণও শুরু হয়। ষাটের দশকে চট্টগ্রামে বিভিন্ন ধরনের লোকনৃত্য পরিবেশনের খবর পাওয়া যায়। স্বাধীনতাত্তোরকালে চট্টগ্রামে নৃত্যচর্চা ব্যাপকতা লাভ করে এবং গড়ে উঠে অনেক নৃত্যসংগঠনও, যেগুলো এখনও সক্রিয় রয়েছে। কতিপয় নৃত্যসংগঠনের নাম : ওডিসি অ্যান্ড টেগোর ডান্স মুভমেন্ট সেন্টার, অপ্সরী ডান্স একাডেমি, উদিত নৃত্য একাডেমি, নটরাজ নৃত্যাঙ্গন একাডেমি, দি স্কুল অব ফোক ডান্স, মনোরমা নৃত্যাঙ্গন, নৃত্য নিকেতন, নিক্কন একাডেমি, স্কুল অব ওরিয়েন্টাল ডান্স, গুরুকুল নৃত্যম একাডেমি, ঘুঙুর নৃত্যকলা কেন্দ্র, সঞ্চারি নৃত্যকলা একাডেমি, চারুতা নৃত্যকলা একাডেমি, শ্যামা নৃত্যাঙ্গন, নৃত্যনন্দন, দি স্কুল অব ক্লাসিক্যাল এন্ড ফোক ডান্স ও নৃত্যাঞ্চল সাংস্কৃতিক একাডেমি (পটিয়া) প্রভৃতি।

ছয়.
বাংলা সাহিত্যের আধুনিক ধারার সূচনা ঘটে উনিশ শতকের গোড়ার দিকে। তবে উনিশ শতকের মধ্যভাগে মাইকেল মধুসূদন দত্তের আবির্ভাবের মধ্য দিয়ে প্রকৃত আধুনিক যুগের সূচনা ঘটে মনে করা হয়। কথাসাহিত্য, প্রবন্ধ, নাটক আধুনিক যুগের সৃষ্টি। কবিতায়ও সৃষ্টি হয় আধুনিকতার জাগরণ। উনিশ শতকের মধ্যভাগের পরে এই আধুনিকতার ছোঁয়া চট্টগ্রামেও এসে লাগে, নবীনচন্দ্র সেনের (১০ ফেব্রুয়ারি ১৮৪৭-১৯০৯) মাধ্যমে। মাইকেল মধুসূদন দত্তের পরে তিনিই বাংলা সাহিত্যের মহাকবি। চট্টগ্রামের রাউজানের নোয়াপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণকারী নবীনচন্দ্র সেন ‘পলাশীর যুদ্ধ’ নামে মহাকাব্য রচনা করেন। ১৮৭৫ সালে এই মহাকাব্য প্রকাশিত হওয়ার পরে তার কবিখ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ‘অবকাশ রজনী’ (প্রথম ভাগ), ‘অবকাশ রজনী’ (দ্বিতীয় ভাগ), ‘কুরুক্ষেত্র’, ‘প্রভাস’ ও ‘রৈবতক’ প্রভৃতি তার কাব্যগ্রন্থ। তিনি কথাসাহিত্যিক বা গদ্যশিল্পীও। ‘ভানুমতি’ তার উপন্যাস, যা ১৯০০ সালে প্রকাশিত হয়। তার ‘আমার জীবন’ নামক আত্মজীবনীমূলক গদ্যগ্রন্থটি উপন্যাসের মতো আনন্দদায়ক। তিনি ভগবদ্গীতা ও চণ্ডীর কাব্যানুবাদ করে অনুবাদক হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করেন। তার আরও গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘প্রবাসের পত্র’, ‘ক্লিওপেট্রা’, ‘খৃস্ট’ ও ‘শুভ নির্মলা’ (নাটিকা)।
এখানে উল্লেখ্য, উনিশ শতকের মধ্যভাগের পরে নবীনচন্দ্র সেনের মাধ্যমে চট্টগ্রামের সাহিত্যে আধুনিকতার ছোঁয়া এসে লাগলেও এসময় থেকে বিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত অনেক কবি মধ্যযুগীয় ধারার কাব্য রচনা করেছেন। ইতোমধ্যে বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের আলোচনায় আস্কর আলী পণ্ডিত, আবদুল জলিল সিকদারের কথা উল্লেখ করেছি। তাঁরা উনিশ শতকের কবি ছিলেন। আস্কর আলী পণ্ডিতের জন্ম ১৮৪৬ সালে চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার পুরানগড়ে। তিনি স্থায়ী বসতি স্থাপন করেন পটিয়া উপজেলার শোভনদণ্ডি গ্রামে। ১৯২৭ সালে তিনি সেখানে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্য ‘জ্ঞান চৌতিসা’ ও ‘পঞ্চসতী প্যারজান’। আবদুল জলিল সিকদার সাতকানিয়া উপজেলার মনেয়াবাদ গ্রামে ১৮৫৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ‘মনেয়াবাদের ইতিবৃত্ত’ এবং ‘জাহাঁগীর চরিত ও বারমাসী’ কাব্য রচনা করেন। ১৯৩৪ সালের ৬ সেপ্টেম্বর তার মৃত্যু ঘটে। উনিশ শতকের চট্টগ্রামে মধ্যযুগীয় ধারার আরেকজন কবি হলেন ক্ষেমেশচন্দ্র রক্ষিত (১৮৪৭-১৯২২)। দক্ষিণ পটিয়া (বর্তমান চন্দনাইশ উপজেলা)-র জোয়ারা গ্রামের এই সন্তান ‘আমার খেয়াল’ ও ‘মানবকুসুম’ নামে কাব্য রচনা করেন। তিনি আরও অনেক গ্রন্থ রচনা করেন। তার রচনাবলির জন্য তিনি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের সুযোগ্য উত্তরসূরি চিহ্নিত হন এবং কাশীর মহামহোপাধ্যায় যাদবেশ্বর ন্যায়রতœসহ অনেক বিদ্বান কর্তৃক কবিরঞ্জন উপাধিতে ভূষিত হন।
নবীনচন্দ্র সেনের পর থেকে আজ পর্যন্ত আধুনিক ধারার সাহিত্যচর্চা, প্রবন্ধ রচনা ও গবেষণাকর্মে এবং অনুবাদের কাজে অনেক এগিয়েছে চট্টগ্রাম। যেসব লেখক এগিয়ে নিয়েছেন, তাদের মধ্য থেকে উল্লেখযোগ্যদের নাম :
রায়বাহাদুর শরচ্চন্দ্র দাশ, নবীনচন্দ্র দাশ, মৌলভী নূর আহমদ চেয়ারম্যান, বিপিনবিহারী নন্দী, সর্বানন্দ বড়–য়া, আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ, শশাঙ্কমোহন সেন, আবুল মা আলী মুহম্মদ হামিদ আলী, মৌলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, জীবেন্দ্রকুমার দত্ত, হেমন্তবালা দত্ত , চৌধূরী শ্রীপূর্ণচন্দ্র দেববর্ম্মা তত্ত্বনিধি : আশুতোষ চৌধুরী, বেনী মাধব বড়–য়া, কমরেড মুজফ্ফর আহমদ, গিরীশচন্দ্র বড়–য়া বিদ্যাবিনোদ, মাহবুব-উল আলম, জ্যোতির্ময়ী রায় চৌধুরী, ড. মুহম্মদ এনামুল হক, দিদারুল আলম, আবুল ফজল, হাবীবুল্লাহ বাহার, শামসুন নাহার মাহমুদ, ড. যতীন্দ্র বিমল চৌধুরী, ওহীদুল আলম, আসহাব উদ্দিন আহমদ, কল্পতরু সেনগুপ্ত, বুলবুল চৌধুরী, অধ্যক্ষ আবুল কাসেম, আহমদ শরীফ, সোমনাথ হোর, এ. কে. এম. মনসুর উদ্দীন, অশোক কুমার বড়–য়া, উমরতুল ফজল, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্, আবদুল হক চৌধুরী, ফেরদৌস খান, সুলতানা রহমান, মাহবুব উল আলম চৌধুরী, ড. আবদুল করিম, আলাদীন আলী নূও, সুচরিত চৌধুরী, চৌধুরী আহমদ ছফা, সফিনাজ নুরুন নাহার, নূর মোহাম্মদ চৌধুরী সাহিত্যরতœ, ড. মাহফুজুল হক, ড. সুনীতি ভূষণ কানুনগো, অরুণ দাশগুপ্ত, বেলাল মোহাম্মদ, সুকুমার বড়–য়া, বেগম মুশতারী শফী, ড. মনিরুজ্জামান, ড. রশীদ আল ফারুকী, ড. অনুপম সেন, ড. শামসুল আলম সাঈদ, বিপ্রদাশ বড়ুয়া, আহমদ ছফা, আবুল কাসেম স›দ্বীপ, মনসুর মুসা, সিদ্দিক আহমেদ, অধ্যপক ভুঁইয়া ইকবাল, চৌধুরী জহুরুল হক, স্বপন দত্ত, ড. মোঃ আবুল কাসেম, ড. মাহবুবুল হক, খুরশীদ আনোয়ার, ফেরদৌস আরা আলিম, আবুল মোমেন, আনন্দমোহন রক্ষিত, ড. প্রকৃতি প্রভা চক্রবর্তী, আনোয়ারা আলম, ময়ুখ চৌধুরী, ড. রাজীব হুমায়ুন, বিপুল বড়ুয়া, ত্রিদিব দস্তিদার, বিমল গুহ, ড. মোহীত উল আলম, সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ, হরিশংকর জলদাস, মৃদুল গুহ, ফাউজুল কবির, ছন্দা দাশ, অভিক ওসমান, ড. শিরীণ আখতার, জ্যোতির্ময় নন্দী, ড. নুরুল আমিন, তৌফিকুল ইসলাম চৌধুরী, আসাদ মান্নান, ইউসুফ মুহম্মদ, অজয় দাশগুপ্ত, এমরান চৌধুরী, ওমর কায়সার, উৎপলকান্তি বড়–য়া, সুজন বড়–য়া, আবু মুসা চৌধুরী, রহীম শাহ, শাহিদ আনোয়ার, আলম খোরশেদ, রিজোয়ান মাহমুদ, জসীম মেহবুব, মিনার মনসুর, বিশ্বজিৎ চৌধুরী, প্রণব কুমার চৌধুরী, শামসুদ্দীন শিশির, এজাজ ইউসুফী, হাফিজ রশিদ খান, ড. মহীবুল আজিজ, দেবাশিস ভট্টাচার্য, বদরুননেসা সাজু, খালেদ হামিদী, কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর, শ্যামল দত্ত, সাজিদুল হক, রাশেদ রউফ, অনিন্দ্য বড়–য়া, ড. আজাদ বুলবুল, জিললুর রহমান, বিজন মজুমদার, খোকন কায়সার, জি এইচ হাবীব, শাকিল আহমদ, সেলিনা শেলী, শাহিদ হাসান, ভাগ্যধন বড়–য়া, রাজীব নূর, বিচিত্রা সেন, ড. ইলু ইলিয়াস, শাহীন মাহমুদ, ড. আহমেদ মাওলা, আহমেদ মুনির, ফারজানা রহমান শিমু, জাহেদ মোতালেব, তাপস চক্রবর্তী, মহি মুহাম্মদ, মুয়িন পারভেজ, শোয়ায়েব মুহামদ, গোফরান উদ্দিন টিটু, শামসুল আরেফীন, আলী প্রয়াস, আসমা বীথি, ফজলুল কবিরী, পান্থজন জাহাঙ্গীর, সালেক নাছির উদ্দিন, রিমঝিম আহমেদ এবং শাফিনূর শাফিন।

আধুনিক ধারার সাহিত্যচর্চা, প্রবন্ধ রচনা, গবেষণা ও অনুবাদকর্মে চট্টগ্রামে আরও যারা যুক্ত ছিলেন, আছেন, তাদের নাম উল্লেখ করলে এই প্রবন্ধের কলেবর অনেক বৃদ্ধি হবে।

শামসুল আরেফীন
লোকসাহিত্য ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়