যৌতুকের জন্য স্ত্রী হত্যার মামলায় স্বামীর মৃত্যুদণ্ড

আগের সংবাদ

বিদেশিদের নজর ঢাকার দিকে : ব্যস্ত সময় পার করলেন ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কোরিয়ার শীর্ষ কূটনীতিকরা

পরের সংবাদ

সাংবাদিকতাসহ জীবনানন্দের জীবনবেদ

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

আনন্দ খোঁজার উপাদানে ঠাসা জীবনানন্দ। যার সামান্যই উদ্ধার হয়েছে কবি জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে করা নানা গবেষণা ও লেখায়। চেষ্টা চালাতে থাকলে আরো উদ্ধার হবে। মিলবে অনেক কিছুর তালাশ। ‘রূপসী বাংলার কবি’ হিসেবে পরিচিত জীবনানন্দ দাশের বাংলাদেশ ও ভারতের ৫৫ বছরের ঘটনাবহুল জীবনের নানা বাঁকে অনেক ঘটনা। দুদেশের জায়গায়-জায়গায় বহু স্মৃতি তার।
কর্মজীবনের বড় অংশ শিক্ষকতায় কাটানো জীবনানন্দ দাশ জীবদ্দশায় মূলত কবি হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। কর্মজীবনে শিক্ষকতা করলেও এই পেশার প্রতি তার খেদ, অভিমান ও বিরক্তির নানা প্রকাশ রয়েছে। শিক্ষকতার প্রতি বীতশ্রদ্ধতার কথা বিভিন্ন সময়ে তার সুহৃদদের কাছে লেখা চিঠিতেও আছে। বরিশাল ব্রজমোহন কলেজের স্থায়ী ও সম্মানজনক চাকরি ফেলে কলকাতায় গিয়ে সাংবাদিকতায় জড়িয়ে পড়ার মাঝেও অনেক ঘটনা। প্রথম কাজ নিয়েছিলেন দৈনিক ‘স্বরাজ’ পত্রিকায়। সেখান থেকে চাকরি খোয়ান তার সমসাময়িক (একই বছরে জন্ম) কবি কাজী নজরুল ইসলামের (তিনি তখন তুমুল জনপ্রিয়) ‘সমালোচনা’ করার কারণে। ১৯২৯-৩০ সালের ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে লাহোরে জওহরলাল নেহরুর সভাপতিত্বে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভায় স্বাধীনতা প্রস্তাব গৃহীত হয়। নেহরু তখন ওই মাসের ২৬ তারিখকে পূর্ণ স্বরাজ দিবস ঘোষণা করেন। সেই স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা রেখে ১৯৪৭ সালের ২৬ জানুয়ারি হুমায়ুন কবিরসহ আরো কয়েকজনের উদ্যোগে যাত্রা শুরু স্বরাজ পত্রিকার। সম্পাদক করা হয় সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদারকে। সাহিত্যপাতার সম্পাদক জীবনানন্দ দাশ। অফিস কলকাতা শহরের শিয়ালদহ স্টেশনের কাছে। হরিশংকর জলদাসের (জীবনানন্দ ও তাঁর কাল, পৃষ্ঠা ১৫১) তথ্য অনুযায়ী, জীবনানন্দ স্বরাজে কাজ করেছেন সাত মাস (১৯৪৭ সালের জানুয়ারির শেষ অথবা ফেব্রুয়ারি থেকে ওই বছরের জুলাই-আগস্ট পর্যন্ত)। তিনি ১৯৪৭ সালের ৩০ জুলাই মাসেও যে এই পত্রিকায় ছিলেন তা বোঝা যায় ওই তারিখে অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তকে লেখা একটি চিঠিতে। যেখানে তিনি স্বরাজের কাজ ভালো লাগছে না বলে তাকে জানান।
দেশভাগের ডামাডোল শুরু হলে পূর্ববাংলার হিন্দুরা নিজেদের আসন্ন বিপদ সম্পর্কে আতঙ্কিত হয়ে ওঠেন, যা থেকে খোদ জীবনানন্দও মুক্ত থাকতে পারেননি। বরিশাল ব্রজমোহন কলেজে জীবনানন্দের ছাত্র এবং পরবর্তীকালে প্রখ্যাত উপন্যাসিক শামসুদ্দিন আবুল কালামের বর্ণনা বলছে- বরিশাল থেকে পাকাপাকিভাবে কলকাতা গিয়েই (১৯৪৭) জীবনানন্দ ‘স্বরাজ’ পত্রিকায় কাজ নেন। জীবনানন্দের আগ্রহে তিনিও এই পত্রিকায় কয়েকটি গল্প লিখেছিলেন।
জীবনানন্দ স্বরাজ পত্রিকার রবিবাসরীয়তে ‘মনমর্মর’ নামে একটি বিভাগ খুলেছিলেন। যেখানে অনেক সাহিত্যিক বন্ধু তাদের ব্যক্তিগত গদ্য লিখেছেন জীবনানন্দের অনুরোধে। ১৩৫৪ বঙ্গাব্দের ২৪ শ্রাবণ এই পত্রিকায় জীবনানন্দ নিজেই একটি গদ্য লিখেছিলেন ‘রবীন্দ্রনাথ’ শিরোনামে। তারই দায়িত্বে সে বছর প্রথম পূজাসংখ্যাও প্রকাশের পরিকল্পনা নেয়া হয়। ভূমেন্দ্র গুহর ভাষ্য অনুযায়ী : ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষের স্বাধীনতার আগে, পূজার আগে দৈনিক স্বরাজ পত্রিকা কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে বিশেষ সংখ্যা বের করে কোনো এক রবিবার। নজরুল তখন স্মৃতিশক্তিহীন। ওই সময়েই স্বরাজের জন্য তিনি লেখেন, ‘নজরুল ইসলাম’ নামের প্রবন্ধটি। এডিট হয়নি। প্রæফ দেখাও হয়নি। পত্রিকায় ছাপার জন্য পড়ে থাকে সম্পাদকের টেবিলে। তা নিয়েই তোলপাড়। ভূমেন্দ্র গুহর বর্ণনায় এসেছে, অন্যান্য কারণের সঙ্গে নজরুলকে নিয়ে এই প্রবন্ধের ইস্যুটাও স্বরাজ পত্রিকা থেকে জীবনানন্দের চাকরিচ্যুতির উপলক্ষ হয়ে ওঠে।
চরম দারিদ্র্য ও সংগ্রামের মধ্যে জীবনাতিপাত করা জীবনানন্দের জন্ম ধনাঢ্য ঘরে। তার জীবনবেদও কাব্যময়। বরিশাল শহরে তাদের পরিবার ছিল অন্যতম সম্ভ্রান্ত এবং প্রভাবশালী। এমনকি আধুনিক বরিশালের রূপকার বলা হয় যে অশ্বিনীকুমার দত্তকে, তিনিও মিউনিসিপ্যাল নির্বাচনে হেরেছিলেন জীবনানন্দের দাদা সর্বানন্দ দাশের কাছে। আমাদের সেই জীবনানন্দকেই চিনতে হয় বাংলাদেশের বরিশাল, বাগেরহাট, ভারতের কলকাতা, খড়গপুর, দিল্লিসহ ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে। বাংলাদেশ ও ভারতের বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা, কিছুদিনের সাংবাদিকতাসহ কর্মজীবনের কোথাও স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে থিতু হতে পারেননি এই কবি। তার সোনার খনি থেকে সৃষ্টি হয়েছে অনেক গল্প-উপন্যাসও। এসব সৃষ্টিতে তিনি ফিরে আসেন বারবার।
কবি জীবনানন্দ দাশ বোধ হয় খুবই অল্প কিছু মানুষের একজন, যিনি তার কবিতার মাধ্যমে মানুষের জন্ম-মৃত্যু আর কর্মকাণ্ডকে মহাজাগতিক প্রেক্ষাপটে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেই প্রকাশ তার ‘দুজন’ কবিতায় …
‘পৃথিবীর পুরনো পথের রেখা হয়ে যায় ক্ষয়,
প্রেম ধীরে মুছে যায়, নক্ষত্রেরও মরে যেতে হয়, …?’
বিখ্যাত জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানী কার্ল সাগান এ রকমই একটি কথা অন্যভাবে বলেছিলেন : মানুষের মতোই নক্ষত্র ও গ্রহগুলোর জন্ম হয়, জীবনযাপন করে, আবার মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
একজন মানুষের জীবনকালের পরিমাপ হয় দশকের ভিত্তিতে; সূর্যের জীবনকালের ব্যাপ্তি এর চেয়ে ১০ কোটি গুণ বেশি। নক্ষত্রের তুলনায় আমরা হলাম প্রজাপতির মতো, দ্রুত ধাবমান, ক্ষণস্থায়ী।
জীবনানন্দ দাশের জন্ম ১৮৯৯ সালে বরিশাল জেলায়। বাবা সত্যানন্দ দাশ একজন স্কুলশিক্ষক, প্রবন্ধকার, ব্রহ্মবাদী নামে পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক। মা কুসুমকুমারী দাশ হাসির গান ও কবিতা লিখতেন।
জীবনানন্দ দাশের প্রথম কাব্যগ্রন্থ বের হয় ১৯২৭ সালে ‘ঝরা পালক’; এর পর ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ (১৯৩৬); ‘বনলতা সেন’ তার তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ। তার মৃত্যুর পর বের হয় রূপসী বাংলা (১৯৫৭) ও বেলা অবেলা কালবেলা (১৯৬১)।
বাংলা কাব্যসাহিত্যে এ রকম একটি নতুন ধারা হঠাৎ তিনি তৈরি করতে সমর্থ হননি বরং ক্রমাগতভাবে তা অর্জন করেছেন। তার গভীরতর উপলব্ধিকে তিনি অনবরত শব্দ, ভাষার প্রয়োগে এমন এক স্তরে উঠিয়ে এনেছেন, যার ফলে কবিতার শরীর থেকে বিকীর্ণ মহাজাগতিক ব্যাপ্তি আমরা অনুভব করি।
বস্তুত মানুষ সবাই নিরন্তর বহমান সময়ের থেকে খসে গিয়ে সময়ের জালে জড়িয়ে পড়ে। এটা একটা মায়া, কুহক, বিভ্রান্তি; অবিরল শূন্যের গ্রাস।
তারপরও ২২ অক্টোবর এলেই আমাদের মনের ভেতরে সেই পুরনো বিভ্রান্তিটি খচখচ করে ওঠে- জীবনানন্দ কি তবে আত্মহত্যাই করেছিলেন, নাকি মৃত্যুকে তিনি আলিঙ্গন করেছেন অথবা ভেবেছিলেন যে, জীবনের লেনদেন ঘুচেই যেহেতু গেছে, সুতরাং অন্ধকারে চিরকাক্সিক্ষত মানুষের মুখোমুখি বসে থেকে এইবার না হয় দুদণ্ড শান্তির আয়োজন।
আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে জীবনানন্দ দাশ প্রায়ই নাকি ট্রাম দুর্ঘটনায় মৃত্যুর কথা ভাবতেন। এর চেয়েও আশ্চর্যজনক বিষয় হচ্ছে গত একশ বছরে কলকাতা শহরে ট্রাম দুর্ঘটনায় মৃত্যুর ঘটনা একটাই।
জীবনানন্দ রচনা করেছেন প্রায় ১ হাজার ৬০০ কবিতা, এক ডজন উপন্যাস, প্রায় পঞ্চাশটি গল্প ও বহু প্রবন্ধ। তিরিশের দশক থেকে মৃত্যুবধি তিনি গল্প-উপন্যাস রচনা করে গিয়েছেন, কিন্তু সেগুলোর একটিও তার জীবদ্দশায় প্রকাশিত হয়নি। তার কবিতারও এক ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ গ্রন্থিত হয় তার জীবদ্দশায়, যদিও আরো কয়েকশ কবিতা বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়- অধিকাংশই বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনে। ‘মাল্যবান’ তার লেখা প্রথম উপন্যাস, যা গ্রন্থিত হয় ১৯৭০ সালে। বাস্তবিকই তার অকালমৃত্যুর পরে কারোর ধারণাই ছিল না যে তার পাণ্ডুলিপির ট্রাঙ্কের ভেতর এতগুলো অপ্রকাশিত গল্প ও উপন্যাস রয়েছে।
কবি হিসেবে তো বটেই, ব্যক্তি জীবনানন্দ দাশও ছিলেন গম্ভীর, ভেতরগোটানো এবং গাঢ় নির্জন ধরনের মানুষ। বেঁচে থাকার সময়, তার লেখালেখির ধরন ও চরিত্রের গড়নের কথা কাছের ও দূরের মানুষেরা কিছু কিছু জানতেন। এ বিষয়ে সবচেয়ে ভালো করে জানতেন বুদ্ধদেব বসু।
মাল্যবান জীবনানন্দ দাশের প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস। উপন্যাসটি লেখা হয় জুন ১৯৪৮ সালে, অল্প কয়েকদিন সময়ের ব্যাপ্তিতে। তার জীবদ্দশায় উপন্যাসটি ট্রাঙ্কবন্দি অবস্থায় চাপা ছিল। মৃত্যুর কুড়ি বছর পর, তার ছোট ভাই অশোকানন্দ দাশের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত ‘নিউ স্ক্রিপ্ট’ থেকে এটি প্রথম বই আকারে প্রকাশিত হয়। উপন্যাসটির প্রথম সংস্করণে নামপত্রে প্রকাশকের নাম, প্রচ্ছদ : সত্যজিৎ রায়, কপিরাইট : লাবণ্য দাশ ও সমরানন্দ দাশ, মূল্য : ১০ টাকা- এই কথাগুলো উল্লেখ ছিল। বইয়ের কোথাও প্রকাশকাল উল্লেখ নেই।
জীবনানন্দ দাশ সচেতনভাবেই সিরিয়াসলি ঔপন্যাসিক হতে চেয়েছেন। এ ব্যাপারে তিনি কখনো প্রতিভা বসুর কাছে উপন্যাস বিক্রির বিষয়ে খোঁজখবর নিয়েছেন, সঞ্জয় ভট্টাচার্যকে চিঠিতে ছদ্মনামে উপন্যাস লিখবার বাসনার কথা জানিয়েছেন এবং বয়সে ছোট কিন্তু বন্ধুর মতো জীবনানন্দ-অনুরাগী প্রভাকর সেনকে গল্প-উপন্যাস পড়তে দিয়েছেন। এমনকি ‘মাল্যবান’-এর চিত্রনাট্য লিখে প্রেমেন্দ্র মিত্রকে জমা দেবেন বলেও ভেবেছেন। কারণ প্রেমেন তার বন্ধু এবং বিখ্যাত সিনেমা পরিচালক ও চিত্রনাট্যকার। কাজেই গল্প-উপন্যাসের জগতে জীবনানন্দ দাশ হঠাৎ খেয়ালে কবিতা থেকে কলম তুলে ঢুকে পড়েছেন, এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই।
জীবনানন্দকে বাঙালি পাঠকবিশ্বে তুলে ধরেছিলেন যে শুভাকাক্সক্ষী বুদ্ধদেব বসু তার উপযুক্ত সমাধিফলকই লিখে গিয়েছিলেন, যখন তিনি তাকে ‘আমাদের নির্জনতার কবি’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। হতে পারে সেই নির্জনতার কারণেই আজ অবধি বাংলা সাহিত্যের এই মহৎ ব্যক্তিত্বের একটি মাত্র জীবনী লেখা হয়েছে বাংলায়- অন্য কোনো ভাষায় একটিও নয়।’
শেষোক্ত এই উদ্ধৃতি-অংশে যে-টীকার উল্লেখ করা হয়েছে, তারই দৌলতে আমরা জানতে পেরেছি যে, ক্লিন্টন বি সিলির এ পোয়েট অ্যাপার্ট প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৯০ সালে।
তার আগে জীবনানন্দ নামে গোপালচন্দ্র রায়ের লেখা একটা জীবনীগ্রন্থ বেরিয়েছিল ১৯৭১ সালে। এটিই ছিল বাংলা সাহিত্যে কবির ওপর লেখা প্রথম জীবনীগ্রন্থ। পরে তার জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে জীবনানন্দ দাশ নামে প্রভাতকুমার দাসের লেখা একটি জীবনীগ্রন্থ বের হয় ১৯৯৯ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি। ক্লিন্টন এটিকে ‘উৎকৃষ্ট একটা জীবনী’ বলে অভিহিত করেছেন।
দুর্ভাগ্যজনক হলেও নিরেট সত্যটা এই যে, বাংলা সাহিত্যপ্রেমী একজন বিদেশি, মার্কিন নাগরিক ক্লিন্টন বি সিলি বাংলা সাহিত্যে যিনি ‘নির্জনতম কবি’ বলে অভিহিত, সেই কবির দ্বিতীয় বিস্তারিত জীবনীটি লেখার জন্য যেভাবে প্রাণিত হন এবং আমাদের আলোচ্য সেই বিশালায়তনের গ্রন্থটি রচনা করেন, এক অর্থে, তা বিস্ময়করই বটে।
আমরা এখন জোর গলায় বলতে পারি, পোয়েট অ্যাপার্ট তথা অনন্য জীবনানন্দ কবি জীবনানন্দ দাশের জীবন ও তার কাব্যকৃতি নিয়ে এ যাবৎ প্রকাশিত সবচেয়ে বিস্তারিত ও ঋদ্ধ গ্রন্থ। স্মর্তব্য, গ্রন্থটি রচিত হয়েছিল মার্কিন তথা ইংরেজি ভাষাভাষী পাঠকদের সঙ্গে জীবনানন্দ ও তার কাব্যকৃতির পরিচয় করিয়ে দেয়ার লক্ষ্য থেকে।
ফারুক মঈনউদ্দীনের নিবিড় ও নিষ্ঠশ্রমে বাংলায় অনূদিত হওয়ার পর এ-গ্রন্থ এখন বাংলা সাহিত্যেরও এক অবিচ্ছেদ্য মূল্যবান সাহিত্য-দলিলে পরিণত হলো। নতুন মহাদেশ আবিষ্কার করার মতো করে জীবনানন্দকে তিনি যেভাবে আবিষ্কার করেন, অনেক ক্ষেত্রে আমাদের কাছেও মনে হয়, আহা আমরা এতদিন আমাদের নিজের ভাষার এই কবিকে এভাবে আবিষ্কার করতে পারিনি কেন?
সজনীকান্ত জীবনানন্দ ও অন্য আধুনিক কবিদের রচিত কবিতাকে অভিহিত করতেন ‘গবিতা’ বলে। কিন্তু জীবনানন্দসহ ত্রিশের কবিরা যে শেষ পর্যন্ত রক্ষণশীল কাব্য ও সাহিত্যবোদ্ধাদের চোখের সামনে দিয়েই নিজেদের দৃঢ? অবস্থান তৈরি করতে শুরু করে দিয়েছিলেন, পরিবর্তিত কালের প্রেক্ষাপটে নিজেদের পৃথক সাহিত্যিক বা কাব্যিক সত্তাকে স্পষ্ট করার অভিযানে অক্লান্ত ছিলেন এবং সেক্ষেত্রে নানা বিপত্তি ও বাধা সত্ত্বেও তারা যে সাফল্যের মুখ দেখছিলেন, সিলি তার বইয়ের এই অধ্যায়ে তারও বিস্তারিত বিবরণ পেশ করেছেন।
জীবনানন্দ সম্পর্কে সুওয়াকিবহাল পাঠকমাত্রেরই একটি বিষয় জানা আছে যে, জীবনানন্দ-বিশেষজ্ঞদের অনেকেই ইতিমধ্যে তার ‘বনলতা সেন’ কবিতাকে মার্কিন কথাসাহিত্যিক ও কবি এডগার অ্যালান পোর ‘টু হেলেন’ কবিতার প্রায় সমূল অনুবাদ বলে ব্যাখ্যাসহ প্রতিপন্ন করার প্রয়াস চালিয়েছেন। কিন্তু মার্কিন এই গবেষক জীবনানন্দের ‘বনলতা সেন’ কবিতার দীর্ঘ আলোচনায় কোথাও এ ধরনের প্রয়াস চালাননি। ভুলেও নয়। এবং ‘টু হেলেন’ যে সিলির পড়া নেই, এ-কথা মোটেও বিশ্বাসযোগ্য নয়।
ফলে যারা বা যেসব গবেষক ‘বনলতা সেন’কে ‘টু হেলেনে’র অনুসৃতি মাত্র বলে থাকেন, তাদের এই বইয়ের এ-অধ্যায়টিতে ‘বনলতা সেনে’র আলোচনা নিঃসন্দেহে চমকিত করবে।
জীবনানন্দের জীবন ও সাহিত্যকর্মের বিচারে ক্লিন্টনের বিশ্লেষণ-প্রয়াস একপেশেমিতায় পর্যবসিত নয়। ফলে আমরা দেখি, তিনি, জীবনানন্দ যে রাজনীতির বাইরে থাকতে পারেননি, কিংবা তখনকার বাস্তবতা তাকে রাজনীতি-নিস্পৃহ থাকতে দেয়নি, সেটা তুলে ধরতেও তিনি কসুর করেননি।
শেষ করছেন তিনি ’৪৭ সালের দেশভাগের সুগভীর মর্মবেদনা ও হাহাকার দীর্ণতা জীবনানন্দ কীভাবে তার কবিতা বা কাব্যকর্মে তুলে ধরছেন, পেশ করছেন তার পরিচয়বাহী স্বাক্ষর। এবং ‘রাজনীতির কবিতা’ নামে যে-অধ্যায়টি যুক্ত করা হয়েছে এ-বইয়ে, সেটিও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
এখানে নানা দৃষ্টান্ত সহযোগে তুলে ধরা হয়েছে বামপন্থি, তথা কমিউনিস্ট চক্রভুক্ত সাহিত্য-ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে তার সম্পর্ক, শেষ পর্যন্ত সেই সম্পর্কের টানাপড়েনের কথা এবং এসবের পরিণতি তার সৃজনকর্মে কতটা প্রভাব বিস্তার করেছে, ক্লিন্টন বি সিলি তারও বর্ণনা দিয়েছেন সবিস্তারে। তিনি দেখিয়েছেন, জীবনানন্দের কবিস্বভাব মূলত তার স্বকাল ও জীবনের দ্ব›দ্ব-সংঘাতেরই ভাষিক অনুরণন, স্রেফ রাজনীতিকেন্দ্রিক কিছু নয়।
‘উপন্যাসের আরেকটি প্রয়াস’ এ-বইয়ের এমনই একটি অধ্যায়, যেখানে জীবনানন্দের গদ্যচর্চা তথা কথাসাহিত্য, বিশেষভাবে তার উপন্যাস রচনার পটভূমি ও প্রয়াসের কথা তুলে ধরা হয়েছে। তুলে ধরা হয়েছে তার জীবনের দ্ব›দ্ব-সংঘাতজনিত নানা টানাপড়েনের কথাও।
ক্লিন্টন বি সিলি এ-বই নিজের ভূমিকায় জীবনানন্দের দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর কথা দিয়ে শুরু করেছিলেন, শেষও করেছেন তার মৃত্যু ও মৃত্যু-পরবর্তী প্রতিক্রিয়ার বিবরণ দিয়ে।
সত্যি বলতে কি, জীবনানন্দকে মার্কিন তথা ইংরেজি ভাষাভাষী পাঠককুলের সঙ্গে পরিচিত করাতে পোয়েট অ্যাপার্ট নামে কবির যে সাহিত্যিক-জীবনী রচনা করেন তিনি, ফারুক মঈনউদ্দীনের স্বচ্ছন্দ ও সাবলীয় অনুবাদে সম্পাদিত অনন্য জীবনানন্দ নামের সেই জীবনীই বাংলা ভাষাভাষী জীবনানন্দ-প্রেমিকদের জন্য অপরিহার্য গ্রন্থ হয়ে উঠেছে।
ব্যক্তিগত জীবন তার ঘোর কালো ছিল। কিন্তু সেসব ভুলে থেকে যে লেখালিখিতে একটু শান্তি পাবেন, তাও কপালে জোটেনি। সিটি কলেজে ধর্মীয় কারণে ঝামেলা হওয়ায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমে যায়। যার দরুণ জুনিয়র প্রভাষকদের চাকরি চলে যায়। জীবনানন্দ দাশ ছিলেন তাদেরই একজন। ব্যাস, গুজব রটানো হয় কবিতায় অশ্লীলতার অভিযোগে তিনি চাকরি হারান। পত্র-পত্রিকা থেকে তার লেখা ফেরত আসে। নতুন কবিতার সংকলনে তার নাম আসে না। শুরুর দিকের বই প্রকাশের জন্য প্রকাশক পাননি, নিজ খরচেই প্রকাশ করতে হয়েছিল।
জীবনানন্দ দাশ বাস্তবতার কবি নন, পরাবাস্তববাদের কবি। তাই তিনি মৃত্যুর চেয়ে অপমৃত্যুর ছবি আঁকেন বেশি। তিনি লাশ কাটা ঘরের মর্মান্তিক পরিবেশ তুলে ধরেন। দেখান যে, ইঁদুর যেমন ওষুধ খেয়ে ভেবেছিল খাদ্য-অপমৃত্যুর শিকার হয়, মানুষও লাশ কাটা ঘরে অমনই নিয়তির শিকার হয়। মুখে তার রক্তের ফেনা ওঠে।
খুব তাৎপর্যপূর্ণভাবে জীবনানন্দ দাশ তার কাব্যসম্ভারে বারংবার ‘ভাঁড়’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। তিনি যেমন বাস্তবের উপরিতল ভেদ করে, গভীরে চোখ নামিয়ে মানুষের দুর্গতি, লাঞ্ছনা, অসহায়ত্ব, অপমৃত্যু দেখেছেন, তেমনি দেখেছেন সমাজের অন্তঃসারশূন্য ভাঁড়ামিকে। ত্রিশ-চল্লিশের দশকে একদিকে মানুষ ভাগ্যবিড়ম্বিত বিপন্ন হয়েছে, অন্যদিকে মানুষ হৃদয়হীন ভাঁড় হয়েছে, আবার শকুনও হয়েছে, মানুষ শকুনের খাদ্যও হয়েছে। এমন অস্তিত্ব বিপন্নের ট্র্যাজেডি আর কারো কবিতায় নেই জীবনানন্দ ছাড়া।
অনেকে তাকে নির্জনতার কবি বলেছেন। এ নিয়ে বিতর্ক আছে। নির্জনতার কবি হন বা না হন, তিনি স্বল্পবাক ছিলেন, অনেক ক্ষেত্রে একাকী ছিলেন। কোলাহলমুখর, প্রচারপ্রবণ, যোদ্ধাবেশ তার ছিল না। তার মৃত্যু তার নির্জন বৈশিষ্ট্যকে ফুটিয়ে তোলে।
তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ঝরাপালক’-এ কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী সত্তার প্রভাব আছে। তিনিও নজরুলের মতো দেশবন্ধুকে চেতনার পক্ষে জীবনানন্দ দাশ ও চেতনাসঞ্চারী কবিতা লিখেছেন। নজরুল শেষদিকে ইসলামি গজল লিখেছেন, তাতে বেজে উঠেছে মরমি সুর। এ সুর জীবনানন্দের শেষদিককার কবিতাগুলোতে প্রভাব ফেলেছে।
নজরুলের মতো জীবনানন্দের কবিতা ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। তার ‘রূপসী বাংলা’ কাব্যটি অনেক মুক্তিযোদ্ধার হাতে হাতে ছিল। সেই যে অমর পঙ্ক্তি, ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর।’ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে সুর দিয়ে এ কবিতাটি গান হিসেবে গাওয়া হয়েছে। রূপসী বাংলার কবি হিসেবে তিনি আজ বাঙালির হৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত।
হেমন্ত ছিল জীবনানন্দ দাশের প্রিয়তম ঋতু। হেমন্তের এক রাতেই তিনি অনন্তের পথে পাড়ি দেন। জীবনানন্দপ্রেমীদের কাছে তাই ২২ অক্টোবর এক বিরহছোঁয়া দিন। এদিন তিনি তার সমস্ত শিল্পপ্রচেষ্টার কিছু শেষ করে, কিছু অসমাপ্ত আর বেশির ভাগই অপ্রকাশিত রেখে চোখ বুজেছেন।

এ কে এম রেজাউল করিম
লেখক ও গবেষক

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়