দুদক মামলা : আদালতে হাজিরা দিলেন আব্বাস দম্পতি

আগের সংবাদ

শিল্প খাতে বাড়ল গ্যাসের দাম > সবচেয়ে বেশি বাড়ছে ক্ষুদ্রশিল্পে, মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ বাড়বে : বিশেষজ্ঞদের অভিমত

পরের সংবাদ

বিশ্বতাপ এড়ানোর ফাঁকে বাংলাদেশ

প্রকাশিত: জানুয়ারি ১৮, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ১৮, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বিশ্ব রাজনীতি, কূটনীতি, অর্থনীতি সবই টালমাটাল। কেবল রুশ-মার্কিন নয়, ওই প্রান্তের উগান্ডা থেকে এই প্রান্তের বাংলাদেশ, কারোই এ চাপ-তাপ থেকে রেহাই নেই। স্নায়ুযুদ্ধের জেরে মার্কিন ডলারের ক্রমাগত শক্তি আঘাত করছে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে। বৈশ্বিক এ তোড়ের মাঝে দেশে দেশে স্থানিক যন্ত্রণাও ব্যাপক। এর পরিণামে শত্রæ-মিত্রের সংজ্ঞা পাল্টে যাচ্ছে। শত্রæই বন্ধু, বন্ধুই শত্রæ হয়ে যাচ্ছে। আবার কাউকে শত্রæ বা মিত্রের পাল্লায় না রেখে যার যার সুবিধামতো সবাইকে আয়ত্তে নেয়ার কৌশল চর্চাও করছে বিভিন্ন দেশ। এখানে ডান-বাম, গণতন্ত্র-সমাজতন্ত্র, উদার-কট্টর বাছ-বিচারের সুযোগ থাকছে না। তা করতে গিয়ে কেবল দুই নৌকায় নয়, ঘাটে ঘাটে নানান নৌকায় পা দিয়ে রাখার এক নতুন কূটনীতি ধাবমান পৃথিবীর সব মেরুতে।
জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক-আইএমএফসহ আন্তর্জাতিক-আঞ্চলিক প্রতিষ্ঠানগুলো বহু আগ থেকেই সতর্কবার্তা দিয়ে আসছে। মহামারি, যুদ্ধসহ নানা কারণে এ বছর বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ দেশ মন্দার কবলে পড়ার শঙ্কা জানিয়েছে অন্তত এক বছর আগেই। বাণিজ্য ঘাটতি, ক্রমবর্ধমান জ¦ালানি খরচ, ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকুচিত হওয়ার কারণে বাংলাদেশের সংকটের কথাও আছে তাদের বার্তায়। বিশ্বব্যাংকের আভাসও ছিল এমন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তা অগ্রাহ্য করেননি। তবে দাবি করেছেন কষ্ট পোহালেও বাংলাদেশে খাদ্য সংকট হবে না। বিশ্বমন্দার তাপ-চাপ যেন কম পড়ে সেজন্য সবাইকে সংযমী-সাশ্রয়ী হওয়ার পাশাপাশি নিজস্ব উৎপাদন বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন তিনি। বলেছেন, কোনো জমি অনাবাদি না রাখতে। অনাবাদি জমি খুঁজে বের করার নির্দেশ দিয়েছেন প্রশাসনকে। আর পদক্ষেপ হিসেবে রাষ্ট্রীয় তহবিল ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধির পাশাপাশি বর্ধিত মূল্যস্ফীতি মোকাবিলায় নেয়া হয়েছে আইএমএফের ঋণ। বৈশ্বিকের পাশাপাশি স্থানিক অর্থনৈতিক ধকল সামলাতে সরকারের আরেক পদক্ষেপ ঋণের সুদহার দশমিক ২৫ শতাংশ বাড়িয়ে সতর্কতামূলক মুদ্রানীতি ঘোষণা। আমানতের সুদহারের সর্বোচ্চ সীমা ৬ শতাংশ প্রত্যাহার। ভোক্তা ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার ৯ থেকে বাড়িয়ে ১২ শতাংশ নির্ধারণ। তবে শিল্প ঋণে বহাল থাকবে আগের সর্বোচ্চ সুদহারের সীমাই। নিত্যপণ্যের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধির জাঁতাকলের লাগাম টানার চেষ্টায় কোনো অন্ত করছে না সরকার। সাফল্য ধরা দিচ্ছে না সেই মাত্রায়। এ বিশ্ব পরিস্থিতির মাঝে বাংলাদেশের বাস্তবতায় কিছু ভিন্নতা। একদিকে সামনে নির্বাচন, আরেক দিকে ভূ-রাজনীতি। উপ-আঞ্চলিক রাজনীতিতে বাংলাদেশ একটি বড় ফ্যাক্টর। উচ্চতাও বেশ উপরে। শক্তিধর দেশগুলোর ঢাকায় অবস্থিত দূতাবাসের প্রচার-প্রচারণায়ও ঠাণ্ডা যুদ্ধের উত্তপ্ত আলামত।
বিশ্ব পরাশক্তির অন্যতম দেশ যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, যুক্তরাজ্য, কানাডা থেকে জাপান-জার্মান পর্যন্ত সবার কাছেই এখন ভিন্ন উচ্চতার ভ্যালু বাংলাদেশের। এর রসায়নেই এক্সিলেন্সিরা শুধু বাংলাদেশের কোনো ব্যাপার নিয়েই আসছেন-যাচ্ছেন, এমন নয়। তাদেরও এজেন্ডা আছে। ঝানু কূটনীতিকদের কাছে এ সংক্রান্ত তথ্য ও বিশ্লেষণের অনেক রসদ। সেই তাগিদে একজন বিদেশি মেহমান যেতে না যেতেই আরেকজন ছুটে আসছেন। কখনো কখনো একজন থাকতে থাকতেই চলে আরেকজন বা অন্য কোনো জন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের বিশেষ দূত-উপদেষ্টা রিয়ার এডমিরাল আইলিন লাউবাচার যেতে না যেতেই এলেন দেশটির হাই ভোল্টেজ কূটনীতিক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু। আবার লাউবাচারের ঢাকা অবস্থানকালেই চীনের নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী শিন গ্যাং আফ্রিকা যাওয়ার পথে ১ ঘণ্টার যাত্রাবিরতি দেন ঢাকায়। সফর দিয়েছেন আইএমএফের ডিএমডি অ্যান্তেইনও। এর মাঝেই জাতিসংঘ দূত ফেলিপ গঞ্জালেজ মোরালসের আগমনী বার্তা। তিনি আসছেন ২০ জানুয়ারি। থাকবেন কয়েক দিন। এই রাজ-অতিথিরা এখানে খুদ-কুঁড়া খেতে বা ডুব-সাঁতার কাটতে আসছেন না। বাংলাদেশকেও এখন অনেকের দরকার। একা চলা বা অন্যকে তাচ্ছিল্যের আদি দিন ফুরিয়ে গেছে শক্তিধর অনেক রাষ্ট্রেরই।
এর মূল সূচনাটা করে দিয়ে গেছে মহামারি করোনা। এরপর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এ যুদ্ধের ভালো-মন্দের শরিক কেবল দেশ দুটিই নয়। কেবল অংশীজনরাও নয়। দুনিয়ার সব প্রান্ত এর শিকার। যুদ্ধটি বিশ্বময় অর্থনীতির হিসাব-নিকাশেও স্নায়ুচাপ পাকিয়ে দিয়েছে। এর কারণে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সুদ হার বেড়ে যাওয়া ও চীনে নতুন করে করোনা ভাইরাসের বিস্তার বিশ্ব অর্থনীতিকে হুমকির মুখে ফেলেছে। করোনা ভাইরাস নতুন করে বিস্তার শুরু করলেও চীন সম্প্রতি তাদের ‘শূন্য কোভিড’ নীতি থেকে সরে এসেছে। তারা অর্থনীতিতে আবারো গতি সঞ্চার করতে চায়। ফলে চলতি বছর বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনীতির দেশ চীন এক কঠিন পরিস্থিতির মুখে পড়তে পারে। আগামী কয়েক মাস চীনের জন্য কঠিন সময়। ফলে চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। চীনের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়লে তাতে বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আবার যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি সংকুচিত হলে চীন, ভিয়েতনামসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে এর প্রভাব পড়বে। এর মাঝেও কিছু সেক্টর ও সুচকে বাংলাদেশ তুলনামূলক সুবিধাজনক অবস্থায় আছে। এর একটি পোশাকশিল্প। বৈশ্বিক পোশাকের বাজারে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের হিস্যা কমলেও শুধু বাংলাদেশের বেড়েছে। নানান টানাহেঁচড়ায়ও স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত মাথাপিছু মোট দেশজ উৎপাদন-জিডিপি বেড়েছে তিন গুণ। বৈষম্যও বেড়েছে।
বিদায়ী ২০২২ সাল যে ভালো যাবে না, সেই আভাস ছিল ২০২১ সালে। চলতি ২০২৩ নিয়ে সতর্ক বার্তা ২০২২ সালের শুরু থেকেই। ২০২২ সালে ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে শুরু হওয়া ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ এখন পর্যন্ত অর্থনীতির কোনো দুশ্চিন্তারই অবসান ঘটায়নি, বরং অনিশ্চয়তা আরো বাড়িয়েছে। কোভিড-১৯ দুর্বল হওয়ার কারণে বিশ্ব যখন পুনরুদ্ধারের পথে, তখনই যুদ্ধ ছিল অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে বড় আঘাত। তা কপালের ভাঁজের পরত বাড়িয়েছে। ২০২২ সালকে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের পালাবর্ষ ভাবা হলেও বাস্তবকে আরো কঠিন করেছে। এই অভিঘাত থেকে রক্ষার চেষ্টায় হাই রেসে দৌড়ানোর মাঠ ঠিক করা হচ্ছে। রাজস্ব বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছে। এর আওতায় শুল্ক বাড়ানোর কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। এতে উল্লেখযোগ্য অঙ্কে না হলেও কিছু বিলাসী পণ্যের আমদানি কমেছে। বেশ কিছু সাশ্রয় পদক্ষেপও নেয়া হয়েছে। প্রবাসী আয় বাড়ানোর চেষ্টায়ও কমতি হচ্ছে না। মূল্যস্ফীতি ও মুদ্রামান বেশি কাবু করেছে বাংলাদেশকে। স্বাধীনতার পর থেকে ১২ বছর পর্যন্ত বাংলাদেশের জন্য মধ্যবর্তী মুদ্রা ছিল ব্রিটিশ পাউন্ড। ১৯৮৩ সালে পাউন্ডের পরিবর্তে মার্কিন ডলারকে বেছে নেয়া হয়। আর ২০০৩ সালের মে মাস থেকে বাংলাদেশি মুদ্রার ভাসমান বিনিময় হার চালু করা হয়। এ সময় থেকেই চাহিদা ও জোগানের ভিত্তিতে মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারণ হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে ডলার বিক্রি ও তদারকির মাধ্যমে বিনিময় হার নিয়ন্ত্রণ করে এসেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
টাকার মান কমা মানেই অর্থনীতি দুর্বল হয়ে গেছে- এ রকম একটি মনস্তাত্ত্বিক ধারণা থেকেও টাকার মান কৃত্রিমভাবে ধরে রেখেছে বাংলাদেশ। ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু হলে রপ্তানি খাতে অবস্থান ধরে রাখতে চীন ব্যাপকভাবে তাদের মুদ্রার অবমূল্যায়ন করে। এতে প্রতিযোগী প্রায় সব দেশই নিজেদের মুদ্রার অবমূল্যায়ন করেছিল। কিন্তু বাংলাদেশ তখনো টাকার দর ধরে রেখেছিল। ধরে রাখা সেই বিনিময় হার নিয়েই বিপাকে পড়ে যায় বাংলাদেশ। বিশ্বব্যাপী ডলারের দর বেড়ে যাওয়ায় বেশি দরেই পণ্য আমদানি করতে হয়েছে বাংলাদেশকে। আবার বিনিময় হার কম থাকায় প্রবাসী আয়ও বৈধ পথে আসা কমে যায়। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংক বাধ্য হয়েই ডলারের দর বাড়াতে টাকার অবমূল্যায়ন করে।
করোনার প্রকোপের আগে চীন রপ্তানি সক্ষমতা ধরে রাখতে তাদের মুদ্রার বড় ধরনের অবমূল্যায়ন করেছিল। ২০১৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত চীন অবমূল্যায়ন করেছিল ৩৩ শতাংশ। চীনের সেই সিদ্ধান্তের কারণে প্রতিযোগী দেশগুলোও একই পথে হাঁটতে বাধ্য হয়েছিল। তখন তাকে বলা হয়েছিল মুদ্রাযুদ্ধ। ব্যতিক্রম ছিল বাংলাদেশ। তখনো কেন্দ্রীয় ব্যাংক টাকার মূল্যমান ধরে রাখে। এখন সেখানেও ভিন্ন ভাবনায় উৎরানোর পথে যাচ্ছে সরকার। বহুকাল অর্থনৈতিক গোলকায়নের শোরগোল দেখেছে বিশ্ব। সেই গোলকে এখন ভাঙচুরের চেষ্টা। এ অভিযাত্রায় খুব সতর্কতায় বাংলাদেশ। করোনার আগে বাংলাদেশের পরিচয় ছিল উচ্চ প্রবৃদ্ধির দেশ। আবার একই সঙ্গে বাংলাদেশ নিম্ন কর-জিডিপি অনুপাতের দেশ। বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত এখন ১০ দশমিক ০৯ শতাংশ। আর নেপালে এ অনুপাত ২৪ দশমিক ০২ শতাংশ এবং লাওসের ১৩ দশমিক ০৩ শতাংশ। কর-জিডিপি অনুপাতে পিছিয়ে আছে কেবল দেউলিয়া হয়ে যাওয়া শ্রীলঙ্কা, ৮ দশমিক ৯ শতাংশ। এই নিম্ন রাজস্ব আদায়ের কারণে কোভিডের সময় বাংলাদেশের দেয়া প্রণোদনা তহবিলের বড় অংশই ছিল মূলত ব্যাংক ঋণনির্ভর। আবার নিম্ন আয়ের কারণে জ¦ালানিসহ বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি দিয়েও কুলানো যাচ্ছে না। এ রকম পরিস্থিতিতে ভারসাম্য এবং সতর্কতা দুই পথেই এগোচ্ছে বাংলাদেশ।

মোস্তফা কামাল : সাংবাদিক ও কলাম লেখক; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়