আরো এক মামলায় রফিকুল মাদানীর বিচার শুরু

আগের সংবাদ

নাশকতার শঙ্কায় সতর্ক আ.লীগ : ষড়যন্ত্র ঠেকাতে নেতাকর্মীদের মাঠে থাকার নির্দেশ ক্ষমতাসীন দলের, ‘পাল্টা কর্মসূচি’তে অস্বস্তি বিএনপির

পরের সংবাদ

শিল্প খাতে বাড়ল গ্যাসের দাম > সবচেয়ে বেশি বাড়ছে ক্ষুদ্রশিল্পে, মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ বাড়বে : বিশেষজ্ঞদের অভিমত

প্রকাশিত: জানুয়ারি ১৯, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ১৯, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

কাগজ প্রতিবেদক : বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কয়েকদিনের মধ্যেই বিদ্যুৎ ও শিল্প খাতে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম ১৪ থেকে ১৭৯% পর্যন্ত বাড়িয়েছে সরকার। যা কার্যকর হচ্ছে ১ ফেব্রুয়ারি থেকে। তবে আবাসিক, সার ও চা উৎপাদনে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম বাড়ছে না। এ নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো গণশুনানি ছাড়াই (সদ্য মঞ্জুর করা নীতি) বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম সমন্বয় করল সরকার। গতকাল বুধবার এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে এই দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেয় বিদ্যুৎ, জ¦ালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম বর্তমানের ৫ টাকা ২ পয়সা থেকে বেড়ে ১৪ টাকা হবে। এর আগে ১২ জানুয়ারি সরকার খুচরা পর্যায়ে দাম ৫% বাড়িয়ে প্রতি কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুতের দাম ৭ দশমিক ৪৮ টাকা করার ঘোষণা দেয়। এদিকে গ্যাসের দাম বাড়ানো বাংলাদেশের ব্যবসা খাতে প্রতিযোগিতার ক্ষতি করতে পারে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। যদিও অনেকেই নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের জন্য আরো বেশি অর্থ দিতে ইচ্ছুক। অন্যরা বলছেন, চলমান গ্যাস সংকটের সমাধান না করে দাম বাড়ানো হলে শিল্প খাত টিকতে পারবে না। গ্যাসের দাম বাড়লে উৎপাদন খরচও বাড়বে, যা শিল্পের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমিয়ে দেবে। ব্যবসায়ী নেতারা বলেছেন, একদিকে গ্যাসনির্ভর শিল্পগুলোর ব্যয় বেড়ে যাবে, একইসঙ্গে বিদ্যুতের দাম বেড়ে গেলে পণ্যের উৎপাদন ব্যয়ও বেড়ে যাবে। এতে পণ্যমূল্য আরো বেড়ে যাবে। এতে সাধারণের দুর্ভোগ যেমন বাড়বে, তেমনি উদ্যোক্তারাও প্রতিযোগিতার সক্ষমতা হারাবেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি ব্যারিস্টার সামির সাত্তার ভোরের কাগজকে বলেন, গ্যাসের দাম সবচেয়ে বেশি বাড়ছে ক্ষুদ্র শিল্পে। তিনি বলেন, বড় ও মাঝারি খাতের উদ্যোক্তারা বেশিরভাগই রপ্তানিমুখী পণ্য উৎপাদন করে থাকে। এজন্য তাদের নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস-বিদ্যুতের প্রয়োজন হয়। সরকার দাম বাড়ালে তাদের পণ্যের খরচ বেড়ে যায়। তবে অন্যান্যভাবে তারা এ দাম সমন্বয় করতে পারে। কিন্তু ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা আভ্যন্তরীণ পণ্যের চাহিদা মেটায়। এ খাতের

উৎপাদন খরচ বেড়ে গেলে তা ভোক্তার কাঁধে পড়বে। ফলে মূল্যস্ফিতির উপর চাপ আরো বাড়বে। এ ব্যবসায়ী নেতা বলেন, বৈশ্বিক অস্থিরতার কারণে সরকার দাম বাড়াতে পারে। তবে আগামীতে এটা যেন সমন্বয় করা হয়, সে বিষয়ে সরকারকে নজর দিতে হবে।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স এন্ড এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশনের নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম জানান, তারা স¤প্রতি সরকারকে চিঠি দিয়ে বলেছেন- গ্যাস সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন হলে অতিরিক্ত অর্থ দিতে রাজি আছেন। তিনি বলেন, কিন্তু যদি বর্তমান পরিস্থিতির উন্নতি না হয়, তাহলে শিল্প টিকে থাকতে পারবে না।
এ দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়াকে সম্পূর্ণ অযৌক্তিক বলে মন্তব্য করেন কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান। ভোরের কাগজকে তিনি বলেন, আমরা দাম বাড়ানোর কোনো কারণ দেখছি না। দাম বাড়ানোর বিষয়ে সরকারের কাছে নির্বাহী ক্ষমতা আছে, সেটাই তারা ব্যবহার করছে। এ ধরনের কার্যক্রম জ¦ালানি খাতকে পঙ্গু করে দেবে। কোনো স্বচ্ছতা থাকবে না।
নতুন প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম বর্তমানের ৫ টাকা ২ পয়সা থেকে বেড়ে ১৪ টাকা হবে (১৭৯% বৃদ্ধি)। এছাড়া ক্যাপটিভ পাওয়ার প্লান্টের গ্যাসের দাম ১৬ টাকা থেকে বেড়ে ৩০ টাকা হবে (৮৮% বৃদ্ধি)। বৃহৎ শিল্পের ক্ষেত্রে এই দাম ১১ টাকা ৯৮ পয়সা থেকে বেড়ে ৩০ টাকা হচ্ছে (১৫০% বৃদ্ধি)। মাঝারি শিল্পে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের নতুন দাম ১১ টাকা ৭৮ পয়সা থেকে বেড়ে হবে ৩০ টাকা (১৫৫% বৃদ্ধি)। এছাড়া হোটেল-রেস্তোরাঁ এবং অন্যান্য বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের বেলায় গ্যাসের দাম হবে ৩০ টাকা ৫০ পয়সা, যেখানে এতদিন দাম ছিল ২৬ টাকা ৬৪ পয়সা (১৪% বৃদ্ধি)। তবে আবাসিক, সার ও চা উৎপাদনে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়নি।
গত কয়েক মাস থেকে গ্যাসের সংকট দেখা দেয় শিল্পকারখানাসহ বাসা-বাড়িতে। গ্যাস সংকটে শিল্পোৎপাদন ব্যহত হয়। এ নিয়ে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করে জ¦ালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ। উৎপাদনের খরচ বাড়লেও শিল্প বাঁচাতে প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম ২৫ টাকা পর্যন্ত দিতে রাজি হন ব্যবসায়ীরা। তবে তারা নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের নিশ্চয়তা চান। তারা বলেন, দাম বাড়িয়ে গ্যাস না দিলে শিল্প খাত ধ্বংস হয়ে যাবে। আর বিশ্ববাজারে দাম কমলে দেশেও সমন্বয় করতে হবে। সরকারি-বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য প্রতি ইউনিট গ্যাসের বর্তমান দাম ৫ টাকা ২ পয়সা। নতুন করে এই দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১৪ টাকা। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ বেড়ে যাবে।
শিল্পোদ্যোক্তা এনস্টার গ্রুপ ও নুসাইবা টেক্সটাইল লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী মো. নাজমুল ইসলাম বলেন, দাম বাড়ানোর আগে সরকারকে শতভাগ গ্যাসের সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। কারণ সরবরাহ নিশ্চিত হলে উৎপাদন ঠিক রাখা যাবে। দাম বাড়িয়ে যদি সরবরাহ বাড়ানো না হয় তাহলে বিশাল ক্ষতির মুখে পড়বে শিল্প খাত।
সিপিডির জ্যেষ্ঠ গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, গ্যাসের বাড়ানো সরকারের ভর্তুকি কমানোর কাজে লাগতে পারে; কিন্তু এর মাধ্যমে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহে ইতিবাচক অগ্রগতি হওয়ার সুযোগ কম। তিনি বলেন, গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানোর জন্য অনুসন্ধান ও ধারাবাহিকভাবে বিনিয়োগ দরকার, কিন্তু তা দেখা যায় না। গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য সরকারের হাতে গ্যাস উন্নয়ন তহবিল রয়েছে, সেটি যাতে অনুসন্ধানে ব্যবহার করা হয়। এগুলো না করে শুধু দাম বাড়ালে ভোক্তাকে বাড়তি ব্যয়ের চাপে ফেলা হবে।
গ্যাসের দাম বাড়ানোর ব্যাখ্যায় জ¦ালানি বিভাগ জানিয়েছে, বর্তমান বৈশ্বিক বিশেষ জ¦লানি পরিস্থিতিতে ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বব্যাপী সব ধরনের জ¦ালানির দামে অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। এছাড়া জ¦ালানি সংশ্লিষ্ট অন্যান্য ব্যয়, যেমন- বিমা খরচ, ঝুঁকি ব্যয়, ব্যাংক সুদ, মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকা দুর্বল হওয়ায় সামগ্রিকভাবে জ¦ালানি খাতে ব্যয় ব্যাপকভাবে বেড়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় বিশ্ববাজারে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) আমদানি ব্যয় অস্বাভাবিক পরিমাণে বেড়ে যাওয়ায় এ খাতে সরকারকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ভর্তুকি বাবদ দিতে হচ্ছিল। সে কারণে গত বছরের জুলাই থেকে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি বন্ধ রয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে বিদ্যমান উৎপাদন/সরবরাহ সক্ষমতা বিবেচনায় নিয়ে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিদ্যুৎ, ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ ও শিল্পসহ সব খাতে গ্যাস রেশনিং করা হচ্ছে। চলমান কৃষিসেচ মৌসুম, আসন্ন রমজান ও গ্রীষ্মে বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাসের বর্ধিত চাহিদা মেটানো, শিল্প খাতে উৎপাদন নিরবচ্ছিন্ন রাখা এবং রপ্তানিমুখী কলকারখানার নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় উৎপাদিত ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ উৎপাদন অব্যাহত রাখার উদ্দেশ্যে করণীয় সম্পর্কে সব অংশীজনের মতামত নেয়া হয়। ব্যাখ্যায় আরো বলা হয়, যেহেতু স্পট মার্কেট থেকে উচ্চমূল্যে এলএনজি আমদানি করে ওই বর্ধিত চাহিদা পূরণ করতে হবে, সেই কারণে সরকার বিদ্যুৎ, শিল্প, ক্যাপটিভ বিদ্যুতে ও বাণিজ্যিক খাতে ব্যবহৃত গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
সূত্রে জানা গেছে, শিল্প ও বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাসের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে হবে। আগামী মার্চ-এপ্রিলে গ্যাসের চাহিদা আরো বাড়বে। চাহিদা পূরণ করতে সরকারকে বাড়তি দাম দিয়ে স্পট মার্কেট (খোলাবাজার) থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করতে হবে। এতে বিপুল পরিমাণ টাকা লাগবে। ভর্তুকি কমাতে সেই টাকার একটা অংশ উঠানো হবে গ্যাসের দাম বাড়িয়ে।
এর আগে গ্যাসের সংকটের সময় শিল্পোদ্যোক্তারা বাড়তি দাম দিয়ে হলেও সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার পক্ষে মত দিয়েছিলেন। গত বছরের জুনেও সরবরাহ বাড়ানোর প্রতিশ্রæতি দিয়ে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়ে। কিন্তু বিশ্ববাজারে (বিশেষ করে স্পট মার্কেট) এলএনজির দাম বাড়ার কারণে জুলাই মাস থেকে আমদানি বন্ধ করে সরকার। এতে গ্যাসের চাপ কম থাকায় শিল্পের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। আবাসিক পর্যায়েও সারাদেশে গ্যাসের সংকট আছে।
জ¦ালানি বিভাগের সচিব মোহাম্মদ খায়রুজ্জামান মজুমদার বলেন, এখন স্পট মার্কেটে এলএনজির দাম কিছুটা নি¤œমুখী। এটা একটা ভালো খবর। মার্চ-এপ্রিলের দিকে যাতে গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানো যায়, সেই ভাবনা সামনে রেখে জ¦ালানি বিভাগ কাজ করছে। গ্যাসের দাম সমন্বয় নিয়েও সরকার ভাবছে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়