দুদক মামলা : আদালতে হাজিরা দিলেন আব্বাস দম্পতি

আগের সংবাদ

শিল্প খাতে বাড়ল গ্যাসের দাম > সবচেয়ে বেশি বাড়ছে ক্ষুদ্রশিল্পে, মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ বাড়বে : বিশেষজ্ঞদের অভিমত

পরের সংবাদ

দেশের ইতিহাস আওয়ামী মুক্তকরণে বিএনপির মেরামত তত্ত্বের পূর্বাভাস

প্রকাশিত: জানুয়ারি ১৮, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ১৮, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

সম্প্রতি বিএনপি, জামায়াত সরকারবিরোধী আন্দোলনরত ৫০-এর অধিক নামসর্বস্ব দল ১০, ১৪ ও ২৭ দফা ঘোষণা করেছিল। এসব দফাকে তারা ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র মেরামতের কর্মসূচি হিসেবে অভিহিত করেছে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটিয়ে বিএনপির নেতৃত্বাধীন এসব দল ও জোট বাংলাদেশে রাষ্ট্রের সংবিধান পরিবর্তন ঘটিয়ে রাষ্ট্র মেরামত করবে বলে প্রতিশ্রæতি দিচ্ছে। এসব দল এবং জোট যাদের নিয়ে গঠিত হয়েছে তাদের রাজনৈতিক অতীত ও বর্তমান অনেকেরই জানা নেই। এটি যে ‘একটি পথ কুড়িয়ে পাওয়া’ জোট তা এরই মধ্যে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে জানা গেছে। এই জোটের মূল এবং প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল বিএনপি এবং জামায়াত। যদিও জামায়াত কৌশলগত কারণে কোনো জোটে নেই বলে দাবি করা হচ্ছে। তবে ১০ দফা ঘোষণার মাধ্যমে তাদেরও ছায়ার মতো জোটেই অবস্থান স্পষ্ট হয়ে গেছে। তাছাড়া জামায়াতের অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা বিক্ষিপ্ত-বিচ্ছিন্নভাবে মিছিল করার চেষ্টা করছে, বিএনপি ও জোটভুক্ত বিভিন্ন নামসর্বস্ব দলের পরিচয় লুকিয়ে যুগপৎ কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছে। সে কারণে ১০ দফা এবং ২৭ দফাভিত্তিক এই আন্দোলন মূলতই বিএনপি ও জামায়াতের- সে সম্পর্কে রাজনীতি সচেতন কোনো মহলের সন্দেহ নেই। যদিও ৭ দলীয় জোটের গণতন্ত্র মঞ্চের কারো কারো অতীত বাম রাজনীতি ছিল। কিন্তু তারা এখন ১০ এবং ২৭ দফার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত দাবির নানা বিষয় নিয়ে ১৪ দফা যুগপৎভাবে তাদের আন্দোলনের কর্মসূচি হিসেবে প্রদান করছে। ১০, ১৪ ও ২৭ দফার বিষয়গুলো নিয়ে বিএনপি বিভিন্ন সভা-সমাবেশ এবং টিভি টকশোগুলোতে বেশ জোরেশোরে বলার চেষ্টা করছে যে ভবিষ্যতে রাষ্ট্রক্ষমতায় গেলে তারা গণতন্ত্রের বন্দোবস্তসহ বাংলাদেশকে এমন একটি শাসন, প্রশাসন এবং শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রদান করবে যা ইউটোপিয়াকেও হার মানাতে পারে বলে রাজনীতি সচেতন মানুষের কাছে মনে হতে পারে। অবশ্য বিএনপি-জামায়াত অতীতে ১৫ বছরের বেশি ক্ষমতায় ছিল, তখনকার তাদের ভূমিকা ছিল মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের সব ভিত্তিপ্রস্তর, অবকাঠামো এবং আদর্শকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেয়া, বাংলাদেশকে একটি জঙ্গি রাষ্ট্রে পরিণত করা- যে কারণে যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া ব্যর্থ রাষ্ট্রের নামের তালিকায় বাংলাদেশ অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। এখন সেই বিএনপি, জামায়াত আর কতগুলো নাম-ঠিকানাবিহীন, আদর্শহীন এমনকি রাস্তা থেকে কুড়িয়ে আনা ব্যক্তিদের নিয়ে রাষ্ট্র মেরামত করার এক আজগুবি তত্ত্ব মানুষের সম্মুখে হাজির করেছে।
ছদ্মাবরণে ডানপন্থি ও সুবিধাবাদীরা এবং রাস্তায় নিক্ষিপ্ত অতীত বাম নামধারী উগ্র কিছু ব্যক্তি ও গোষ্ঠী মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য এ ধরনের তাক লাগানো কথাবার্তা, কর্মসূচি ও স্বপ্নের কথা শোনানোর অভিজ্ঞতা দুনিয়াজুড়েই রয়েছে। বাংলাদেশে এর অভিজ্ঞতা অতীতেও দেখা গেছে। তবে এবারের মতো এত সংঘবদ্ধভাবে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে ঘটতে দেখা যায়নি। বোঝা যাচ্ছে এর নেপথ্যে অনেক ব্যক্তি, গোষ্ঠী এবং অপশক্তি রয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেশে ও দেশের বাইরে থেকে অনেকেই এতে যুক্ত থাকার আভাস-ইঙ্গিতও পাওয়া যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক কোনো কোনো মহল এসব শক্তিকে নানাভাবে ব্যবহার করতেও পারে। বাংলাদেশে অনেক রাষ্ট্রের নানা ধরনের স্বার্থ রয়েছে। সেসব স্বার্থ উদ্ধারে যারা সহায়তা করতে এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছে তারা সেই শক্তির নানা ধরনের বলে ও সমর্থনে দেশে ‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের’ নামে আন্দোলন করতে পারে। ২০০১ সালে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে বন্দোবস্তের একটি দফারফা হয়েছে বলে সবাই জানে, সেই নির্বাচন এবং নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে দেশে কী হয়েছিল তাও নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু বাংলাদেশকে জঙ্গিবাদী ধারায় একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার কাজটি তখনকার ক্ষমতাসীন জোটের শক্তিগুলো ভালোভাবেই করে দিয়েছিল। ১৯৯৯ সালের ৩০ নভেম্বর ঘোষিত চারদলীয় জোটের ঘোষণাপত্রেও বলা হয়েছিল যে আওয়ামী লীগ সরকার দেশকে ধ্বংস করে দিয়েছে, জোট ক্ষমতায় গেলে দেশ উন্নতি ও গণতন্ত্র পাবে। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর দেশ জোটের শাসনামলে সেইসবের কী পেয়েছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এখন তখনকার জোটভুক্ত প্রধান দুটি দল বিএনপি এবং জামায়াত এবং নতুন করে কুড়িয়ে নেয়া ৩-৪টি নামসর্বস্ব জোটের ৫০-এর অধিক দল ১০, ১৪ ও ২৭ দফা নামে রাষ্ট্র মেরামতের যেসব প্রতিশ্রæতি দিচ্ছে তা একই গোষ্ঠীর ‘নতুন বোতলে পুরনো মদ’ ছাড়া ভিন্ন কিছু হওয়ার সম্ভাবনা নেই। বরং প্রধান শক্তি বিএনপি ‘নতুন মিশন-ভিশন’ নিয়ে নামতে যাচ্ছে- সেটির পূর্বাভাস তারা এখনই দেয়া শুরু করেছে।
১০ এবং ২৭ দফাকে জনসম্মুখে ব্যাপকভাবে প্রচার দেয়ার জন্য বিএনপি এবং এর নানা ধরনের সংস্থা নানা নামে আলোচনা সভার আয়োজন শুরু করেছে। দেশে ৩০টিরও বেশি বেসরকারি টিভি চ্যানেল, অসংখ্য নিউজ পোর্টাল এবং প্রিন্ট মিডিয়া রয়েছে। এগুলোতে তাদের বক্তব্য যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করা হয়। সুতরাং ‘দেশে গণতন্ত্র নেই’ বলে যতই অভিযোগ কিংবা চেঁচামেচি করা হোক না কেন, এতসব মিডিয়ায় তাদের একটি ছোট পরিসরে অনুষ্ঠিত আলোচনার কথাও প্রকাশিত বা প্রচারিত হতে কখনো বাধা দেখি না। আলোচিত ১০ দফা নিয়ে তেমনই একটি আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়ে গেল গত ১৩ জানুয়ারি ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে, যেটি আয়োজন করেছিল অ্যাগ্রিকালচারিস্টস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ নামে বিএনপির একটি পেশাজীবী সংগঠন। সেখানে আলোচক হিসেবে ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় এবং ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু। তারা দুজনেই তাদের এবং দলের লালিত বিশ্বাসের কথা ছুড়ে দিলেন। গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বললেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা ‘বাই চান্স’ বা ‘ভাগ্যক্রমে’ হয়েছে। তাই দেশের সংবিধানও অপরিকল্পিত। তিনি পাকিস্তানের জায়গায় বাংলাদেশ, কায়েদে আজমের জায়গায় শেখ মুজিবের নাম সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে মর্মেও অভিমত প্রকাশ করেন। তাই তারা ক্ষমতায় গেলে এই সংবিধান পরিবর্তন করতে উদ্যোগ নেবেন। অপর আলোচক ব্যবসায়ী আবদুল আউয়াল মিন্টু তাচ্ছিল্য করে বলেছিলেন, ‘কী দরকার পুরনো একটা জিনিস বারবার টোপ দেয়া। এটাকে ছাড়েন। আপনারা নতুন সংবিধান তৈরি করেন…। আপনারা ঘোষণা দেন ক্ষমতায় গেলে নতুন সংবিধান প্রণয়ন করবেন।’ তিনি আরো বলেছেন, দেশ স্বাধীনের পর যে সংবিধান প্রণীত হয়, আওয়ামী লীগ তা ‘একদলীয় শাসন কায়েমের জন্য’ করেছিল… যারা সংবিধান প্রণয়ন করেছেন, তারা কিন্তু সংবিধান প্রণয়নের উপযুক্ত লোকও ছিলেন না দু-একজন ছাড়া। উনাদেরকে কেউ ভোট দিয়ে এই কনস্টিটিউশন বানানোর জন্য অথরিটিও দেয় নাই। তার এই বক্তব্যের সঙ্গে সঙ্গতি প্রকাশ করে উপস্থিত শ্রোতারা হাততালি দিচ্ছিলেন। এর মানে দাঁড়ায় তারাও আবদুল আউয়াল মিন্টুর মতোই সংবিধান ছুড়ে ফেলে দিতে চান! আলোচনা সভায় দুজনেই যেন দুটি বোমা ফাটিয়েছেন। বাংলাদেশের ভিত্তিমূলেই তাদের যে কোনো আস্থা নেই সেটি তারা প্রকাশ করেছেন। গয়েশ্বর চন্দ্র রায় মুক্তিযুদ্ধকে আকস্মিকভাবে পাওয়া বিষয় হিসেবে দেখেন। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ইতিহাস, আন্দোলন সংগ্রাম তার কতটা জানা আছে সেই প্রশ্ন করে লাভ কি? তার জানা থাকলেও এখন তিনি সেটি স্বীকার করেন না, মানেনও না। আবদুল আউয়াল মিন্টু একসময় তো আওয়ামী লীগই করতেন। কীভাবে সংবিধান কারা তৈরি করেছেন সেটি তিনি ভালো করেই জানেন। কিন্তু এখন বিএনপি করেন, জানপ্রাণ দিয়ে করেন। তাই বিএনপি যা ভাবে তিনিও তাই বলেন। ১৯৭২-এর সংবিধান যারা রচনা করেছিলেন তাদের যোগ্যতা মাপার যোগ্যতা আবদুল আউয়াল মিন্টুর আছে কিনা সেটাই তো এখন তিনি প্রশ্নের মুখে তুলে দিলেন। রাষ্ট্র, সংবিধান, রাজনীতির জ্ঞানতত্ত্ব সম্পর্কে তার জ্ঞান যদি কিছু থাকত তাহলে তার ন্যূনতম প্রকাশ হলেও তার বক্তব্যে ঘটত। কিন্তু তার বক্তব্য অসীম দাম্ভিক অর্থবিত্তশালী জমিদারের মতোই সবকিছুই তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয়া মানসিকতার প্রকাশ ঘটিয়েছে। তাদের দুজনের বক্তব্য নিয়ে দেশে অনেক প্রতিবাদ হচ্ছে। কিন্তু দল এখানে নীরব। এর মানে হচ্ছে বিএনপি তাদের দুই নেতার বক্তব্যকে অনুমোদন করে।
বিএনপি প্রতিষ্ঠার পর থেকে রাজনীতিতে কোন আদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে চায় তা নতুন করে বলার কিছু নেই। মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, বাংলাদেশের সংবিধান ইত্যাদি নিয়ে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান মুখে তেমন কিছু না বললেও ’৭২-এর সংবিধান কাটাছেঁড়া, অবৈধভাবে নিজে ক্ষমতা দখল, ইনডেমনিটি অধ্যাদেশকে সংবিধানের ৫ম সংশোধনীতে সংযোজন, ‘রাজনীতিকে রাজনীতিবিদদের জন্য জটিল করে দেবো’ উক্তির মধ্যেই প্রমাণ পাওয়া যায় যে তিনি বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের বিরুদ্ধে পরিচালিত হওয়ার একটি রাজনৈতিক শক্তির উত্থানকে ভবিষ্যতের জন্য নিশ্চিত করে গেছেন। বিএনপিতে তিনি জায়গা করে দিয়েছিলেন স্বাধীনতাবিরোধী উগ্র ডান, বাম এবং সুবিধাবাদী গোষ্ঠীকে। একই সঙ্গে তিনি চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনৈতিক শক্তিকে। অবশ্য ১৯৮১ সালে তিনি সামরিক অভ্যুত্থানেই নিহত হন। তার মৃত্যুর পর বিএনপি কিছুদিন সংকটে ছিল। কিন্তু ১৯৯১ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জামায়াতের ভোট এবং নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর বিএনপি বাংলাদেশের রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িক ধারাকে নেতৃত্ব দেয়ার পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হয়। তখন থেকে বিএনপির নেতৃত্ব মুক্তিযুদ্ধে জিয়াউর রহমানের ভূমিকাকে গুরুত্ব দেয়ার জন্য ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাটস্থ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত তার একটি ঘোষণাকে স্বাধীনতার ঘোষণা এবং তাকে স্বাধীনতার ঘোষক বলে প্রচার করতে থাকে। এর মাধ্যমে বিএনপি চেয়েছিল মুক্তিযুদ্ধে দলীয়ভাবে আওয়ামী লীগের ভূমিকার মতো জিয়াউর রহমানের জন্য একটি আলাদা গুরুত্বপূর্ণ স্থান নির্ধারণ করতে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে রাজনৈতিকভাবে দুই দলের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেয়ার একটি ‘বন্দোবস্ত’ তারা চেয়েছিল। কিন্তু ২০০১ সালে চারদলীয় জোট নির্বাচিত হওয়ার পর বিএনপি, জামায়াত এবং সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর অবস্থান আরো বদলে যায়। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস থেকে বঙ্গবন্ধু এবং আওয়ামী লীগের নাম সম্পূর্ণরূপে তুলে দেয়া হয়। গোটা শিক্ষাব্যবস্থায় মুক্তিযুদ্ধের বিকৃত নগ্ন ইতিহাস সংযোজন করা হয়। ২৬ মার্চ জিয়াউর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেন, শেখ মুজিব আত্মসমর্পণ করেন, আওয়ামী লীগ ভারতে পালিয়ে যায়- পাঠ্যপুস্তকে এমনই একটি বিকৃত ইতিহাস তুলে ধরা হয়। রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগ এবং অসাম্প্রদায়িক শক্তিকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার চেষ্টা করা হয়। ২১ আগস্টসহ সব হত্যাকাণ্ডের পেছনেই ছিল বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে মুক্তিযুদ্ধ এবং আওয়ামী লীগের নাম মুছে ফেলা। ২০০৯ সালের পর লন্ডনে বসে তারেক রহমান মুক্তিযুদ্ধের নতুন ইতিহাস রচনা করার উদ্যোগ নেন। তাতে তিনি বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের রাজাকার, জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক, প্রথম প্রেসিডেন্ট এবং জাতির পিতা হিসেবে আখ্যায়িত করেন। আওয়ামী লীগকে স্বাধীনতাবিরোধী এবং বিশ্বাসঘাতকের দল হিসেবে অভিহিত করেন। বিএনপির নেতা, কর্মী-সমর্থক, শুভানুধ্যায়ী সবাই কমবেশি বিএনপির এই চিন্তাধারার সঙ্গে একমত। আওয়ামী লীগের বিরোধিতায় তারা মোটেও দ্বিধাগ্রস্ত নয়। মুক্তিযুদ্ধ এবং আওয়ামী লীগের শাসনামল সম্পর্কে তাদের অবস্থান এতটাই কট্টর এবং আপসহীন। স্বয়ং বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা নিয়ে যেমন প্রশ্ন তুলেছেন, একইভাবে মুক্তিযুদ্ধকালে আওয়ামী লীগের ভূমিকা নিয়েও নানা ধরনের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছেন।
বিএনপির বর্তমান নেতৃত্ব দাবি করছে যে আওয়ামী লীগই মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার চেতনার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছে ও করছে। সুতরাং বিএনপি কোনো অবস্থাতেই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে পরিচালিত রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন এবং স্বাধীনতা-পরবর্তী সাড়ে ৩ বছরের যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ে তোলার শাসনকে গ্রহণ করতে রাজি না। তাদের যে কোনো নেতাকর্মী এবং সমর্থকের বক্তৃতা, বিবৃতি, বক্তব্য ও আলাপচারিতায় আওয়ামী লীগের বিরোধিতার সঙ্গে ইতিহাসকেও অস্বীকার এবং ছুড়ে ফেলার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। জামায়াত স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে কিন্তু স্বাধীনতা সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করছে না। বিএনপি জামায়াতের মনের ইচ্ছার ষোলকলাই পূর্ণ করছে, অন্যান্য সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীও তাই করছে। সুতরাং গয়েশ্বর রায় এবং আবদুল আউয়াল মিন্টু যা বলেছেন তা কোনো মুখ ফসকে যাওয়া কথা নয়, এটি বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১০, ১৪ ও ২৭ দফাধারী সব রাজনৈতিক শক্তিরই পরিকল্পনা, যা তারা ক্ষমতায় গেলে বাস্তবায়ন করতে এক সেকেন্ডও দেরি করবে না। সংবিধান ছুড়ে ফেলে দেবে, মুক্তিযুদ্ধের নাম ভুলিয়ে দেয়া হবে। বাংলাদেশ এমন এক মেরামত রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হবে, যা ইতিহাসের কোনো পাঠেই খুঁজে পাওয়া যাবে না।

মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী : অধ্যাপক (অবসরপ্রাপ্ত), ইতিহাসবিদ ও কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়