নিউমার্কেটে সংঘর্ষ : তিন মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল পেছাল

আগের সংবাদ

নামমাত্র প্রস্তুতিতে পাঠদান : বই পায়নি অনেক শিক্ষার্থী > বই, সহায়িকা ছাড়াই শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ > নোট-গাইড ছাপার তোড়জোড়

পরের সংবাদ

ঊনসত্তরের অভ্যুত্থানের কড়চা

প্রকাশিত: জানুয়ারি ১৭, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ১৭, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

ঊনসত্তরের অভ্যুত্থানের প্রস্তুতি পর্বে একটি নির্ধারক দিন ছিল ১৭ জানুয়ারি। ওই দিন ডাক পুরো পাকিস্তানব্যাপী দাবি দিবস পালনের কর্মসূচি দিয়েছিল। ছিল হরতালের আহ্বান। এদিকে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদও নিজস্ব কর্মসূচি নিয়েছিল। সরকার ১৪৪ ধারা বলবৎ রাখে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাতে জমায়েত হয়ে ছাত্ররা ঠিক করে তারা ১৪৪ ধারা ভাঙবে। রুশপন্থিরা তখন যুক্ত হয়েছেন ডাকের সঙ্গে এবং ডাক ১৪৪ ধারা ভাঙার পক্ষে নয়। দিনটি ছিল শুক্রবার; ডাক নেতারা ঠিক করেছিলেন তারা বায়তুল মোকাররম মসজিদে জমায়েত হবেন এবং নামাজের পর চারজন করে বের হয়ে মিছিল নিয়ে বার লাইব্রেরি হলে গিয়ে সমাবেশে মিলিত হবেন।
বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরের বিশাল সমাবেশ থেকে ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভেঙে মিছিল করে বের করতে চাইলে পুলিশ জলকামান, কাঁদানে গ্যাস ইত্যাদি ব্যবহার করে। ছাত্রদের ছত্রভঙ্গ করার জন্য রোকেয়া হলে আশ্রয় গ্রহণকারী ছাত্রীদের ওপরও আক্রমণ চালায়। এরপর ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আন্দোলন অপ্রতিরোধ্য হয়ে পড়ে। পার্টির নির্দেশে রুশপন্থি ছাত্র ইউনিয়ন ১৪৪ ধারা ভাঙার বিপক্ষে অবস্থান নেয়, তারা ‘জোরালো’ বক্তব্য দেয়, কিন্তু ছাত্ররা তাদের পরামর্শ শোনেনি। ফলে তাদের যে ‘বিব্রতকর’ অবস্থায় পড়তে হয়, এ সত্য তারা নিজেরাই স্বীকার করেছেন। এভাবে ডাকের সঙ্গে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের যে বিচ্ছেদ ওই দিন ঘটে, তা স্থায়ী হয়ে যায়। স্মরণীয় যে সমান্তরাল ঘটনা ঘটেছিল ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে, যেদিন কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নির্দেশ অমান্য করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা মিছিল বের করে এবং পুলিশের গুলিবর্ষণের দরুন রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন এক উচ্চতর স্তরে উন্নতি হয়ে যায়। ১৭ তারিখের ঘটনায় আসলে সরকারবিরোধী আন্দোলন দুটি ভিন্ন ধারায় চলে গেল। ডাকের ধারাটি আপসপন্থি; অন্যধারাটি আপসবিরোধী। এরপর থেকে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ প্রতিদিন সমাবেশ ও মিছিল করে। ২০ জানুয়ারির মিছিল ছিল দীর্ঘ ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। পুলিশ গুলি ছোড়ে এবং আসাদ শহীদ হন। আসাদ ছিলেন আইনের ছাত্র এবং চীনপন্থি ছাত্র ইউনিয়নের নেতা ও ভাসানী ন্যাপের সদস্য। ভাসানীর আহ্বানে তিনি তার নিজের এলাকা, নরসিংদীর হাতিরদিয়াতে একটি সফল হাট হরতাল সংঘটিত করেছিলেন। হরতালের সময় পুলিশের গুলিতে তিনজন নিহত হন।
১৯৬৯-এর শহীদ আসাদ যেন ১৯৫২-এর শহীদ বরকতেরই উত্তরসূরি এবং উত্তরসূরি হওয়ার কারণে অধিক রাজনীতি-সচেতন ও সংগঠনমনস্ক। বরকতের শাহাদাতবরণের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন যেভাবে একটি নতুন মাত্রা পেয়ে যায়, ঠিক সে রকমেরই ঘটনা ঘটেছিল আসাদের শাহাদাতবরণের মধ্য দিয়ে, ঊনসত্তরের অভ্যুত্থানের ক্ষেত্রে। আসাদ যে মিছিলে ছিলেন আসাদকে হারানোর পরে সেখান থেকে স্বতঃস্ফূর্ত আওয়াজ উঠেছিল; ‘আসাদের মন্ত্র জনগণতন্ত্র’। এরপর প্রতিদিন মিছিল হয়েছে। নতুন সংযোজন হিসেবে এসেছে মশাল মিছিল। দিনের বেলাতেও মশাল মিছিল বের হয়েছে। আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল সমগ্র পূর্ববঙ্গব্যাপী।
ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ২৪ জানুয়ারি হরতাল ডাকে। সেই হরতালে যা ঘটেছিল তা অভাবিতপূর্ব এবং অবিশ্বাস্য। অফিস আদালত দোকানপাট বন্ধ থাকে। হাজার হাজার মানুষ নেমে আসে রাজপথে। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ছিল মেহনতি মানুষের অংশগ্রহণ। সরকার ইপিআরের হাতে শহরের নিয়ন্ত্রণ ভার ছেড়ে দেয়, কিন্তু ইপিআর পিছু হটতে বাধ্য হয়; রাজধানী চলে যায় জনতার দখলে। পুলিশের গুলিতে নিহত হয় তিন কিশোর, মতিউর, রুস্তম ও মকবুল। জনতা সরকারি পত্রিকা দৈনিক পাকিস্তান ও মর্নিং নিউজ অফিসে আগুন ধরিয়ে দেয়; আগুন লাগায় সরকার-সমর্থক পয়গাম পত্রিকার অফিসেও। নবাবপুরের এক হোটেলে থাকতো আগরতলা মামলার একজন রাজসাক্ষী; ওই হোটেলেও অগ্নিসংযোগ করা হয়। জনতা প্রস্তুত ছিল ক্যান্টনমেন্টের দিকে যেতে। অভূতপূর্ব এই বিপ্লবী পরিস্থিতি দেখে কেউ কেউ আবার বিচলিতও হয়ে পড়ে। রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছিল অনুপস্থিত। ‘ডাক’ হয়ে পড়েছিল সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক। ১৭ জানুয়ারিতে ডাক নেতারা বার লাইব্রেরি হলে কোনো মতে একটি সভা করেন এবং ঘোষণা দেন যে আগামী দুই মাসের মধ্যে নতুন কর্মসূচি জানানো হবে; কিন্তু সে ঘোষণায় কোনো চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়নি। এর বিপরীতে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ওপর দায়িত্ব এসে পড়ে আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয়ার। পরবর্তী কর্মসূচি কি হবে ঠিক করা তাদের পক্ষে অত্যন্ত কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এক পর্যায়ে তারা ঠিক করে যে পল্টনে জনসভা করাটা ঠিক হবে না। কর্মসূচি পালন করা আর সম্ভব হয়নি। সরকার সেনাবাহিনীকে তলব করে। রাত ৮টা থেকে পরের দিন রাত ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টার কারফিউ জারি করে। দেখামাত্র গুলি করার জন্য সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দেয়া হয়। নতুন কর্মসূচি দিলে জনতা অবশ্য কারফিউ মানত না, বেরিয়ে পড়ত, পরিস্থিতি ছিল এমনই বিস্ফোরণমুখী। কিন্তু সেই রকমের কর্মসূচি দেয়ার মতো সংগঠন ও নেতৃত্ব উপস্থিত ছিল না। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ চাচ্ছিল সাময়িকভাবে হলেও আন্দোলনকে নিয়ন্ত্রণ রাখতে। সংগ্রাম পরিষদ তাই এক বিবৃতির মাধ্যমে ২৪ জানুয়ারিতে ঘটনাকে ‘গণঅভ্যুত্থান’ হিসেবে ঘোষণা করে এবং ২৬, ২৭ ও ২৮- এই তিন দিন শোক দিবস পালনের আহ্বান জানায়।
তা রুশপন্থিরা কেন জাতীয় মুক্তির সংগ্রামে নেতৃত্ব দেয়ার ব্যাপারে পিছিয়ে গেলেন? কেবল পিছিয়ে গেলেন না, পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদীদের পাকিস্তানকে টিকিয়ে রাখার ব্যাপারে পরোক্ষে সাহায্যই করলেন? পাকিস্তানকে এক রাখার দায়ভার তো পাঞ্জাবি শাসকদের; বাংলার কমিউনিস্টরা কেন তাদের সঙ্গে হাত মিলাতে যাবেন? কেন তারা ডাক-এ যোগ দেবেন? কেন বলবেন যে, আইয়ুবের গোলটেবিল বৈঠক ডাকা গণআন্দোলনের এক তাৎপর্যপূর্ণ বিজয়? কেন তারা মওলানা ভাসানীর ওপর ক্ষিপ্ত হবেন; তিনি গোলটেবিল বর্জনের আওয়াজ তুলেছিলেন বলে? কেনই বা বলবেন গোলটেবিলে অর্জন যাতে নস্যাৎ না হয়, সে জন্য সতর্ক থাকা চাই? (আসলে তো কোনো অর্জনই ঘটেনি; আইয়ুব খান নিজের নিরাপদ প্রস্থানের জন্য পথ পেয়ে গেছেন মাত্র।) আবার কেনই বা তারা অংশ নেবেন সত্তরের নির্বাচনে, রাষ্ট্রশাসকদের দিক থেকে যে নির্বাচনের উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানকে টিকিয়ে রাখার জন্য শেষ চেষ্টা করা? কারণটা কি তাত্ত্বিক বিভ্রান্তি? সেটা তো হওয়ার কথা নয়, কারণ কমিউনিস্ট সাহিত্যে ও কর্মসূচিতে কোথাও বলা হয়নি যে কমিউনিস্টরা দেশপ্রেমে বিশ্বাস করেন না, বরঞ্চ কমিউনিস্টরাই তো হচ্ছে খাঁটি দেশপ্রেমিক; তারাই তো দেশের সব শ্রেণির মানুষকে সাম্রাজ্যবাদী-পুঁজিবাদী শোষণ থেকে মুক্ত করতে চান, অবসান ঘটাতে চান বুর্জোয়াদের একনায়কত্বের। না, আসল কারণ তাত্ত্বিক বিভ্রান্তি নয়। আসল কারণ সামাজিক বিপ্লবের দায়িত্ব নিতে সংকোচ। ভয়ও বলা চলে। দল ক্ষুদ্র, গণসংযোগ নেই- দুটিই সত্য। কিন্তু ওই দুর্বলতা কেটে যেত মেহনতিদের কাছে গেলে। পার্টির শক্তি পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটিতে থাকে না, থাকে জনসমর্থনে। এবং জনগণের কাছে যেতে হয় সঠিক রাজনীতি নিয়ে। সঠিক রাজনীতির অর্থ জনমুক্তির তথা সামাজিক বিপ্লবের রাজনীতি। ওই যাওয়াটাই হয়নি। ভয় ছিল যেতে চাইলে নিপীড়ন বাড়বে। ১৯৬৯-এর জুন মাসে মস্কোতে ৭৫টি দেশের কমিউনিস্ট ও ওয়ার্কার্স পার্টির নেতাদের এক সম্মেলন হয়, তাতে গোপনে যোগ দিয়েছিলেন বারীন দত্ত ও খোকা রায়; মতামত বিনিময়ের সময় অন্য দেশের কমিউনিস্ট নেতারা তাদের বলেন, ‘পূর্ববঙ্গের পার্টি যে রকম দুর্বল তাতে যদি স্বাধীন পূর্ব বাংলাকে লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করেন তাহলে পাকিস্তানি শাসকদের শ্বেত সন্ত্রাসের সামনে’ তারা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবেন। পূর্ববঙ্গের নেতারাও মনে হয় ওই রকমের পরামর্শই শুনতে চাইছিলেন।
‘উগ্রপন্থা’ গ্রহণের ব্যাপারে পাকিস্তানি শাসকদের সন্ত্রাসের শঙ্কা তো ছিলই, ছিল এই অতিরিক্ত অনুভূতিই যে উগ্রপন্থার দিকে গেলে পার্টিকে সমর্থনদানকারী বুর্জোয়ারাও ভয় পেয়ে যাবেন এবং সমর্থন গুটিয়ে নেবেন। তাই চেষ্টা ছিল বুর্জোয়াদের সঙ্গে থেকে গণতান্ত্রিক, অর্থাৎ সংস্কারমূলক, রাজনীতি করা; পারলে জোট গঠন করা, নির্বাচন এলে তাতে শামিল হওয়া। ১৯৬৪-তেও ফজলুল হক সাহেবের কাছে না গিয়ে এবং কৃষক প্রজা পার্টি ও তাদের আশ্রয়ে অবস্থিত নেজামে ইসলামকে বাদ দিয়ে, যদি আওয়ামী লীগকেই প্রধান করে একটি বাম-গণতান্ত্রিক জোট গঠন করা যেত, তাহলে পূর্ববঙ্গের রাজনৈতিক ইতিহাস হয়তো ভিন্ন পথে এগোত। আবার ১৯৬৯-তেও যুক্তফ্রন্ট গঠিত হতে পারত বামপন্থিদের নিয়ে, সেটা না করে রুশপন্থিরা আগবাড়িয়ে যুক্ত হয়েছেন ডাকের সঙ্গে, যে জোটের নেতৃত্বে ছিল ভয়াবহ রকমের প্রতিক্রিয়াশীল ও সাম্রাজ্যবাদ-সমর্থক ধনী ব্যক্তিরা, সেটাও ছিল একটি পশ্চাৎমুখী পদক্ষেপ।
রুশপন্থি চীনপন্থি বিভাজনের সময় পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির ১১ জন সদস্যের মধ্যে ৯ জনই ছিলেন রুশপন্থি; ভাগ করাতে তাদের উৎসাহই ছিল অধিক। ছাত্র ইউনিয়নকে ভাগ করাটা কঠিন হয়নি, কৃষক সমিতিও সহজেই বিভক্ত হয়েছে, পার্টিকে বিভক্ত করাতে তেমন কষ্টই হলো না; তবে ন্যাপ ভাঙাটা সহজ ছিল না। কারণ ন্যাপে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্ব ছিল অপ্রতিদ্ব›দ্বী। কিন্তু ন্যাপও ভাঙা হয়েছে। এবং ভাঙার পর রুশপন্থিরা সরকারের বিরুদ্ধে যতটা নয় তার চেয়ে ঢের বেশি বিষোদ্গার করেছেন চীনপন্থিদের বিরুদ্ধে এবং আক্রমণের জন্য বিশেষভাবে চিহ্নিত করেছেন মওলানা ভাসানীকে। শরিকদের মধ্যে সম্পত্তির ভাগাভাগি নিয়ে বিরোধ ঘটলে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি অস্বাভাবিক নয়; কিন্তু রুশপন্থিদের পক্ষে চীনপন্থিদের প্রতি বিদ্বিষ্ট হওয়ার বড় কারণ ছিল দৃষ্টিভঙ্গি ও অবস্থানগত পার্থক্য। রুশপন্থিদের দৃষ্টিতে চীনপন্থিরা ছিলেন উগ্রপন্থি। যাদের ওপর তাদের ভরসা সেই সোভিয়েত ইউনিয়ন তো তখন নরমপন্থা গ্রহণ করে ফেলেছে এবং ওই পথেই এগোচ্ছে। প্রতিপক্ষ চীন সোভিয়েত ইউনিয়নকে সংশোধনবাদী বলা শুরু করেছে, এমনকি সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী বলেও অভিযুক্ত করতে ছাড়ছে না। দুই লাইনের বিরোধটা পূর্ববঙ্গেও এসে পড়েছে, সরাসরি। এদিকে আবার সোভিয়েত ইউনিয়নের সন্দেহ হয়েছে যে স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনের পেছনে আমেরিকার সমর্থন তো আছেই, রয়েছে মাওবাদীদের তৎপরতাও। তাদের পত্রিকা নিউ টাইমস ও ইজভেস্তিয়া রাখঢাক না করে কথাটা বলেছেও। নিউ টাইমসের ভাষায় : ‘কিছু চীনপন্থি বিচ্ছিন্নতাবাদী নৈরাজ্যজনক কার্যকলাপ শুরু করেছে।’
মওলানার ওপর রাগের কারণ হয়তো ঈর্ষাও। মওলানা কমিউনিস্ট নন, কমিউনিস্ট না হয়েও তিনি সেসব কাজ করে চলেছেন যেগুলো রুশপন্থিদের করার কথা এবং যা তারা করতে পারছেন না; ভাসানীর জনপ্রিয়তা বাড়ছে, তাদেরটা কমছে। ঈর্ষা তাই ছিল স্বাভাবিক এবং তার পেছনে হয়তো ছিল ব্যর্থতার বোধও। মওলানা বলে দিচ্ছেন কী করা চাই, সেই পথটাকে উগ্র বলে গালাগাল দেয়া সম্ভব, কিন্তু বিপ্লবী না হলে কমিউনিস্ট পার্টি যে তার চরিত্র হারায় সেটাও তো ওই কমিউনিস্টদের অজানা ছিল না। ১৯৬৯-এর জানুয়ারিতে অভ্যুত্থানের লক্ষণগুলো যখন পরিস্ফূট হয়ে উঠছে, রুশপন্থিরা তখনো এর কৃতিত্ব বা দায়িত্ব কোনোটাই নিতে চাননি, যার সম্ভাব্য কারণ বিষয়ে আমরা ওপরে উল্লেখ করেছি। তারা বলতে চেয়েছেন ঘটনা শুরু হয়েছে পশ্চিমে, পূর্বে ঘটেছে পরে, কিছুটা প্রতিক্রিয়াতে এবং তারপরে আন্দোলন দাঁড়িয়েছে সারা পাকিস্তান পর্যায়ের। তা পশ্চিম পাকিস্তানে ছাত্র বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল বৈকি, কিন্তু পূর্ববঙ্গে যা ঘটেছে তা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন চরিত্রের এবং সেটা ছিল পূর্ববঙ্গের নিজস্ব জিনিস। পশ্চিমের ঘটনা ছিল মূলত বুর্জোয়া বিক্ষোভ, যদিও আইয়ুববিরোধী অবশ্যই; কিন্তু পূর্ববঙ্গ লড়ছিল পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের জন্য, অর্থাৎ পূর্ববঙ্গ চাইছিল পশ্চিম পাকিস্তানের এককেন্দ্রিক শাসন থেকে মুক্ত হতে। আর পূর্ববঙ্গের আন্দোলনে যে সমাজতান্ত্রিক উপাদান ছিল সেটা তো মোটেই উপেক্ষা করবার বিষয় নয়।
পরিস্থিতি দেখে সরকার তো অবশ্যই ঘাবড়ে গিয়েছিল; আতঙ্ক দেখা দিয়েছিল বুর্জোয়া শিবিরেও। হামিদুল হক চৌধুরী ছিলেন ডাকের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা; তার মালিকানাধীন পত্রিকা পাকিস্তান অবজারভার সম্পাদকীয় লিখে ছাত্রনেতাদের কাছে আবেদন জানায় তারা যেন ‘সামাজিক বিপ্লব সাধনের আহ্বান না জানায়’ এবং ওই সংগ্রামকেই শেষে যুদ্ধে পরিণত না করে। অবসরপ্রাপ্ত এয়ার মার্শাল আসগর খান বিবৃতি দিয়ে (২৬ জানুয়ারি) বলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানে এইরূপ বিপ্লবের আশঙ্কা আছে বলিয়াই আমি পূর্ব হইতে সতর্ক করিয়া আসিতেছিলাম। আইয়ুব সরকারই এর জন্য দায়ী। আইয়ুব সরকারকে অপসারণ করা দরকার […] বিপ্লব চলিতেছে- এখনো সময় আছে।’

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়