কাগজ প্রতিবেদক : বাংলাদেশে জনসাধারণের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের জন্য নেয়া মেগা প্রকল্পে জি-২০ নেতাদের সহায়তা চাইলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নিজস্ব অর্থায়নের পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল ও কর্ণফুলী নদীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, জনগণের জীবনযাত্রার মান বাড়াতে আমরা আরো কয়েকটি মেগা প্রকল্প হাতে নিচ্ছি। এসব প্রকল্পে উন্নত বিশ্বের কাছ থেকে ব্যাপক আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রয়োজন। এই বিষয়ে জি-২০ সহায়ক হবে বলে আমি আশা করি। ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে গতকাল বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত ‘ভয়েস অব দ্য সাউথ সামিট-২০২৩’ এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি যোগ দিয়ে তিনি এ আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
টেকসই বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও ‘বৈশ্বিক দক্ষিণের’ (গেøাবাল সাউথ) উন্নয়নের জন্য সম্মিলিতভাবে কাজ করতে বিশ্বনেতাদের প্রতি আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জি-২০ জোটের সামনে ছয়টি প্রস্তাব রেখে তিনি বলেন, ‘বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনীতিকে বিবেচনায় নিয়ে একটি ন্যায্য ও গ্রহণযোগ্য অর্থনৈতিক ব্যবস্থার জন্য সম্মিলিতভাবে কাজ করার এখনই উপযুক্ত সময়।
গুরুত্বপূর্ণ এই শীর্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশকে অতিথি দেশ হিসেবে আমন্ত্রণ জানানোয় ভারত সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, এই সম্মেলন বিশ্বজুড়ে তাদের সমকক্ষদের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার এক অনন্য সুযোগ করে দেবে। বাংলাদেশ গেøাবাল সাউথের একটি দেশ এবং ‘এক পৃথিবী, এক পরিবার, এক ভবিষ্যৎ’ ধারণার আওতায় অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন নিশ্চিত করার জন্য জি-২০-এর প্রেসিডেন্ট হিসেবে ভারতের দৃষ্টিভঙ্গিকে স্বাগত জানায়। ‘আসুন আমরা একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ ও একটি উন্নত বিশ্বের জন্য একসঙ্গে কাজ করি।
টেকসই বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য প্রথম প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মানবতার বৃহত্তর স্বার্থে বিশ্ব শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে হবে। দ্বিতীয়ত, একটি নতুন দৃষ্টান্ত প্রয়োজন যা এসডিজির সমান্তরালে সামগ্রিকভাবে বৈষম্যকে মোকাবিলা করবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তৃতীয়ত, স্বল্পোন্নত দেশ, জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোসহ সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর জন্য বিশেষ অর্থায়নের প্রয়োজন। তাদের উত্তরণের সময় এটি পূরণ করতে হবে। চতুর্থ প্রস্তাবে, তিনি নারীসহ সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে ‘ডিজিটাল ডিভাইডস’ সেতুবন্ধন রচনার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন। তরুণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিনিয়োগ করে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সুবিধা নিতে অর্থায়ন ও প্রযুক্তি হস্তান্তর সমর্থন অত্যাবশ্যক। পঞ্চমত, সব মানুষেরই ভালোভাবে জীবনযাপনের সমান অধিকার থাকা উচিত। তিনি বলেন, বৈশ্বিক স¤প্রদায় দুর্ভাগ্যজনকভাবে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিকদের মিয়ানমারে প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করতে যেন ভুলবেন না।
একটি ন্যায়সঙ্গত আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে প্রায় পাঁচ দশক আগে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানের কথা স্মরণ করিয়ে ষষ্ঠ প্রস্তাবে শেখ হাসিনা বলেন, বৈশ্বিক মানব উন্নয়ন নিশ্চিত করতে সাউথ-সাউথ ও ত্রিপক্ষীয় সহযোগিতা জোরদার করুন। এখানে অংশীদার, আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি খাত, থিংক-ট্যাংক ও অন্যান্য

স্টেকহোল্ডারদের কাছ থেকে সমর্থন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
জি-২০ প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেয়ায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও ভারত সরকারকে অভিনন্দন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের বিষয়ে পরামর্শমূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে জি-২০ প্ল্যাটফর্মকে আরো অর্থবহ করতে তার দৃঢ় প্রতিশ্রæতিকে আমি গভীরভাবে উপলব্ধি করি।
‘ভয়েস অব দ্য সাউথ সামিট’ আহ্বান করা ও ‘মানবকেন্দ্রিক উন্নয়ন’ বিষয়ক উদ্বোধনী অধিবেশনে আমন্ত্রণ জানানোয় নরেন্দ্র মোদিকে অভিনন্দন জানিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশ টেকসই উন্নয়নের স্তম্ভ হিসেবে মানব উন্নয়নের প্রকৃত মূল্যে বিশ্বাস করে। এটা সরকারের নীতিতে প্রতিফলিত হয়। আমরা বিশ্ব নেতৃবৃন্দের সহযোগিতায় মানবকেন্দ্রিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করতে আপনার (মোদির) জোরালো উদ্যোগে অবদান রাখতে প্রতিশ্রæতিবদ্ধ।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সা¤প্রতিক কোভিড-১৯ মহামারি এবং নিষেধাজ্ঞা ও পাল্টা নিষেধাজ্ঞা নিয়ে চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্বজুড়ে বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। বিশ্বব্যাপী মন্দা ও খাদ্য, জ্বালানি ও সারের সংকট জলবায়ু পরিবর্তনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবকে যুক্ত করে মানুষের জীবনকে অসহনীয় করে তুলেছে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য বৈশ্বিক পর্যায়ে সাহসী, দৃঢ় এবং সমন্বিত পদক্ষেপের প্রয়োজন।
১৯৭৪ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে জাতির পিতার ভাষণ উদ্ধৃত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মানুষের স্বাস্থ্য ও সুস্থতা, মানসম্মত জীবনযাপনের অধিকার নিশ্চিতে আন্তর্জাতিক দায়িত্ব রয়েছে। এই দৃষ্টিভঙ্গি আজও প্রাসঙ্গিক। এই চেতনাকে সামনে রেখে, আমরা মানুষের অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন নিশ্চিতে যথাসাধ্য চেষ্টা করছি। গত এক দশকে বাংলাদেশ সবার জন্য সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। বাংলাদেশ বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির একটি হিসেবে স্বীকৃত। আইএমএফের সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা গেছে বাংলাদেশ জিডিপির দিক থেকে বিশ্বের ৩৫তম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশে গত ১৪ বছরে দারিদ্র্যের হার ৪১ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশে নেমে এসেছে, যেখানে মাত্র এক দশকে মাথাপিছু আয় তিনগুণ হয়েছে। বাংলাদেশ এলডিসি স্তর থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার সব শর্ত পূরণ করেছে। বাংলাদেশ বিশ্বের পঞ্চম সেরা কোভিড প্রতিরোধী দেশ এবং দক্ষিণ এশিয়ার সেরা পারফরমার হিসেবে স্থান পেয়েছে। আর্থিক ও অন্যান্য প্রণোদনার জন্য ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি মূল্যের ২৮টি প্যাকেজ সরাসরি ৭ কোটি ৩ লাখ লোক এবং ২ লাখ ১৩ হাজার সংস্থার কাছে পৌঁছেছে।
শেখ হাসিনা বলেন, আমরা একটি শক্তিশালী অর্থনীতির ভিত্তি হিসেবে উন্নত ভৌত অবকাঠামো দিয়ে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ার আকাক্সক্ষা রাখি। গত বছর নিজস্ব অর্থায়নে আমরা পদ্মা বহুমুখী সেতু উদ্বোধন করেছি, যা জিডিপি বাড়াবে। কয়েক দিন আগে ঢাকায় প্রথম মেট্রোরেল সার্ভিস চালু করেছি। খুব শিগগিরই চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে ৩ দশমিক ২ কিলোমিটার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের কাজ শেষ করব, যা দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম। ইতোমধ্যে, আমরা আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় ৩৫ লাখ মানুষকে বিনা খরচে ঘর ও জীবিকার উপায় করে দিয়েছি। জনগণের জীবনযাত্রার মান বাড়াতে আমরা আরো কয়েকটি মেগা প্রকল্প হাতে নিচ্ছি। এসব প্রকল্পের জন্য আমাদের উন্নত বিশ্বের কাছ থেকে ব্যাপক আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রয়োজন। এই বিষয়ে জি-২০ সহায়ক হবে বলে আশা করি।
তিনি বলেন, আমাদের আকাক্সক্ষা হচ্ছে ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি জ্ঞানভিত্তিক দেশে রূপান্তরিত করা ও ২১০০ সালের মধ্যে একটি সমৃদ্ধ ও জলবায়ু সহনশীল ব-দ্বীপ গড়ে তোলা। আমরা টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিতের জন্য এবং সবার জন্য সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে এই লক্ষ্যগুলো অর্জন করার প্রত্যাশা করি।