সংসদে অর্থমন্ত্রী : গত বছরের ১১ মাসে রেমিট্যান্স এসেছে ১৯.৫৮ বিলিয়ন ডলার

আগের সংবাদ

তারল্য সংকটে বিপাকে ব্যাংক : সংকট উত্তরণে দরকার দৃশ্যমান রাজনৈতিক অঙ্গীকার, এখনই সমাধান না করলে সংকট আরো গভীর হবে

পরের সংবাদ

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব : পাইকগাছা-কয়রায় লবণাক্ততা বাড়ায় ব্যাহত কৃষিকাজ

প্রকাশিত: জানুয়ারি ১২, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ১২, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

তৃপ্তি রঞ্জন সেন, পাইকগাছা (খুলনা) থেকে : বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে খুলনা জেলার সর্ব দক্ষিণে পাইকগাছা ও কয়রা উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় লবণাক্ততার পরিমাণ বাড়ছে। ফলে পরিবেশের মারাত্মক বিপর্যয় ঘটছে। দিন দিন বাড়ছে লবণাক্ততা। ব্যাহত হচ্ছে কৃষিকাজ। সুপেয় পানির অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। পৃথিবীতে তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে বিভিন্ন সময় অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, বন্যা, জলোচ্ছ¡াস বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ কারণে নষ্ট হচ্ছে কোটি কোটি টাকার সম্পদ। এদিকে দিন যত গড়াচ্ছে ততই লবণাক্ততার পরিমাণ বাড়ছে পাইকগাছা ও কয়রা উপজেলার বিভিন্ন নদনদীতে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশে নানা রকম প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেড়েছে। ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ¡াস, বন্যা, নদীভাঙন উল্লেখযোগ্য। আগে ১৫ কিংবা ২০ বছর পরপর বড় ধরনের কোনো

প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলেও বর্তমানে ২ থেকে ৩ বছর পরপরই বড় ধরনের দুর্যোগ হানা দিচ্ছে।
ব্রিটিশ গবেষণা সংস্থা ম্যাপলক্রাফটের তালিকায় প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ ১৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সবার আগে।
বাংলাদেশের দক্ষিণে রয়েছে বঙ্গোপসাগর। ভূতাত্ত্বিকভাবে দেশটি থেকে উত্তর দিকে রয়েছে সুউচ্চ হিমালয় পার্বত্যাঞ্চল। যেখান থেকে বরফগলা পানির প্রবাহে সৃষ্ট বড় বড় নদী দেশের ভেতর দিয়ে প্রবহমাণ এবং নদীগুলো গিয়ে পড়েছে বঙ্গোপসাগরে। বর্ষাকালে নদীবাহিত পানির প্রবাহ বেড়ে নদী উপচে পানি লোকালয়ে পৌঁছে যায় এবং বন্যার সৃষ্টি হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিভিন্ন সময় ঘূর্ণিঝড় ও অতিরিক্ত জলোচ্ছ¡াসে সমুদ্র থেকে আসা লোনা পানি জেলার পাইকগাছা ও কয়রা উপজেলার নি¤œভূমিতে ঢুকে সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতার।
ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ¡াসের প্রভাবে ভেঙে পড়ে উপকূলীয় অঞ্চলের অবকাঠামো, বেড়িবাঁধ। ফলে অবাধে লোনা পানি প্রবেশ করে জলাবদ্ধতাকে স্থায়ী রূপ দেয়। অতিরিক্ত ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ¡াসের ফলে রাস্তাঘাট, বেড়িবাঁধের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। অন্যদিকে লবণ পানি প্রবেশের ফলে ফসলেরও ব্যাপক ক্ষতি হয়। দেখা দেয় সুপেয় পানিরও মারাত্মক অভাব। মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয় উপকূলের বাসিন্দারা। অতিরিক্ত লবণ পানির প্রভাবে বিভিন্ন গাছপালা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অতিরিক্ত লবণাক্ততার ফলে অনেক কৃষক কৃষিকাজে অনীহা দেখাচ্ছে।
প্রতি বছর পাইকগাছা-কয়রা এই দুটি উপজেলার উপকূলীয় এলাকার উর্বর জমি লবণ পানিতে তলিয়ে গেলে, বৃষ্টিতে সেই লবণাক্ততা কাটাতে প্রায় দুই তিন বছর সময় লাগে। কিন্তু লবণাক্ততা কাটতে না কাটতেই আবার প্লাবিত হয় এলাকা।
জানা গেছে, ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের পর ১৯৯৫, ১৯৯৭, ২০০০ ও ২০০১ সালে ঘূর্ণিঝড় হলেও তা তেমন ক্ষয়ক্ষতি করেনি। এছাড়া ২০০১ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত বলতে গেলে তেমন কোনো ঘূর্ণিঝড়ই হয়নি। কিন্তু জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে একদিকে যেমন বেড়েছে এসব জলোচ্ছ¡াসের তীব্রতা, তেমনি বেড়েছে এদের সংখ্যা। ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর আঘাত হানে সিডর, তার প্রভাব রেখে যেতে না যেতেই পিছু পিছু ২০০৮ সালের ২ মে ধেয়ে আসে ঘূর্ণিঝড় নার্গিস, একই বছর ২৬ অক্টোবর রেশমি, ১৫ নভেম্বর খাইমুক, ২৬ নভেম্বর নিসা, ২০০৯ সালের ১৭ এপ্রিল বিজলি এবং একই বছর ২৫ মে ঘূর্ণিঝড় আইলা। এরপর মহাসেন, তিতলি, ফণী, ২০১৯ সালের ৯ নভেম্বর বুলবুল, ২০২০ সালের ২০ মে আম্ফান ও ২০২২ সালের ২৫ অক্টোবরে আঘাত হানে সিত্রাং।
এসব ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে পাইকগাছা-কয়রা উপজেলার বির্ভিন্ন স্থানের বেড়িবাঁধের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এসময় সমুদ্রের লোনাপানি বিভিন্ন বেড়িবাঁধ ভেঙে লোকালয়সহ ফসলের মাঠে প্রবেশ করে এবং স্বাদু পানিকে লোনা করে দেয়।
পাইকগাছার গড়ইখালী ইউনিয়নের বাইনবাড়িয়া গ্রামের খগেন্দ্রনাথ মণ্ডল জানান, অতিরিক্ত লবণ পানির ফলে এলাকায় কৃষিকাজ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। গড়ইখালী ইউনিয়নে তরমুজের ফলন এক সময় খুবই ভালো হতো। কিন্তু বিভিন্ন সময় প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে ফসলের জমিতে লবণ পানি ঢুকে পড়ে। বেশি লবণাক্ততার ফলে তরমুজের বৃদ্ধি এবং উৎপাদনও কম হয়। লস্করের হরিপদ মণ্ডল জানান, ঘূর্ণিঝড় এবং জলোচ্ছ¡াসে এলাকায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এলাকার বাড়িঘরসহ বিভিন্ন জায়গা লবণ পানিতে তলিয়ে যায়।
সমুদ্রের লোনাপানি বেড়িবাঁধ ভেঙে লোকালয়ে এবং ফসলের মাঠে প্রবেশ করে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে নষ্ট হয় সুপেয় পানি। দুর্বিসহ হয়ে উঠে উপকূলীয় লাখ লাখ মানুষের বসবাস। প্রতিনিয়ত নদনদীর বাঁধ ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। জলবায়ু প্রভাবের ফলে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এ এলাকার বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠী প্রতিনিয়ত বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হচ্ছে। বিভিন্ন সময় নদী ভাঙনের ফলে এলাকা ছেড়ে লোকজন অন্য এলাকায়ও আশ্রয় নিচ্ছে।
লস্করের ইউপি চেয়ারম্যান কে এম আরিফুজ্জামান তুহিন জানান, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এলাকায় লবণাক্ততার পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় মিষ্টি পানির মাছ দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। পানি এমনিতেই লবণাক্ত। এরপর প্রতি বছর বেড়িবাঁধ ভেঙে এলাকার সবকিছু লোনা পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। ফলে লবণাক্ততার পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে, আর কৃষি জমির পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে। অপরদিকে সুপেয় পানিরও অভাব দেখা দিচ্ছে। এখন দেশীয় প্রজাতির মাছ প্রায় বিলুপ্তির পথে।
পাইকগাছার গড়ইখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুস সালাম কেরু জানান, জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে বিভিন্ন সময় ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ¡াস হচ্ছে। অতিরিক্ত জলোচ্ছ¡াসের ফলে এলাকার রাস্তাঘাট ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। লবণ পানি এলাকায় ঢুকে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। বেড়িবাঁধ ভেঙে যাচ্ছে। অতিরিক্ত লবণাক্তায় গাছপালা মারা যাচ্ছে।
তিনি জানান, যে সব এলাকায় লবণ পানি ঢুকছে সেখানে ধান উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। সুপেয় পানির অভাব হচ্ছে মারাত্মক। খাবার পানি সংরক্ষণের জন্য এলাকায় ডরপ ও পানিই জীবন প্রকল্প এলাকায় পানির ট্যাংকি দিচ্ছে।
কয়রা উপজেলা চেয়ারম্যান আলহাজ এস এম শফিকুল ইসলাম জানান, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে জলোচ্ছ¡াসের প্রভাবে বেড়িবাঁধ ভেঙে এলাকায় লবণ পানি প্রবেশ করে। এতে যেমন ফসলের মারাত্মক ক্ষতি হয়। তেমনি অনেক পরিবার গৃহহীন হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করে থাকে।
পাইকগাছা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ জাহাঙ্গীর আলম জানান, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সাগরে পানির পরিমাণ বেড়ে ফসলের জমিতে লবণ পানি ঢুকে নিয়মিত ফসল উৎপাদন ব্যাহত করে। ফসলের ক্ষেত তলিয়ে যায়। ফসলের জমির উপরের মাটিতে লবণাক্ততার পরিমাণ বেড়ে যায়। পরবর্তীতে স্বচ্ছ বৃষ্টির পানি এবং স্বচ্ছ নদীর পানিতে লবণাক্ততা কাটতে অনেক সময় লেগে যায়। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে তরমুজের ক্ষেতেরও ব্যাপক ক্ষতি হয়। উপজেলার সোলাদানা, লস্কর, গড়ইখালী ও দেলুটির কিছু অংশে লবণাক্ততার পরিমাণ বেশি থাকে। বর্ষা মৌসুমে নদীতে লবণাক্ততা কম থাকে। কিন্তু বর্ষা মৌসুম ছাড়া অন্য সময় যে প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয় তাতে এলাকায় নদীর পানি বৃদ্ধির ফলে এলাকায় লবণ পানি ঢুকে পড়ে।
পাইকগাছার সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা টিপু সুলতান জানান, লবণপানির জন্য মিষ্টি পানির মাছ বিলুপ্তির পথে। রুই, কাতলা, মৃগেল, শিং মাছ, মিষ্টি পানির টেংরা, কৈ, শোল মাছ আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছে। জলোচ্ছ¡াসের ফলে ঘেরগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বেশি।
পাইকগাছা-কয়রার সংসদ সদস্য আলহাজ মো. আক্তারুজ্জামান বাবু বলেন, পাইকগাছা-কয়রা উপজেলায় সুপেয় পানি সংরক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে পানির ট্যাংক ও বদ্ধ খাল খননের কাজ অব্যাহত রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টেকসই বেড়িবাঁধের জন্য দেড় হাজার কোটি টাকার যে প্রকল্পটা পাস করেছিলেন তারমধ্যে থেকে গত বছরের ১৯ ডিসেম্বর ১৬০ কোটি টাকার টেন্ডার হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে। আস্তে আস্তে সব কাজ সম্পন্ন হবে। পাইকগাছা-কয়রার নদী খননের কাজও চলমান রয়েছে।
এলাকাবাসী লবণাক্ততার হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্য নদীবেষ্টিত এলাকায় টেকসই বেড়িবাঁধ ও মিষ্টি পানি সংরক্ষণের জন্য স্থানীয় সংসদ সদস্যসহ বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দ্রুত হস্তক্ষেপ কামনা করেন।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়