সংসদে অর্থমন্ত্রী : গত বছরের ১১ মাসে রেমিট্যান্স এসেছে ১৯.৫৮ বিলিয়ন ডলার

আগের সংবাদ

তারল্য সংকটে বিপাকে ব্যাংক : সংকট উত্তরণে দরকার দৃশ্যমান রাজনৈতিক অঙ্গীকার, এখনই সমাধান না করলে সংকট আরো গভীর হবে

পরের সংবাদ

কোম্পানীগঞ্জে বালু উত্তোলনের মহোৎসব : স্লুুইস গেট বিলীনের আশঙ্কা

প্রকাশিত: জানুয়ারি ১২, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ১২, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

মোহাম্মদ সোহেল, নোয়াখালী থেকে : নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের ৭নং মুছাপুর ইউনিয়নে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের যোগসাজশে ৬০০ একর সরকারি খাস জমি দখল এবং ছোট ফেনী নদী ও বামনী নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে বিক্রির অভিযোগ উঠেছে। উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের দাবি, সরকারি খাস জমি দখল ও বালু উত্তোলন বন্ধ না হলে যে কোনো মুহূর্তে বিলীন হয়ে যাবে মুছাপুর ক্লোজার ও স্লুুইস গেট। স্থানীয়দের অভিযোগ, এসব বিষয়ে উপজেলা প্রশাসন ও জেলা প্রশাসনের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েও মেলেনি কোনো প্রতিকার।
গত সোমবার সকাল ৯টার দিকে খোদ কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাহাব উদ্দিন তার নিজ ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে খাস জমি দখল করে বিক্রি ও বালু উত্তোলন নিয়ে দুটি স্ট্যাটাস দেন। এতে পুরো জেলা জুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়।
তাতে তিনি লিখেন, বালু উত্তোলনকারী এবং ভূমি দস্যুরা অনেক শক্তিশালী, তাদের হাত নাকি অনেক লম্বা। উপজেলা পরিষদের পক্ষে উপজেলা প্রশাসন, কোম্পানীগঞ্জ থানা, কোস্ট গার্ড অন্তত বিশবার অভিযান চালিয়েও বালুলুট, ভূমিলুট বন্ধ করতে পারেনি,পারছেও না। বিশেষ সংস্থা বালু উত্তোলনকারী দস্যু এবং ভূমিদস্যুদের গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়ার পরও ছেড়ে দিয়েছে। কোথায় তাদের এত শক্তি? ভূমিহীনদের বন্দোবস্ত দেয়া জমিও দখল বিক্রি করে দিচ্ছে। ভূমিহীনরা অসহায়, ভয়ে দখলে যেতে পারছে না।
অপর এক স্ট্যাটাসে তিনি লিখেন, ছোট ফেনী নদী থেকে মুছাপুরে বালু উত্তোলনে পাঁচ হাজার কোটি টাকার স্লুইস গেট যেকোনো মুহূর্তে বিলীন হয়ে যাবে। চরপার্বতী,

চরহাজারী, মুছাপুর ইউনিয়ন বিলীন হবে। কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। এখনই এসব বন্ধ করা প্রয়োজন।
স্থানীয়দের অভিযোগ, জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের রহস্যজনক ভূমিকায় গত ৮ মাস ধরে মুছাপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আইযুব আলী ও ৭ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য (মেম্বার) মো. আলী আজগর জাহাঙ্গীরের যোগসাজশে তার ভাই জালাল উদ্দিন এবং তাদের সহযোগী মাইন উদ্দিন দুটি ড্রেজার দিয়ে রাতদিন ছোট ফেনী নদীর ভেতরের অংশ থেকে বালু উত্তোলন করে আসছে। গত ১ মাস ধরে একই সিন্ডিকেট স্থানীয় মাইন উদ্দিন দয়াল নামে এক ব্যক্তির তত্ত্বাবধানে মুছাপুর ক্লোজারের ছোট ফেনী নদী ও বামনী নদীর আরো ৩টি স্পট থেকে বালু উত্তোলন করছে। ৬০০ একর খাসজমি বিক্রি করে এই চক্র ৫ কোটি টাকা, ছোট ফেনী নদী এবং বামনী নদী থেকে গত ৮ মাসে অবৈধভাবে ৬ কোটি টাকার বালু উত্তোল করে হাতিয়ে নিয়েছে। এতে বিভিন্ন স্থানে নদী ভাঙন সৃষ্টি হচ্ছে।
স্থানীয়রা অভিযোগ করে আরো বলেন, ২০১৫ সালে নির্মিত কোম্পানীগঞ্জের পর্যটন এলাকা হিসেবে খ্যাত ১৭৫ কোটি টাকায় নির্মিত মুছাপুর ক্লোজার বাঁধ ও স্লুইস গেইট ও প্রধান সড়ক নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছে। এর ফলে এলাকার ফেনী নদীর পাশে থাকা পাকা সড়কে ভাঙন দেখা দিয়েছে। পাশাপাশি হাজার হাজার একর ফসলি জমি ভেঙে নদীতে বিলীন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এর আগেও

ছোট ফেনী নদী থেকে বালু উত্তোলনের ফলে পাকা সড়কে ভাঙন দেখা দেয়। আশপাশের কয়েক হাজার একর কৃষিজমি, শতাধিক বসতবাড়ি ও এলাকার জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে। এছাড়া বালু উত্তোলনের ফলে মাছের আবাস ও প্রজননস্থল বিনষ্ট হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
গত সোমবার সরজমিন গিয়ে দেখা গেছে, মুছাপুর ক্লোজারের উত্তর মাথায় আর্দশ গ্রামের শৈবালে, মুছাপুর ক্লোজারের পূর্বে নতুন চরের মাথায়, মুছাপুর ক্লোজারের দক্ষিণে ফরেস্ট বাগানের পাশে ও জেলে বাড়ির একটু আগে ফেনী নদীর ২টি স্পট থেকে ড্রেজার মেশিন দিয়ে অবাধে বালু উত্তোলন চলছে। মুছাপুর ক্লোজার সংলগ্ন ছোট ফেনী নদী থেকে ফেনীর সোনাগাজী এলাকার একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে উত্তোলন করা হচ্ছে কোটি টাকার বালু।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত বছরের ৩১ জুলাই কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় বালু উত্তোলনকে কেন্দ্র করে রামপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান সিরাজীস সালেকিন রিমন ও মুছাপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আইয়ুব আলীর মধ্যে হট্টগোল ও হাতাহাতির ঘটনা ঘটে।
উপজেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় মুছাপুর ক্লোজার সংলগ্ন ছোট ফেনী নদী থেকে চেয়ারম্যান মো.আইয়ুব আলীর যোগসাজশে বালু উত্তোলনের অভিযোগ তোলেন সেতুমন্ত্রীর ভাগ্নে রামপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান সিরাজীস সালেকীন রিমন। তখন দুই ইউপি চেয়ারম্যানের মধ্যে হট্টগোল ও হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। এই ঘটনার একটি ভিডিও চিত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে পড়ে।
অপরদিকে, গত বছরের ২৬ আগস্ট মুছাপুর ইউনিয়নের চৌধুরী বাজারে সর্বস্তরের জনগণের ব্যানারে খাস জমি দখল ও বালু উত্তোলনের প্রতিবাদে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন উপজেলা আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগ সভাপতি ও মুছাপুর ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম চৌধুরী। লিখিত বক্তব্যে তিনি অভিযোগ করেন, আইয়ুব আলী জননেত্রী শেখ হাসিনা ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নাম ভাঙিয়ে লোকজনকে ভূমিহীন সাজিয়ে মুছাপুর ইউনিয়নের মুছাপুর ক্লোজারঘাট পর্যটন এলাকার সরকারি খাসজমি বন্দোবস্ত নেন। ওই জমি পরে ওইসব লোকের কাছে টাকার বিনিময়ে বিক্রি করেন। একই সঙ্গে ছোট ফেনী নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন শুরু করেন। এ বিষয়ে স্থানীয় বিভিন্ন মহল থেকে প্রতিবাদ শুরু হলে উপজেলা ভূমি প্রশাসনের লোকজন সেখানে অবৈধ দখল উচ্ছেদ করতে গিয়ে উল্টো আইয়ুব আলীর বাহিনীর হাতে হামলার শিকার হন। সেখানে ইউপি চেয়ারম্যান আলীর জলদস্যু বাহিনীর সদস্য জাহাঙ্গীর মেম্বার ও তার ভাই জলদস্যু জালালের ইন্ধনে ওই ঘটনা ঘটে। কিন্তু এ ঘটনায় স্থানীয় প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। তিনি অভিযোগ করে আরও বলেন, বরং পার পেয়ে এই ভূমিদস্যু, বালু খেকো সিন্ডিকেট ড্রেজার মেশিন বসিয়ে তাদের কার্যক্রম আরো দ্রুত গতিতে চালিয়ে যাচ্ছে বীরদর্পে।
স্থানীয় ইউপি সদস্য (মেম্বার) মো. আলী আজগর জাহাঙ্গীর ও তার ভাই জালাল বলেন, তারা খাস জমি দখল ও বালু উত্তোলনের সঙ্গে জড়িত নয়।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মুছাপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়াম্যান আইয়ুব আলী অভিযোগ নাকচ করে দিয়ে উল্টো ভোরের কাগজের সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা করার হুমকি দেন।
কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মেজবাউল হক ভূঁইয়া বলেন, সেখানে বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য কেউ একজন মাটি নেয়ার চেষ্টা করছে এই রকম খবর আমরা পেয়েছি। সেই অনুযায়ী আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ব্যক্তি বা কাউকে দোষারোপ করতে হলে আমার পর্যায় থেকে সুনির্দিষ্ট তদন্ত প্রতিবেদন বা প্রমাণসহ কথা বলতে হবে। যার কারণে এই বিষয়ে আপনাকে সুনির্দিষ্ট কিছু বলার মতো আমার কাছে কোনো তথ্য নেই। একাধিকবার খাস জায়গায় গড়ে উঠা ঘরগুলো ভেঙে দেয়া হয়েছে এবং বালু উত্তোলন বন্ধে ২০ বার অভিযান চালানো হয়েছে।
খাস জমি দখল ও অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়ার সত্যতা নিশ্চিত করে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা পরিষদ চেয়রম্যান মোহাম্মদ সাহাব উদ্দিন বলেন, খাস জমি দখল ও অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধে বৃহস্পতিবার বিকালের দিকে মুছাপুর ক্লোজারে বৈঠক ডাকা হয়েছে। আমি এসব অনিয়ম বন্ধে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। দেখা যাক কি হয়।
নোয়াখালীর জেলা প্রশাসক দেওয়ান মাহবুবুর রহমান সম্প্রতি জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় বলেন, আমরা ইতোমধ্যে সেখানে অভিযান চালিয়ে অবৈধ দখলদারদের কাছ থেকে সরকারি খাস জমি উদ্ধার করেছি। শুনেছি দখলদাররা আবারো সেখানে দখলের চেষ্টা করছে। শিগগিরই সেখানে খাস জমি দখলদার ও অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা হবে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়