ঢাকা-ওয়াশিংটন : রোহিঙ্গা, প্রতিরক্ষা সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা

আগের সংবাদ

একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি : শিক্ষার্থী পায়নি ২০০ প্রতিষ্ঠান

পরের সংবাদ

কেমন যাবে ২০২৩ সাল

প্রকাশিত: জানুয়ারি ১১, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ১১, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

আইএমএফের ভবিষ্যদ্বাণী যদি ঠিক হয় তো নতুন বছর ২০২৩ সুখকর হবে না অনেক দেশের জন্য। সংস্থাটি জানিয়েছে বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ দেশ এ সময় মন্দায় আক্রান্ত হবে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে পণ্যসামগ্রীর উচ্চমূল্য, কোনো কোনো দেশে নীতি সুদহার বৃদ্ধি, ফের করোনা ভাইরাসের প্রকোপ ইত্যাদি কারণে এমন পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে বলে আশঙ্কা তাদের। বলা নিষ্প্রয়োজন, অবস্থা এ রকম দাঁড়ালে কোনো দেশই তেমন বিপদমুক্ত থাকবে না। যুক্তরাজ্যের মতো প্রভাবশালী উন্নত দেশ ইতোমধ্যে বড় বিপদে পড়ে গেছে। খোদ খাদ্যের সংকট দেখা দিয়েছে সেখানে। রেকর্ড পরিমাণ মূল্যস্ফীতির দরুন মানুষ চাহিদামাফিক খাদ্য কিনতে পারছে না। জ¦ালানির উচ্চমূল্যে ইউরোপের অনেক দেশ এই শীতে নিদারুণ ভুগছে। জার্মানির মূল্যস্ফীতি সর্বোচ্চ পর্যায়ে, খাদ্য ও জ¦ালানির দাম মাত্রা ছাড়িয়েছে। এই যদি হয় বৈশ্বিক পরিস্থিতি তাহলে নিজেদের নিয়ে উদ্বিগ্ন হতেই হয়।
আমাদের অর্থনীতিতে এ মুহূর্তে বড় সমস্যা বৈদেশিক মুদ্রার মজুত। সেটি সন্তোষজনক না হওয়ায় আমদানিতে কাটছাঁট করতে হচ্ছে। কেবল কম প্রয়োজনীয় পণ্য নয়, অতি প্রয়োজনীয় পণ্য জ¦ালানি তেল ও এলএনজি আমদানি কমাতে হয়েছে। এতে ঘাটতি দেখা দিয়েছে গ্যাস, বিদ্যুতের। অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়েছে। এসব করেও বৈদেশিক মুদ্রার মজুত ধরে রাখা যাচ্ছে না। সংকটের মূল কারণ আমদানিতব্য পণ্যের উচ্চমূল্যে, পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের গতি হারানো। গত ডিসেম্বরে পরিস্থিতি কিছুটা বদলেছে, আহরণের গতি বৃদ্ধি পেয়েছে। রপ্তানি আয় ৫ হাজার কোটি ডলারের মাইলফলক স্পর্শ করেছে, একই সঙ্গে বৃদ্ধি পেয়েছে প্রবাসী আয়। এই গতি টেকসই হয় কিনা দেখার অপেক্ষায় থাকতে হবে।
সবাই জানেন যে বাংলাদেশের আমদানি আয় তৈরি পোশাকের ওপর নির্ভরশীল। এই পোশাকের গন্তব্য মূলত আমেরিকা-ইউরোপ। মন্দার পূর্বাভাস সেখানেই বেশি। এমনটি হলে দুশ্চিন্তার সম্ভাবনা থাকবে। কেবল একটি পণ্যের ওপর গোটা রপ্তানির নির্ভরতা আর গেল না। রপ্তানির বহুমুখীকরণ খুব জরুরি। বিভিন্ন মহল থেকে বারবার এ বিষয়ে সতর্ক করা হচ্ছে। বিদেশে আমাদের দূতাবাসগুলো নতুন বাজার খোঁজায় বিশেষ অবদান রাখতে পারত। দুঃখের বিষয় খোদ সরকার প্রধানের উপর্যুপরি তাগিদ সত্ত্বেও পরিস্থিতির উন্নতি ঘটছে না। হোম টেক্সটাইল ও কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্যের নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে, সেটি সম্প্রসারিত হলেই ভালো।
বাংলাদেশ মুদ্রাস্ফীতির জ¦ালা ভোগ করছে সেই করোনাকাল থেকে। বলা যায় প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে। মৌসুমের শাকসবজি ছাড়া অন্য পণ্যাদির মূল্যে তেমন হেরফের নেই। কোনোটি বেড়ে গিয়ে এক জায়গায় স্থিত হয়েছে, আবার কোনোটি বেড়েই চলছে। আমদানিপ্রধান দেশ হওয়ায় আমাদের বিপদ বেশি। প্রয়োজনের অধিকাংশ পণ্য বিদেশ থেকে আমদানি করে আনতে হয়। বিশ্ববাজারে দাম বৃদ্ধি ও ডলারের সংকটের কারণে আমদানি করা প্রতিটি পণ্যের দাম বেড়েছে। আবার সংকটকে সম্বল করে একটা শ্রেণি মুনাফার পাহাড় গড়ছে। মুক্তবাজার প্রকৃতপক্ষে মুক্ত নয় এদেশে, কতিপয়ের হাতে শৃঙ্খলিত। বিগত শতকের আশির দশকেও ছোট ছোট আমদানিকারকে ছাওয়া ছিল দেশ, তখন কারসাজি কম হতো। এখন বড়দের রাজত্ব, কারসাজির ক্ষমতা তাদের ব্যাপক। কতিপয় লোকের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছেন দেশের মানুষ। বৈশ্বিক পরিস্থিতির বদল না হলে মূল্যবৃদ্ধিজনিত সমস্যা দূর হবে না। তবে রক্ষাকবচ হতে পারে সরকার। প্রয়োজনমাফিক নীতি সহায়তা দিয়ে মানুষের পাশে থাকলে দুর্ভোগ অনেকাংশে কমবে। বর্তমানে ১ কোটি ফ্যামিলি কার্ডের বিপরীতে টিসিবি সহনীয় মূল্যে কতিপয় পণ্য বিক্রি করছে, এর পাশাপাশি রয়েছে ওএমএস বা খোলাবাজারে পণ্য বিক্রয়ের কর্মসূচি। এসব কর্মসূচিকে যদি ব্যাপকতর করা যায় তাহলে সাধারণ মানুষ কিছুটা নিস্তার পাবে।
আমাদের ওষুধশিল্পের খুব রমরমা অবস্থা এখন। দেশীয় চাহিদা সংকুলান করে বিদেশেও বাজার ধরেছে শিল্পটি। আশির দশকে প্রণীত জাতীয় ওষুধনীতির সুবাদে শিল্পটি বিকশিত হতে পেরেছে। তখন সরকারের বাঁধন ছিল তুলনামূলক শক্ত। অপ্রয়োজনীয় ওষুধ পরিহার এবং প্রয়োজনীয় সব ওষুধের মূল্য নির্ধারণ করে দেয়ার ক্ষমতা রাখত ওষুধ প্রশাসন। তাতে ভোক্তাসাধারণ সহনীয় মূল্যে ওষুধ কিনতে পারত। এখন সেই অবস্থা নেই, বাঁধন অনেকটাই আলগা। নব্বইয়ের দশকের গণতান্ত্রিক শাসনামলে পাওয়া এই ছাড় কাজে লাগিয়ে মালিকশ্রেণি তাদের ব্যবসাকে জমজমাট করেছেন, কিন্তু ভোক্তাদের ছাড় দিচ্ছেন না। ওষুধের মূল্য বাড়িয়েই চলছেন। গণমাধ্যম অন্য সব ব্যাপারে সরব থাকলেও ওষুধের ব্যাপারে আশ্চর্যরকম নীরব। গণমাধ্যমের মালিকদের কারো কারো এই ব্যবসার সঙ্গে সংযুক্তির কারণে এমন হাল দাঁড়িয়েছে। সিন্ডিকেশনকে প্রকারান্তরে তারা সহায়তা করছেন। নতুন বছরে এই জায়গাটায় দৃষ্টি দিতে অনুরোধ করব সরকারকে। খেটেখাওয়া গরিব মানুষও এখন রোগেশোকে সামান্য চিকিৎসাসেবা পেতে চান। তাদের সেই চাওয়া মূল্যায়িত হোক।
ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনেক শিল্প বর্তমান প্রেক্ষাপটে খুব খারাপ অবস্থায় আছে। উদাহরণস্বরূপ পোল্ট্রি শিল্পের কথা ধরা যায়। অনেক তরুণ ব্রয়লার-লেয়ারের খামার করে আত্মকর্মসংস্থানের পথ বেছে নিয়েছিল। তাদের প্রচেষ্টা ধ্বংস হতে চলেছে। পোল্ট্রির খাবার সম্পূর্ণ আমদানিনির্ভর। প্রধান উপকরণ ভুট্টা ও সয়াবিনের দাম বর্তমানে অস্বাভাবিক, সেইসঙ্গে বেড়েছে এর ওষুধের দাম। এ অবস্থায় শিল্পটির টিকে থাকাই কঠিন। গবাদি পশু ও মৎস্য খামারের একই অবস্থা। খাদ্যের উচ্চমূল্যের কারণে উদ্যোক্তারা খামার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। এরকমই নীরবে নিভৃতে অনেক ছোটখাটো বিনিয়োগ মাঠে মারা যেতে বসেছে। এসব দিকে বিশেষ নজর দেয়া দরকার। নয়তো বেকারে ভরপুর দেশে নতুন করে বেকারত্ব তৈরি হবে।
বিভিন্ন ব্যাংক থেকেই অনিয়মের ঘটনা ঘটছে। নানা ক্ষেত্রে সংঘটিত হচ্ছে দুর্নীতি। এসব অর্জন ও দুর্নীতির ঘটনায় সরকারের সব অর্জন ভেস্তে যেতে বসেছে। সম্প্রতি ইসলামি ধারার কয়েকটি ব্যাংক থেকে একটি শিল্প গ্রুপের বিপুল পরিমাণ ঋণ গ্রহণ দেশে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। এতে ব্যাংকগুলো তারল্য সংকটে পড়েছে। এর দায় এড়াতে পারেন না ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ও দেখভালের দায়িত্বপ্রাপ্তরা। এর আগে ফারমার্স ব্যাংক ও বেসিক ব্যাংকে সংঘটিত অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেলেঙ্কারির যদি বিচার হতে পারে তাহলে এসব ক্ষেত্রে কেন নয়? ছাড় দেয়ার প্রবণতা দূর না হলে ব্যাংক খাত বিপর্যস্ত হয়ে অর্থনীতিতে অমোচনীয় ক্ষত সৃষ্টি করবে। উদ্ঘাটিত আরেক অনিয়ম হতবাক করার মতো ঘটনা। রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী এক ঠিকাদার বিসিআইসির ৫ শতাধিক টাকার সার গুদামে পৌঁছে না দিয়ে লোপাট করে দিয়েছেন। ঠিকাদারের অসততার পাশাপাশি বিসিআইসির কর্মকর্তারাও এর জন্য দায়ী। তারা দায়িত্ব পালন করেননি অথবা জেনে বুঝেও চোখ বন্ধ রেখেছিলেন। দৃশ্যমান ব্যবস্থা ছাড়া এমনতর ঘটনা ঘটতেই থাকবে। ২০২৩ সাল, এমনকি পরেও আমরা ভালো থাকতে পারব না যদি না এর পুনরাবৃত্তি রোধ করা যায়।
আমাদের ভালো থাকা মন্দ থাকা অনেকখানি নির্ভর করে কৃষির ওপর। প্রকৃতির সহায় থাকা এবং কৃষকদের প্রাণান্ত চেষ্টার কারণে করোনাকালেও দেশ বড় বিপদে পড়েনি। সরকার যদি পাশে থাকে নতুন বছরেও বৈশ্বিক আশঙ্কাকে অমূলক করে আমরা অন্তত খাদ্যসংকটে পড়ব না। সরকারি গুদামে খাদ্যের মজুত ভালো আছে সেটিও ভরসার কারণ।
২০২৩ সাল কিংবা তার পরপরই দেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। দেশের রাজনীতিতে ইতোমধ্যে সংকট বিরাজমান। দুই পক্ষ মুখোমুখি অবস্থানে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যদি হানাহানি ও অরাজক পরিস্থিতি তৈরি হয় তাহলে বৈশ্বিক সংকটের সঙ্গে দেশীয় সংকট একাকার হয়ে বিপর্যয় গভীর হবে। প্রধান বিরোধী দলের অংশগ্রহণসহ একটি সুষ্ঠু নির্বাচন সবার প্রত্যাশিত। নির্বাচনে উৎসবের আমেজ থাকুক, উৎকণ্ঠা নয়। সেটি সম্ভব হবে তখনই যখন দুই পক্ষ সমঝোতায় আসবে। এতে ২০২৩ সাল কেমন যাবে এ নিয়ে তেমন দুশ্চিন্তা করতে হবে না।

মজিবর রহমান : প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়