ইউনেসকোর প্রতিবেদন : দেশে শিক্ষা ব্যয়ের ৭১ ভাগ বহন করে পরিবার

আগের সংবাদ

তীব্র শীতে জবুথবু জনজীবন

পরের সংবাদ

অর্থনীতিতে সংকট আর সম্ভাবনার বছর : বছরজুড়ে টালমাটাল অর্থনীতি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে নাভিশ্বাস

প্রকাশিত: জানুয়ারি ৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ৫, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

মরিয়ম সেঁজুতি : গত বছরের শুরুতে করোনা মহামারির ধাক্কা সামলে স্বাভাবিক হয়ে ওঠে জনজীবন, কর্মচঞ্চল হয়ে ওঠে অর্থনীতি। কিন্তু ফেব্রুয়ারিতে তা থমকে দাঁড়ায়। ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ প্রভাব ফেলে আমদানি-রপ্তানিতে। যুদ্ধের ডামাডোলে চাল, সয়াবিন তেল, চিনিসহ নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে। ডলার সংকটের অজুহাতে ভোক্তাদের কাছ থেকে ইচ্ছেমতো দাম আদায় করেছেন ব্যবসায়ীরা। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি বিষিয়ে তোলে মানুষের স্বাভাবিক জীবন। এরপরও নানা জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে স্বপের পদ্মা সেতু আর মেট্রোরেলের মতো মেগা প্রকল্পের উদ্বোধন। এককথায় দেশের আর্থিক খাতে অনিশ্চয়তা, বিপর্যয়, সংগ্রাম এবং ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টার বছর ছিল ২০২২। ধারাবাহিকভাবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমতে থাকা, নজিরবিহীনভাবে ডলারের বিনিময় মূল্য বাড়তে থাকা, পণ্য সরবরাহে বিঘœ, ব্যাংকিং খাতে সুশাসনের অভাব, কর বনাম মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাত কমতে থাকা, নিত্যপণ্যের আকাশচুম্বী দাম ও অর্থ পাচার নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার চাপে ছিল অর্থনীতি।
মার্চ-এপ্রিলে দরপতন হয় ডলারসহ বৈদেশিক মুদ্রার বাজারে। ১২ কেজি একটি সিলিন্ডার গ্যাসের দাম বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ৪৩৯ টাকায়, যা ২০২২ সালে সর্বোচ্চ। এরপর মে মাসে আবারো উত্তপ্ত হয়ে ওঠে তেলের বাজার। এক লাফে ৩৮ টাকা বেড়ে ১৯৮ টাকায় পৌঁছায় প্রতি লিটার সয়াবিন তেলের দাম।
জুলাই মাসের পর থেকে হঠাৎ দেশে আলোচনায় রিজার্ভ, দুই বছর পর ৪০ বিলিয়নের নিচে নামে দেশের রিজার্ভ। এছাড়া আদমশুমারির ফল প্রকাশ, ফ্যামিলি কার্ডে পণ্য বিক্রি শুরু করে টিসিবি।
এরপর আগস্ট, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে আবারো নাভিশ্বাস দ্রব্যমূল্যের বাজারে, ডলারের দাম বেড়ে দাঁড়ায় ১২০ টাকায়, বৈদেশিক মুদ্রাবাজার কারসাজিতে জড়িত ৬ ব্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা, সংকটে পড়ে চিনির বাজার, রেমিট্যান্স, আমদানি-রপ্তানিতে ডলারের ভিন্ন ভিন্ন দাম নির্ধারণ। সংকট কাটিয়ে নভেম্বরে ৫০৯ কোটি ২৫ ডলার নিয়ে সর্বোচ্চ রপ্তানি আয়ের রেকর্ড করে দেশ। সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিতে সম্মত হয় আইমএফ।

বছর শেষে ডিসেম্বরে মেট্রোরেলের যুগে প্রবেশ করে বাংলাদেশ।
জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি : রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত শুরুর পর বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য রেকর্ড পরিমাণ বেড়েছে। ফলে অর্থনৈতিক টানাপড়েন, খাদ্য সংকট এবং ভয়াবহ মূল্যস্ফীতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে পৃথিবী। প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশেও। জ্বালানি তেল এমন একটি পণ্য যার ব্যবহার কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য, পরিবহন, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ সবক্ষেত্রে।
বাজার খরচ কমাতে কমাতেই বছর পার : রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি, ডলার সংকট, রপ্তানি আদেশে বাধা এবং জাহাজের ভাড়া বাড়ানোর অজুহাতে আমদানি করা পণ্যের দাম বেড়েছে কয়েক গুণ। পাল্লা দিয়ে বাড়ে দেশে উৎপাদিত পণ্যের দামও। ফলে খরচ মেটাতে মধ্যবিত্ত, নি¤œ মধ্যবিত্ত, নি¤œবিত্ত ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষকে হিমশিম খেতে হয়।
আন্তর্জাতিক মূল্যস্ফিতির চাপ দেশেও : দেশে মূল্যস্ফীতি এখনো ৯ শতাংশের কাছাকাছি। বাজারে গিয়ে ক্রেতারা স্বস্তি না পেলেও তিন মাস ধরে অল্প অল্প করে মূল্যস্ফীতি কমছে বলে জানিয়েছে সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। অর্থাৎ ২০২১ সালের নভেম্বরে একজন মানুষ যে পণ্য ১০০ টাকায় কিনতেন, বিদায়ী বছরের নভেম্বর মাসে একই পণ্য কিনতে খরচ হয়েছে ১০৮ টাকা ৮৫ পয়সা।
ডলার ও রিজার্ভ সংকট : বিশ্ববাজারে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে আমদানি ব্যয়। ডলার সংকটে টালমাটাল অবস্থা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে। রপ্তানি আয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কমছে রেমিট্যান্স।
বিলাসীপণ্য আমদানিতে কড়াকড়ি : আমদানি ব্যয়ের চাপ কমাতে বিলাসীপণ্য আমদানির লাগাম টেনে ধরে বাংলাদেশ ব্যাংক। মোটরকার, হোম অ্যাপ্লায়েন্স হিসেবে ব্যবহৃত ইলেকট্রিক্যাল এবং ইলেকট্রনিক্স সামগ্রীর আমদানি ঋণপত্র (এলসি) খোলার ক্ষেত্রে ন্যূনতম ৭৫ শতাংশ নগদ মার্জিন সংরক্ষণ করার কথা বলা হয়। একই সঙ্গে অতি জরুরি পণ্য ছাড়া অন্য সব পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে কমপক্ষে ৫০ শতাংশ নগদ মার্জিন সংরক্ষণ করতে বলা হয়।
বাণিজ্য ঘাটতি : একদিকে পণ্য বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে, অন্যদিকে কমেছে রেমিট্যান্স প্রবাহ। এর সরাসরি প্রভাব পড়েছে বৈদেশিক মুদ্রার চলতি হিসাবের ভারসাম্যে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানিয়েছে, বাণিজ্য ঘাটতি বৃদ্ধিতে চলতি হিসাবের ভারসাম্যও ঋণাত্মক হয়ে গেছে।
ব্যাংক খাতে অস্থিরতা : ২০২২ সালের শেষের দিকে ব্যাংক খাতের একের পর এক কেলেঙ্কারির ঘটনা ফাঁস হয়। ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড থেকে ১১টি অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠান হাতিয়ে নিয়েছে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা। সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক থেকে চারটি প্রতিষ্ঠান নিয়েছে প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক থেকে তিনটি প্রতিষ্ঠান নিয়েছে এক হাজার ২০০ কোটি টাকা। এছাড়া ব্যাংকে টাকা নেই, এমন গুজবও ছড়ানো হয়। গুজবে কান দিয়ে অনেকেই ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নেন; যা নতুন সংকটের জন্ম দেয়। তবে বছর শেষে এই প্রবণতা কমে এসেছে।
প্রবাসী আয়ে ধস : চলতি ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই ও আগস্ট) টানা দুই বিলিয়ন ডলার করে রেমিট্যান্স আসে দেশে। এর পরের মাস সেপ্টেম্বর থেকে টানা তিনমাস দেড় বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে আসে রেমিট্যান্স।
রাজস্ব আয় : চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) এনবিআরের রাজস্ব আদায় হয়েছে ১ লাখ ১৫ হাজার ৬২০ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। এটি গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১৩ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ বেশি।
একক মাস হিসেবে নভেম্বরে রাজস্ব আদায় হয়েছে ২৪ হাজার ৭০৩ কোটি টাকা। নভেম্বরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৮ হাজার ২৮ কোটি টাকা।
আইএমএফের ঋণ : ডলার সংকটে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে চাপ তৈরি হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও কমেছে। ডলারের সরবরাহ বাড়াতে সরকার আইএমএফের কাছে ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ চেয়েছে। আগামী জানুয়ারি কিংবা ফেব্রুয়ারি মাসে ঋণ অনুমোদন হতে পারে। তখন প্রথম কিস্তিতে ৪৫ কোটি ডলার পাবে বাংলাদেশ।
সরকারের ব্যয় সংকোচন নীতি : অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় চলতি বছরে ব্যয় সংকোচন নীতি গ্রহণ করে সরকার। সরকারি সব দপ্তরে বিদ্যুতের ব্যবহার ২৫ শতাংশ কমানো, দেশজুড়ে এলাকাভিত্তিক লোডশেডিং, অধিকাংশ সভা অনলাইনে আয়োজন করা, অত্যাবশ্যক না হলে বিদেশ ভ্রমণ যথাসম্ভব পরিহার করাসহ বেশকিছু পদক্ষেপ নেয় সরকার। এছাড়া ছোটো-বড়সহ বেশকিছু প্রকল্পের কাজ স্থগিত করা হয়।
কম দামে টিসিবির পণ্য : ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) ফ্যামিলি কার্ডের মাধ্যমে পণ্য বিক্রি কার্যক্রম শুরু করে ২০ মার্চ থেকে। ঢাকা সিটি করপোরেশনের বাইরে সারাদেশে একযোগে এই কার্যক্রম শুরু হয়েছে।
সবচেয়ে বড় অর্জন পদ্মা সেতু : দেশের সড়ক যোগাযোগের নতুন দিগন্ত বাঙালির বহু আকাক্সিক্ষত পদ্মা সেতু। যার দ্বার খুলেছে এ বছরের ২৫ জুন। এই সেতু নির্মাণের মধ্য দিয়ে সম্পূর্ণ দেশীয় অর্থায়নে বড় অবকাঠামো নির্মাণে সক্ষমতা দেখিয়েছে বাংলাদেশ। এই সেতু শুধু একটি বড় অবকাঠামো নয়, এটি বিদেশি অর্থায়ন ছাড়া প্রথমবারের মতো বাস্তবায়িত বাংলাদেশের একটি ‘মেগা’ প্রকল্প।
মেট্রোরেল যুগে দেশ : স্বপ্নের মেট্রোরেল যুগে প্রবেশ করল বাংলাদেশ। যানজটের শহরে এই মেট্রোরেল নিঃসন্দেহে জাদুর কাঠি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। গত ২৮ ডিসেম্বর চালু হয়েছে মেট্রোরেল।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়