বোটানিক্যাল গার্ডেনে স্ত্রীকে হত্যার ঘটনায় স্বামীর স্বীকারোক্তি

আগের সংবাদ

বিদেশে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচারণা : কী করছেন কূটনীতিকরা

পরের সংবাদ

মন্দা মোকাবিলায় দুই চ্যালেঞ্জ : ডলারের দাম যৌক্তিক জায়গায় রাখা > মূল্যস্ফীতি কমিয়ে ৫ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনা

প্রকাশিত: জানুয়ারি ৪, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ৪, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

মরিয়ম সেঁজুতি : ভালো যাবে না ২০২৩ সাল। বিশ্বের এক তৃতীয়াংশ মন্দার কবলে পড়তে চলেছে- যার ধাক্কা গিয়ে পড়বে পৃথিবীর বাকি অংশে। বছরের শুরুতেই জানিয়ে দিলেন আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডারের (আইএমএফ) প্রধান ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা। তিনি বলেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং চীনে মন্দা শুরু হয়ে গেছে। এর ধাক্কা পড়বে বাকি বিশ্বে। তিনি আরো বলেছেন, মন্দার হার সা¤প্রতিক অতীতের সব নজির ছাড়িয়ে যাবে। কিন্তু যেসব দেশ সরাসরি মন্দার কবলে পড়বে না, সেখানে প্রভাব কিছু কম হওয়ার সম্ভাবনা দেখেছেন আইএমএফপ্রধান। বাংলাদেশের অর্থনীতিও এ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে বলে মনে করেন সরকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, দেশ সবচেয়ে বড় সংকটে পড়বে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও মূল্যস্ফীতি নিয়ে। পাশাপাশি টাকার মান আরো কম ও মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে যাওয়ারও শঙ্কা রয়েছে। এতে ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতা কমে গিয়ে ভোগান্তি বাড়িয়ে দেবে বলে মনে করেন তারা।
মূলত, করোনা-উত্তর বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার কার্যক্রম শুরু হওয়ার লগ্নে রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে কালো মেঘের ছায়া নেমে এসেছে। আইএমএফসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বারবার ভবিষ্যদ্বাণী করছে, বিশ্ব অর্থনীতি ভয়াবহ মন্দার দিকে ধাবিত হচ্ছে। মার্কিন অর্থনীতি পরপর দুই প্রান্তিকে সংকুচিত হলেই মন্দা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এ বছর মার্কিন অর্থনীতি ধারাবাহিকভাবে দুই প্রান্তিকে সংকুচিত হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপির দুই তৃতীয়াংশ আসে ভোক্তা ব্যয় থেকে। মার্কিন জনগণ তাদের ভোগ ব্যয় কমিয়ে দিয়েছে। তারপরও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন বিশ্ব নেতারা। বিভিন্ন দেশ নিচ্ছে আগাম প্রস্তুতি। বাংলাদেশও বসে নেই। এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্ভাব্য মন্দার প্রভাবে আগামী বছর দেশের অর্থনীতিতে চাপ আরো বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। বলেছেন প্রস্তুতির কথাও। পরিস্থিতি মোকাবিলায় দেশের মানুষকে তিনি প্রতি ইঞ্চি জমিতে শস্য আবাদের পরামর্শ দিয়েছেন। যাতে করে উৎপাদন বাড়িয়ে মানুষ সঞ্চয় করতে পারে। খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি না হয়। অপচয় বন্ধ করতে সরকারি সংস্থাগুলো নির্দেশনা দিয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি মন্দার পরিপ্রেক্ষিতে আগামী অর্থবছরের বাজেট কেমন হবে, তা নিয়ে এখনই চিন্তাভাবনা করার কথা জানিয়েছেন।
সারা বিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দা হলে বাংলাদেশের ওপরও এর প্রভাব পড়বে বলে মন্তব্য করেছেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। গত অক্টোবরে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, বড় রাষ্ট্রগুলোর ওপর যেভাবে প্রভাব পড়বে বাংলাদেশে সেভাবে পড়বে না। কারণ বিশ্বের উচ্চ অর্থনীতির সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনীতির যোগাযোগ অতটা সরাসরি নয়। বাংলাদেশের অর্থনীতির সঙ্গে বড় রাষ্ট্রগুলোর অর্থনীতির যোগাযোগ ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে নানাভাবে। সংকট মোকাবিলার কৌশল সম্পর্কে মন্ত্রী বলেছেন, আমাদের নিজেদের ঘর গোছাতে হবে। মোটকথা আমাদের ব্যয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে হবে।
বাংলাদেশে কী ধরনের চ্যালেঞ্জ আসতে পারে : বিশ্বমন্দার প্রভাবে বাংলাদেশে কী ধরনের চ্যালেঞ্জ আসতে পারে- জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ ভোরের কাগজকে বলেন, খুব বেশি আতঙ্কিত হওয়ার মতো পরিস্থিতি নেই। কারণ বাংলাদেশে খুব বেশি প্রভাব পড়বে না। তিনি বলেন, ইতোমধ্যেই আমাদের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। সরকার বিষয়গুলো নিয়ে ভাবছে। তাই চিহ্নিত সমস্যা দ্রুত সমাধান করা হলে মন্দার প্রভাব বাংলাদেশকে খুব বিপদে ফেলতে পারবে না। ড. সালেহ উদ্দিন বলেন, সরকার যত দক্ষতার সঙ্গে পরিকল্পনা করে এগুলো মোকাবিলা করতে পারে, তত দ্রুত অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে। তিনি আরো বলেন, এখন টাকা পাচার, হুন্ডি বন্ধ, খেলাপি ঋণ ঠেকানো ও আদায় বাড়ানো জরুরি। তাহলে বৈদেশিক মুদ্রা ও তারল্য সংকট হবে না। মূল্যস্ফীতির বল্গা টেনে ধরতে পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে

কঠোর নজরদারি বাড়াতে হবে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম ভোরের কাগজকে বলেন, বাংলাদেশে মন্দার কোনো প্রভাব আমি দেখছি না। কারণ আমাদের রপ্তানি, রেমিট্যান্স, বিদেশি ঋণ সহায়তা- সব মিলিয়ে ভালো অবস্থানে আছে। তিনি বলেন, বিশ্বব্যাংক এবং আইএমএফ বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি কমবে বলে আভাস দিয়েছে। যদিও প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের ওপরে রাখা হয়েছে। কিন্তু তা আগের চেয়ে কম। সুতরাং মন্দা হবে না। তবে প্রবৃদ্ধি কিছুটা কমার আশঙ্কা আছে। কারণ বিশ্বমন্দায় বাংলাদেশের দুটি খাতে কিছুটা প্রভাব পড়বে। প্রথমত, রপ্তানি কমবে। কারণ, বাংলাদেশের রপ্তানির বেশির ভাগই ইউরোপ-আমেরিকায় যায়। কিন্তু অর্থনৈতিক মন্দার কারণে তাদের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাবে। এতে চাহিদা কমবে। ফলে তারা ক্রয়াদেশ কমিয়ে দেবে। দ্বিতীয়ত, রেমিট্যান্স কমবে। যদিও বাংলাদেশের বেশির ভাগ রেমিট্যান্স আসে মধ্যপ্রাচ্য থেকে। কিন্তু মন্দা এলে ওইসব দেশও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এতে তেলের চাহিদা কমবে। ফলে প্রবাসী শ্রমিকদের আয়ও কমবে। তিনি আরো বলেন, পরিস্থিতি মোকাবিলায় এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে। এক্ষেত্রে আমাদের বিদেশনির্ভরতা কমাতে হবে। কীভাবে দেশের ভেতরের উৎপাদন ও চাহিদা ঠিক রাখা যায়, সেদিকে নজর দিতে হবে। বিশ্বমন্দা মোকাবিলায় নি¤œ-আয়ের মানুষের জন্য খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষ করে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি আরো বাড়াতে হবে।
বিশ্বমন্দার বিষয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দার আশঙ্কা বাংলাদেশকেও চিন্তায় ফেলেছে। কারণ বাংলাদেশ বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে বহুপাক্ষিকভাবে জড়িত। আমদানি, রপ্তানি, রেমিট্যান্স এবং বৈদেশিক বিনিয়োগের বিষয়ে বৈশ্বিকভাবে জড়িত। তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বৈশ্বিক সংকটের প্রভাব ইতোমধ্যে পড়তে শুরু করেছে। এ অবস্থায় বিশ্বমন্দা এলে আরো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় দুটি পদক্ষেপ নিতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে, ডলারের দাম যৌক্তিক জায়গায় রাখা। দ্বিতীয়ত, মূল্যস্ফীতি কমিয়ে ৫ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনা। এটি করতে না পারলে সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে।
বিশ্বমন্দার কবলে বাংলাদেশের প্রধান প্রধান রপ্তানিকারক দেশও থাকবে বলে জানিয়েছেন সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান। ভোরের কাগজকে তিনি বলেন, মন্দার প্রভাব আমাদের রপ্তানি চাহিদার ওপরও পড়বে। সুতরাং আমাদের চেষ্টা করতে হবে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বজায় রেখে রপ্তানি বাড়ানো। এ অর্থনীতিবিদ বলেন, রপ্তানি খাতে গত ৬ মাসে ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। তবে গত দুই মাসে ক্রয়াদেশ কিছুটা কমেছে। তার প্রভাব আগামী মাসগুলোতে পড়তে পারে। আবার মন্দা হলে তারও একটা প্রভাব পড়বে। সুতরাং রপ্তানির প্রবৃদ্ধি যেন ধরে রাখতে পারি সেজন্য চেষ্টা করতে হবে। ড. মোস্তাফিজ বলেন, আমাদের টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে, তাতে রপ্তানিকারকরা কিছুটা সুবিধা পাবে। কিন্তু বৈশ্বিক বাজারে চাহিদার একটি সংকোচন হবে বলে মনে হয়। সেক্ষেত্রে আমাদের আঞ্চলিক বাজারগুলোতে জোর দিতে হবে। তিনি বলেন, এ সময়ে উৎপাদন কার্যক্রম যেন ব্যাহত না হয় সেজন্য গ্যাস বিদ্যুৎ সরবরাহ ঠিক রাখতে হবে। সেটা রপ্তানিমুখী এবং আমদানি প্রতিস্থাপক চাহিদা- দুই ক্ষেত্রের উৎপাদন কার্যক্রমই ঠিক রাখতে হবে। আমাদের অর্থনীতির একটি বড় অংশ অভ্যন্তরীণ বাজারমুখী কর্মকাণ্ডের ওপর নির্ভর করে।
সরকারের প্রস্তুতি : অর্থনীতিবিদদের পাশাপাশি সরকারি কর্তাব্যক্তিরাও মনে করেন, মন্দা দেখা দিলে বাংলাদেশও তার বাইরে থাকবে না। তবে বাংলাদেশ কতটা চাপে পড়বে, তা নির্ভর করছে মন্দার ব্যাপকতার ওপর। সঠিক পদক্ষেপ নিলে সংকট এড়ানো সম্ভব। তবে আগামী কিছুদিন যে বিশ্ব অর্থনীতি ভালো যাবে না, তা বিভিন্ন সংস্থার পূর্বাভাস থেকে নিশ্চিত। এজন্য সরকার বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানিয়েছেন তারা। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও প্রস্তুতির বিষয়ে কথা বলেছেন। তিনি বলেন, আমাদের উৎপাদন বাড়াতে হবে এবং সেগুলো সংরক্ষণ করতে হবে; যাতে আমাদের দেশ কোনো বিপদে না পড়ে। সরকারপ্রধান বলেন, করোনা ভাইরাস এবং যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা ব্লক ও রাশিয়ার যুদ্ধসংক্রান্ত নিষেধাজ্ঞা ও পাল্টা নিষেধাজ্ঞার প্রভাবে বিশ্ব এখন অর্থনৈতিক মন্দার মুখে পড়েছে। ফলে খাদ্যদ্রব্যের দাম সবার ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। এছাড়া বিদ্যুৎ, জ্বালানি, পরিবহনসহ সবকিছুর দাম বাড়ানো হয়েছে। সংরক্ষণ সক্ষমতা সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকার চাল মজুতের জন্য বেশ কিছু আধুনিক গোডাউন স্থাপন করেছে। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত খাদ্য সামগ্রীর জন্য এ ধরনের গোডাউন জরুরিভাবে প্রয়োজন। তিনি আরো বলেন, সরকার দেশের বিভিন্ন স্থানে যে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলছে, তার মধ্যে খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের ওপর গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, মন্দা দেখা দিলে সরকার তার প্রভাব মোকাবিলায় একটি বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজ নেয়ার পরিকল্পনা করছে। দেশের অর্থনীতিতে করোনা মহামারির প্রভাব মোকাবিলায় সরকার ২৮টি প্যাকেজ নিয়েছে। আগামীতে প্রয়োজন হলে একই ধরনের প্যাকেজ ঘোষণা করতে পারে সরকার। বৈদেশিক মুদ্রার মজুত সুরক্ষিত রাখতে বিভিন্ন পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে। ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসী আয় বাড়াতে সরকার রেমিট্যান্সের বিপরীতে প্রণোদনার হার বাড়াতে পারে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়