রাজধানীর বাজারদর : সবজিতে স্বস্তি মাছ-ডিমের দাম অপরিবর্তিত

আগের সংবাদ

বই সংকটে উৎসবে ছন্দপতন : শিক্ষার্থীদের হাতে দেয়া হয় একটি-দুটি অথবা গতবছরের বই > ফেব্রুয়ারির আগে সব শিক্ষার্থী বই পাবে না

পরের সংবাদ

পার্ক স্ট্রিটে নিউ ইয়ার্স

প্রকাশিত: জানুয়ারি ১, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ১, ২০২৩ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

আমির খসরুর বিখ্যাত ফারসি পঙক্তি- ‘অগর ফিরদৌস বার রু-ই জমিন আস্ত/হামিন আস্ত-ও হামিন আস্ত-ও হামিন আস্ত। বাংলায় অনুবাদ করলে দাঁড়ায় ‘পৃৃথিবীতে কোথাও যদি স্বর্গ থাকে তবে এটিই সেটা।’ নিউ ইয়ার্স ইভে কলকাতার পার্ক স্ট্রিট সম্পর্কে আমার অনুভূতি বয়সের ষাটের কোটায় এসেও পাল্টাল না। কলকাতায় যত ফূর্তি এই এক কিলোমিটার রাস্তার দুধারে। এ রাস্তায় এদিন ভেঙে পড়ে মফস্বল। শহর এখন পালিয়ে যায় ক্লাবে বা ব্যক্তিগত পার্টিতে। পার্ক স্ট্রিট আজ মধ্যবিত্তদের মহাফেজখানা। বারে লাইন পড়বে। জায়গা পাওয়া মানে লটারি পাওয়া। সন্ধ্যে বেলায় স্ত্রী-পুত্র-কন্যা নিয়ে ভুভুজেলার উদ্দাম শব্দ। অ্যালেন পার্কে হুল্লোড়। টিভিতে দেখা বিটকেল চশমা-টুপিতে অদ্ভুত সাজ। একটু হইচই আর ছোটখাটো হুজ্জোতি করে, লোকেরা মদ-খাবার পেট পুরে খেয়ে সঙ্গিনীকে বগলদাবা করে ‘হ্যাপ্পি নিউ ইয়ার’ বলে বাড়ি ফিরবেন।
রাস্তার ওপর নিষ্পাপ মজাও আছে। যেমন সান্তাক্লজের টুপি পরিয়ে দিয়ে কিছু আদায় করা। এমন মজা দেখতে গিয়েই প্যান্টের পাশ-পকেট থেকে টাকা ধাঁ। পকেট হালকা। এইদিনের দামাল রাতে আর এক উৎপাত হলো : বাইক-বাহিনীর উল্লাস-সফর। মৌলালির চার্চের কাছ থেকে পার্ক স্ট্রিটের দিকে ছুটবে অন্তত পঞ্চাশটি মোটরসাইকেল, যার সওয়ারি কয়েকজন মহিলাও। পুলিশ ধরলেও পেটি কেস দিয়ে সকালেই ছেড়ে দেবে। গণ্যমান্য লোকদের ছেলেমেয়েরা যে মাঝরাতে শহর দখল করতে বেরিয়ে পড়ে তা কি পুলিশ জানে না! কে যাবে হ্যাপা সামলাতে!
আসলে পার্ক স্ট্রিট ছিল গোরস্তানে যাওয়ার পথ। পরে হলো অভিজাত সাহেবপাড়া। শহরটার বুকে এক টুকরো ‘কলোনিয়াল ক্যালকাটা’। যে কলকাতা তার ক্রমশ ফিকে হয়ে আসা বিলিতিয়ানার গরিমাটুকু টিকিয়ে রাখছে প্রাণপণ। পার্ক স্ট্রিট মানে পিটার ক্যাটের চেলো কাবাব, অক্সফোর্ডে বই-আড্ডা, অবপ্যাঁ-র কাফে-আভিজাত্য। স্টিফেন কোর্টের পোড়া বাড়িটা। কেএফসি, ম্যাকডোনাল্ডস, বাস্কিন রবিন্স। হ্যাংওভারে ভর করে পেছন ফিরলে, ট্রিংকাজ বা ব্লু ফক্সের সন্ধেগুলো টুকি দিয়ে যায়। ফ্রি স্কুল স্ট্রিট-সদর স্ট্রিটে টইটই ঘুরে, টুং ফং-এর দুপুরে নিরালা-যাপন হাতছানি দেয়।
লম্বা পথটাকে তখনকার কলকাতা চিনত গোরস্তান থেকে চৌরঙ্গি যাওয়ার পথ হিসেবেই। এখনকার রাজপথে টিকে আছে শুধু পার্ক স্ট্রিট আর সার্কুলার রোডের মোড়ের বিশাল সমাধিক্ষেত্রটাই, যেখানে শায়িত এশিয়াটিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা উইলিয়াম জোন্স, ডিরোজিয়ো, উনিশ শতকের সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি স্যার জন রয়েডস, সর্বধর্ম সমন্বয়পন্থি ব্রিটিশ সেনা চার্লস স্টুয়ার্ট ওরফে হিন্দু স্টুয়ার্ট, দুঁদে পুলিশকর্তা ইলিয়ট সাহেব, চিকিৎসক চার্লস ওয়েস্টনের মতো নামজাদা মানুষরা। এখনকার লোরেটো হাউস ছিল তখনকার ভারতের সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি স্যার ইলাইজা ইম্পে-র বাড়ি। সবুজেঘেরা বিশাল বাগানবাড়িটার আশপাশে তখন পোষা হরিণরা চরে বেড়াত। সেই ডিয়ার পার্কের সৌজন্যেই লম্বা রাস্তাটার নাম হয়ে যায় ‘পার্ক স্ট্রিট’।
এ যুগের পার্ক স্ট্রিটের একেবারে মুখে দাঁড়িয়ে করিন্থিয়ান স্থাপত্যের ঐতিহ্যবাহী, এশিয়াটিক সোসাইটির দুধসাদা বাড়িটা। যে বাড়িতে সাপ্তাহিক অধিবেশনে কে না আসতেন সে কালে! উইলিয়াম জোন্সের হাতে গড়া বাড়িতে, পায়ে পায়ে আঠারো থেকে একুশ শতকে এসেও যার গায়ে ঔপনিবেশিক দিনগুলোর গন্ধ। এশিয়াটিক সোসাইটি। বাংলা তথা ভারতের ইংরেজি শিক্ষায় আধুনিক হয়ে ওঠার পেছনেও তো রয়ে গেছে এক চিলতে পার্ক স্ট্রিট। এশিয়াটিক সোসাইটির উলটো দিকের ফুটপাতে বেঙ্গল ক্লাবের বাড়িটায় একদা বাস করতেন লর্ড মেকলে। সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের বিশাল বাড়িটা যেখানে, আঠারো শতকে সেখানেই ছিল বিরাট এক গুদামঘর। সেই বাড়িটা কিনে ফেললেন অভিনেত্রী এসথার লিচ। তার হাতেই ভোল বদলে গুদামঘর হয়ে উঠল সাঁ সুসি থিয়েটার। একদিন কোনোভাবে আগুন লেগে গিয়েছিল উইংসের পাশে দাঁড়ানো এসথারের পোশাকে। ‘আগুন! আগুন!’ চিৎকার করতে করতে ছুটছেন তিনি। ছোটাছুটি পড়ে গেল প্রেক্ষাগৃহে। শেষমেশ যতক্ষণে বের করে আনা হলো অভিনেত্রীকে, তখন অনেকখানিই পুড়ে গিয়েছে শরীর। এসথার মারা গেলেন দু’দিন পরেই। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সেই থিয়েটার-হল আর লাগোয়া বাড়িটা কিনে জেসুইটরা গড়ে তুললেন সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ।
ব্রিটিশ আমলের শেষ দিক থেকেই পার্ক স্ট্রিটজুড়ে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছিল একের পর এক হোটেল রেস্তোরাঁ। ইতালীয় ‘ফ্লুরিজ’-এর কেক-কফি-ব্রেকফাস্ট থেকে চিনে ‘পিপিং’। ওয়ালডর্ফ, মোক্যাম্বো, ব্লু-ফক্স, ট্রিংকাজ-এ বিলিতি-কন্টিনেন্টাল খানা, তারা-ভরা স্কাই রুম-এ স্টেক-বিলাস বা লেজেন্ড হয়ে ওঠা প্রন ককটেল, মুলাঁ রুজ-এ সিজলার, ম্যাগনোলিয়ায় আইসক্রিম, পার্ক স্ট্রিট কলকাত্তাইয়া ভোজনবিলাসীর স্টেটাস সিম্বল! ঘুরে ফিরে আসা অঞ্জন দত্ত, বাংলা ব্যান্ডের গানের আনাচ-কানাচেও। সত্যজিতের ছবিতে ‘ওয়ালডর্ফ’ চিনেছে বাঙালি। ‘ব্লু-ফক্স’-এর দরজা দিয়ে টলতে টলতে বেরিয়ে এসেছেন কলঙ্কিত ‘নায়ক’ উত্তমকুমার। হালফিলের বলিউডি ‘পরিণীতা’য় মুলাঁ রুজ-এ ডিনার জমে উঠেছে রেখার লাস্যে। রাজপথ লাগোয়া ছোট্ট গলির তস্য ছোট্ট তিব্বতি দোকানের ধোঁয়া-ওঠা মোমো-থুকপায় উষ্ণতা খুঁজেছে ভালোবাসা। ছুটির দুপুরে সাধ্যের বাইরে থাকা অভিজাত হোটেল-রেস্তোরাঁয় খানাপিনার সাধ পিপিংয়ে শার্ক ফিন স্যুপের বাটিতে, গোল্ডেন ড্রাগনের চিনা খানার প্লেটে সপরিবার মিটিয়ে গেছে মধ্যবিত্ত বাঙালি। সেকেলে কলকাতার ফুটপাতে বাক্সবন্দি কেকের পসরার সুবাস, কলেজের দিনগুলোতে ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের ছোট্ট ছোট্ট তিব্বতি রেস্তোরাঁয় প্রেম, রাসেল স্ট্রিট, ক্যামাক স্ট্রিট, সদর স্ট্রিট, কিড স্ট্রিটে ইতিউতি ছড়িয়ে থাকা অ্যাংলো পাড়ার চিকেন স্টেকের সুবাস।
আমাদের বড় হয়ে ওঠাও এই রাস্তার হাত ধরেই। পার্ক হোটেল ছাড়িয়ে অলি পাব বা অলিম্পিয়া। তার এক তলায় জমজমাট নিশিঠেক, দোতলায় ‘ফ্যামিলি’ সুরা-পানের জায়গা। শিল্পী-সাহিত্যিক-অভিনেতা কিংবা সাধারণ মধ্যবিত্ত, সবারই ভালোবাসায় মোড়া রইল আদুরে ‘অলি’। এখনো কলকাতার বহু আঠারো পেরোনোর মদিরায় হাতেখড়ির ঠিকানা। ট্রিংকাজ, ব্লু ফক্স-এ সুরার সঙ্গে জমল লুই ব্যাঙ্কস, স্কিনি অ্যালি, ঊষা উত্থুপদের গানভাসি সন্ধ্যা। ব্লু-ফক্সে তখন গায়ক তালিকায় অমৃক সিংহ অরোরাও। তবে এ কলকাতার আরো বেশি বড় হয়ে ওঠার ক্রেডিট অবশ্য মোক্যাম্বো-মুলাঁ রুজ-এ প্যাম ক্রেন, মিস লিলি, মিস লোলাদের নাচে মোড়া আনন্দ, কিংবা অন্ধকার মোড়া অলিগলির সাবালক আমোদের। আঠারো থেকে আটষট্টিকে পাগলপারা করে তোলা সেই প্যাম ক্রেন অবশ্য পরে বিয়ে করে চলে গিয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়ায়। নিশি-বিনোদনের সংজ্ঞা এখন বদলে গেছে নাইট ক্লাব তন্ত্র-র উদ্দামতায়, সামপ্লেস এল্স-এর গান-ঠেকে, সদর স্ট্রিটের কাফেতে।
ইদানীং অবশ্য সারা বছরই বহাল ঝিলমিল আলোর সাজ। ডিসেম্বর পড়তে না পড়তেই একুশ শতকের ঝাঁ-চকচক শহরে এখনো ‘অল রোডস লিড টু পার্ক স্ট্রিট’! নতুন করে খুলেছে ফ্লুরিজ, পিটার ক্যাট। বাড়িছাড়া স্টিফেন কোর্ট, কুইন্স ম্যানসনের বহু পরিবার। বন্ধ হয়ে গিয়েছে পার্ক স্ট্রিটের আইকন হয়ে ওঠা মিউজিক ওয়ার্ল্ডও। বছর-শেষের কার্নিভাল শুরু এই রাস্তারই অ্যালেন্স পার্ক-এ। সব মিলিয়ে গোরস্তানের পার্ক স্ট্রিট এখন জীবনের ঠিকানা। বদলে গিয়েছে নামটাই। মাদার টেরিজা সরণি! নাহ, সে সরণিতে এখন সে আভিজাত্য নেই। যারা আসেন তারাও জানেন না এর গরিমা। কাজেই যৌবনের বার হপিং, উদ্দাম নাচ, গানের ঝংকার, সঙ্গিনীর কোমর জড়িয়ে রাস্তায় টলমলে হাঁটা। না নেই। এখন ভিড় সামলানো পুলিশের নিদান-চলো নিয়ম-মতে, চলো সমান পথে, দূরে তাকিয়ো নাকো, ঘাড় বাঁকিয়ে নাকো, চলো সমান পথে। কী বিপদ! তবু পার্ক স্ট্রিট পার্ক স্ট্রিটই।

অমিত গোস্বামী : কবি ও লেখক।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়