ঢাকা কলেজে কমিটির দাবি : ছাত্রলীগ সভাপতির গাড়ি আটকে দিল বিক্ষুব্ধ নেতারা

আগের সংবাদ

প্রতিটি ব্যাংকেই টাকা আছে > ছাত্রলীগের সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী : বিএনপি-জামায়াত যেন ক্ষমতায় না আসতে পারে

পরের সংবাদ

বিচ্যুত হননি যিনি

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ডিসেম্বর ৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

মানুষটি ছোটখাটো, চুল মাঝখানে সিঁথি করে আঁচড়ানো, চুপচাপ বেশির ভাগ সময়। কথা বলেন কম, সালাম দিলে কখনো স্মিত হাস্যে, কখনো নীরবে তা গ্রহণ করেন। তোফাজ্জল হোসেনের কথা মনে হলে এ চেহারাটিই আমার মনে পড়ে। যখন ছাত্র ছিলাম, তখন বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার থেকে শুরু করে পাবলিক লাইব্রেরি, ব্রিটিশ কাউন্সিল থেকে শুরু করে ইউসিস- সব গ্রন্থাগারেই যেতাম, বিশেষ করে ইউসিসে। এবং যেতাম পাকিস্তান কাউন্সিলেও। সেখানে তখন কাউন্সিলের পরিচালক তোফাজ্জল হোসেন। লাইব্রেরিতে গেলেই দেখা পেতাম। হয়তো তার অফিসটি ছিল ভেতরে কোথাও। কিন্তু প্রায়ই লাইব্রেরিটা ঘুরে যেতেন।
স্বাধীনতা পাওয়ার পর বিএসআরআর কাউন্সিল মিলে হয়ে গেল বাংলাদেশ পরিষদ। কাউন্সিল থেকে এর পরিধি আরো বড়। তোফাজ্জল হোসেন এটিকে গণমুখী করার জন্য পরিকল্পনাও দিয়েছিলেন। কিন্তু তারপর বোধহয় পরিষদ বিলুপ্ত হলো। তিনি চলে এলেন সরাসরি সরকারি চাকরিতে, তথ্য অধিদপ্তরে। আজকের বিএমের উল্টোদিকে দোতলায় ছিল লাইব্রেরিটি। স্বাধীনতার পর দৈনিক বাংলা/বিচিত্রায় সাংবাদিকতা শুরু করি, ১৯৭২-এর শেষের দিকে [নাকি ’৭৩-এর শুরুতে?] বিচিত্রা ১৮ মে ১৯৭২ সালে সাপ্তাহিক হিসেবে প্রকাশিত হয় বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি প্রচ্ছদ করে। তারপর দীর্ঘ এক দশক বিচিত্রাই ছিল তরুণদের মুখপত্র এবং সবচেয়ে প্রভাবশালী পত্রিকা। সাংবাদিক হওয়ার পর যথারীতি প্রেস ক্লাবের সদস্য হই, প্রেস ক্লাবে যাতায়াত বাড়ে, সেখানে দেখি তোফাজ্জল ভাইকে। তখন লায়েক হয়েছি, তার সঙ্গে পরিচয় হয়েছে এবং তিনি ভাইয়ে পরিণত হয়েছেন। জানি তিনি বাংলাদেশ পরিষদের কর্মকর্তা, কিন্তু প্রেস ক্লাবে প্রায়ই আসেন, কখনো একা বসে চা খান অথবা অন্য কারো সঙ্গে গল্প করেন। তার অফিস ঠিক উল্টোদিকে। মাঝে মাঝে মনে হয়েছে উনি কি সাংবাদিকতাও করেছেন? তখন তো আর অতো বিশদ করে তার পরিচয় জানতে চাইনি। পরে জেনেছি, সাংবাদিক হিসেবেও কাজ করেছেন পঞ্চাশ দশকে। তখনো যেতাম পরিষদে। তারপর যোগ দিয়েছি বিশ্ববিদ্যালয়ে, পরিষদে, প্রেস ক্লাবে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। তিনিও তখন বোধহয় তথ্য অধিদপ্তরে। সুতরাং তার শান্ত সৌম্য চেহারা আর নজরে পড়ত না।
এটা স্বাভাবিক যে, আমাদের সঙ্গে তার ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে উঠবে না। বয়স আর পেশার কারণে। কিন্তু ঢাকার সাংবাদিক সাংস্কৃতিক জগতে যে তিনি অপরিচিত নন, সেটি বুঝতাম। কিন্তু পঞ্চাশ-ষাটের দশকে তার ভূমিকা কী ছিল, সেটি আমাদের প্রজন্মের কাছে ছিল অজানা। তা জেনেছি পরে। গণ্যমান্য হিসেবেই সমীহ করতাম, আমাদের সংস্কৃতিতে তখন এই বোধটি ছিল।
পাকিস্তান কাউন্সিলে যখন ছিলেন, তখনো চাইতেন পাকিস্তানি না হয়ে বাঙালি থাকতে। অনেকের স্মৃতিকথায় এর উল্লেখ আছে। ১৯৭২ সালে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা এটাই বুঝতে পেরেছিলাম সরকার এ দেশের জনসাধারণের ওপর যা চাপিয়ে দিতে চান, তা জনস্বার্থবিরোধী, জনগণ কখনো তা মেনে নেননি। আবার জনসাধারণ যা চেয়েছেন, সরকার তার নীতি অনুযায়ী বিরোধিতা করেছেন। আমরা সরকারি কর্মচারী ছিলাম এ কথা যেমন সত্যি, তেমনি এ দেশের জনসাধারণের একটা অংশ ছিলাম এ কথাও সমান সত্যি। আমরা সব সময়ই এই দুই সত্যের সমতা রক্ষা করার চেষ্টা করেছি।
এ কথা যে কতটা সত্যি বোঝা যাবে কাউন্সিলের পাঠাগার সম্পর্কিত নীতির বিরোধিতা করে বাঙালিত্ব প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টায়। পাঠাগার সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আগেকার পাকিস্তানপন্থি বইগুলো নষ্ট করা হয়নি। রেফারেন্সের জন্য আলাদা করে রাখা হয়েছে। ভবিষ্যতে কেউ যদি গবেষণা করতে চান তাদের কাজে লাগবে।… পাঠাগারের জন্য বিদেশ থেকেও বই আনতে হবে। আগে ভারতীয় সাহিত্য বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের কোনো সংগ্রহ ছিল না বললেই চলে।’
তিনি জানিয়েছিলেন, পাকিস্তান আমলে বেশ কিছু বই নিষিদ্ধ করে নষ্ট করে ফেলতে বলা হয়েছিল। তোফাজ্জল বলেছিলেন, ‘ওরা যে বই নিষিদ্ধ ঘোষণা করে পুড়িয়ে ফেলতে বলেছিল তার কোনোটাই আমি নষ্ট করিনি। যেমন বদরুদ্দীন উমরের বইগুলি। কি ন্যক্কারজনক কাজই না ওরা করেছিল। আমি তার বইগুলি নিষিদ্ধ ঘোষণার পর সরিয়ে রেখেছিলাম। এখন লাইব্রেরিতে রেখেছি।’
এই সাক্ষাৎকারটি উদ্ধৃত করছি এ জন্য যে, রাষ্ট্র ও সমাজ সংস্কৃতি সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায় এখানে। স্বাধীন দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা হবে এ নিয়ে তার আশা ছিল। তিনি বলেছেন, ‘বর্তমানে প্রতিটি রাজনৈতিক দলই সমাজতন্ত্রের কথা বলছেন। আমাদের সরকারের চার নীতির একটি সমাজতন্ত্র। অথচ এ দেশের বহু লোক সমাজতন্ত্র সম্পর্কে পরিচিত নন। আমরা পাঠাগারের মাধ্যমে দেশের সব জায়গার মানুষের কাছে সমাজতন্ত্রের বাণী নিয়ে যেতে পারি। এর ফলে জনগণের সঙ্গে সরকারের প্রথাগত যে একটা দূরত্ব থাকে সেটা বহুলাংশে কমিয়ে আনা যাবে। আমরা এই দূরত্ব সম্পূর্ণ অপসারণের জন্যই কাজ করব।’
বাংলাদেশ পরিষদকে তিনি ব্রিটিশ কাউন্সিলের মতো করতে চেয়েছিলেন। সে প্রস্তাবনা কার্যকর হলে অন্যরকম হতো। কিন্তু আমাদের নীতিনির্ধারকদের শিক্ষা-সংস্কৃতি সম্পর্কে পরামর্শ দেয়া বাতুলতা। তোফাজ্জল হোসেন বলেছিলেন- ‘এই পরিষদ ব্রিটিশ কাউন্সিলের মতো একটি প্রতিষ্ঠান হতে পারে, যার কাজ হবে বাংলার সাহিত্য শিল্প ও সংস্কৃতিকে আমাদের রাষ্ট্রনীতির পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে দেশে ও বিদেশে তুলে ধরা, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যাপকভাবে পাঠাগার স্থাপনের মাধ্যমে নবজীবনে সর্বস্তরে জ্ঞানের আলো পৌঁছে দেয়া, গ্রামাঞ্চলের জন্য ভ্রাম্যমাণ পাঠাগারের ব্যবস্থা করা। বিভিন্ন অঞ্চলের স্কুল-কলেজে জাতীয় ভাবধারায় রচিত পুস্তকাবলি সরবরাহ করা, রাষ্ট্রভাষা বাংলাসহ প্রয়োজনীয় বিদেশি ভাষা শিক্ষার ব্যবস্থা করা এবং শিক্ষা ও সংস্কৃতিবিষয়ক অনুষ্ঠান প্রদর্শনী ইত্যাদির মাধ্যমে বাংলার জাতীয় জীবনকে তুলে ধরা ইত্যাদি।’
এ প্রস্তাব বিবেচনা দূরে থাকুক, বাংলাদেশ পরিষদ পরিপূর্ণই বিলুপ্ত করে দেয়া হয়। পাকিস্তান কাউন্সিল/বাংলাদেশ পরিষদ বা তথ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তা ছিলেন তোফাজ্জল হোসেন, সেটি তার বড় পরিচয় নয়। তিনি পঞ্চাশ দশকে যারা সংস্কৃতির ক্ষেত্রে নতুন পথ দেখাচ্ছিলেন, তাদের একজন। ১৯৫০-এর দশকে যারা এ যাত্রা শুরু করেছিলেন, তাদের অধিকাংশ ছিলেন স্কুল-কলেজের ছাত্র, কয়েকজন বিশ্ববিদ্যালয়ের। আমি মাঝে মাঝে ভেবে অবাক হই, এত অল্প বয়সে কেউ রাজনীতিতেও আসতে পারেননি। ৫০ দশকের অন্যতম ছিলেন হাসান হাফিজুর রহমান। ১৯৫০-এর দাঙ্গার ওপর প্রথম সংকলন, ২১ ফেব্রুয়ারির ওপর প্রথম সংকলন ও স্বাধীনতার দলিলপত্র আমাদের ইতিহাসের তিনটি মাইলফলক সংকলনের সঙ্গেই যুক্ত ছিলেন হাসান হাফিজুর রহমান।
১৯৫০ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা যখন সব লণ্ডভণ্ড করে দিচ্ছে, তখন সেই আবহের মধ্যে হাসান হাফিজুর রহমান ‘দাঙ্গার গল্প’ এবং ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ প্রকাশ করেছিলেন। এ দুটি সংকলনে যারা লিখেছিলেন ও এঁকেছিলেন, তারা ও তাদের সাথিরা প্রায় ছয় দশক বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ সংকলনে যে দুটি গান সংকলিত হয়েছিল, তা লিখেছিলেন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ও তোফাজ্জল হোসেন। এ থেকেই বোঝা যায় পঞ্চাশ দশকেই লেখক ও কবি হিসেবে তার উত্থান হয়েছিল।
‘একুশে ফেব্রুয়ারী’র সঙ্গে যুক্ত হয়েও তিনি কেন সাহিত্যচর্চা করলেন না তার সতীর্থদের মতো, সেটির জবাব তিনিই দিতে পারতেন। খুব একটা লেখেননি, লিখলেও প্রকাশ করেননি। ইউসিসে থাকার সময় বই অনুবাদ করেছেন দুটি। ওই সময় ইউসিস থেকে ক্রাউন মাটদের সুন্দর অনুবাদ প্রকাশিত হতো এবং পঞ্চাশের লেখকরা যারা তখন পরিপূর্ণ যুবক, অর্থের কারণে ওই বইগুলো অনুবাদ করতেন।
তিনি লেখালেখি আবার শুরু করেন চাকরির শেষ পর্যায়ে এসে। ১৯৭৫ সালের পর তাহেরউদ্দিন ঠাকুর যিনি তোফাজ্জল হোসেনের কাছে সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি নিয়েছিলেন, তাকে ইচ্ছে করে বদলি করেন তার দুধাপ নিচের পদে। তখন তথ্য সচিব তাকে এই বিড়ম্বনা থেকে মুক্ত করতে তথ্য মন্ত্রণালয়ের জনসংখ্যা সেলে বদলি করেন। তিনি এটি নতুনভাবে গড়ে তোলার জন্য মন দেন, সঙ্গে সঙ্গে এ বিষয়ে লেখার পরিকল্পনাও করেন।
ওই সময় জনসংখ্যা বিষয়ক বাংলা বই তেমন একটা ছিল না। এ পর্যায়ে তিনটি বই লিখেছেন, তথ্যসমৃদ্ধ, সমাজ বিজ্ঞানীর দৃষ্টি থেকে, যদিও তিনি বাংলার ছাত্র। বই তিনটি হচ্ছে, বিপন্ন পৃথিবী বিপন্ন জনপদ, জনসংখ্যা বিস্ফোরণ ও আগামী পৃথিবী এবং শিশু : বিশ্ব ও বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট। এ বইগুলো বেরিয়েছে তিন দশক আগে। তখনো পরিবেশ নিয়ে তেমন চিন্তা-ভাবনা শুরু হয়নি। জনসংখ্যা আশীর্বাদ না অভিশাপ, সে বিতর্ক চলছে। জনসংখ্যার অতি বৃদ্ধি পরিবেশ বিপন্ন করতে পারে এবং জনপদ ও পৃথিবী হবে বিপন্ন তা হলে আগামীর শিশুদের অবস্থা কী হবে? তিন দশক আগে এ তিনটি বইয়ের চেয়ে ভালো বই আর বেরোয়নি এখনো।
তোফাজ্জল হোসেনের আরেকটি বই জাতিসংঘ। এটিও পাঠ্য হতে পারে স্নাতক পর্যায়ে। জাতিসংঘের বিবরণ শুধু নয়, জাতিসংঘ কী করতে পারে তাও বিবৃত হয়েছে। এটিকে বলা যেতে পারে তার ম্যাগনাম ওপাস।
কবিতাসমগ্র বেরিয়েছে তার। কবিতাতে তিনি উজ্জ্বল আমি তা বলব না, কিন্তু বলব কবিতার বিষয় নিয়ে। দেশ, আন্দোলন ও প্রগতি এর বিষয়। যেমন প্রগতিশীল রুশ ও উর্দু কবিতা। তিনি যে কোনো কবিতা অনুবাদ করতে পারতেন। কিন্তু লক্ষণীয় প্রগতিশীল শব্দটি। অর্থাৎ সে কবিতা তার কবিতা যা প্রগতিশীল।
১৭ বছর বয়সে একুশের গান লিখে তোফাজ্জল হোসেন যাত্রা শুরু করেছিলেন, আজীবন তারই চর্চা করেছেন, যে পেশায়ই তিনি থাকুন না কেন এবং মৃত্যুর আগেও সে চর্চা অব্যাহত রেখেছেন। একেই বলে ইংরেজিতে ইনটেগ্রেটি, আরবিতে ইমান, বাংলায় জানি না। ওরকম প্রতিশব্দ খুঁজে পাইনি।

মুনতাসীর মামুন : ইতিহাসবিদ; বঙ্গবন্ধু অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়