স্বাস্থ্যমন্ত্রী : বিদেশফেরত কর্মীদের এইচআইভি পরীক্ষা করতে হবে

আগের সংবাদ

প্রধানমন্ত্রীকে বরণে প্রস্তুত চট্টগ্রাম : নিñিদ্র নিরাপত্তা, সাজসজ্জা ও প্রচারণা সম্পন্ন

পরের সংবাদ

পাহাড়কে অশান্ত করেছে জিয়া : সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী > পার্বত্য শান্তিচুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের তাগিদ

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৩, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ডিসেম্বর ৩, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

কাগজ প্রতিবেদক : নানা আয়োজনে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির দুই যুগ পূর্তি উদযাপিত হয়েছে। দিবসটি উপলক্ষে গতকাল শুক্রবার সকালে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু ভবনের সামনে রক্ষিত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং। এছাড়া দিবসটি উপলক্ষে রাজধানীতে কয়েকটি আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। স¤প্রীতি বাংলাদেশ আয়োজিত গতকাল রাজধানীর সিরডাপের শামসুল হক মিলনায়তনে ‘পাহাড়ে স¤প্রীতি’ শীর্ষক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ বলেছেন, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর সব অপরাধীদের পুনর্বাসন করে জিয়াউর রহমান পাহাড়কে অশান্ত করেছে।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী উলফাকে আশ্রয় ও আর্থিক সহায়তা দিয়ে জিয়াউর রহমান পাহাড়ের পরিবেশ অশান্ত করতে কাজ করেছে। এ নিয়ে দীর্ঘদিন ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের টানাপোড়ন চলেছে। জিয়া-এরশাদ শাসনামলের প্রসঙ্গ টেনে খালিদ বলেন, গণতান্ত্রিক সরকার না থাকায় সামরিক শক্তিগুলো পাহাড়কে অশান্ত করে তুলেছিল। প্রধানমন্ত্রীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এখন পাহাড়ে শান্তির সুবাতাস বইছে। তবে পাহাড়িদের নিজেদের মধ্যে সংঘাত রয়েছে। আনসারুল্লাহ বাংলাটিমসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসীগোষ্ঠী পাহাড়ে আশ্রয় নিয়ে দেশের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করছে। আলোচনা সভায় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আব্দুল মান্নান বলেন,

একটি মহল পাহাড়ের পরিস্থিতি ঘোলাটে করে ফায়দা লুটার জন্য তৎপর। ওখানে কে এন এফ নামে একটি বিচ্ছিন্নতাবাদীর জন্ম হয়েছে। সেখানে আমাদের দেশেরই বাঙালিসত্তা তাদের জঙ্গিবাদের ট্রেনিং দিচ্ছে অর্থের বিনিময়ে। পার্বত্য অঞ্চলে এখনো শান্তি বিরাজ না করার পেছনে নানাবিধ কারণ আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, পাহাড়ের মানুষ শান্তিপ্রিয়, পাহাড় আগে খুব বেশি অশান্ত ছিল না। পাহাড়ি জনগোষ্ঠী ও সমতলের বাঙালিদের সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক থাকতে হবে। পাহাড়ের ভূমিবিষয়ক সেসব সমস্যার উত্তরণ ঘটিয়ে আমরা স¤প্রীতির বাংলাদেশে বসবাস করব।
লিখিত বক্তব্যে স¤প্রীতি বাংলাদেশের আহ্বায়ক পীযূষ বন্দোপাধ্যায় বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের মোট আয়তনের এক-দশমাংশ। জনসংখ্যার ঘনত্ব বিবেচনায় মোট আয়তনের এক-দশমাংশ বিশাল এলাকা। সেখানকার ভূমিবিন্যাস, স্থানীয় উপজাতি জনগণ, অভাবনীয় ও অনাবিষ্কৃত প্রাকৃতিক সম্পদ এবং সর্বোপরি ভৌগোলিক অবস্থান বাংলাদেশের অপার বহুত্ববাদের সৌন্দর্যমণ্ডিত করেছে। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষরা জাহান্নামের নরকে বসেও পুষ্পের হাসি হাসতে পারে। তারা এতটাই সহজ সরল। ১৯৯৭ সালে শান্তিচুক্তির প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, শান্তিচুক্তি হওয়ার আগ পর্যন্ত দীর্ঘ ২১ বছর যা ক্ষতি হয়েছে তা কখনো পূরণ হওয়া সম্ভব নয়। চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৪৮টি সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়নের কাজ শেষ হয়েছে। ১৫টি ধারার আংশিক বাস্তবায়ন করা হয়েছে। ৯টি ধারা বাস্তবায়নে প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। তিনি বলেন, সরকারের সদিচ্ছার পাশাপাশি পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত সব ধর্ম, গোত্র ও জাতির স¤প্রীতির বন্ধন দৃঢ়তর করা দরকার। আলোচনা সভায় আরো উপস্থিত ছিলেন সংগঠনটির সদস্য সচিব অধ্যাপক ড. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক সুভাষ সিংহ রায়।
বাস্তবায়ন নিয়ে শঙ্কায় আদিবাসীরা : এদিকে, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৫ বছর পেরিয়ে গেলেও চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো এখনো বাস্তবায়ন হয়নি বলে মন্তব্য করেছেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির ও বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সভাপতি বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা)। তিনি বলেন, প্রশাসনিক, আইনশৃঙ্খলা, ভূমি, অর্থনৈতিক ও উন্নয়ন সংক্রান্ত অধিকার এখনো পার্বত্যবাসীদের হাতে দেয়া হয়নি। উল্টো পাহাড়ে সেনা ক্যাম্প বাড়ানো হয়েছে। যা শান্তিচুক্তি বিরোধী। গতকাল শুক্রবার রাজধানীর মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় এসব কথা বলেন তিনি। পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির ২৫তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে এই আলোচনা সভার আয়োজন করে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি ও বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম।
শান্তিচুক্তির ২৫ বছর পার হলেও চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য পাঁচটি মিটিংও হয়নি উল্লেখ করে চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে সন্তু লারমা বলেন, পাহাড়ের সমস্যা সমাধান সামরিকভাবে নয়, রাজনৈতিকভাবে করতে হবে। রাষ্ট্র চায় না চুক্তি বাস্তবায়ন হোক। পার্বত্য ”ট্টগ্রামে যে একটি শান্তি চুক্তি হয়েছে সেটা যেন মানুষ ভুলে যায় শাসকগোষ্ঠী সেটাই চেয়েছে। স্বাধীনতার মাধ্যমে আমরা নতুন দেশ পেয়েছিলাম। পাহাড়ের মানুষের স্বপ্ন ছিল সামরিক শাসন আর থাকবে না। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে সামরিক শাসন উঠে গেলেও পাহাড়ে এখনো সামরিক শাসন জারি আছে। সামরিক সরকারের সহায়তা পাহাড়ে বাঙালি ও মুসলমান প্রবেশ করিয়ে পাহাড়কে বিপর্যয়ের মধ্যে ফেলে দেয়া হলো। পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী চলে না বলে অভিযোগ করে তিনি বলেন, পাহাড়ে অগণতান্ত্রিকতা, সাম্প্রদায়িকতা, উগ্রজাতীয়তাবাদ বিরাজ করছে। সেখানে বাকস্বাধীনতা নেই। চুক্তি নিয়ে কোনো আলাপ করতে দেয় না। সরকার যেভাবে বলে সেভাবে বলতে বাধ্য করে।
অনুষ্ঠানে ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি সংসদ সদস্য রাশেদ খান মেনন বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম উপজাতীয় অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃত হওয়ার কথা ছিল। সেটেলার বাঙালি ঢুকিয়ে পাহাড়ের সমস্যা আরো বাড়িয়ে তোলা হয়েছে। ২৫ বছরেও হয়নি চুক্তির বাস্তবায়ন। উল্টো নানা সশস্ত্র গ্রুপ তৈরি করে পাহাড়কে রক্তাক্ত করা হচ্ছে। বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলেন, পার্বত্য চুক্তির ২৫ বছর পার হলেও পাহাড়ি মানুষের মন ভালো নেই। পার্বত্য চুক্তি অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়ন হলে পাহাড়িদের সঙ্গে বাঙালি ভাইবোনদের জন্যও ভালো। রাষ্ট্রকে সব মানুষের অধিকার দিতে হবে। আদিবাসীদের অধিকার রক্ষায় সবকটি চুক্তি বাস্তবায়ন করতে হবে। তার সঙ্গে একমত পোষণ করে রবীন্দ্রনাথ সরেন চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন। পাহাড়ে নারীরা সবচেয়ে হুমকির মধ্যে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ধর্ষণ, গণধর্ষণের বিচার হয় না। আদিবাসীদের পক্ষে কেউ দাঁড়াতে চায় না। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সমতল আদিবাসীদের জন্য ভূমি কমিশন করার কথা ছিল। কিন্তু হয়নি। এখন মাত্র ৮ ভাগ আদিবাসীদের কাছে ভূমি আছে। আদিবাসীরা আর এই সরকারকে বিশ্বাস করতে চায় না।
চুক্তি বাস্তবায়নে পাহাড়ি বাঙালিদের ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের ডাক দিয়ে বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ২৫ বছর আগে চুক্তি হলেও কেনো এখনো বাস্তবায়ন হচ্ছে না? ২৫ বছরে দাঁড়িয়ে আমরা রোড ম্যাপ বাস্তবায়ন দেখতে চাই। আমরা আদিবাসীদের নাগরিক ও সাংবিধানিক স্বীকৃতি চাই। রাষ্ট্রের শক্তি দিয়ে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা যায়, শান্তি পাওয়া যায় না মন্তব্য করে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মেসবাহ কামাল বলেন, সামরিক বাহিনী দিয়ে বল প্রয়োগ করে সমাধান করলে হবে না। পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যার সমাধান রাজনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমে করতে হবে। বর্তমানে আদিবাসীদের অস্তিত্ব প্রায় বিলুপ্তির পথে দাবি করে কবি ও সাংবাদিক সোহরাব হাসান বলেন, অস্তিত্ব রক্ষায় পাহাড়ি তরুণদের মূলধারার রাজনীতিতে আসা প্রয়োজন। আলোচনা সভায় আরো অংশ নেন ঐক্য ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক এড. আসাদুল্লাহ তারেক, পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক আন্তর্জাতিক কমিশনের সদস্য খুশী কবির, বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি অলিক মৃ প্রমুখ।
উল্লেখ্য, পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা জাতীয় ও রাজনৈতিক উপায়ে স্থায়ী ও শান্তিপূর্ণভাবে সমাধানের লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সঙ্গে পার্বত্য শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করে। চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্যদিয়ে অবসান ঘটে শান্তিবাহিনীর দীর্ঘ প্রায় দুই দশকের সংগ্রামের। স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে শান্তিবাহিনীর সশস্ত্র আন্দোলনকারী সদস্যরা। শান্তিচুক্তির ফলে প্রাথমিকভাবে শান্তি বাহিনীর সদস্যরা অস্ত্র জমা দেয়। সরকার তাদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে। দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়