রাষ্ট্রবিরোধী বক্তব্য : শিশুবক্তা রফিকুলের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য পেছাল

আগের সংবাদ

ঢাবি সমাবর্তনে রাষ্ট্রপতি : বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজে স্বচ্ছতা থাকতে হবে

পরের সংবাদ

সিলেটে বিএনপির সমাবেশ অভিমুখে নেতাকর্মীদের ঢল

প্রকাশিত: নভেম্বর ১৯, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ১৯, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

রুমানা জামান, ফারুক আহমেদ ও জাহিদুল ইসলাম, সিলেট থেকে : পুরো সিলেট যেন বিএনপির নগরী। বিভাগীয় গণসমাবেশকে কেন্দ্র করে এক যুগ পরে সিলেট বিএনপিতে নতুন এক গণজাগরণ। নগরের কেন্দ্র থেকে বিভাগের প্রত্যন্ত অঞ্চল- সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা এখন আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধ। দ্বিধা-দ্ব›দ্ব ভুলে সমাবেশ সফল করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। প্রস্তুত নগরীর আলিয়া মাদ্রাসা মাঠ। এখানেই লাখো নেতাকর্মীর উপস্থিতিতে আজ শনিবার বক্তব্য রাখবেন দলটির নীতিনির্ধারকরা। নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত করতে দেবেন একগুচ্ছ প্রতিশ্রæতি ও আগামীর দিকনির্দেশনা।
২০১৩ সালের অক্টোবরে সিলেট শহরের আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে সবশেষ জনসভা করেছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। প্রায় এক যুগ পর একই স্থানে, একই প্রেক্ষাপটে আজ শনিবার বিএনপির গণসমাবেশ। যেখানে মূল দাবি- নির্দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন। আজ দুপুর ১২টায় আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হবে বিএনপির সিলেট বিভাগীয় গণসমাবেশ। এতে প্রধান অতিথি থাকবেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
সারাদেশের বিভাগীয় পর্যায়ে এই কর্মসূচি ঘিরে মামলা-হামলায় জর্জরিত বিএনপিতে ব্যাপক চাঞ্চল্য তৈরি হয়েছে। ইতোমধ্যে অনুষ্ঠিত হয়েছে ৬টি সমাবেশ। প্রতিটি সমাবেশ ঘিরে বাস ধর্মঘটসহ সরকারি দলের ব্যাপক মহড়া ও কড়াকড়ি ছিল লক্ষণীয়। এসব প্রতিবন্ধকতা পেরিয়েই কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছে লাখো নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ। সিলেটের গণসমাবেশ ঘিরেও ‘ধর্মঘট কৌশলের’ আশ্রয় নেয়া হয়েছে। আজ সিলেটে সকাল-সন্ধ্যা বাস ধর্মঘট ডাকা হয়েছে। বিভাগের বাকি ৩ জেলায় গতকাল সকাল থেকে চলছে ৩৬ ঘণ্টার ধর্মঘট। তবে এসব প্রতিবন্ধকতা জনস্রোত ঠেকাতে পারবে না বলে জানিয়েছেন সমাবেশ প্রস্তুতি কমিটির নেতারা। ইতোমধ্যেই সমাবেশে যোগ দিতে বিভাগের ৪ জেলার প্রতিটি স্পট থেকে সিলেট শহরে এসে হাজির হয়েছেন নেতাকর্মীরা। তাদের স্বতঃস্ফূর্ত উচ্ছ¡াস আহূত ধর্মঘটকে অনেকটাই তামাটে করে দিয়েছে। ট্রেন, ট্রলার, নৌকা, বাইক, নসিমন-করিমন যে যা পেয়েছেন, তাতে চেপেই সমাবেশস্থলে এসেছেন। আলিয়া মাদ্রাসার বিশাল মাঠ গতকাল বিকালেই কানায় কানায় ভরে গেছে। শহরজুড়ে চলছে উদ্দীপ্ত মিছিল, আনন্দ-উল্লাস। প্রতিটি মিছিলের অগ্রভাগে বাঁশের মাথায় বাঁধা জাতীয় ও দলীয় পতাকা। দলের প্রতি নেতাকর্মীদের ত্যাগের এ যেন এক অনন্য নজির।
সিলেট বিভাগীয় গণসমাবেশ প্রস্তুতি কমিটির প্রধান উপদেষ্টা বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড.

আব্দুল মঈন খান গতকাল সন্ধ্যায় ভোরের কাগজকে বলেন, সিলেট শহরে আজ অভূতপূর্ব জাগরণ সৃষ্টি হয়েছে। এটা জোর করে হয় না, দেশের মানুষ আজ জেগে উঠেছে। কারণ সরকারের দুঃশাসনে জনজীবন অতিষ্ঠ। দেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে সবাই আজ ঐক্যবদ্ধ। মানুষের মনের চাপা ক্ষোভ আজ প্রকাশ পাচ্ছে বিএনপির শান্তিপূর্ণ গণসমাবেশের মাধ্যমে। সেই ধারাবাহিকতায় সিলেটে সফল ও শান্তিপূর্ণ সমাবেশ হবে। আমরা আশা করছি, গণমানুষের ঢল নামবে আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে।
উৎসবের নগরী সিলেট : গতকাল বিকালে সরজমিনে দেখা যায়, মাঠের একপাশে তৈরি করা হয়েছে মঞ্চ। কয়েক কিলোমিটারজুড়ে লাগানো হয়েছে মাইক। মাঠের দুই পাশে দুটি ‘বড় পর্দা’ লাগানো হয়েছে। মাঠে রয়েছেন বিভিন্ন স্থান থেকে আসা বিএনপির হাজার হাজার নেতাকর্মী। প্রত্যেকেই ফুরফুরে মেজাজে। এদের মিছিল-স্লোগানে, গানবাদ্যের তালে মুখর মাঠ ও আশপাশের এলাকা। সমাবেশস্থলে কাজী নজরুল ইসলামের রণসঙ্গীত, শাহ আব্দুল করিম, রাধারমণ দত্ত ও দেশাত্মবোধক গানের তালে নেচে গেয়ে উচ্ছ¡াস প্রকাশ করেন তরুণ নেতাকর্মীরা। সব মিলিয়ে উৎসবমুখর সমাবেশস্থল। বিভিন্ন জেলা থেকে আসা দলটির কর্মীরা নেতাদের নামে, দলের বিভিন্ন ইস্যুতে স্লোগান দিচ্ছেন।
মাঠেই রান্না ও রাত্রিযাপন : সমাবেশ সফল করতে গত বুধবার থেকে কয়েক হাজার নেতাকর্মী বিভাগের বিভিন্ন স্থান থেকে সিলেটে এসেছেন। মাঠে স্থানীয় বিএনপি, যুবদল, ছাত্রদলসহ অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা দায়িত্ব পালন করছেন। মাঠেই টানানো তাঁবুতে কাটাচ্ছেন রাত, চলছে গল্পগুজব আর ঘুম। মঞ্চের তিন পাশে নির্মাণ করা হয়েছে বিভাগের বিভিন্ন এলাকার নেতাদের উদ্যোগে ক্যাম্প। সেখানে চলছে রান্না ও খাবারের আয়োজন। ক্যাম্পগুলোতে মজুত করে রাখা হয়েছে চালের বস্তা, তেল ও রান্নার সামগ্রী। কয়েকজন নারীকে পেঁয়াজ, রসুন, আদা, মরিচ কাটতে দেখা গেছে। প্রতিটি ক্যাম্পেই বড় বড় ডেকচিতে হচ্ছে রান্না। কেউ রান্না করেছেন সাদা ভাত, মাছ, মাংস। আবার কেউ রান্না করছেন খিচুড়ি। মাঠের প্রবেশমুখে করা হয়েছে ‘ডা. জোবায়দা রহমান ফ্রি ফুড ক্যাম্প’। এ ক্যাম্প থেকে সমাবেশস্থলে আসা নেতাকর্মীদের পানি ও শুকনো খাবার বিতরণ করা হচ্ছে। মৌলভীবাজার জেলার জুড়ি ও বড়লেখা উপজেলার বিএনপি নেতা নাছির উদ্দিন আহমদ মিঠুর সৌজন্যে একটি প্যান্ডেলে নেতাকর্মীদের জন্য রান্না করছিলেন বাবুর্চি শাহ আলম। তিনি বলেন, শুক্রবার সকালে প্রায় ৩ হাজার লোকের জন্য খিচুড়ি রান্না করেছি। একইভাবে দুপুরের জন্য আরো ৬ হাজার লোকের জন্য রান্না করেছি। এরপর রাতেও আবার রান্না করব।
ব্যানার, ফেস্টুন-পোস্টারে ছেয়ে গেছে আলিয়া মাঠ : ব্যানার, ফেস্টুন ও পোস্টারে ছেয়ে গেছে সিলেট সরকারি আলিয়া মাদ্রাসা মাঠ। এছাড়া নগরীর বিভিন্ন পয়েন্টে শোভা পাচ্ছে পোস্টার-ফেস্টুন। দীর্ঘদিন পর বিভাগীয় এই গণসমাবেশকে কেন্দ্র করে উজ্জীবিত বিএনপি নেতাকর্মীরা। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, গত এক দশকে সিলেট নগরীতে এমন পোস্টার-ফেস্টুন শোভা পায়নি। দেয়ালে, গাছের ডালে, বিদ্যুতের খুঁটিতে, দোকানপাটে সাঁটানো হয়েছে এসব পোস্টার-ব্যানার। নেতাকর্মীরা বলছেন, একদিনের সমাবেশ তিন দিনের সমাবেশে পরিণত হয়েছে।
ধর্মঘট পেরিয়ে নেতাকর্মীদের ঢল : বাধাবিপত্তি উপেক্ষা করে বিএনপির গণসমাবেশে যোগ দিতে গত শুক্রবার রাতেই জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতাকর্মী ও সমর্থকরা পৌঁছেছেন সভাস্থলে। সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজার জেলার নেতাকর্মীরা মাঠেই অবস্থান করছেন। পথে পথে বাধা পেরিয়ে সিলেট অভিমুখে এখন লাখো মানুষের ঢল নামছে। সিলেটে প্রথমে ধর্মঘট ডাক দেয়া হয়েছিল শুধু শনিবার অর্থাৎ গণসমাবেশের দিন। এই একদিনের ধর্মঘট হঠাৎ নেয়া হলো দুই দিনে। গতকাল সকাল ৬টা থেকে আজ সন্ধ্যা পর্যন্ত বন্ধ থাকবে পরিবহন। হবিগঞ্জ জেলা আরো একধাপ এগিয়ে। তারা ডাক দিয়েছে অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট। সুনামগঞ্জ-সিলেট সড়কের লামাকাজী এলাকার এম এ খান সেতুর টোল আদায় বন্ধ, ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক ও পরীক্ষামূলক (অন টেস্ট) সিএনজিচালিত অটোরিকশা বন্ধ, সুনামগঞ্জ বাস টার্মিনাল সংস্কার ও আধুনিকায়ন- এই চার দফা দাবিতে তারা আগে থেকেই আন্দোলন করছেন। তারই ধারাবাহিকতায় এ কর্মসূচি দেয়া হয়েছে। বিএনপির সমাবেশের সঙ্গে বাস ধর্মঘটের কোনো সম্পর্ক নেই বলে দাবি করেছেন সুনামগঞ্জ জেলা বাস মালিক সমিতির সভাপতি মো. মোজাম্মেল হক।
এদিকে শত বাধা পেরিয়ে প্রায় আট হাজার মোটরসাইকেলে সুনামগঞ্জ জেলা বিএনপির নেতাকর্মীরা গতকাল রাতেই সিলেট এসে পৌঁছান। গত বুধ ও বৃহস্পতিবার থেকে হাওরের উপজেলা জামালগঞ্জ, ধর্মপাশা, তাহিরপুর ও শাল্লার নেতাকর্মীরা নৌকা, ট্রলার, লঞ্চযোগে কিংবা সড়কপথে কৌশলে খাবারদাবার নিয়ে আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে পৌঁছেন। মাঠেই তারা ফেসবুক লাইভ করে আগত নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত করে তুলেছেন। রান্না করে নিজেরাই খাবার খেয়ে নেচেগেয়ে রাত কাটান।
বিভক্ত বিএনপি একাট্টা, মুক্তাদির-আরিফ একসঙ্গে : দুটি বলয়ে বিভক্ত সিলেট বিএনপি অতীতে বহুধা বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। সময়ের ব্যবধানে সেই বিএনপি এখন একাট্টা। প্রয়াত সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান ও সাবেক সংসদ সদস্য এম ইলিয়াস আলীর প্রধান দুটি বলয় মিলেছে একই মোহনায়। দীর্ঘ কয়েক যুগে সিলেট বিভাগীয় গণসমাবেশ বিরাট এই ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছে বিএনপিতে। চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা খন্দকার আব্দুল মুক্তাদিরকে নিয়ে দফায় দফায় বৈঠক করেছেন সিলেটের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। সব সময় সঙ্গে থাকছেন দলের বিদ্রোহী নেতা আব্দুর রাজ্জাকও। বিভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধভাবে বিভাগীয় সমাবেশ সফলে বিএনপি নেতাদের ঐক্যবদ্ধ এমন তৎপরতায় স্বস্তিবোধ করছেন কেন্দ্রীয় নেতারাও। খন্দকার আব্দুল মুক্তাদির বলেন, বড় দলে মতানৈক্য-মতবিরোধ একটু থাকেই। সব মতানৈক্য ভুলে আমরা এই অবৈধ সরকার পতনের লড়াইয়ে নেমেছি। এই লড়াই জনগণের ভোটাধিকার ও জীবনের নিরাপত্তা ফিরিয়ে দেয়ার।
বিএনপির নেতাদের প্রত্যাশা : গতকাল বিকালে আলিয়া মাদ্রাসা মাঠ পরিদর্শনে এসে বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, আমাদের সব প্রস্তুতি শেষ। জুমার নামাজের পর থেকে এই সিলেট নগরী একটি জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছে। সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি আবদুল কাইয়ুম চৌধুরী বলেন, সমাবেশ সামনে রেখে বাড়ি বাড়ি তল্লাশি, হয়রানি ও বিভিন্ন বাধার মুখে ফেলা হচ্ছে বিএনপি নেতাদের। এরপরও স্মরণকালের বড় গণজমায়েত ঘটবে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়