জাহাঙ্গীর কবির নানক : বিএনপির মানবতার শিক্ষা নেয়া দরকার

আগের সংবাদ

এপার ওপার সুড়ঙ্গ সংযোগ : কর্ণফুলীর তলদেশে ‘বঙ্গবন্ধু টানেল’ উদ্বোধনের অপেক্ষায়

পরের সংবাদ

‘ড্রপ আউট অব স্কুল স্টুডেন্ট এডুকেশন’ প্রকল্প : সাতক্ষীরায় উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রমে হরিলুট

প্রকাশিত: নভেম্বর ১৭, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ১৭, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

মসিউর রহমান ফিরোজ, সাতক্ষীরা থেকে : সাতক্ষীরা জেলাজুড়ে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রমে চলছে হরিলুট। ‘ড্রপ আউট অব স্কুল স্টুডেন্ট এডুকেশন’ শিরোনামে পরিচালিত এই প্রকল্পের কোটি কোটি টাকা লুটেপুটে খাচ্ছে সাতক্ষীরা উন্নয়ন সংস্থা (সাস) পরিচালক ইমান আলী ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো, সাতক্ষীরা জেলা উপ-পরিচালক হিরামন কুমার বিশ্বাস।
বিগত ২০১০ থেকে ২০১৪ সাল সাতক্ষীরা উন্নয়ন সংস্থা (সাস) পিএলসিএইচইডির ৫ বছর মেয়াদি শিক্ষা প্রকল্প সাতক্ষীরা জেলায় বাস্তবায়নের কাজ করে। সেই সময় সাস পরিচালক ইমান আলীর অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ে পত্র-পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর প্রকল্পটি মাঝপথে বন্ধ হয়ে যায়। পরে জগাখিচুড়ির মধ্য দিয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত প্রকল্প শেষ নামায় সাসের পরিচালক ইমান আলী। তারপর ২০২০ সালে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের শিক্ষা প্রকল্প-৪ ‘ড্রপ আউট অব স্কুল স্টুডেন্ট এডুকেশন’ শিক্ষা প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব পায় অনিয়ম ও দুর্নীতির আখড়া সাস এনজিও। জেলার উপ-পরিচালক হিরামন কুমার বিশ্বাস (ভারপ্রাপ্ত) ও সুকৌশলী ইমান আলী চলমান ২২ কোটি টাকার প্রকল্প থেকে কোটি কোটি টাকা বাণিজ্য করে ঢাকায় ফ্ল্যাট ক্রয়সহ খুলনায় বাড়ি নির্মাণ করেছেন।
সাতক্ষীরা জেলা উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ঝরেপড়া সব শিক্ষার্থীর সমন্বয়ে ৮ থেকে ১৪ বছরের ছেলেমেয়েদের জন্য প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের শিক্ষা প্রকল্প-৪ কার্যক্রম বাস্তবায়নে ২০২০ সালে সাতক্ষীরা উন্নয়ন সংস্থা (সাস) অনুমতি পায়। গাফিলতি করে নির্দিষ্ট সময়ে প্রকল্প বাস্তবায়নের কার্যক্রম শুরু না করে ১৮ থেকে ২০ মাস পর ১৫ ডিসেম্বর ২০২১ সালে তাদের প্রকল্প বাস্তবায়নের জগাখিচুড়ি কার্যক্রম শুরু করেন। শুরুতে ৪২ মাস মেয়াদি এই প্রকল্পের ২০ মাসের দুর্নীতিসহ ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। ৪২ মাসের প্রকল্প শুরু হয় নির্ধারিত সময়ের ২০ মাস পরে।
সূত্রটি আরো জানায়, জেলার ছয়টি উপজেলায় যথাক্রমে আশাশুনিতে ৮৩টি, দেবহাটায় ৫০টি, তালায় ৭০টি, কলারোয়ায় ৭০টি, কালিগঞ্জে ৭০টি ও সাতক্ষীরা সদর উপজেলায় ৭৭টি মোট ৪২০টি কেন্দ্রে ১২ হাজার ৬০০ শিক্ষার্থীর তালিকা তৈরি করে করে এনজিও সাস প্রকল্পটি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষ্যা ব্যুরোর সহযোগিতায় বাস্তবায়ন করছে। এই প্রকল্পের মেয়াদ শুরু থেকে ৪২ মাস। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বলছে প্রকল্পটি স্বল্প সময়ের মধ্যে শেষ করা হবে।
প্রকল্পের শুরুতেই কেন্দ্র প্রস্তুত করে আসবাবপত্র ও উপকরণ সরবরাহের জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে দরপত্র আহ্বান করার কথা থাকলেও গোপনে নামসর্বস্ব একটি পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখিয়ে কোনো ঠিকাদার নিয়োগ না করে নিম্নমানের নোংরা পরিবেশ বেষ্টিত স্থানে ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। যে কারণে কেন্দ্রগুলো অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। জেলার ৬টি উপজেলায় ৪২০টি কেন্দ্রে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রমের নামে কোটি কোটি টাকা লুটপাটের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে সাতক্ষীরা উন্নয়ন সংস্থা-সাস। প্র্রকল্পের মেয়াদ শেষ হতে চললেও বাস্তবে কাজীর গরু কেতাবে আছে গোয়ালে না থাকার মতো অবস্থা।
অভিযোগ, কথিত রিসোর্স পার্সন, ট্রেইনার, কর্মকর্তা নিয়োগ ও সাসের অন্য প্রকল্পের স্টাফদের দিয়ে মাস্টার রোলে ভুয়া স্বাক্ষর দেখিয়ে প্রকল্পের সমুদয় অর্থ আত্মসাৎ করা হচ্ছে। জেলা শিক্ষা অফিসের তথ্যানুযায়ী, ঝরেপড়া শিক্ষার্থী প্রায় দেড় হাজার থাকলেও সাসের কেন্দ্রগুলোতে কাগজে-কলমে শিক্ষার্থী রয়েছে ১২ হাজার ৬০০ জন।
সরজমিন, কাগজে-কলমে ৬টি উপজেলায় ৪২০টি কেন্দ্র। সাতক্ষীরা উন্নয়ন সংস্থা-সাস কর্তৃক বাস্তবায়িত এই প্রকল্পের কেন্দ্রগুলো দেখতে জেলার ছয়টি উপজেলা ঘুরে দেখা গেছে তিন ভাগের এক ভাগও কেন্দ্র নেই। বেশির ভাগ কেন্দ্রের শিক্ষক/সহায়কদের খুঁজে পাওয়া যায়নি। যেগুলো আছে সেগুলো শিক্ষার্থীদের পাঠদান না থাকায় গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগির খামারে রূপ নিয়েছে। অথচ প্রতি তিন মাস পরপর সাস, কেন্দ্রপ্রতি সমুদয় টাকা উত্তোলন করেছে। আর এই অপকর্মে সহযোগিতা করছে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো উপ-পরিচালক হিরামন কুমার বিশ্বাস।
সরকারের এ প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ঝরেপড়া ছেলেমেয়ে লেখাপড়া শেখানোর পাশাপাশি তাদের কারিগরিসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া। এতে প্রতিদিন সকাল-বিকাল দুটি শিফটে ৩০ জন করে মোট ৬০ শিক্ষার্থী থাকার কথা রয়েছে। প্রত্যেক সাইকেল শিক্ষার্থীকে ৯ মাসের কোর্স সম্পন্ন করার কথা থাকলেও বাস্তবে সেই প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে না। প্রতিটি কেন্দ্রে সপ্তাহে চার দিন প্রশিক্ষণ ও দুই দিন মৌলিক শিক্ষার ক্লাস হওয়ার কথা।
কেন্দ্রে দুজন করে প্রশিক্ষক ও দুজন করে সহায়ক-সহায়িকা রয়েছে। এর মধ্যে প্রশিক্ষকরা ক্লাসপ্রতি ২০০ টাকা এবং সহায়ক-সহায়িকারা পাবেন প্রায় ১৭৫ টাকা। সব মিলিয়ে প্রতি মাসে একেকজন প্রশিক্ষক ৩ হাজার ২০০ এবং সহায়ক-সহায়িকারা পাবেন ১৩ থেকে ১৪শ টাকা। অথচ প্রশিক্ষকদের প্রতি মাসে দেয়া হচ্ছে ১ হাজার ৬০০ টাকা এবং সহায়ক-সহায়িকাদের ১১ থেকে ১৩শ টাকা। এভাবে প্রশিক্ষক ও সহায়ক-সহায়িকাদের দেখিয়ে প্রতি মাসে লুটপাট করা হচ্ছে লাখ লাখ টাকা। শিফটপ্রতি প্রশিক্ষণ উপকরণ বাবদ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ৫ হাজার ৭০০ টাকা। যা দিয়ে নামেমাত্র উপকরণ কেনা হয়েছে। অনেক কেন্দ্রে উপকরণ দেয়া হয়নি।
এদিকে তালা উপজেলার ভায়ড়া, বারুইহাটি, চরগ্রাম, আটারই, খাজরা, নলতা, ধুলণ্ডা, বাগমারা, ধানদিয়া, কাটাখালি গ্রামের কেন্দ্রগুলো ঘুরে দেখা যায়, সেখানে কোনো শিক্ষার্থী নেই, নেই কোনো প্রশিক্ষক ও সয়ায়ক-সহায়িকা। কেন্দ্রগুলো পরিত্যক্ত।
বিভিন্ন উপজেলা থেকে ফারুক হোসেন, রফিকুল ইসলাম, আবু জাফর, আবদুর রহমানসহ কয়েকজন এলাকাবাসী জানান, কাগজে-কলমে ছাত্রছাত্রী দেখালেও কোনোদিন কেন্দ্রে ৫-৭ জনের বেশি শিক্ষার্থী আসে না। কেন্দ্রগুলোতে ক্লাস হয় না, শিক্ষার্থীও আসে না। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীকে এখানে ভর্তি করা হয়েছে। একই অবস্থায় সাতক্ষীরা সদরসহ তালা, কলারোয়া, দেবহাটা, কালিগঞ্জ ও আশাশুনি উপজেলায়ও। এভাবে সরকারের টাকা লুটেপুটে খাচ্ছে এই এনজিও।
‘ড্রপ আউট অব স্কুল স্টুডেন্ট এডুকেশন’ প্রকল্পের সমন্বয়কারী সাসের কর্মকর্তা হাবিবুল ইসলাম বলেন, আমরা প্রকল্পটি সঠিকভাবে চালাতে পারছি না। এ বিষয়ে বেশি কিছু বলতে পারব না।
সাতক্ষীরা উন্নয়ন সংস্থা-সাসের নির্বাহী পরিচালক শেখ ইমান আলীর সঙ্গে প্রকল্পের বিস্তারিত তথ্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রকল্পের সমন্বয়কারী কামরুল ইসলাম প্রকল্পটির সার্বিক বাস্তবায়নে দায়িত্ব পালন করছেন। বিস্তারিত তিনি বলতে পারবেন। আমি কিছু জানি না। আপনার সংস্থা প্রকল্প বাস্তবায়ন করে, আপনি কিছু জানেন না? এটা কীভাবে সম্ভব? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি কোনো উত্তর দেননি।
উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো, সাতক্ষীরা জেলা অফিসের উপ-পরিচালক হিরামন কুমার বিশ্বাসের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এসব অনিয়ম, দুর্নীতি ও অর্থ লোপাটের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, প্রকল্পটি দেরিতে শুরু হওয়ায় কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। একজনের পক্ষে সব জায়গায় যাওয়া সম্ভব হয় না। যারা ঝরে পড়েছে কিংবা কোনোদিন স্কুলে যায়নি তাদের শিক্ষাদান করা কঠিন। আমাদেরও কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়