জামায়াত আমিরের ছেলেসহ দুজন ফের রিমান্ডে

আগের সংবাদ

জামায়াত-জঙ্গি নতুন সমীকরণ : দলটির আমির ডা. শফিকের ছেলে ডা. রাফাতকে গ্রেপ্তারের পর বেরিয়ে আসছে নতুন তথ্য ও যোগসূত্র

পরের সংবাদ

একজন স্বল্প শিক্ষিতের কথা

প্রকাশিত: নভেম্বর ১৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ১৬, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বাজারে গেলে মধ্যবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র মানুষের মন খারাপ হয়। সামর্থ্যে কুলায় না কোনো কিছু কিনে খাওয়ার। বেশি করুণ অবস্থা নিম্নবিত্ত ও দরিদ্র মানুষের। আমিষ কিনে খেতে যে অর্থের প্রয়োজন, তা নেই তাদের। এমনকি নিত্যপণ্যের ক্রয়ক্ষমতাও নেই। করোনা-পরবর্তী অবস্থায় আয় কমে যাওয়া, চাকরিচ্যুত হওয়া, সহায়-সম্বলহীন হয়ে পড়ার পর ইউক্রেন ও রাশিয়ার যুদ্ধে জ¦ালানিসহ নিত্যপণ্যের, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি সাধারণ মানুষের জীবনযাপনের স্বাভাবিকতাকে বিনষ্ট করেছে, বিপর্যস্ত করেছে। শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দায় আক্রান্ত। গোটা বিশ্ব দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা করছে। করোনা মোকাবিলায় আমরা দেখেছি, অনেক উন্নত বিশ্ব হিমশিম খেয়েছে। তাদের উন্নত জীবনের সব আয়োজন, ব্যবস্থাপনা তছনছ হয়ে গেছে এক করোনায়। বৈশ্বিক মন্দার আঘাত তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। ভয়াবহ পরিস্থিতির অবতারণা করেছে। অতি ভয়ংকর বিষয়টি হলো এমন পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক ফায়দা নেয়ার পাঁয়তারা থেকে বিরত নেই সংগঠনগুলো। চলছে রাজনৈতিক তৎপরতা মন্দা অবস্থাকে কেন্দ্র করে।
একজন অতি সাধারণ ও স্বল্প শিক্ষিত ব্যক্তি বলছিলেন, বৈশ্বিক মন্দা হলেও আমাদের দেশের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য দায়ী ব্যবসায়ীরা। সেটা কেমন জানতে চাইলে তিনি যা বললেন তার মানে দাঁড়ায়, যখন ব্যবসায়ীদের স্বার্থে আঘাত পড়ে তখন তারা জোট পাকায়। এক হয়ে আন্দোলন করে। সরকার ও সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে। অথচ এই যে নিত্যপণ্যের দামের এত ঊর্ধ্বগতি, মানুষ যখন বেঁচে থাকার চিন্তায় দিশাহারা, তখন ব্যবসায়ীরা বেবাক বোবাকালা হয়ে আছে। কারণ এসব তাদেরই কারসাজি। করোনার কালেও কোটিপতি কারা হয় এটা নিয়ে গবেষণা করলে, বিশ্লেষণ করলে একটা সঠিক তথ্য পাওয়া যেত, যাতে মূল সমস্যা কোথায় এই দেশে তার একটা জবাব মিলত। কিন্তু সেই বিশ্লেষণ কেউ করবে না। গবেষণাও না। কারণ?
দেশটা আসলে চালান ব্যবসায়ীরা, রাজনৈতিক ক্ষমতাসীন একটা সরকার থাকার পরও। স্বল্প শিক্ষিত ব্যক্তিকে থামাতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু নাছোড়বান্দা সে। অভিজ্ঞের মতো তার কথা বলে গেল। এক এক করে অনেক ব্যবসায়ী ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের নামোল্লেখ করল। দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসা ও শিল্প প্রতিষ্ঠান একেকটি। এসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসায়ীগণকে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় দেখা যায়। এমনকি ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক অবস্থানেও থাকে আসীন। কে এদের ভুল ধরে, শাসন করে। উপরন্তু এরাই ব্যবসায়িক কৌশলে সাধারণ মানুষের ভুল ধরে, শাসন করে, এমনকি রাজনৈতিক সংগঠন চালায়। নিয়ম বানায়। এই নিয়মে লাভ তাদের গোলায় ওঠে। তারা বড় থেকে আরো বড় হয় এবং সেটা অর্থবিত্তে, ক্ষমতায়। শুধু এই সরকার আমলেই নয়, এই শ্রেণি ও সংস্কৃতি সব সরকার আমলেই শ্যাওলার মতো থাকে, চর্চা হয়। এরাই কিন্তু সমাজে ময়লা-আবর্জনার জন্ম দেয়। সমাজকে টাকাবাজ বানায়। মূল্যবোধ থেকে সরিয়ে আনে, সমাজ থেকে মূল্যবোধ উধাও হয়। নৈতিকতার বালাই থাকে না। অপরিহার্য শিক্ষাকার্যক্রম দ্বিতীয় সারিতে গিয়ে দাঁড়ায়। ক্রমশ শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা শূন্যের কোঠায় পৌঁছায়। এরাই মুখ্য গোষ্ঠী, ক্ষমতাধর হিসেবে সমাজে বিচরণ করে। এরা রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর মৌলিক আদর্শকে গ্রাস করে, পকেটজাত করে। এক পর্যায়ে এরাই রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর মাথায় পরিণত হয়। কখনোবা মুকুট হয়।
খানিক বিরতি নিয়ে স্বল্প শিক্ষিত ব্যক্তি বললেন, খেয়াল করলে দেখা যাবে, ব্যবসায়ীদের অনেকেই যেমন রাজনীতি করে, ঠিক তেমনি অনেক রাজনীতিকই একটা পর্যায়ে ব্যবসায়ীতে পরিণত হয়। একেকজন বড় বড় ব্যবসায়ী হয়। বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও রাজনীতিক-ব্যবসায়ীদের হাতে ওঠে। এরা দেশের সবচেয়ে নিরাপদ শ্রেণি হয়ে বেঁচে থাকে। এরা সূর্যের প্রখর তাপও শরীরে অনুভব করে না। টাকার সঙ্গে ক্ষমতা মিশে কিংবা ক্ষমতার সঙ্গে টাকা মিশে জাদুকরি মহাশক্তিতে পরিণত হয়। কেউ এদের ছোঁয় না। ছুঁতে পারে না। মৃত্যুদণ্ডনীয় অপরাধ করেও এরা বিচারবহির্ভূত থাকে বছরের পর বছর। রাজনৈতিক সংগঠনগুলো প্রথমে ব্যবসায়ীদের দ্বারস্থ থাকে। তারপর সব এক হয়। রাজনীতি করতে গেলে প্রচুর টাকা লাগে। এই টাকার জোগান হয় নাকি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে।
এই যে জিনিসের দাম বাড়ছে, সরকার ভ্রাম্যমাণ আদালত দিয়ে, আইন ও শাসন করে কী পারছে করতে? কিসসু না। কারণ যারা দাম বাড়িয়ে লাভ তুলছে ঘরে তারা তো সরকারের আশপাশে ও ভেতরে থাকছে। বাজারে খুচরা বিক্রেতাদের ধরে বাজার নিয়ন্ত্রণের যে চেষ্টাখেলা চলছে, তাতে কি বাজার নিয়ন্ত্রণ হয়? নাকি হবে? হয় না, হবেও না। রাঘববোয়ালরা ধরা পড়ে না। পড়বেও না। এই ব্যবসায়ীদের হাত থেকে মুক্ত না হলে, মুক্তি নেই। আরো একটা ব্যাপার আছে। এই ব্যবসায়ীরা সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখে। রাখতে হয়। জিয়ার আমল, এরশাদ আমল এবং এই আমল সব আমলেই আছে। থাকে।
শুধু রাজনীতিতেই নয়, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতিসহ দেশের সব সেক্টরেই ব্যবসায়ীদের বিচরণ, দখল। কৃষ্টি ও ঐতিহ্যের তারাই ধারক ও বাহক। তারা যা বলে সেটাই সংস্কৃতি হয়ে যায়। ঐতিহ্য হয়ে যায়। তারা নাকি আইনকেও নিয়ন্ত্রণ করে। আইন তাদের সমীহ করে। ধর্ষণ করে মেরে ফেললেও ধর্ষক ব্যবসায়ীর বিচার হয় না। বিচারের আওতায় আনা যায় না। উপরন্তু তার পক্ষে প্রচার-প্রচারণা চলে যাতে সে নির্দোষ প্রমাণিত হয়। তদন্তে নির্দোষ প্রমাণ দেখায়। রাষ্ট্রে ব্যবসায়ীদের জন্য বিচার প্রক্রিয়া এক রকম, অন্যদের জন্য আরেক রকম। এটা অনেকেই মনে করে। এই মনে করা বিশ্বাসে জায়গা পেয়েছে। এমন বিশ্বাস কত ভয়ংকর, কেউ কি টের পায় না। নিশ্চয়ই পায়। চুপ থাকে। এই চুপ থাকার পেছনে গল্প থাকে, যে গল্প সবাই পড়তে পারে না।
স্বল্প শিক্ষিত ব্যক্তির কথা শেষ হয় না। এই যে রাজনৈতিক দলগুলোর শোডাউন, কী করে তা সম্ভব? বাজারে গেলে যার মন খারাপ হয়ে যায় জিনিসপত্রের চড়া দামে, সেই মানুষ কি রাজনীতি করার ইচ্ছা পোষণ করে? করে না। তাহলে? যারা এই সভা-সমাবেশে যায় তাদের মাথাপিছু একটা খরচ থাকে। এই টাকা কোত্থেকে আসে, উত্তরে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের খোঁজ মিলবে। রাজনীতির খেলাটা চলে ব্যবসায়ীদের টাকায়। এই খেলা জমানোর জন্য তৈরি হয় নানান ইস্যু। এক রাজনৈতিক সংগঠনের সিনিয়র নেতা বলছিল, তারা পৈতৃক সম্পত্তি বিক্রি করে রাজনীতি করে। তারা তাদের ক্ষমতার আমলে যা কামিয়ে নিয়েছে তা দিয়ে তারা অনেকদিন রাজনীতি করতে পারবে। তাছাড়া অনেক ব্যবসায়ী সংগঠনও তো আছে তাদের। কিছুদিন আগেও তাদের সভা-সমাবেশে এত লোক উপস্থিত হতো না। এত বেশবাস, ক্যাপ, আয়োজন ছিল না। মুহূর্তের মধ্যে বদলে গেল দৃশ্যপট। কারণ যেমন আছে, তেমন আছে সহায়তাকারী।
রাজনীতির জন্য টাকা লাগে। প্রচুর টাকা। এই প্রচুর টাকার সরবরাহ অক্ষুণ্ন ও অবিরত রাখার জন্য ব্যবসায়ীদের অন্যতম আশ্রয় ও অবলম্বন রাজনৈতিক সংগঠনগুলো। তাই তাদের সাত খুন মাফ হয়। আর বাজার হয় অস্থিতিশীল। ভোগান্তি আর বিপন্নতায় নিথর হয় জনজীবন। অভাব আর অক্ষমতার আবেগে তাদের চেতনার রূপ বদলে যায়। জনগণ বেঁচে থাকার আকাক্সক্ষায় মরিয়া হয়। আস্থা খুঁজে ফেরে। অথচ ব্যবসায়ীদের ওপর থেকে রাজনৈতিক সংগঠনের নির্ভরতা কমে না। অতঃপর স্বল্প শিক্ষিত ব্যক্তির কথা আপাতত শেষ হয়।

স্বপ্না রেজা : কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়