বাংলা একাডেমির তিনটি পুরস্কার ঘোষণা

আগের সংবাদ

মহাসড়কে পদে পদে মরণফাঁদ :

পরের সংবাদ

জেল হত্যাকাণ্ড : জিয়া খুনিদের দিয়েছিলেন আশ্রয়-প্রশ্রয়

প্রকাশিত: নভেম্বর ৪, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ৪, ২০২২ , ১২:১৯ পূর্বাহ্ণ

বাঙালি জাতির ইতিহাসে কলঙ্কময় জেলহত্যা মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তির ১০ বছর পরও পলাতক ১০ আসামিকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। কার্যকর হয়নি সবার সাজা। অথচ ১৪ বছর ধরে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায়। বঙ্গবন্ধু ও জেলহত্যা মামলার নেপথ্যের ক্রীড়নকদের চিহ্নিত করার জন্য কমিশন গঠন করার কথা থাকলেও তাও হয়নি। ফলে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুসহ জাতির শীর্ষ নেতাদের হত্যার নেপথ্যের কুশীলবদের চিহ্নিত করা যায়নি। জাতি জানতে পারেনি কারা ছিল সেই ষড়যন্ত্রে। ৪৭ বছর আগে অর্থাৎ ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের নিরাপদ প্রকোষ্ঠে হত্যা করা হয় জাতির চার শীর্ষ নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামানকে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর কয়েক দিনের মধ্যে খুনি চক্রের অন্যতম ষড়যন্ত্রকারী স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাকের নির্দেশে গ্রেপ্তার করা হয় জাতির শীর্ষ চার নেতাকে। খন্দকার মোশতাকের পেছনে শক্তি জুগিয়েছেন জেনারেল জিয়াউর রহমান। সব ষড়যন্ত্রের মূল ইন্ধনদাতা ছিলেন জিয়াউর রহমান এটা বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাত্র এক মাস ১০ দিন পর ২৬ সেপ্টেম্বর ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে এই বিচারের পথ রুদ্ধ করে দেন স্বঘোষিত অবৈধ রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক। পরে মোশতাককে হটিয়ে ক্ষমতার দখল নেন জেনারেল জিয়াউর রহমান। তিনিও স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতি হয়ে সংবিধান সংশোধন (৫ম সংশোধনী) করে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করেন। এতে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশসহ চার বছরে সামরিক আইনের আওতায় সব অধ্যাদেশ, ঘোষণাকে সাংবিধানিক বৈধতা দেন। কোনো হত্যাকাণ্ডের বিচার রুদ্ধ করে সংবিধান সংশোধন করা পৃথিবীর ইতিহাসে নেই। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর খন্দকার মোশতাকের জারি করা অধ্যাদেশে বলা হয়, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে বলবৎ আইনের পরিপন্থি যা কিছুই ঘটুক না কেন, এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টসহ কোনো আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের বা কোনো আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না। এতে বলা হয়- রাষ্ট্রপতি উল্লিখিত ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে যাদের প্রত্যয়ন করবেন, তাদের দায়মুক্তি দেয়া হলো। অর্থাৎ তাদের বিরুদ্ধে কোনো আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের বা কোনো আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না। বঙ্গবন্ধুকে নৃশংসভাবে হত্যার পর খুনিদের যাতে বিচার করা না যায়, অবৈধ ক্ষমতা দখলকারীদের আইনগত কর্তৃত্ব চ্যালেঞ্জ করা না যায় এবং হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্র ও নেপথ্যে জড়িতদের যাতে সুরক্ষা দেয়া যায়, তার জন্যই এই কুখ্যাত অধ্যাদেশ জারি করা হয়। মোশতাককে বিদায় করে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান রাষ্ট্র ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণকারী হিসেবে আবির্ভূত হন। ওই সময় বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম রাষ্ট্রপতি ছিলেন। ১৯৭৬ সালের ২৯ এপ্রিল রাষ্ট্রপতি সায়েম জেনারেল জিয়াউর রহমানের কাছে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব হস্তান্তর করেন। ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল বিচারপতি সায়েম রাষ্ট্রপতির পদ থেকে সরে দাঁড়ান এবং জেনারেল জিয়া রাষ্ট্রপতি হন। ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি সামরিক আইনের অধীনে দেশে দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে জিয়াউর রহমানের দল দুই-তৃতীয়াংশ আসনে বিজয়ী হয়।
একতরফা নির্বাচনে জয়লাভ করে জিয়াউর রহমান সংসদের মাধ্যমে সংবিধানে পঞ্চম সংশোধনী আনেন। এতে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশসহ চার বছরে সামরিক আইনের আওতায় সব অধ্যাদেশ, ঘোষণাকে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে আইনি বৈধতা দেয়া হয়। সংবিধান বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জিয়াউর রহমান সংবিধান সংশোধন করে অধ্যাদেশকে বৈধতা না দিলে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার করা যেত, জাতীয় চার নেতার খুনিদের বিচার করা যেত।
কিন্তু জেনারেল জিয়া খুনিদের বিচার না করে তাদের নিরাপদে দেশত্যাগে সহায়তা করেন এবং বিদেশের দূতাবাসে চাকরির ব্যবস্থা করে দেন। জিয়া নিহত হওয়ার পর বিচারপতি আবদুস সাত্তার, হোসেইন মোহাম্মদ এরশাদ এবং দুদফায় ১৯৯১ সালে এবং ২০০১ সালে খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এলেও ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল বা রহিত করেননি। ফলে দায়মুক্তি পেয়ে খুনিরা প্রকাশ্যে দাপিয়ে বেড়ায়, রাজনীতি করে হত্যার কথা প্রকাশ্যে বলে বেড়াত। এরশাদ ও খালেদা জিয়া এই খুনি চক্রের অনেককে সংসদ সদস্য পর্যন্ত করেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে ওই বছরের ১২ নভেম্বর ‘দি ইনডেমনিটি রিপিল অ্যাক্ট-১৯৯৬’ বিলের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের দায়মুক্তির কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশটি সংসদের মাধ্যমে বাতিল হয়। আর এর মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু ও জেলহত্যা হত্যাকাণ্ডের বিচারের বাধা দূর হয়।
খন্দকার মোশতাক ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে বর্বরতার পরিচয় দিলেও জিয়াউর রহমান ছিলেন আরো বেশি প্রতিহিংসা পরায়ণ। তিনি অধ্যাদেশটি সংবিধানে সংযোজন করে সংবিধানের অংশ করে নেন। এতেই ক্ষান্ত হননি, কোনো বিদেশিও যাতে এ নিয়ে কোনো অনুসন্ধান করতে না পারে তা নিশ্চিত করেন। ঘটনা অনুসন্ধানের জন্য ব্রিটিশ পার্লামেন্টের একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফরে আসতে চাইলে তাদের ভিসা পর্যন্ত দেয়া হয়নি। ইতিহাস পর্যালোচনায় জানা যায়, বাংলাদেশে আইন করে বিচারের পথ রুদ্ধ হয়ে যাওয়ায় ১৯৮০ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারজয়ী শন ম্যাকব্রাইডসহ চার ব্রিটিশ আইনবিদ মিলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তার পরিবার ও জাতীয় চার নেতা হত্যার ঘটনায় প্রথম অনুসন্ধান কমিশন গঠন করেন যুক্তরাজ্যে। সেই কমিটি অনুসন্ধানের কাজে বাংলাদেশে আসতে চাইলে তাদের ভিসা দেয়নি জিয়াউর রহমানের সরকার। এ কমিশনকে দেশে আসতে না দেয়ার মধ্য দিয়ে এটি স্পষ্ট হয়েছিল যে বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে জড়িতদের প্রতি জিয়াউর রহমানের সামরিক সরকারের সরাসরি সমর্থন ছিল। সরকার এর তদন্ত কাজ বাধাগ্রস্ত করেছিল। ওই অনুসন্ধান কমিশনের প্রতিবেদনটি শেখ মুজিব মার্ডার ইনকোয়ারি : প্রিলিমিনারি রিপোর্ট অব দ্য কমিশন অব ইনকোয়ারি শিরোনামে পুস্তিকা লন্ডনের র‌্যাডিক্যাল এশিয়া পাবলিকেশন্স থেকে ১৯৮২ সালের নভেম্বরে প্রকাশিত হয়। এর মুখবন্ধ লিখেছিলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। (সূত্র -বিবিসি)।
প্রকাশিত পুস্তিকায় এ কমিটি গঠনের ইতিবৃত্ত থেকে শুরু করে অনুসন্ধান কমিশনের সিদ্ধান্তগুলো তুলে ধরা হয়। এ কমিশন গঠিত হয় ১৯৮০ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের অনুসন্ধানে কমিশনের কাছে আবেদন করেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা, জাতীয় চার নেতার অন্যতম সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনসুর আলীর ছেলে প্রয়াত মোহাম্মদ সেলিম এবং আরেক জাতীয় নেতা এবং সাবেক উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের ছেলে ও প্রয়াত সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম।
শেখ মুজিব মার্ডার ইনকোয়ারি : প্রিলিমিনারি রিপোর্ট অব দ্য কমিশন অব ইনকোয়ারি পুস্তিকাটিতে যুক্তরাজ্যের অনুসন্ধান কমিশনের প্রথম বৈঠকের পর দেয়া বিবৃতিটি সংযুক্ত আছে। কমিশনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, বঙ্গবন্ধু, তার পরিবার এবং জাতীয় চার নেতা হত্যার ঘটনার আইন ও বিচারের প্রক্রিয়া কেন সঠিক পথে এগোচ্ছে না, তা অনুসন্ধান করা। কমিশন এ জন্য দেশে-বিদেশে প্রকাশিত নানা বিবৃতি-বক্তব্য, নথিসহ প্রচুর তথ্য সংগ্রহ করে। ১৯৭৭ সালে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের বাংলাদেশে পাঠানো কমিশনের প্রতিবেদনও আমলে নেয় এই অনুসন্ধান কমিশন। যুক্তরাজ্যের অনুসন্ধান কমিশন সার্বিক বিবেচনার পর তিনটি সিদ্ধান্তে পৌঁছায়। এক. এ হত্যাকাণ্ডের বিচারে আইন ও বিচারপ্রক্রিয়াকে যথাযথভাবে এগোতে দেয়া হয়নি। দুই. বিচারপ্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করতে সরকারই দায়ী। তিন. হত্যাকাণ্ডের বিচারের প্রক্রিয়ার বাধাগুলো দূর করতে হবে এবং সেই সঙ্গে আইন ও বিচারের প্রক্রিয়াকে তার নিজ ধারায় অগ্রসর হতে দিতে হবে। কিন্তু জিয়াউর রহমানের শাসনামলে এই কমিশনের কোনো সদস্য বাংলাদেশে আসতে পারেননি।
উপরোক্ত আলোচনায় এটা স্পষ্ট, বঙ্গবন্ধু ও জেলহত্যা ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্যে খন্দকার মোশতাক আর জেনারেল জিয়াউর রহমান ছিলেন মূল কুশীলব। তাদের প্রতিহিংসা এমন পর্যায়েই ছিল, আইন করে, সংবিধান সংশোধন করে বিচারের পথ রুদ্ধ করে রেখেছিল। শান্তিতে নোবেল জয়ী একজন ব্রিটিশ এমপিকে বাংলাদেশে আসতে পর্যন্ত দেয়নি। এরই ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছেন এরশাদ ও খালেদা জিয়াও। তারা ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিলতো করেনইনি, বরং খুনিদের নানাভাবে পুরস্কৃত করেছেন। ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসে খালেদা জিয়া আপিল বিভাগে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে রেখেছিলেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করলে বঙ্গবন্ধু ও জেলহত্যা মামলা পুনরুজ্জীবিত হয়। তদন্ত শেষে বিচার হয়। বিচারে ঘটনায় সরাসরি জড়িত কিছু সেনাসদস্যের ফাঁসির রায় হয়, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। কিন্তু নেপথ্যের ষড়যন্ত্রকারীরা রেহাই পেয়ে যায়, আড়ালেই থেকে যায়। এই ষড়যন্ত্রকারীদের চিহ্নিত করতে না পারলে বঙ্গবন্ধু ও জেলহত্যা মামলার পূর্ণাঙ্গ বিচার সম্পন্ন হবে না বলে মনে করেন সচেতন মহল। আর এদের চিহ্নিত করার জন্যই দরকার কমিশন গঠন করা। এটা গঠন করতে যত বিলম্ব হবে জাতির কাছে দায়ভারও তত বাড়বে। -তথ্য সূত্র-বঙ্গবন্ধু ও জেলহত্যা মামলার রায়, বিবিসিসহ বিভিন্ন মাধ্যম।

শংকর মৈত্র : সাংবাদিক ও কলাম লেখক।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়