ঢাকার রাশিয়ান হাউজ : স্পুতনিক উৎক্ষেপণের ৬৫তম বার্ষিকী উদযাপন

আগের সংবাদ

উত্তপ্ত রাজপথে পাল্টাপাল্টি শোডাউন

পরের সংবাদ

পুষ্টির দৈন্য কাটছে না : পুষ্টি কার্যক্রমে মন্ত্রণালয় সংখ্যা বাড়লেও নেই সমন্বয়

প্রকাশিত: অক্টোবর ২৯, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: অক্টোবর ২৯, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

সেবিকা দেবনাথ : প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় ৬টি খাদ্য উপাদান থাকাকে বলা হয় পুষ্টিকর খাবার। এগুলো হলো- শর্করা, আমিষ, চর্বি, ভিটামিন, খনিজ লবণ ও পানি। তবে বাস্তবতা হচ্ছে দেশে অপুষ্টিতে ভোগা জনগোষ্ঠীর সংখ্যা এখনো অনেক বেশি।
পুষ্টি সম্পর্কিত দেশের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ জাতীয় পুষ্টি পরিষদের (বিএনএনসি) তথ্য অনুযায়ী, দেশে ৫ বছরের কম বয়সি শিশুদের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী অপুষ্টি বা খর্বতায় ভুগছে ৩১ শতাংশ। ৮ শতাংশ ভুগছে তীব্র অপুষ্টি বা কৃশতায়। বয়স অনুপাতে কম ওজন ২২ শতাংশ শিশুর। এছাড়া শিশু ও নারীদের ক্ষেত্রে সাব-ক্লিনিক্যাল আয়োডিনের স্বল্পতাও রয়েছে। সর্বশেষ হিসাবে শিশুদের ৪০ শতাংশই এ সমস্যায় ভুগছে। আর নারীদের মধ্যে ৪২ শতাংশের মধ্যে এ সমস্যা দেখা যায়। বর্তমানে দেশে মাতৃমৃত্যুর অন্যতম কারণ রক্তস্বল্পতা।
মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে-২০২১ (এমআইসিএস)-এর তথ্য অনুযায়ী, আগের তুলনায় দেশে অপুষ্টি বেড়েছে ৯ শতাংশ। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০২১ সালে দেশের হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা মারাত্মক অপুষ্টিতে ভোগা শিশুর সংখ্যা ৭২ শতাংশেরও বেশি বেড়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ এন্ড ইনফরমেটিকস বিভাগের ২০২১ সালের এক গবেষণার তথ্য বলছে, দেশের এক-চতুর্থাংশ প্রবীণ অপুষ্টিতে ভুগছেন।
অপুষ্টি দূর করতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি খাদ্য, দুর্যোগ ও ত্রাণ ব্যবস্থাপনা, মহিলা ও শিশু, তথ্য, শিক্ষা, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ, স্থানীয় সরকারসহ সরকারের ২৩টি মন্ত্রণালয় বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নানা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে। চিকিৎসা, সরাসরি খাদ্য বিতরণ ও ভিটামিন, ক্যালসিয়াম, আয়োডিন,

এমআইএনটি পাউডার, মিনারেল খাওয়ানোর মতো কর্মসূচিগুলোকে বিবেচনা করা হয় প্রত্যক্ষ কার্যক্রম হিসেবে। পরোক্ষ কার্যক্রম হিসেবে ধরা হয় অপুষ্টি দূরীকরণ সংক্রান্ত সভা, সেমিনার, প্রশিক্ষণ, সচেতনতা বাড়ানো ইত্যাদি কর্মসূচিকে। মোটা দাগে ১৩টি মন্ত্রণালয় এসব কার্যক্রম বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা পালন করছে।
অপুষ্টি দূর করতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০২৫ সাল পর্যন্ত একটি বৈশ্বিক পুষ্টি উন্নয়ন লক্ষ্য ঘোষণা করেছে। এর সঙ্গে সঙ্গতি রেখে অপুষ্টির প্রাধান্য থাকা দেশগুলো নিজেদের পুষ্টি কার্যক্রম ও নীতি-পরিকল্পনা সাজিয়েছে। অপুষ্টিকে গুরুত্বপূর্ণ জনস্বাস্থ্য সমস্যা বিবেচনা করে সরকার পুষ্টি কার্যক্রম জোরদার করতে জাতীয় পুষ্টি নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। তীব্র অপুষ্টিতে ভোগা শিশুদের যথাযথ সেবা দিতে সরকারিভাবে গাইডলাইনও তৈরি হয়েছে। রয়েছে নানা উদ্যোগ। এরপরও বাংলাদেশ কেন অপুষ্টির চক্র থেকে মুক্ত হতে পারছে না?
এদিকে আগামী বছর এশিয়া ও আফ্রিকার বেশ কয়েকটি দেশে খাদ্য ঘাটতি বড় সংকটের আকার নেবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও)। মারাত্মক খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার হুমকিতে থাকা এসব দেশের তালিকায় নাম রয়েছে বাংলাদেশেরও। এসময় পুষ্টির ভারসাম্যহীনতার শঙ্কাও তৈরি হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমানে জনসংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বহুমাত্রিক মারাত্মক অপুষ্টিতে ভুগছে। অপুষ্টি সমস্যার সমাধান করতে হলে জন্মের আগে থেকেই ব্যবস্থা নেয়ার ওপর জোর দিতে হবে। এছাড়া পুষ্টি কার্যক্রমের সঙ্গে যেসব মন্ত্রণালয় সম্পৃক্ত সেসব মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয় নেই। শুধু তা-ই নয় মাঠপর্যায় পর্যন্ত সমন্বয়হীনতা প্রকট। এসব মন্ত্রণালয়গুলো যে অপুষ্টি রোধে কাজ করে- অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে সেই ধারণাও নেই। এছাড়া সরকারি কর্মকর্তাদের সবার মধ্যে পুষ্টি সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণারও অভাব রয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুষ্টি একটি মাল্টিসেক্টরাল কার্যক্রম। অপুষ্টি দূর করতে যেসব মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর, উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা রয়েছে তাদের সমন্বয় যেমন জরুরি, তেমনি জরুরি রাজনৈতিক সদিচ্ছা। আরেকটি লক্ষণীয় বিষয় হল- অপুষ্টি দূরীকরণের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ কার্যক্রমেরই ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। পরোক্ষ কার্যক্রম এক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। তবে এ খাতে যে বরাদ্দ হয় তার ৯৮ শতাংশই ব্যয় হয় পরোক্ষ কার্যক্রমে।
এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জনস্বাস্থ্যবিষয়ক পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. আবু জামিল ফয়সাল মনে করেন পুষ্টি নিশ্চিতে সরকার বড় পরিসরে কার্যক্রম চালাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু এর সুফলভোগী কম। পুষ্টিতে এখনো ছোট ছোট অনেক কাজের সুযোগ রয়েছে। সবচেয়ে বড় বিষয় হল সমন্বয়ের অভাব।
বিএনএনসি ও জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠানের তথ্য অনুযায়ী, দেশে সরকারি ও বেসরকারিভাবে পুষ্টির বিষয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে প্রায় ৩০০ কর্মসূচি চলমান রয়েছে। এর মধ্যে সরকারের বহুমুখী কর্মপরিকল্পনা রয়েছে ৩১টি। এ ৩১ পরিকল্পনার মধ্যে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় বাস্তবায়ন করছে ১৯টি। সরকারের চলমান এ কর্মসূচি ২০২৩ সাল পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। আর জাতীয় পুষ্টি পরিষদের প্রকাশনার তথ্য অনুযায়ী, পুষ্টি খাতে সর্বাধিক ৮০ শতাংশ ব্যয় করে ৪টি মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে খাদ্য মন্ত্রণালয় ৩৪ শতাংশ, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় ২৩ শতাংশ, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ১৩ শতাংশ এবং মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় ৭ শতাংশ ব্যয় করেছে।
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে গেøাবাল এলায়েন্স ফর ইমপ্রæভড নিউট্রিশন (গেইন) বাংলাদেশ এর পোর্টফোলিও লিড ড. আশেক মাহফুজ বলেন, ন্যাশনাল মাইক্রো নিউট্রিয়েন্ট সার্ভে ২০১৯-২০ এর ফলাফল অনুযায়ী বাংলাদেশে এখনো অপুষ্টিজনিত সমস্যা রয়েছে। আমাদের অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা থেকে ইউএন ফুড সিস্টেমে ন্যাশনাল পাথওয়ে ডকুমেন্ট, ইউএন ফুড সিস্টেম সামিটসহ অন্যান্য সরকারি নীতির সবগুলোতেই পুষ্টি গুরুত্বপূর্ণ স্থান পেয়েছে এবং আমরা ধীরে ধীরে খাদ্যনিরাপত্তা তথা পুষ্টিনিরাপত্তা নিশ্চিতে জোর দিচ্ছি। এর জন্য সরকারের উদ্যোগ ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সহায়তা প্রয়োজন।
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি বিজ্ঞান ও খাদ্যপ্রযুক্তি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. ওবায়দুল হক মনে করেন, গত ১০ বছরে দেশের পুষ্টি পরিস্থিতির অগ্রগতি হয়েছে। তবে পুষ্টির সুষম বণ্টন এখনো নিশ্চিত হয়নি। ফলে দেশে অপুষ্টি যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে অতি পুষ্টিও। তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, সামগ্রিকভাবে ভিটামিন ও মিনারেলসের ঘাটতির পরিমাণ এখন অনেক কমেছে। তবে ব্যক্তিপর্যায়ে এসবের ঘাটতি রয়েছে। খাদ্যগ্রহণের মানসিকতা এখনো পরিবর্তন হয়নি। সুষম খাবার সম্পর্কে ধারণাও কম। ফলে কেউ কেউ পুষ্টিকর খাবার বেশি খেয়ে ফেলছে, আবার কেউ কেউ তা পাচ্ছেন না। এছাড়া ব্যক্তিগত হাইজিন, পুষ্টি সম্পর্কে সচেতনতার অভাব, খাবার রান্নার প্রক্রিয়া, খাদ্যশস্যসহ খাবার উৎপাদন প্রক্রিয়ার ত্রæটির কারণেও পুষ্টির অভাব থেকে যাচ্ছে।
আগামীতে খাদ্য সংকট দেশে পুষ্টি পরিস্থিতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলবে বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. আহমেদ পারভেজ জাবিন। তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। ফলে খাদ্য সংকটের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। ভবিষ্যতে বিশ্বের যে কয়েকটি দেশে খাদ্য সংকট হতে পারে সেই তালিকায় বাংলাদেশও আছে। যদিও পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে বেশ কিছু উদ্যোগ এখনই নেয়া হচ্ছে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়