হাজারীবাগের বিস্ফোরণ : পা হারানো দিলীপসহ শঙ্কাজনক অবস্থায় ২

আগের সংবাদ

পাঁচ কারণে বাড়ছে ডেঙ্গু!

পরের সংবাদ

শেখ হাসিনা এক নীলকণ্ঠ লেখক

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৮, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: সেপ্টেম্বর ২৮, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

দুই শব্দের একটি নাম। এই নাম উচ্চারিত হতেই আমি ফিরে যাই কৈশোরে সেই বৃষ্টিভেজা মেঘাচ্ছন্ন সেই কালো দিনের কাছে। সেই দুঃসহ লজ্জাবৃত স্মৃতি বারবার ফিরে আসে ভয়াল ভীষণ বেগে। আমি উৎকণ্ঠিত হই। স্বজন বিচ্ছেদের যন্ত্রণায় কাতর হয়ে পড়ি। আমি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কথা বলছি। সেদিন প্রত্যুষে ঘুম ভাঙতেই প্রত্যক্ষ করি অনেকের অশ্রæসিক্ত চোখ। অনেককে দেখতে পাই বিধ্বস্ত অবস্থায় রেডিওর চারপাশে বসে আছেন কোনো এক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার প্রতাশায়। কিন্তু আমাদের চরমতম দুর্ভাগ্য সেই দুঃস্বপ্নের ভোর আর হয়নি। সেদিন আমি প্রথম মৃত্যু নামের ভয়াল বিভীষিকাময় ‘নেই’-এর সঙ্গে পরিচিত হই। সেই থেকে ‘নেই’ শব্দটার সঙ্গে ঘর করতে শুরু করি। এরপর আমি আরো অনেকবার ‘নেই’-এর মুখোমুখি হই; কিন্তু এসব ‘নেই’ শব্দের বেদনা আমার জীবনের প্রথম নেই-এর বেদনাকে ছাপিয়ে উঠতে পারেনি। আমি নিশ্চিত কখনো পারবে না। এই না পারার দলে আছেন আরো এক নাম, সেই নামটি হলো শেখ হাসিনা, তার জন্মদিন ২৮ সেপ্টেম্বর। ১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর শেখ হাসিনা গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। আজো যখন শেখ হাসিনা নামটি উচ্চারিত হয়, আমার ভেতরের সব দুঃখবোধ হু-হু করে অসহায়ের মতো বেরিয়ে আসে। বঙ্গবন্ধুর পরিবারের কেউ তখনো বেঁচে আছে আমি জেনেছি, অনেক পরে। আমার চেতনাজুড়ে তখনো ছিল রাসেল নামের ছেলেটি, আমারই সমবয়সি কিশোরটি শুধু বঙ্গবন্ধুর সন্তান হওয়ার কারণেই সম্পূর্ণ নিষ্পাপ অবস্থায় খুন হলো শুনে বুকের ভেতর যে আগুন জ্বলছিল, তা প্রকাশের জন্য অনেক বেশি সচেষ্ট ছিলাম। বিদেশে থাকাতে দুবোন বেঁচে যান, এটাই আজ আমাদের পরমতম সৌভাগ্য। আজ শেখ হাসিনা জননেত্রী, প্রধানমন্ত্রী, মানবতার জননী, সর্বোপরি সফল এক রাষ্ট্রনায়ক। আমি সেই শেখ হাসিনার কথা তার জন্মদিনে বলতে আসিনি। আমি বলতে চাই, অন্য এক শেখ হাসিনার কথা। যিনি সেখানেও অনন্যা। আমি বলতে চেয়েছি, লেখক শেখ হাসিনার কথা। শেখ হাসিনার লেখক সত্তা আমাদের সামনে ভিন্ন এক বার্তা নিয়ে দাঁড়ায়।
লেখক শেখ হাসিনার অন্তর্গত বেদনা, নিঃসঙ্গতাটুকু প্রকাশিত হয়েছে তার লেখা প্রথম দুটি গ্রন্থ ‘ওরা টোকাই কেন?’ এবং ‘বাংলাদেশে স্বৈরতন্ত্রের জন্ম’-এর মাধ্যমে। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রিধারী শেখ হাসিনার লেখা এবং সম্পাদিত গ্রন্থেও সংখ্যা ত্রিশের অধিক। সম্পাদনা করেছেন বঙ্গবন্ধুর ভাষণ। ১৯৯৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে তার নির্বাচিত ভাষণও গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছে। কারণ আমি যে শেখ হাসিনাকে দেখার চেষ্টা করেছি, তা একমাত্র তার লেখালেখিতে খুঁজে পাওয়া যাবে। ছোট ছোট সহজ-সরল বাক্যে শেখ হাসিনা তার লেখকসত্তাকে জাগিয়ে তোলেন। পাঠকের মনের গহিনে ঝড় তুলতে পারেন। যেমন পারতেন বুদ্ধদেব বসু তার গদ্যে। শেখ হাসিনার গদ্যে যে সহজিয়া ভাবটা খুঁজে পাওয়া যায়, তা সত্যি বিরল। কারণ বুদ্ধদেব, রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, বিভূতিভূষণ তার অন্তর্গত। সারল্যমাখা গ্রামীণ জীবন শেখ হাসিনার প্রিয়। তাই ঘুরে-ফিরে বারবার গ্রামীণ জীবনের প্রতিচ্ছবি তার লেখায় ব্যক্ত হয়েছে। ওখানেই এক স্থানে জেনে যাই, আর দশজন বাঙালি কিশোর-কিশোরীর মতো বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালি’ কৈশোরে তাকেও ভীষণভাবে আচ্ছন্ন করে রাখে। ‘পথের পাঁচালি’ তার নিজের গ্রাম বাইগার নদীর পাশে অবস্থিত টুঙ্গিপাড়াকে মনে করিয়ে দেয়। রবীন্দ্রনাথের গ্রামভিত্তিক ছোটগল্পগুলো তার প্রিয়। প্রিয় জয়নুলের সেই কলাগাছের ঝোপে নোলক পড়া বউয়ের স্কেচগুলো। বাউল গান, বৈষ্ণব গান, ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি মাঝির গান- এসব কিছু তার উদার দুপুরের সাথী। এসব পড়তে পড়তে যে কোনো পাষাণ হৃদয়েরও মায়া হয়। চোখ অশ্রæসিক্ত হয়। শেখ হাসিনা কিন্তু এও জানেন ‘পথের পাঁচালি’র অপু, দুর্গা কিংবা তার গ্রামের সেই সুন্দর দিনগুলো আর কখনো ফিরে আসবে না। একে একে সব হারিয়ে গেছে। তিনিও গ্রাম পতনের খবর পেয়ে যান। হ্যাঁ পাবেনই তো। কারণ তিনি যে শুধু জননেত্রী, মানবতার মাতা নন তিনি একজন সংবেদনশীল লেখকও বটে। এখনো যখন গণভবনে বড়শি দিয়ে মাছ ধরতে যান, রিকশায় চড়ে টুঙ্গিপাড়া ঘুরতে চান তখন গ্রামীণ জীবনের প্রতি ভালোবাসার সত্যতা মেলে।
‘ওরা টোকাই কেন?’ এবং ‘বাংলাদেশে স্বৈরতন্ত্রের জন্ম’ গ্রন্থ দুখানার ১৫টি প্রবন্ধের অধিকাংশই হচ্ছে স্মৃতি তাড়ানিয়া অতীত নিয়ে। এখানে তার গভীর সেই বেদনাবোধ উন্মাচিত হয়েছে। প্রকৃতির কাছে মানুষের অসহায়ত্বের অসংখ্য করুণ চিত্র তিনি তুলে ধরেছেন বাংলার ৬৮ হাজার দারিদ্র্যপীড়িত গ্রামে ঘুরে ঘুরে। বঙ্গবন্ধুর মতো তারই সুযোগ্য কন্যা কোথায় যাননি? বাংলার প্রায় গ্রামে তার পদধূলি পড়েছে। আর ওখান থেকে রাজনৈতিক হীন স্বার্থেও বিপরীতে ‘হৃদয়ে প্রেমের শীর্ষে’ স্থান পেয়েছে অযুত-নিযুত ভাগ্যবঞ্চিত মানুষ। গ্রাম থেকে গ্রামে ঘুরে ঘুরে তিনি স্বজন হারানোর বেদনা ঘুচাতে চেয়েছেন। কিন্তু কতটুকুই আর তা সম্ভব। ওখানকার মানুষের দুঃখ-কষ্টগুলো নিজের মধ্যে আরো বড় হয়ে দেখা দেয়। কিন্তু এক সময় তিনি ফিরে আসেন নিজের মধ্যে। এই ফেরাটুকু বোধ করি আত্মনুসন্ধান।
শেখ হাসিনার লেখকসত্তায় মধুমতি নদীর তীরের টুঙ্গিপাড়া গ্রামখানি ছাড়া এই বদ্বীপের যে জনপদটির নাম বারবার মূর্ত হয়ে উঠে তা চট্টগ্রাম। শেখ হাসিনা নিঃসঙ্গতা আর বেদনা নিংড়ানো হৃদয়ে চট্টগ্রামের যে বর্ণনা দেন, তা অপরূপ ও অনন্য- ‘চট্টগ্রাম! বীর প্রসবিনী চট্টগ্রাম! বীর সূর্য সেন আর কালজয়ী প্রীতিলতার পুণ্য স্মৃতি জড়িত এই চট্টগ্রাম। বীরের রক্তপ্রাত এ মাটি। মহাকবি আলাওলের সুধাময়ী সুর জালের মূর্ছনা তোলা এই জনপদ। সে রোসাঙ্গ দেশ বা রোসাঙ্গরাজের আজ অস্তিত্বও নেই। কিন্তু আছেন মহাকবি আলাওল। আছে চট্টগ্রাম। সাগর বেষ্টন যাকে আবদ্ধ করেছে মহাপ্রেমে, মহামায়ায়।’ এই মধুমতি ধানসিঁড়ি, কর্ণফুলী নদীর তীরে বেদনা আর নিঃসঙ্গতায় নীলকণ্ঠ হয়ে ওঠা লেখক শেখ হাসিনা নিজেকে বারবার হারিয়ে যেন ফিরে পান। গভীরতম অন্ধকার থেকে নদী, সাগর তাকে বারবার সুন্দরের দিকে, সভ্যতার দিকে, সত্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়, বেঁচে থাকার প্রেরণা জাগায়। অন্যথায় তার পক্ষে লেখা অসম্ভব, ‘সাগর আমাকে বড় আকর্ষণ করে। সাগরকে আমি বিভিন্ন রূপে দেখেছি। দেখেছি সকালের মৃদু আলোতে, যখন দূর পাহাড়ের চূড়া দিয়ে সূর্য ধীরে ধীরে তার দিনের আলো বিকিরণ করতে করতে উঠে আসে অন্ধকার রাত্রির অবসান ঘটিয়ে। এ যেন আলো হাতে উঠে আসছে জীবনের স্পন্দন জাগাতে। অন্ধকার বুক চিরে বালুকা বেলায়-আলোর আগমন জীবনকে দেয় জাগিয়ে।’ আহারে কি চমৎকার জীবনের প্রকাশ! শেখ হাসিনা জীবনের এই সত্যকে আবিষ্কার করতে বারবার পাঠ নেন প্রকৃতির কাছ থেকে। এখানে আমরা লেখক শেখ হাসিনার গভীর অন্তর দৃষ্টির সন্ধান পাই।
শেখ হাসিনার লেখক সত্তার প্রকাশ আজো সম্পূর্ণ উন্মোচিত হয়েছে বলে মনে করি না। জানি না তিনি স্মৃতি কথা লিখছেন কিনা। জানি না ডায়েরির পাতা ভরিয়ে রাখছেন কিনা ভাবীকালের পাঠকের জন্য। এসব লেখালেখিকে সেদিনের প্রস্তুতি হিসেবে কিন্তু অনুমান করতে পারি। আরো অনুমান করি, যখন আমার মতো একজন অপরিচিত, মফস্বলবাসী ছাত্রের কাছ থেকে ডাকযোগে পুস্তক গ্রহণ করে পত্র দিয়ে প্রাপ্তি সংবাদ পাঠান। এটা ১৯৯২ সালের নভেম্বর মাসের কথা। তখন তিনি বিরোধী দলের নেত্রী। আমি আমার প্রকাশিত প্রথম কিশোর গল্প গ্রন্থ ‘আগামীর জন্য ভালোবাস’ তার কাছে ডাকযোগে পাঠালাম। তারপর ক’দিন পর আমার ঠিকানায় বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের বিরোধী দলের দপ্তর থেকে আসে একটা চিঠি। চিঠিতে তৎকালীন বিরোধী দলের নেতা শেখ হাসিনা লিখেছেন, ‘স্নেহের প্রীতীশ, তোমার চিঠি, পাঠানো বই এবং স্মরণিকা আছি পেয়েছি। তোমার এ মহতী প্রয়াস সফল হোক। আমি তোমার বই পড়ছি। একজন লেখক হিসেবে তুমি সফল হও। দেশ এবং জাতি তোমার কাছ থেকে প্রকৃত সত্য এবং তথ্য জানতে পাক এই কামনা করি। অনেক অনেক শুভেচ্ছাসহ শেখ হাসিনা।’ এর প্রায় ৯ বছর পর ২০০১ সালে, যেদিন শেখ হাসিনা প্রথমবার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন শেষে তৃতীয় তত্ত্বাবধায় সরকারের প্রধান বিচারপতি লুৎফর রহমানের কাছে দায়িত্ব অর্পণ করে নির্বাচনে যোগদান করেন, সেদিন আমি টুঙ্গিপাড়া বঙ্গবন্ধুর মাজারে গিয়ে দেখি ওখানকার লাইব্রেরির একটা আলমারিতে আমার প্রদত্ত সেই বই পরম যতেœ শোভা পাচ্ছে। সাহিত্য এবং সাহিত্যিকের প্রতি স্নেহ-মমতা তো একজন প্রকৃত লেখকেরই থাকার কথা।
নিঃসঙ্গতা আর বেদনায় নীল হওয়া নীলকণ্ঠ এক লেখক শেখ হাসিনার গাঢ় মানবিক মূল্যবোধ আর নিঃসঙ্গতার বার্তাবাহক হিসেবে গ্রন্থগুলোকে বেছে নিলে আমরা অন্য এক শেখ হাসিনাকে খুঁজে পাব। তিনি মানবিক শেখ হাসিনা। তিনি অন্য এক অনন্যা। তিনি নিঃসঙ্গ, উৎকণ্ঠিত এক নীড়হারা পাখি যেন। নিঃসঙ্গতা আর বেদনায় নীল হওয়া নীলকণ্ঠ লেখক শেখ হাসিনার অবয়ব যখন উন্মোচিত হয়, তখন নিজের মধ্যেই গাঢ় এক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। চিন চিন করে বুকের ভেতর যন্ত্রণা অনুভব করি। শেখ হাসিনার বাহ্যিক আবরণে প্রাণিত হয়ে অনেকে স্বপ্ন দেখেন। কিন্তু রাত গভীরে গ্রন্থদ্বয় পাঠ শেষে একমাত্র বুঝে ওঠা সম্ভব হয়, তার দুঃস্বপ্নের ভোর নেই। বিস্তার আছে। আছে শুধু অন্ধকার আর আতঙ্ক। এখনো একটি বুলেট তাকে তাড়া করছে। তাকে একবার নয়, দুবার নয়, প্রায় বিশের অধিকবার হত্যার চেষ্টা করেছে ঘাতকের দল। দেশে-বিদেশে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। তাই শেখ হাসিনা এবং শেখ হাসিনাই বারবার মুখোমুখি হোন এই অন্ধকার আর আতঙ্কের। এরপর কি আর তার সামনে ছাদ ফাটিয়ে হাসা যায়? খিলখিলিয়ে উচ্ছ¡াস প্রকাশ করা যায়? জন্মদিনের আলোকিত উচ্ছ¡াস হারিয়ে যায়, বেদনা আর দীর্ঘশ্বাসের অতলে। সবে পার হয়ে এলো শোকের মাস আগস্ট। তারপরও বলব, শুভ জন্মদিন জননেত্রী থেকে আজকের সফল রাষ্ট্রনায়ক, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আপনি অন্য এক অনন্যা। নিঃসঙ্গতায়, বেদনায় নীল হওয়া নীলকণ্ঠ এক লেখক।

কুমার প্রীতীশ বল : কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়