রফিকুল ইসলাম সুইট, পাবনা থেকে : পাবনা প্রেস ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ভাষাসৈনিক মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক ও কলামিস্ট রণেশ মৈত্র মারা গেছেন। গতকাল সোমবার ভোর পৌনে ৪টার দিকে ঢাকার পপুলার হাসপাতালে বার্ধক্যজনিত রোগে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৯০ বছর। মফস্বল সাংবাদিকতায় বিশেষ অবদান রাখায় সম্প্রতি তাকে বসুন্ধরা মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড দেয়া হয়। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, দুই ছেলে ও তিন মেয়েসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। তার মৃত্যুতে পাবনা প্রেস ক্লাবসহ সাংবাদিক পরিবারের পক্ষ থেকে গভীর সমবেদনা জানানো হয়েছে। শোক ও সমবেদনা জানানো হয়েছে ভোরের কাগজ পরিবারের পক্ষ থেকেও।
তার স্ত্রী পূরবী মৈত্র বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের পাবনা জেলা শাখার সভাপতি। তিনি তার মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, তাদের সন্তান অস্ট্রেলিয়া থেকে বাংলাদেশের উদ্দেশে রওনা হয়েছে। সে পৌঁছানোর পর পারিবারিক সিদ্ধান্তে তার শেষকৃত্য সম্পন্ন করা হবে।
জানা যায়, ১৯৩৩ সালের ৪ অক্টোবর রাজশাহী জেলার ন’হাটা গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। পৈত্রিক বাসস্থান পাবনা জেলার সাঁথিয়া উপজেলার ভুলবাড়িয়া গ্রামে। বাবা রমেশ চন্দ্র ছিলেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। সপ্তম শ্রেণিতে উঠার পর থেকেই রণেশ মৈত্র টিউশনি করে নিজের লেখাপড়ার খরচ চালাতেন। নিজ জীবনের সংগ্রাম থেকে শিক্ষা নিয়েই রণেশ মৈত্র দেশের অসহায়, শোষিত ও বঞ্চিত মানুষের জন্য আন্দোলন ও সংগ্রাম করেন। ১৯৫০ সালে পাবনা জিসিআই স্কুল

থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। ১৯৫৫ সালে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ থেকে আইএ এবং ১৯৫৯ সালে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৫১ সালে সিলেট থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক নওবেলাল পত্রিকায় সাংবাদিকতার মাধ্যমেই তার সাংবাদিকের জীবন শুরু। এরপর কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক সত্যযুগে তিন বছর সাংবাদিকতার পর ১৯৫৫ সালে তিনি যোগ দেন দৈনিক সংবাদে।
১৯৬১ সালে ডেইলি মর্নিং নিউজ এবং ১৯৬৭ সাল থেকে ১৯৯২ পর্যন্ত দৈনিক অবজারভারে পাবনা জেলা প্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯২ সালে দি নিউ নেশনের মফস্বল সম্পাদক হিসেবে যোগ দেয়ার পর ১৯৯৩ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত তিনি দি ডেইলি স্টারের পাবনা প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন। পরে স্বেচ্ছায় অব্যাহতি নিয়ে একজন ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক হিসেবে দেশের শীর্ষ পত্রপত্রিকায় কলাম লিখে সারাদেশে ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেন।
এছাড়া, ১৯৬১ সালে তিনি পাবনায় মফস্বল সাংবাদিকদের সম্মেলনের মাধ্যমে গঠিত পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এই সম্মেলনের মাধ্যমে মফস্বল সাংবাদিকরা তাদের পেশার স্বীকৃতি পান। সেই বছরই প্রতিষ্ঠিত পাবনা প্রেস ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
এছাড়া তিনি দীর্ঘদিন প্রেস ক্লাবের সভাপতি ও সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করে জেলার সাংবাদিকদের নেতৃত্ব দিয়েছেন। সাংবাদিকতায় অবদানের জন্য তিনি ২০১৮ সালে সরকার প্রদত্ত দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত হন।
১৯৪৮ সালে ছাত্র ইউনিয়ন থেকে ভাষা আন্দোলনের মিছিলে যোগ দেয়ার মধ্য দিয়ে শুরু হয় রণেশ মৈত্রের রাজনৈতিক জীবন। একই সময়ে তিনি সাংবাদিকতা পেশায় জড়িয়ে পড়েন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে জেল খেটেছেন। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে তিনি পাবনা জেলার অন্যতম সংগঠক ছিলেন। সেই বছরই তিনি ছাত্র ইউনিয়নের জেলা সাংগঠনিক কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৫৩ সালে এডওয়ার্ড কলেজের ছাত্রসংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে সাংস্কৃতিক সম্পাদক নির্বাচিত হন।
রাজনৈতিক আন্দোলনের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক আন্দোলন জোরদার করার লক্ষ্যে তিনি বাংলাদেশ অবজারভারের আব্দুল মতিন, কামাল লোহানীসহ প্রগতিশীল বন্ধুদের সঙ্গে গঠন করেন শিখা সংঘ নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন। সেখানে একটি সমৃদ্ধ পাঠাগার ছিল, যেখান থেকে শিখা নামে একটি হাতে লেখা পত্রিকাও প্রকাশিত হতো। স্ত্রী পূরবী মৈত্র বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের পাবনা জেলা শাখার সভাপতি। ৫ ছেলেমেয়ে সবাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত।
গুণী এই ব্যক্তির মৃত্যুতে তাৎক্ষণিকভাবে পাবনার সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিকসহ নানা পেশাজীবী সংগঠন ও নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে শোক ও শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন।