পল্টনে তৃতীয় লিঙ্গের সদস্য-হকার সংঘর্ষে আহত ৬

আগের সংবাদ

জোয়ারের পানিতে বড় বড় গর্তের সৃষ্টি : কলাপাড়ার ৬০ কিলোমিটার সড়কের অধিকাংশই কাঁচা

পরের সংবাদ

জাঁ লুক গোদার : ফরাসি ছবির নবজন্মদাতাদের একজন

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৭, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: সেপ্টেম্বর ১৭, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

তিনি ঐতিহ্যের মোড় ফিরিয়ে দেন শক্ত হাতে। তৈরি করেন নতুন পথ। তাই বোধ হয় ফরাসি নুভেল ভাগের সঙ্গে খুব সাবলীলভাবেই অন্বিত হয়ে গিয়েছিল তার নাম, তার মুখ। ১৩ সেপ্টেম্বর প্রয়াত হয়েছেন নবতরঙ্গের অন্যতম মুখ চিত্রপরিচালক জাঁ লুক গোদার। ফরাসি ছবির নবজন্মদাতাদের একজন তিনি। ১৯৫০ সালে মূলত ফ্রান্সে এবং পরবর্তীকালে গোটা ফিল্মি-বিশ্বে নবতরঙ্গের ধারার যে ছবি বিশেষ সাড়া ফেলেছিল তার প্রাণপুরুষদের অন্যতম গোদার। ক্যামেরার পেছনে দাঁড়িয়ে তিনি ছবি নির্মাণের সংজ্ঞাই বদলে দিলেন। ক্যামেরার পেছনে দাঁড়িয়ে বদলে দিলেন ক্যামেরার সামনের দৃশ্য। তার ছবি তাই চিরকাল একটা দেয়াল হয়ে রয়ে যাবে। যে দেয়ালের দুদিকের দুই ধরনের ছবি। তিনি যেন সেই বিলীয়মান এবং আসন্ন ছবির মাঝখানে অপূর্ব একা! ১৯৬০-এর দশকজুড়ে গোদারের সোনার সময়। একের পর এক ব্যতিক্রমী ছবি উপহার দিয়েছেন। গোদার সব চেয়ে বেশি বিখ্যাত ‘ব্রেথলেস’ এবং ‘আলফাভিলে’ ছবির জন্য। বিশ্বচলচ্চিত্রের ক্লাসিকের মধ্যে পড়ে তার সৃজন। ‘ব্রেথলেস’ ছবির নির্মাণকৌশল মুগ্ধ করেছিল বিশ্বচলচ্চিত্ররসিকদের। এ ছবির ব্যতিক্রমী ভিজুয়্যাল স্টাইল এক অন্যরকম নির্মাণ-ঐতিহ্য তৈরি করে দিয়েছিল। জাঁ লুক গোদারের যেসব সিনেমা চিরকাল শিল্পমনাদের প্রশংসা পেয়ে এসেছে তার মধ্যে ‘ফ্যাটালিস্টিক রোমান্স’ অন্যতম। এটি ১৯৬০ সালের ছবি। দেড় ঘণ্টার এ ছবিকে বলা হয়েছিল ‘ফ্যাটালিস্টিক রোমান্স’। ‘ব্রেথলেস’ তার দর্শককে রুদ্ধশ্বাস করে দিয়েছিল। শোনা যায়, এ ছবি মুগ্ধ করেছিল সত্যজিৎকেও। প্রেমের ছবি, কিন্তু একেবারে অন্যরকম ট্রিটমেন্ট। প্রথম ছবিতেই মাত করে দিলেন গোদার। ‘লা নুভেল ভাগ’ তথা ‘ফ্রেঞ্চ নিউ ওয়েভ’-এর দরজা যেন খুলে গেল! এরপর আসে ‘ভিভরে সা ভিয়ে’ তথা ‘মাই লাইফ টু লিভ’ আর একটি মাইলস্টোন। গোদারের এই ছবিতে ‘ট্র্যাজিক বিউটি’ হিসেবে উঠে এসেছিলেন আনা কারিনা। তিনি যেন নিউ ওয়েভের ‘মিউজ’ হয়ে উঠলেন। অভিনয়ের একটা পরিমিতি এবং তার পাশাপাশি রহস্যময় স্বতঃস্ফূর্ততা গোদার ও আনা কারিনাকে অনন্য জুটি হিসেবে তুলে ধরল। ‘বাটলগ্রাউন্ড’। এ ছবি অবশ্যই বুদ্ধির দীপ্তিময় উদযাপন কিন্তু তাতে মিশে আছে অনেক কিছু। ছবিটি আসলে যেন একটা ব্যাটলগ্রাউন্ড। যেখানে রয়েছে প্রেম, ঘৃণা, লড়াই, হিংসা, মৃত্যু; আর তাতে মিশে আছে অমিত আবেগ। এ ছবি ফরাসি ছবিতে, বিশ্বসিনেমাতেও একটা কাল্ট। ১ ঘণ্টা ৯ মিনিটের ছবি ‘গুডবাই টু ল্যাঙ্গুয়েজ’। ২০১৪ সালের ছবি। বৃদ্ধ গোদারের হাতে যেন ফুল ফুটল। ছবিনির্মাণকে আবার যেন নতুন করে সংজ্ঞায়িত করলেন তিনি। কালো অন্ধকার থিয়েটারের স্বল্পপরিসরে কী ম্যাজিক যে ঘটতে পারে, এ ছবি না দেখলে তা যেন সম্পূর্ণ উপলব্ধি করা যায় না। ‘দ্য ইমেজ বুক’। এটিও শেষবেলার গোদারের বিচ্ছুরণ। ২০১৮ সালের ছবি। সময় এতে আরো কম। মাত্র ৮৫ মিনিট। এ ছবিতে তিনি আবার প্রমাণ করলেন, তার দেশের সিনেমাশিল্প যে উচ্চতাতেই উঠে যাক, সেই বিপুল নির্মাণের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ আজো তিনি। কিছু পরস্পরবিচ্ছিন্ন দৃশ্য ও শব্দকে এক আলংকারিক ছন্দে গ্রথিত করে যেন নির্মাণ করেছিলেন এই ছবি।
কীর্তিমান এ নির্মাতা নিজের মৃত্যুর সিদ্ধান্ত তিনি নিজেই নিয়েছেন বলে দাবি করেছেন তার দীর্ঘদিনের আইনি পরামর্শদাতা প্যাটিক জঁনেরেত। তিনি জানান, ‘অ্যাসিস্টেড সুইসাইড’-এর মাধ্যমে নিজের জীবনের ইতি টেনেছেন ৯১ বছর বয়সি এই নির্মাতা। সুইজারল্যান্ডে বেশ কয়েকটি বিশেষ ক্ষেত্রে বিবেচনাধীনভাবে ‘অ্যাসিস্টেড সুইসাইড’ বা চিকিৎসকদের সহায়তায় জীবননাশের সিদ্ধান্ত আইনত বৈধ। বিবিসিতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, সংবাদ সংস্থা এএফপিকে প্যাট্রিক জানিয়েছেন যে, চিকিৎসকদের সহায়তায় নিজের জীবনে ইতি টানার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন গোদার নিজেই। প্যাট্রিক বলেন, ‘(গোদারের) মেডিকেল রিপোর্ট অনুযায়ী, একাধিক অক্ষম রোগে আক্রান্ত ছিলেন তিনি। সে কারণে স্বেচ্ছায় প্রস্থানের জন্য সুইজারল্যান্ডে আইনি সহায়তার নেয়ার পথে এগিয়ে ছিলেন।’
১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ৩ ডিসেম্বর ফ্রান্সের ফ্রাঙ্কো-সুইস পরিবারে গোদারের জন্ম। জন্মের চার বছরের মাথায় পুরো পরিবার সুইজারল্যান্ডে চলে যায়। সেখানেই শুরু হয় গোদারের প্রাথমিক শিক্ষাজীবন। এরপর ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি প্যারিসে ফিরে ঐতিহ্যবাহী লিসি বুফোন স্কুলে ভর্তি হন। এ সময় প্যারিসের বেশ কয়েকটি সিনেমার ক্লাবে তার অবাধ যাতায়াত শুরু হয়। এসব জায়গায় ঘুরতে ঘুরতে তার পরিচয় হয় জ্যাকুয়েস রিভেটি, ক্লদ শ্যাব্রল, ফ্রাঁসোয়া ত্রæফো প্রমুখ চলচ্চিত্রপ্রেমীর সঙ্গে। আর সে সুবাদে চলচ্চিত্র সমালোচক হিসেবে নাম লেখান গোদার। প্রকাশ করেন চলচ্চিত্র পত্রিকা গ্যাজেট দ্যু সিনেমা। এরপর ১৯৫২ সালে সুইজারল্যান্ডে ফিরে যান গোদার। সেখানে তিনি একটি বাঁধে নির্মাণ শ্রমিকের কাজ নেন। এই কাজ করার সময়ই বাঁধটি নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের চিন্তা তার মাথায় আসে। সে অনুযায়ী ৩৫ মিমিতে তিনি নির্মাণ করেন অপারেশন কনক্রিট। এরপর একে একে অল দ্য বয়েস আর কলড প্যাট্রিক (১৯৫৭), চার্লট অ্যাট সান জুলস (১৯৫৮) ইত্যাদি।
গোদারের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ব্রেথলেস (১৯৬০)। এই ছবিটিই তাকে দুনিয়াজোড়া খ্যাতি এনে দেয় এবং ব্রেথলেসকে ধরা হয় নবতরঙ্গের একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ। গোদারের উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে- দ্য লিটল সোলজার (১৯৬০), অ্যা উইম্যান ইজ অ্যা উইম্যান (১৯৬১), মাই লাইফ টু লিভ (১৯৬৩), কনটেম্পট (১৯৬৩), অ্যা মেরিড উইম্যান (১৯৬৪), পিয়েরে ল্য ফু (১৯৬৫), মেইড ইন ইউএসএ (১৯৬৬), উইক অ্যান্ড (১৯৬৭), নিউ ওয়েভ (১৯৯০), জেএলজি/জেএলজি (১৯৯৪), গুডবাই টু ল্যাঙ্গুয়েজ (২০১৪) প্রভৃতি। ২০১০ সালে ফরাসি চলচ্চিত্রে অবদান রাখার জন্য বিশেষ অস্কার পান গোদার। কিন্তু তিনি তা গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান। তবে ঠিক কী কারণে তিনি অস্কার নেননি তা পরিষ্কার নয়। অনেকের মতে, মূল অস্কার অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত না হওয়ায় তিনি যেতে রাজি হননি। আবার অনেকে মনে করছেন, সবসময় হলিউডের সমালোচনা করা গোদার অস্কারে না যাওয়াটাই স্বাভাবিক। ২০১৮ সালে ৭১তম কান চলচ্চিত্র উৎসবে গোদারকে বিশেষ পাম দ’র দেয়া হয়। ‘দ্য ইমেজ বুক’ সিনেমার জন্য তাকে সম্মানিত করেছিল উৎসব কর্তৃপক্ষ। গোদারের চলচ্চিত্র অনেক বিখ্যাত পরিচালককে অনুপ্রাণিত করেছে, যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন মার্টিন স্কোরসিসি, কোয়েন্টিন টারান্টিনো, ব্রায়ান ডি পালমা, স্টিভেন সোডারবার্গ, ডিএ পেনবেকার, রবার্ট অল্টম্যান, জিম জারমুশ, ভিম ভেন্ডার্স, বেরনার্দো বেরতোলুচ্চি ও পিয়ের পাওলো পাসোলিনি।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়