কোহলির সেঞ্চুরি : আফগানদের ওপর ঝাল মিটাল ভারত

আগের সংবাদ

ভারতের সাত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে ঢাকায় আমন্ত্রণ : উত্তর-পূর্বের সঙ্গে সংযোগে গুরুত্ব

পরের সংবাদ

তিন কারণে বাড়ছে আত্মহত্যার প্রবণতা : প্রতি মাসে ৪৫ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১০, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: সেপ্টেম্বর ১০, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

রাফিউজ্জামান লাবীব : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ছাত্রী হলের আবাসিক শিক্ষার্থী ইরিন জামান (ছদ্ম নাম) ছিলেন ডিপার্টমেন্টে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম। প্রেমে ব্যর্থ হয়ে প্রায় ৫০টির মতো ঘুমের ওষুধ খান বাবা মায়ের একমাত্র এই সন্তান। রুমমেট, হলের শিক্ষার্থী, প্রভোস্ট ও হাউস টিউটরদের সহযোগিতায় ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে ওয়াশ করে তাকে সুস্থ করা হয়। পরিবারের সহযোগিতা, দীর্ঘদিনের কাউন্সিলিংয়ে সুস্থ হন মেধাবী ইরিন। দুই বছর পড়াশোনায় যতি পড়লেও পরে প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হন। বর্তমানে তিনি আমেরিকার একটি নামি কোম্পানির উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ নেয়ার কারণে ইরিন বেঁচে গিয়েছিলেন এবং উন্নত জীবনযাপন করছেন। কিন্তু গবেষণা বলছে, গত ৮ মাসে (জানুয়ারি থেকে আগস্ট) আত্মহত্যা করেছে ৩৬৪ জন শিক্ষার্থী। এরমধ্যে ৫০ জন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া। যাদের ৬০ শতাংশ ছেলে এবং ৪০ শতাংশ মেয়ে শিক্ষার্থী। আর গড়ে প্রতি মাসে আত্মহত্যা করেছে প্রায় ৪৫ জন শিক্ষার্থী। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডিপ্রেশন, অ্যাংজাইটি ও অবসেসিভ কমপালসিভ ডিসঅর্ডার (ওডিসি)- এই তিনটি প্রধান কারণেই আত্মহত্যার মতো ভয়ঙ্কর সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। কারণগুলো চিহ্নিত করে বিশ্ববিদ্যালয় ও রাষ্ট্রীয়ভাবে ব্যবস্থা নেয়ার ওপর জোর দিয়েছেন তারা।
গতকাল শুক্রবার প্রকাশিত আঁচল ফাউন্ডেশনের সমীক্ষার তথ্য মতে, প্রেমঘটিত কারণেই সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা ঘটছে। ১৩ থেকে ২০ বছর বয়সীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। যা ৭৮ দশমিক ৬ শতাংশ। ২১ থেকে ২৬ বছর বয়সীদের মধ্যে এই হার ১৩ দশমিক ৪৬ শতাংশ। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের মাঝে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় উদ্বেগ বাড়াচ্ছে শিক্ষার্থী,

অভিভাবক ও সংশ্লিষ্ট মহলে। এখনই কোমলমতি শিক্ষার্থীদের এ পথ থেকে ফেরানো না গেলে ভবিষ্যতে এটি সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাড়ছে কাউন্সিলিং সেবা : গত ১ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাউন্টিং এন্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের শিক্ষার্থী জায়না হাবিব প্রাপ্তি রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকায় ১৬তলা বিল্ডিং থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করেন। মৃত্যুর আগে চিরকুটে লিখে যান ‘আমার জীবন একটা ব্যর্থ জীবন। না পারলাম মা বাবাকে খুশি করতে, না পারলাম অন্য কাউকে খুশি করতে। আমি গেলে কিছু আসবে যাবে না জানি।’ আত্মহত্যার পথে পা বাড়ানো শিক্ষার্থীরা সাধারণত ফেসবুকে বিভিন্ন আবেগঘন পোস্ট দিয়ে বা পড়ার টেবিলে চিরকুট লিখে আত্মহত্যা করছেন। এতে কাউকে দোষারোপ না করলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে নিজের ওপর তীব্র অভিমান বা নিজ দায়িত্ব পালনে অক্ষমতাই মূল কারণ। এদিকে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মানসিক চিকিৎসা নেয়ার শিক্ষার্থীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গত এক বছরে ৫৮৯ জন, গত জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪০০ জন চিকিৎসা নিয়েছেন। এ ছাড়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গড়ে দৈনিক ৯ জন, বুয়েটে ৬ জন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪ জন, জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০ জন শিক্ষার্থী মানসিক চিকিৎসা নিচ্ছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, প্রতিনিয়তই এই সংখ্যাটা বাড়ছে।
আত্মহত্যার প্রধান ‘তিন’ কারণ : বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা ও নিজস্ব কাউন্সেলিং সেবা থাকার পরও শিক্ষার্থীদের হতাশা ও আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ার পেছনে নানা কারণ দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। এরমধ্যে পারিবারিক সমস্যা, প্রেমঘটিত সমস্যা, দক্ষতা কেন্দ্রিক সমস্যা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অপব্যবহার, আত্মহত্যার সংবাদগুলো নগ্নভাবে প্রচার করা, পরীক্ষা ভীতি, পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পারা, ট্রমা ইস্যু, মাদকাসক্তি, চাইল্ডহুড এবইউজ, সিজোফ্রেনিয়া, বাইকুলার, অবসেসিভ কমপালসিভ ডিসঅর্ডার (ওডিসি) সমস্যাকে দায়ী করেছেন বিশেষজ্ঞরা। আত্মহত্যার পেছনে একজন শিক্ষার্থীর প্রধান তিনটি মানসিক কারণ রয়েছে বলে জানিয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মানসিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রের পরিচালক অধ্যাপক ড. আনওয়ারুল হাসান সুফি। তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, ডিপ্রেশন, অ্যাংজাইটি ও অবসেসিভ কমপালসিভ ডিসঅর্ডার (ওডিসি) এই তিনটি প্রধান কারণে শিক্ষার্থীরা আত্মহত্যা প্রবণ হয়ে ওঠে। এর বাইরেও বেশ কিছু কারণ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম একটি কারণ হলো, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা আত্মহত্যার ঘটনাগুলো একেবারেই নগ্নভাবে প্রচার করা।
শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য ও হতাশা দূরীকরণ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই কাজ করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. সুরাইয়া পারভীন। তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা আর্থ-সামাজিক নানা কারণে হতাশায় ভোগে। একারণে তারা আত্মহত্যা প্রবণতায় ভোগে। তিনি বলেন, একজন মানুষ হুট করেই আত্মহত্যার চিন্তাও করতে পারে না। যখন তার অভিমান বা চাপ তীব্রতর হয় তখনই সে মুক্তির উপায় হিসেবে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। মূলত ওই সময়টাতে সে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। অন্যদিকে ভার্চুয়াল জগতের এখনকার প্রেমগুলো দ্রুত হয় এবং ভেঙে যায়। বিষয়গুলো একজন শিক্ষার্থীকে তার লক্ষ্য থেকে অনেক সময় দূরে রাখে। এতে অনেকেই আত্মহত্যার মতো বিপথে পা বাড়ায়।
আঘাত পেলে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রত্যয় : আত্মহত্যা প্রতিরোধে পারিবারিক সম্পর্ক বাড়ানো, সন্দেহ হলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া, আত্মহত্যার সংবাদগুলোর বিস্তারিত বর্ণনা না দেয়া, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারে সংযত হওয়া, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কাজে যুক্ত থাকা, নিয়মিত মাঠে খেলাধুলা করা এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের বিনা সুদে ঋণ দেয়ার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো আখতারুজ্জামান ভোরের কাগজকে বলেন, শিক্ষার্থীদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত রাখা, অভিভাবকদের সচেতনতা বাড়ানো ও সহপাঠীদের সহযোগিতার মনোভাব তৈরি করতে পারলে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা প্রবণতা অনেকাংশেই কমে যাবে। যেসব শিক্ষার্থী হতাশায় ভোগে তার বোঝার আগে শিক্ষক, অভিভাবক, বন্ধুদের বুঝতে হবে এবং তারা সহযোগিতা করবে এটি উত্তম পন্থা। এরপর কাউন্সেলিংসহ যা যা করা প্রয়োজন, তা করবে। এতে কোনো ধরনের অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটবে না বলে মনে করেন তিনি।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা যেখানে আশার আলো হয়ে বাকিদের আত্মহত্যা ঠেকিয়ে দেবে সেখানে নিজেরাই হতাশার অতল গহ্বরে তলিয়ে যাচ্ছে। এখান থেকে উত্তরণের অনেক রাস্তাই খোলা আছে বলে জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-নির্দেশনা ও পরামর্শদান দপ্তরের পরিচালক এবং এডুকেশনাল ও কাউন্সিলিং সাইকোলজি বিভাগের চেয়ারপার্সন অধ্যাপক ড. মেহ্জাবিন হক। তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, বর্তমান সময়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে কোনো আঘাত পেলে সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর বিষয়ে ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। এদিক থেকে একজন শিক্ষার্থীকে মানসিকভাবে শক্ত হতে হবে। জীবনের সমস্যাগুলো মোকাবিলা করার শক্তি রাখতে হবে। একবার না পারলে শতবার চেষ্টা করতে হবে। সারারাত জেগে দিনে ঘুমানোর অভ্যাস বাদ দিতে হবে। এতে হতাশা অনেকটাই কমে যাবে। ফেসবুকে হাজারো বন্ধু না রেখে বাস্তব জগতে প্রকৃত বন্ধুর সংখ্যা বাড়াতে হবে। নিয়মিত মাঠে খেলাধুলায় অংশ নিতে হবে বর্তমানে যা অনেকটাই কমে গেছে। বিভিন্ন সামাজিক কাজে সম্পৃক্ত থাকতে হবে। প্রত্যেকের ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলতে হবে এবং পরিবারের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক তৈরি করতে হবে। পরিবার ও গণমাধ্যমের ভূমিকা সম্পর্কে ড. মেহ্জাবিন হক বলেন, শিক্ষার্থীদের ওপর থেকে পরিবারের অতিরিক্ত চাহিদা বাদ দিতে হবে। আর গণমাধ্যমে আত্মহত্যার ঘটনাগুলোর বিস্তারিত বর্ণনা দেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। কেউ আত্মহত্যার দিকে ঝুঁকছে সন্দেহ হলে সহপাঠী বা কাছের মানুষদের দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সাইকোলজিস্ট রাখার পাশাপাশি বিভাগীয় পর্যায়ে স্টুডেন্ট অ্যাডভাইজারের কাজকে গুরুত্বেও সঙ্গে নেয়ারও পরামর্শ দেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মাহমুদুর রহমান ভোরের কাগজকে বলেন, করোনায় মানসিক সমস্যা বাড়া ও অর্থনৈতিক মন্দা আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ার অন্যতম কারণ। এটি একাকী প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার পেছনের কারণগুলো চিহ্নিত করে বিশ্ববিদ্যালয় ও রাষ্ট্রীয়ভাবে ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। হতাশা বাড়ে সংকটের কারণে। সেটা হতে পারে সম্পর্ক বা অর্থের। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের উচিত বিনা সুদে শিক্ষার্থীদের ঋণ দেয়ার ব্যাপারে এগিয়ে আসা।
আত্মহত্যার সংবাদগুলো প্রচার না করার ব্যাপারে জোরালোভাবে আহ্বান জানিয়েছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কাউন্সেলিং সেন্টারের আহ্বায়ক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নূর মোহাম্মাদ। তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, বর্তমানে মিডিয়ায় কে কীভাবে কোথায় আত্মহত্যা করল এটার বিস্তারিত বর্ণনা ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছে। যার ফলে একই মানসিক অবস্থায় থাকা আরেকজন শিক্ষার্থী আত্মহত্যার দিকে প্রবলভাবে ঝুঁকে পড়ছে। এটি এখনই বন্ধ করা জরুরি।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়