ট্রেনে আসন সংখ্যা কম : ছাদে ও বগিতে গাদাগাদি ভ্রমণ, ভোগান্তি চরমে

আগের সংবাদ

জ্বালানি সাশ্রয়ে কৃচ্ছ্রতার কৌশল

পরের সংবাদ

সাহসিকতা অনিবার্য বটে

প্রকাশিত: জুলাই ১৮, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জুলাই ১৮, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

নিউমার্কেটের ঘটনার সময় পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা দ্রুত সাড়া দেয়নি বলে অভিযোগ থাকলেও অন্য সময় পুলিশ যে নিষ্ক্রিয় থাকে এমন কথা কেউ বলতে পারবেন না। বিশেষ করে প্রধান বিরোধী দলের যদি কোনো কর্মসূচি থাকে, তা সেটা যেখানেই হোক না কেন, এর কারণ সবারই জানা। সেই কথাটাই তার নিজের মতো করে সম্প্রতি ব্যক্ত করেছেন পুলিশ বাহিনীরই সাবেক একজন আইজি, এ কে এম শহীদুল হক, তার আত্মজৈবনিক এক বইতে। তার তো অতিপ্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা রয়েছে, সেসবের ভিত্তিতেই তিনি জানিয়েছেন যে ক্ষমতাসীনরা মনে করে যে পুলিশ বাহিনী তাদের নিজস্ব সম্পত্তি। সেভাবেই তারা ওই বাহিনীকে ব্যবহার করতে পছন্দ করে। আমরা অবশ্য জানি যে পুলিশ বাহিনীও সেটা মেনে নেয়। না মানলে বিপদ আছে, মানলে প্রাপ্তির আশা থাকে। পুলিশ যে ক্ষমতাসীনদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয় এটা কে না বলবে। সবাই বলবে পুলিশ হচ্ছে জনগণের সেবক ও রক্ষক; সে জন্যই তাদের রাখা হয়েছে, জনগণের টাকাতে। কিন্তু সে ভূমিকায় পুলিশকে দেখতে পাওয়াটা রীতিমতো সৌভাগ্যের ব্যাপার। ব্রিটিশ আমলে পাওয়া যেত না, পাকিস্তান আমলে আশা করাটাই ছিল অন্যায়; বাংলাদেশ পাওয়ার আশা ক্রমাগত ক্ষীণ হয়েছে। কারণটাও তো জানা। সাবেক পুলিশপ্রধান সেটা জানিয়েছেন, চেপে রাখা সম্ভব হয়নি। কর্মরত অবস্থায় চেপে রাখলেও পরে আর পারেননি।
বিনিময়ে পুলিশ বাহিনী বিস্তর সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকে। তাদের জবাবদিহিতার বালাইও থাকে না। এবং তারা যে ক্ষমতাবান মনের ভেতরে এই বোধটা সর্বদাই জাগ্রত অবস্থাতে থাকে, ঘুমায় না। ওদিকে ক্ষমতা নিজেই এমন জিনিস, যা শান্ত থাকতে জানে না। প্রয়োগ চায়, প্রয়োগের জন্য অস্থির হয়ে ওঠে। আর প্রয়োগ করতে গেলেই তো অন্যায় প্রয়োগ ঘটবে। নিত্যই সেটা ঘটছে। কতটুকুই বা আমরা জানি। দুয়েকটা খবর আচমকা ছিটকে বের হয়ে আসে, হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো। যেমন, ফেনীতে এক মায়ের অভিযোগ। থানাতে গিয়ে তিনি নালিশ করেছেন যে ভয় দেখিয়ে তার কিশোর পুত্রসন্তানটিকে পুলিশের এক সেপাই নিয়মিত বলাৎকার করত। আতঙ্কে ছেলেটি কাউকে কিছু জানায়নি। পরে, অত্যাচারে সে যখন রীতিমতো অসুস্থ হয়ে পড়েছে তখনই মা’কে সে বলেছে ঘটনা। অসহায় মা আর কোথায় যাবেন? কে করবে তাকে সাহায্য? থানাতেই গেছেন নালিশ করতে। থানাতে গিয়ে তিনি কি আশা করেছেন যে সুবিচার পাবেন? সে-আশার তো কোনো বস্তুগত ভিত্তি নেই। কিন্তু অসহায় মা আর কী করতে পারেন? ত্যক্ত-বিরক্ত কোনো মা যখন তার শিশুটির গায়ে দু’ঘা বসিয়ে দেন, কাঁদতে কাঁদতে শিশুটি তো তখন তার মায়ের কাছেই নালিশ করে, মায়ের বিরুদ্ধেই। সাংবাদিকরা এসব খবর তেমন পান না, অল্পস্বল্প যা পান তাও প্রকাশে সাহস রাখেন না; তবে অপরাধের খবর তারা ছেপে থাকেন। অপরাধের খবর বেশ জনপ্রিয়। পহেলা বৈশাখে বৈশাখী মেলা বসে। লালমনিরহাটেও বসেছিল। মেলাতে এখন নিয়মিত জুয়া খেলা চলে। সেই রকমের জুয়া খেলার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে পুলিশ এক তরুণকে ধরে নিয়ে গেছে, ইচ্ছামতো পিটিয়েছে, এবং তাতে তরুণের মৃত্যু ঘটেছে। পরিবারের দাবি তাদের ছেলেটি একেবারেই নির্দোষ, কাজকর্ম করে খায়, মেলাতে সে গিয়েছিল তার শিশুসন্তানের জন্য খেলনা কিনতে।
ওই পহেলা বৈশাখের ছুটিতেই কুমিল্লায় এক কিশোর ও এক কিশোরী সুবিধামতো জায়গাতে বসে নিজেদের মধ্যে গল্প করছিল; ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চের দুইজন সদস্য তাদের ওপর চড়াও হয়েছে, বলেছে টাকা দাও, নইলে চালান করে দেব। এটাও জানাজানি হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে যা করা হয়ে থাকে তাই করা হয়েছে, বিভাগীয় হালকা শাস্তি দেয়া হয়েছে। ব্যস, ওই পর্যন্তই। যাত্রাবাড়ীতে জাতীয় সেবা নম্বর ৯৯৯-এ ফোন করেছিলেন একজন, উদ্ধারের আশাতে; সাড়া দিয়ে বাহিনীর তিন সদস্য চলে এসেছেন, এসে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তাদেরকে পাকড়াও করবে কি, উল্টো হেনস্তা করেছে অভিযোগকারীকেই। এসব ঘটনা আসলে এখন কোনো সংবাদই নয়, তবু এগুলোর বাস্তবতা মানুষকে নিত্যদিন আঘাত করে এবং মানুষের নিরাপত্তাহীনতার নীরব সাক্ষ্য তুলে ধরে। মানুষ নিরাপদে নেই, নিরাপত্তা দান যাদের দায়িত্ব তারাও নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করছে। রাষ্ট্র কেবল যে উদাসীন তাই নয়, রাষ্ট্র অত্যাচারীদের পক্ষে।
পরিস্থিতি এমনই যে পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা নিজেরাও নিরাপদে থাকে না। আসামি ধরতে গিয়ে ঘেরাও হওয়া, আসামিকে ছিনিয়ে নেয়া, এসব আছে। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কখনো কখনো তারা আহত হয়, মৃত্যুও ঘটে। আবার অন্যরকমের সংঘর্ষও দেখা যায়। যেমন পুলিশের সঙ্গে গ্রামবাসীর; পুলিশের সঙ্গে শ্রমিকদের, ছাত্রদের। তবে সম্প্রতি ঘটেছে অন্যরকমের এক সংঘর্ষ, র‌্যাবের সঙ্গে পুলিশের। ফেনীতে। রাতের বেলা পুলিশের লোকেরা গাড়িতে করে টহলে বের হয়েছিল। ওদিকে একটি প্রাইভেট গাড়িতে চড়ে যাচ্ছিল কয়েকজন। এরা র‌্যাবের সদস্য। সাদা পোশাকে ছিল। পুলিশ তাদের থামিয়েছে, বলেছে তল্লাশি করবে। র‌্যাব সদস্যরা সেটা শুনবে কেন? তারাও তো ক্ষমতাবান। ক্ষমতাবান দুই পক্ষের ভেতর প্রথমে কথা কাটাকাটি পরে হাতাহাতি হয়েছে। দুই পক্ষই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। ফলে কিছুটা রক্তপাত না ঘটে পারেনি। কয়েকজন পুলিশ আহত হয়েছে, দুজনকে তো হাসপাতালেই যেতে হয়েছে। মীমাংসা হওয়াটা নিতান্ত সহজ ছিল না, তবে হয়েছে। এক পর্যায়ে র‌্যাবের সদস্যরা যখন গাড়িতে রাখা তাদের পোশাক প্রদর্শন করেছে তখন। পোশাকের ক্ষমতা মানুষের ক্ষমতার চেয়ে বেশি বৈকি।
দ্ব›দ্বটা ওই ক্ষমতারই। সমানে সমান হলে যুদ্ধ চলে, নইলে একপক্ষ আত্মসমর্পণ করে, এবং সেভাবেই আপাত-মীমাংসাটা সম্ভব হয়। দুপক্ষ সমান সমান হলেই যা অসুবিধা; তখন যুদ্ধ চলতে থাকে এবং প্রাণ যায়, যথারীতি, উলুখাগড়াদেরই। যেমন সুপ্রিম কোর্ট বার এসোসিয়েশনের নির্বাচনের ব্যাপারটা। দুপক্ষ (আওয়ামীপন্থি ও বিএনপিপন্থি) সমানে সমান। আইন নিয়ে যাদের সার্বক্ষণিক ব্যস্ততা, ন্যায়বিচার নিশ্চিতকরণ যাদের সাধনা, সমিতির নির্বাচনে তারা জানপ্রাণ দিয়ে লড়েছেন, তারপরে নির্বাচন শেষে ফল নিয়ে কথা কাটাকাটি, হাতাহাতি, এমনকি ধস্তাধস্তি পর্যন্ত করেছেন, এবং তাতেও মীমাংসা হয়নি, অচলাবস্থা জারি রয়েছে। চলচ্চিত্র শিল্পীদের সমিতিতেও নির্বাচনোত্তর অচলাবস্থা তৈরি হয়েছিল, এখন কী হাল হয়েছে জানি না।
রাষ্ট্রের চরিত্রটা কিন্তু এখন বেশ পরিষ্কার রূপেই আমলাতান্ত্রিক। ব্রিটিশ আমলে আমলারাই ছিল সর্বেসর্বা। পাকিস্তানের শাসনকালেও তাই। বাংলাদেশের শাসন ভিন্ন প্রকারের হবে এমন কথা ছিল। হয়নি। উল্টো আমলাদের কর্তৃত্ব আরো বেড়েছে। রাতের আকাশে চাঁদ যেমন বাড়ে, তেমনি বেড়েছে। এখন তো রীতিমতো পূর্ণিমা। অনেক কিছুই আমলারা ঠিক করেন। তবে অদৃশ্য অবস্থায়। যেমন সাহিত্য বিষয়ে পুরস্কার কারা পাবেন না পাবেন সে সিদ্ধান্ত যে তারাই নেন সেটাও টের পাওয়া যাচ্ছে ওই পুরস্কার নিয়ে পর পর দুই বছর বিপত্তি ঘটাতে।
আমলাশাসনের বিরুদ্ধে ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষ মুখ খুলবে এমন উপায় নেই। সাংবাদিকতা কখনো কখনো আমলাদের জন্য বিরক্তিকর খবর ফাঁস করে দেয় বটে, কিন্তু দিতে গিয়ে সবসময় যে বিপদমুক্ত থাকেন এমন নয়। তবে আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে অন্য পেশাজীবীদের ক্ষোভ ক্রমশ যে ধূমায়িত হচ্ছে সেটা টের পাওয়া যাচ্ছে। এ নিয়ে পেশাজীবীরা মাঝে মধ্যেই সরব হয়ে ওঠেন। সম্প্রতি তারা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রীর সঙ্গে এক বৈঠকে মিলিত হয়ে আমলাতন্ত্রের দ্বারা ‘নিষ্পেষিত’ হবার পুঞ্জীভূত অভিযোগগুলো সবেগে তুলে ধরেছেন। প্রকৌশলী, চিকিৎসক, কৃষিবিদ, শিক্ষাবিদ, বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা- সবারই একই অভিযোগ; আমলারা নিজেদেরকে সর্বজ্ঞ ও সর্বেসর্বা ভাবেন এবং অযথা হস্তক্ষেপ দেশের ‘উন্নয়নের’ ও জাতির জন্য অত্যাবশ্যক ‘স্বাভাবিক কাজে’ বিঘœ সৃষ্টি করে থাকেন। এর প্রতিকারের ব্যাপারে তারা মন্ত্রীর মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর আশু হস্তক্ষেপের দাবি জানিয়েছেন। প্রয়োজনে তারা কঠিন কর্মসূচি গ্রহণে বাধ্য হবেন এমন সতর্কবাণী উচ্চারিত হয়েছে।
আসল কথাটা হলো ব্যাধিটা এখন সর্বত্র বিস্তৃত। মূল ব্যাধির নাম অবশ্য পুঁজিবাদ। পুঁজিবাদ অসাম্য সৃষ্টি করে, এবং প্রত্যেককে বাধ্য করে নিজ নিজ স্বার্থ দেখতে। তাতে বিবাদ-বিরোধ অনিবার্য হয়ে পড়ে। এবং অভাব দেখা দেয় ব্যক্তিমানুষের নিরাপত্তার। রেলের কর্তব্যপরায়ণ একজন টিকেট ইন্সপেক্টর (টিটিআই) বিনাটিকেটে ভ্রমণে উদ্যোগী তিন যাত্রীকে জরিমানা করেছিলেন। ওই যাত্রীরা দাবি করেছেন তারা রেলমন্ত্রীর নিকট আত্মীয়। ইন্সপেক্টর তাতে ভীত হননি, নিজের কর্তব্য পালন করেছেন। পরে জানা গেছে ভুয়া নয়, ওই যাত্রীরা সত্যি সত্যি মন্ত্রীর আত্মীয়, তবে ঠিক মন্ত্রীর বলা যাবে না, মন্ত্রীর স্ত্রীর। তা কত আর দূরে? এসব ক্ষেত্রে পতœীরাই বরং প্রবল হয়ে থাকেন স্বামীদের তুলনায়। এই ক্ষেত্রেও ঠিক তেমনটিই ঘটেছে। আত্মীয়রা হেনস্তা হয়েছেন এই মর্মে খবর পেয়ে মন্ত্রীপতœী ক্রুদ্ধ হয়েছেন, তিনি ফোন করেছেন, এবং কর্তব্যপরায়ণ রেলকর্মচারীটি সাময়িকভাবে বরখাস্ত হয়ে গেছেন। তবে মন্ত্রীর জন্য অসুবিধা ঘটেছে দুটি। একটি হলো কর্মচারীর সহকর্মীদের প্রতিবাদ। তাতেও অবশ্য বিশেষ কোনো কাজ হতো না, যদি না সংবাদমাধ্যমে খবরটা এসে যেত; আর ওই যে যাকে সামাজিক মাধ্যম বলা হয় তাতে হৈচৈ শুরু না হতো। ফলে রেল কর্মচারীটি তার চাকরি ফেরত পেয়েছেন। ব্যতিক্রমী ঘটনা বৈকি; যেমন কর্তব্যপালনে সাহসিকতার, তেমনি সাহসিকতার দরুন শাস্তি না-পাওয়ার।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়